ঋতু মীর : “turn your wounds into wisdom”
১।
স্বভাবের দুই প্রচণ্ড বৈপরীত্যে সত্যবতী প্রায়শই সীমাবদ্ধ । একদিকে সে আপাদমস্তক সামাজিক। অন্যদিকে সে শামুকের খোলসে গুটিয়ে থাকা এক গুহাবাসী মানুষ। কোন কিছুর সাতে পাঁচে নেই এমনটা তার সহজে মিশে যাওয়া স্বভাবের সাথে একেবারেই খাপ খায়না। ‘কথা বলা’ বিশেষ করে বাংলা সংস্কৃতির পরিমণ্ডলে নিজের ভাষায় ‘গল্প’ ব্যাপারটা সত্যবতীর কাছে ভীষণ আরামদায়ক এবং পছন্দের কাজ। একটা বলার থাকলে দশটা বলাতেই যেন তার অনাবিল আনন্দ। স্বভাবজাতভাবেই কথা বা গল্পের ঘটনাবলী সংক্ষিপ করার প্রবণতা সত্যবতীর মধ্যে নেই। আবার মুহূর্তেই বাঁচালতাকে প্রশ্রয় না দিয়ে নিজের রাশ টেনে ধরাতেও সে সদা সতর্ক। সম্পর্ক এবং সময়ের এফোঁড় ওফোঁড়ে প্রায়শই সত্যবতী নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে একাকী সময় উপভোগ করে অর্বাচীন স্বার্থপরতায়। নিজের কাজে, নিজের গভীরে, আত্মপলব্ধির নিমগ্নতায় নিজেই বিভোর হয় সত্যবতী। যেন ধ্যান মগ্ন কোন যোগী! নিঃসঙ্গতা, একাকীত্বের রাহু তাকে গ্রাসের সুযোগ পায়না। সেই সত্যবতীর আজ সকাল থেকেই মনটা বড় বেসামাল। বাইরে ফাগুন হাওয়ার দাপাদাপিতে মনটা কেমন উথালপাথাল, এলোমেলো। বাংলা বর্ষবরণের বর্ণাঢ্য আয়োজন, ঢাক-ঢোলের দ্রিম দ্রিম শব্দ, খোল মন্দিরার আওয়াজ, মিষ্টি ছন্দ, ফুলেল সাজে রঙিন নারী, উদ্দাম নৃত্য ছন্দে মাতোয়ারা যুবক যুবতী আর রাস্তায় অগণিত মানুষের ঢল দেখে উচ্ছ¡াসের আবেগে ক্ষণে ক্ষণেই ভেসে যাচ্ছে সত্যবতী। মনের সমস্ত প্রতিবন্ধকতাকে উপেক্ষা করে দরোজা খুলে উঠানে দাঁড়ায় সত্যবতী। সোনালি রোদের আলোয় ভেসে গেছে চারদিক। পাখীর কিচির মিচির শব্দে ময়ুরী মন শীষ দিয়ে নেচে ওঠে। বর্ষবরণের আয়োজন, আনন্দ মিছিলের দিকে পায়ে পায়ে হাটে সত্যবতী।
২।
চেনা অচেনার ভিড়ে বৈশাখী মেলায় অনির্দিষ্ট হাটে সত্যবতী। যত্রতত্র মনোহারী সামগ্রী ঝুড়িতে সাজিয়ে ডেকে চলে ফেরিওয়ালা। মাটিতে বিছানো গামছায় কাঁচের রঙিন চুড়ি সাজিয়ে নিয়ে বসেছে দেহাতী মেয়ে। লাবন্য ঢলঢল মুখ, সূঠাম স্বাস্থ্যে পরিপূর্ণ দেহ। দৃষ্টিতে মদির নেশার আবীলতা। চোখে চোখে ডাকে সত্যবতীকে। লাল, নীল, সবুজ, হলুদ চুরিতে কি অপূর্ব এক রঙধনুর খেলা চলছে! আগ্রহে হাটূ গেঁড়ে বসে যায় সে। সত্যবতীর হাত নিজের হাতের মুঠিতে ভরে অসম্ভব যত্নে চুড়ি