ঋতু মীর : “Maturity doesn’t mean age. It’s sensitivity, manners, and how you react”
১।
অপ্রত্যাশিত দাওয়াতে একপ্রকার অস্বস্তিতে পড়ে যায় সত্যবতী। তার স্বভাবে দুই বৈপরীত্য সবসময়েই বেশ প্রকট। একদিকে সত্যবতী প্রচণ্ড খোলামেলা, আপাদমস্তক এক সামাজিক মানুষ। কোন কিছুর সাতে পাঁচে নেই এমনটা তার সহজে মিশে যাওয়া স্বতঃস্ফূর্ত স্বভাবের সাথে একেবারেই খাপ খায় না। অন্যদিকে সে প্রচণ্ড ঘরকুনো, প্রায়শই বিচ্ছিন্ন এক গুহাবাসী মানুষ। সামাজিক সম্পর্কের বিছানো জালে নিজেকে জড়িয়ে দাওয়াত, পার্টি, হুল্লোড়ের জীবন যাপনে তার বরাবর অনীহা আর ক্লান্তি। দৈনন্দিন জীবনযাত্রার গতানুগতিক ছকের বাইরে যে রেশন মাপা সময়টুকু অবশিষ্ট থাকে সেখানে নিজের সাথে নিজের সখ্যতায়, নিজের প্রতি ভালোবাসায়, বিশ্বাসে নিজের মধ্যে থাকাতেই জীবনের পূর্ণতা খুঁজে পায় সত্যবতী। তবে বন্ধু বা নিকট পরিজনদের সাথে ইনফরমাল ‘কোয়ালিটি’ আড্ডার সময়টা সত্যবতীর কাছে মহা মুল্যবান কিছু। সেই সব আসরের কথোপকথন, নির্ভেজাল আড্ডার নির্যাস স্মৃতির মণি কোঠায় সযতেœ ধরে রাখে সত্যবতী। ঠিক যতোটা ঘনিষ্ঠতা বা উজার করা বন্ধুত্ব থাকলে কোথাও যাওয়ার ইচ্ছাটা প্রবল হয় সেই রকম কোন সম্পর্ক যে আজকের দাওয়াতের প্রেক্ষিতে গড়েই ওঠেনি! এমন পরিস্থিতিতে নিজেকে বড্ড বেমানান মনে হয় সত্যবতীর। সামাজিক সম্পর্ক এবং একজন পরিচিত মানুষের প্রতি স্বাভাবিক সম্মান বোধের তাগিদে অযাচিত আমন্ত্রণটা এড়ানোর উপায় থাকে না সত্যবতীর। ‘না’ শব্দটা অনুচ্চারিতই থেকে যায় তার ঠোঁটে। উইকএন্ডের মহাব্যস্ততায় তড়িঘড়ি কাজ গুছিয়ে যাত্রার প্রস্তুতি নেয় সত্যবতী। সেই প্রস্তুতি শুধু স্থান, যানবাহন, মানুষ বা সময় উপযোগী পোশাক নির্বাচন, সাজগোজ বা উপহার কেনায় সীমাবদ্ধ তা নয়, আসরে নিজেকে খাপ খাওয়ানোর মানসিক প্রস্তুতিতেও নিজেকে পুরোপুরি প্রস্তুত করে নেয় সত্যবতী। জীবনের এই প্রান্তে সব কাজ, সব মুহূর্তই যেন নির্মল আনন্দে উদ্ভাসিত হয়ে স্মৃতিতে জ্বলজ্বলে এক উদাহরণ হয়-এমন মনোভাবেই তৈরি হয় সে। আয়নায় নিজেকে একঝলক দেখে নিশ্চিত হয় সত্যবতী। ছাই, সাদা রঙ কম্বিনেসনে সোনালী জরির কাজ সালোয়ার কামিজ, কালো পাথরে হাল্কা অক্সিডাইজ জুয়েলারি এবং কাঁধে ফেলা মাল্টিকালার শালের সান্ধ্য সাজে বেশ উজ্জ্বল লাগে নিজেকে। নিজের প্রতিবিম্বে অন্যরকম গভীরতায় নিজেকে খুঁটিয়ে দেখে সত্যবতী। কপাল, চোখের কোল, চিবুকে বয়সের বলিরেখার সুক্ষ দাগগুলো এই মুহূর্তে বুঝি কোথাও উধাও! প্রসাধনহীন অবয়বে একটা নিটোল আড্ডার প্রত্যাশার ছায়াই কেবল খেলা করছে।
