ঋতু মীর : “self control is strength, right thought is mastery, calmness is power”
১।
কাজ শেষে সাবওয়ে থেকে নেমে বাসের জন্য দাঁড়ায় সত্যবতী। ট্রেনের প্লাটফর্ম, বগি, বাসের ওয়েটিং স্পেস সব আজ মানুষে মানুষে সয়লাব। গিজগিজে ভিড়ের দিকে ক্লান্ত, অবসন্ন চোখ রাখে সে। ট্রেনের লাইনে কি এক বিপত্তির কারণেই বাস ট্রেন সব কিছুর বিলম্ব এবং এই বিপত্তি। বাসের নির্ধারিত জায়গায় সাঁটল বাসে যাত্রীদের উপচে পড়া ভিড়। সাঁটল বাস রুট পেসেঞ্জারদের বুঝিয়ে দিতে হিমশিম খেয়ে যাচ্ছে ট্রান্সপোর্ট কর্মীরা। নারী, পুরুষ, শিশু, স্ট্রলার, বাজার, সওদার স্রোত ঠেলে ঠেলে ধীরে এগোয় সত্যবতী। প্লাটফর্মের ধার ঘেঁষা সিঁড়িটা বেয়ে উপর নীচ করে জনস্রোতের ঢল নেমেছে। শরীরে মৃদু ধাক্কা অনুভব করে সত্যবতী। এভাবে দাঁড়িয়ে পড়লে যে নির্ঘাত ধাক্কা খেতে হবে! হটাত কানে ভায়োলিনের মিষ্টি সুর ভেসে আসাতে সত্যবতীর চোখ আঁতিপাঁতি করে সুরের উৎস খুঁজে বেড়ায়। কোণের বেঞ্চের উপর দাঁড়ানো লোকটা থুতনিতে ভায়োলিন চেপে এক মনে বাজিয়ে চলেছে। ঠোঁটে স্মিত হাসি, চোখে নির্ভার নিশ্চিন্ত দৃষ্টি। চমৎকৃত হয় সত্যবতী। সামনে পয়সা রাখার কোন কিছু না দেখে সত্যবতী বুঝে নেয় যে লোকটা পেশাদার কেউ নয়। কেবলমাত্র দমবদ্ধ এই পরিস্থিতি থেকে নিজেকে এবং অন্যকে সাময়িক ভাবে মুক্ত রাখার জন্যই বাজাচ্ছে সে। অপার মুগ্ধতায় লোকটার চোখে চোখ রাখে সত্যবতী। সারাদিন কাজের শেষে ট্রেন বাসের এই বিপত্তি এবং সময়মত বাসায় ফিরতে না পারার বিষয়টা সত্যবতীকে অসহনীয় এক ধৈর্য পরীক্ষায় ফেলে দিয়েছে আজ। বেঞ্চে লম্বা হয়ে দাঁড়ানো মানুষটার মত এমন উদ্যোগ সে কখনো নিতে পারতো কি? নাটুকে কায়দায় দেহ ঝুঁকিয়ে চড়ার মাত্রা থেকে মুদারার সুরে অবস্থান করে খাঁদে নেমে সাই করে আবার উঁচুর সুরে বাজিয়ে চলে। অদ্ভুত আনন্দে মন ভরে ওঠে সত্যবতীর। কার্যকারণ ছাড়াই টাইটানিক সিনেমার জাহাজ ডুবে যাওয়া এবং ভায়োলিন বাজিয়ে মৃত্যুর মত আসন্ন বিপদকে মোকাবেলা করে মানুষকে উজ্জিবীত করার সীনটা চোখে ভেসে উঠে। বাজনা থামিয়ে সত্যবতীর দিকে একঝলক তাকায় লোকটা।