পড়ায় উপজাতি মেয়েটা। ভিন্ন উচ্চারণে মিষ্টি শব্দে ভিন্ন বাংলায় কথা বলে মেয়েটা। দুই হাত ভরা চুরির জলতরঙ্গ শব্দে মোহিত হয় সত্যবতী। পয়সা মিটিয়ে হৃষ্ট চিত্তে উঠে দাঁড়ায়। ঠিক পাশেই মণিপুরি শাড়ীর সমাহার সাজিয়ে বসে গেছে মনিপুরী মেয়ে। যেন আঠার মত জায়গাটায় লেগে যায় সত্যবতী। কামরাঙা রঙের শাড়ীতে নীল সুতার নকশায় সূতার হাল্কা কাজ। কারুকাজ আঁচল, ঘন নীল পাড়ের অংশ ঘাড় থেকে সামনে মেলে দিয়ে কোমরে হাত রেখে টানটান দাড়ায় মেয়েটা। নিটোল স্বাস্থ্যে, প্রসাধনহীন মুখে জ্বলজ্বলে সিঁদুরের টিপের স্বর্গীয় সৌন্দর্যে ভারী অদ্ভুত সুন্দর লাগে তাকে। দ্যাখো দিদি! এটা নাও! খুব সুন্দর দেখাবে তোমাকে! নিজেকে মেয়েটার জায়গায় রেখে কথাটা সর্বান্তকরণে বিশ্বাস করে সত্যবতী- শাড়ীটাতে নিশ্চয়ই তাকেও মেয়েটার মতই সুন্দর দেখাবে! শাড়ীর প্যাকেট হাতে নিয়ে দ্রুত পা চালায় সত্যবতী। মাঠের অন্য প্রান্তে বাংলা গানের ক্যাসেট, সিডির স্টল। আর ঠিক তার পাশেই কবিতার বই। খুব একটা ভিড় নেই এখানে। এই জায়গাটাই বুঝি খুঁজছিল সত্যবতী! বৈশাখের দমকা হাওয়া সত্যবতীর অবিন্যস্ত চুল, উড়ন্ত আঁচলকে আরও শুন্যে উড়িয়ে নেয়। উড়ে যায় সত্যবতী। গানের সুরে, কবিতার ছন্দে! আকাশের ওপারে অন্য এক আকাশে।
৩।
সত্যবতীর চোখ খুঁজে বেড়ায় সমসাময়িক পরিচিত বন্ধু জন, প্রিয় কবি, কবিতার বই। কবিতা, গানের নির্জলা আনন্দে মন ভিজিয়ে নিয়ে বাড়ি ফিরলে দিনটা যে সত্যি সার্থক হতো! ইতস্তত এদিক ওদিক তাকাতেই নজরে পরে দম্পতি যুগল। সত্যবতীকে দেখে অনাবশ্যক হল্লায় জোর কদমে এগিয়ে আসে। অনেকদিনের চেনা, আড্ডায়, আসরে দেখা হয় প্রায়ই অথচ এখনও যেন তাঁদের কিছুতেই চিনে উঠতে পার্নো সত্যবতী। দু’জনের বেশভূষায় বৈশাখী সাজের বাহুল্য, আড়ম্বরটা বেশ কটকটে লাগে সত্যবতীর চোখে। কথা, হাসি, অঙ্গভঙ্গি সবকিছুই যেন সাজানো, আরোপিত। ভিতরে একধরণের চাপা অস্বস্তি অনুভব করে সত্যবতী। সুযোগ পেলেই যে এরা কথার ঘায়ে, মারপ্যাচে যেখানে সেখানে যখন তখন আক্রমন করে বসে সত্যবতীকে। কোন রকম অস্র ছাড়াই যে অনায়াসে সত্যবতীকে রক্তাক্ত, ক্ষতবিক্ষত, অসম্মানিত করে ফেলা যায়! এক সুনিপুণ বিচক্ষনতায় নীরবে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে এই সঙ্গ সবসময় এড়িয়ে চলতে