বাহ! ধন্যবাদের অভিব্যাক্তি সত্যবতীর চোখে। তুমি কি সুন্দর পরিস্থিতিকে সামাল দিয়ে দাঁড়িয়ে গেছো। আমাকে দ্যাখো? মনে হচ্ছে ক্ষুধায় আমার পেট জ্বলে যাচ্ছে! তৃষ্ণায় গলা ফেটে যাচ্ছে, এক জার ঠাণ্ডা পানি এই মুহূর্তে চাই আমার! এই মুহূর্তে বসার জন্য আরামদায়ক একটা চেয়ার চাই! মনে হচ্ছে আমার শরীর ধুলায়, ময়লায় কিড়কিড় করছে, এই মুহূর্তে উষ্ণ পানিতে ফ্রেস একটা গোসল চাই… চাই… চাই! অসহায় রাগে গড়গড় করে সত্যবতী। সহিষ্ণুতার শান্ত ছায়া ভায়োলিন হাতে মানুষটার সারা অবয়ব জুড়ে। এই মুহূর্তে ধৈর্য না ধরে আর কিইবা করা যেতো বল? আসলে মানুষের মনটাই সব কিছুর নিয়ন্ত্রক। তাঁকে নিজের নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারার কৌশল জানাটাই সবচেয়ে জরুরি। “you either control your mind or it controls you!” মনে রেখো- “Mind! A beautiful servant and a dangerous master!” তুমি নিজে যদি নিজের মনকে বশে রাখতে না শিখো তাহলে তোমার আচরণকে বশে রাখার কৌশলটাও শেখার কোন উপায় নেই। তাছাড়া train your mind to see the good in every situation। সব ঘটনার পিছনেই কোন না কোন কারণ থাকে। আজকে সাবওয়ের এই পরিস্থিতি হয়ত তুমি প্রতিদিন ফেস করবেনা। পরিস্থিতিকে এভাবে নেগেটিভলি চিন্তা না করে নিজের ধৈর্য পরীক্ষাটা এখানেই দাওনা কেন! জানি সময়ের মুল্য অনেক, কিন্তু এর কোনটাই তোমার নিজের নিয়ন্ত্রনে নেই তাই না? কেবল মাত্র তোমার মনকেই তুমি নিয়ন্ত্রণ করে সঠিক সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারো ।

২।
প্লাটফর্মের ভিড় কমে পাতলা হয়েছে কিছুটা। লোকটার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে হাল্কা পায়ে বাসের প্লাটফর্মের দিকে হাঁটে সত্যবতী। ভায়োলিন বাদকের দার্শনিক কথাগুলো চিন্তার এক সূত্র থেকে অন্য সূত্রে নিয়ে যায় সত্যবতীকে। এক কোনায় হোমলেস বৃদ্ধ মহিলা ছেড়া ফাটা পলিথিন, ভ্যাপসা গন্ধ ময়লা কাপড় চোপর, ভাঙ্গা চাকার ট্রলিতে সংসারের যাবতীয় ভরে নিয়ে পুরো বেঞ্চ জুড়ে বসে আছে। হাতে খাবারের বাক্স। গভীর তৃপ্তিতে কোন দিকে না তাকিয়ে গোগ্রাসে খেয়ে যাচ্ছে। প্রায় প্রতিদিন এই দৃশ্যে অভ্যস্ত সত্যবতী এই মুহূর্তে অন্যদিনের মত চিড়বিড়ে রাগে জ্বলে উঠে না। অলস অন্যমনে ভায়োলিন বাদকের কথাগুলোই ঘুরেফিরে মনে আসে। সত্যবতীকে চমকে দিয়ে যবুথুবু, উরুখুরু চুলের বৃদ্ধা নিজের খাবারের বাক্স সত্যবতীর দিকে এগিয়ে দেয়। মুখের বলিরেখায় সহজ সরল অভিব্যাক্তি, অপূর্ব মায়ার খেলা কোটরাগত চোখে- খাওনা!

ক্লান্ত তুমি! তুমিতো ক্ষুধার্ত! কি বলবে ভেবে পায় না সত্যবতী। ভিক্ষা না চেয়ে এই হতদরিদ্র তাকেই খাবার সাধছে আজ! মিশ্র ভাবনায় তোলপাড় হয় সত্যবতী। তাকে কি তাহলে হোমলেসের মতই দেখাচ্ছে? নাহ! এভাবে ভাবছে কেন বিষয়টা? মনকে নিয়ন্ত্রনের অসম্ভব ক্ষমতায় ভাবনার মোড়কে ঘুড়িয়ে নেয় সত্যবতী। কোনদিন কি গভীর মনোযোগে সে তাকিয়ে দেখেছে এই বৃদ্ধাকে? কেবল অবজ্ঞা বা ঘৃণার দৃষ্টিতে উৎপাত মনে করে জায়গা বদল করে দাঁড়িয়েছে সবসময়। কোনদিন কি ভেবে দেখেছে যে পরিস্থিতির চাপে পড়েই হয়তো এই দুর্দশাগ্রস্থ যাপিত জীবন। দেখেনি তো! অথচ প্রতিদিনের জীবন সংগ্রামে লড়াকু হয়ে বাঁচতে গিয়েও যে সে সত্যবতীর মত মন হারিয়ে বসেনি। কারও মুখে গভীর দৃষ্টি ফেলে তার অবস্থা যাচাই এবং অনায়াস আন্তরিকতায় নিজের খাবারের ভাগ দেয়ার মনটা যে এখনও আছে তার। বাস থেকে নেমে বাসার গন্ত্যব্য ধরে হাঁটে সত্যবতী। মনে মনে বীড়বীড় করে সে- জোনাকি! শোন! ‘Your life is good as your mindset! Everyday is a chance to change your life’। (চলবে)
Ritu Mir, Teacher, Toronto District School Board, Toronto, ritu.mir9@gmail.com