চায় সত্যবতী। সত্যবতীকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই ছোঁ মেরে হাত থেকে শাড়ীর প্যাকেট হাতে নেয় মহিলা। আরে! সব মিলিয়ে যে আস্ত খ্যাত মার্কা শাড়ী হয়েছে সত্য! হুম! এ রঙ তোমাকে যাবেনা মোটেই। রুচির প্রশ্নে অপ্রস্তুত বিড়ম্বনায় অধোবদন হয় সত্যবতী। এই ধরণের কটাক্ষ নতুন নয় তবুও কি এক ক্ষোভে ভিতরে জ্বলে উঠে সত্যবতী। শাড়ীটা পছন্দের ক্ষেত্রে নিজের প্রতি যে আত্মবিশ্বাস ভর করেছিল তা যেন ভেঙ্গেই পড়ছে এখন। মনের পরিস্থিতি সামাল দেয়ার সময় পায়না সত্যবতী। সঙ্গের পুরুষটি এক বিচিত্র অঙ্গভঙ্গিতে সত্যবতীর খুব কাছে এগিয়ে আসে। ছ্যাবলা হাসিতে সরু চোখে সত্যবতীকে দেখে।
পাতলা গোঁফের আড়ালে কৌতুকের নামে গা ঘিনঘিনে পিছলা হাসি। সত্যবতীর পছন্দের পুরুষ কবির নাম উচ্চারণ করে কবি এবং কবিতার সাথে শাড়ীর যোগসূত্র ঘটিয়ে অশোভন অশ্লীল এক ইঙ্গিত হানে সত্যবতীর দিকে। স্বামীর কথার সমর্থনে পাশে গা কাঁপিয়ে হাসে মহিলা। অপমানে আহত সত্যবতীর শ্যামলা মুখ বেগুন রঙ কালো ছোপে ঢেকে যায়। অসহায় এক অস্থিরতায় থরথর কাঁপে সত্যবতী। জনারন্যের এই সমুদ্রে দাঁড়িয়েও মুহূর্তেই বিচ্ছিন্ন, একলা হয় সে।
পরাজিত সৈনিকের ক্লান্তিতে দম্পতির দিকে তাকায় সত্যবতী। চোখে চোখ রাখতে ঘৃণা হয়। সামনে দাঁড়ানো দুই মানুষের সংস্কৃতি-সভ্যতা, শিক্ষার অন্ধকার দিকটা যেন মুহূর্তেই তার সামনে উন্মোচিত হয়। নারী না পুরুষ- লিঙ্গ বিভাজনের এই অসার সামন্ত কায়দা লঙ্ঘনের সাহসটা সত্যবতীর অস্থিতে, মজ্জায়। সম্পর্ক, ভালোবাসা, বিশ্বাস, প্রেমের ক্ষেত্রে তার সামনে থাকে শুধুই ‘মানুষ’। জোনাকি!
শোন! অসংযত আবেগে কণ্ঠস্বর বুজে আসে সত্যবতীর। কবি আমার কাছে লিঙ্গ ভেদের অনেক উপরে সার্বভৌম স্বাধীন এক সত্তা! আর কবিতা! “কবিতা তো রুপান্তরিত শিলা, গবেষণাগারে নিয়ে, খুলে দেখো, তার সব অণু- পরমাণু জুড়ে কেবলি জড়িয়ে আছে মানুষের মৌলিক কাহিনী”! রাতের নিস্তব্ধ গভীরতায় গাছের পাতায় টুপটাপ শিশির ঝরার হাল্কা শব্দ। মাথার কাছে সুদৃশ্য বাক্সে সাগর কুড়ানো বর্ণিল পাথরের স্তুপ। নীরব ভাষায় সত্যবতীকে বলে- “Take the stones people throw at you and use them to build a monument”! শান্ত মনে কবিতার বইটা বন্ধ করে সে। এবার ঘুমাবে সত্যবতী! (চলবে)।
Ritu Mir, Teacher, Toronto District School Board, Toronto, ritu.mir9@gmail.com