স্বস্তি-অস্বস্তির দোলাচলে দুলতে দুলতে দাওয়াতের বাড়িতে ঢুকে যায় সত্যবতী। নতুন বাড়ি, নতুন আসবাব পত্র, ঝকঝকে মেঝে ঝাড়বাতির উজ্জ্বল আলোর বন্যায় ভেসে যাচ্ছে। অমায়িক আন্তরিকতায় সত্যবতীকে জড়িয়ে ধরে নিয়ে সোফায় বসায় যড়ংঃ মেয়েটা। ওর আপ্যায়নের দিলখোলা ভাবটায় এক নিমেষেই গলে মিশে একাকার হয় সত্যবতী। অনাড়ম্বর আতিথেয়তা, রান্না, খাবার পরিবেশনে যত্নের ছোঁয়ায় তাৎক্ষণিক একটা আরামদায়ক অনুভুতির জন্ম হয়। আমন্ত্রিতের সংখ্যা হাতে গোনা কয়েকজন এবং প্রত্যেকেই সত্যবতীর ভীষণ চেনামুখ। শুধু চেনা বললে বোধহয় ভুল হবে। মানুষের জীবনে এমন কিছু সম্পর্ক থাকে যা কেবল শুধু ‘চেনা’ শব্দটা দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায়না। চেনার বাইরেও সেখানে থাকে হৃদয় মনের গভীর যোগাযোগ, থাকে আত্মার আত্মীয়তা। সেই সান্নিধ্যের জন্য থাকে প্রতীক্ষা। একসাথে হওয়ার সেই আয়োজনে থাকে কানায় কানায় উপচে পড়া অভূতপূর্ব আনন্দ। সম্পর্ক ভেঙ্গে যাওয়ার মত পরিস্থিতি খুব একটা ঘটেনি সত্যবতীর জীবনে। প্রতিটা সম্পর্ক রক্ষায় সে সমান মনোযোগী এবং যতœবান। বিশ্বাসে, ভালবাসায়, সম্মানে প্রতিটা সম্পর্ক নিজ নিজ জোড়াল অবস্থানে এক ভিন্নমাত্রার গুরুত্ব বহন করে তার কাছে। সেখানে কখনোই অশ্রদ্ধা, অবহেলা, অবিশ্বাস, শঠতা আর ‘পেছনে কথা বলা’ গøানির মরিচা আস্তর পড়তে দেয়না সত্যবতী। অথচ আজ সেই রকম সম্পর্কে সম্পর্কিত ছিল এমন কারও মুখোমুখি হয়ে ভিতরের পিনপিন করা অস্বস্তিটা কেন নতুন করে উৎকণ্ঠায় পরিণত হচ্ছে ভেবে পায়না সত্যবতী। দেখা হওয়ার উচ্ছ্বাস ভুলে মনটা গভীর কোন বেদনায় এমন উথাল পাথাল করে উঠছে কেন? অতীতে কখন কে তাকে অসম্মানের কাঠগড়ায় দাড় করিয়ে ভুল অভিযোগে ক্ষত বিক্ষত করেছে সেই ঘটনা বুদ্বুদের মত অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে কেন চলকে চলকে উঠে আসতে চাচ্ছে? ক্ষমা এবং শান্তির মন্ত্রে দীক্ষিত সত্যবতীতো কবেই সেই অবিশ্বস্ত সম্পর্কের লুকোচুরি খেলা-খেলা পর্বের পাঠ চুকিয়ে নিজেকে সরিয়ে ফিরে গেছে নিজেরই মধ্যে। কিন্তু দেখা হওয়ার এই ক্ষনে তার প্রতি অন্যপক্ষের অপরিপক্ক আচরণ, বেফাঁস মন্তব্যে বিব্রত হয় সত্যবতী। ভাঙ্গা ভাঙ্গা কণ্ঠে নীচু স্বরে অন্যপক্ষের অবুঝপনা, childish কথাবার্তার মোড় অন্যদিকে ঘুরিয়ে দেয়ার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয় সত্যবতী। আকুল আবেদনে বোঝানোর চেষ্টা করে যে, তারা দুজনেই অন্য একজনের আতিথ্য গ্রহণ করে আজ এখানে এসেছে। আজকের আয়োজনকে অর্থবোধক বা পূর্ণ করার দায়িত্ব কিন্তু অনেকখানি আমন্ত্রিত অতিথিদের উপরও বর্তায়। সেখানে একান্তই ব্যাক্তিক কিছু পুরানো তিক্ততা, ভুল বোঝাবুঝির বিচার বিশ্লেষণ, খণ্ডনের প্রসঙ্গে বাকবিতণ্ডা, কথোপকথন এবং emotional trap এর পথ ধরে হাঁটা এইখানে, এই স্থানে, এই মুহূর্তে কাম্য নয় কিছুতেই। গল্প, কথা চালিয়ে যাওয়ার সমস্ত উৎসাহ হারিয়ে স্বভাব বিরুদ্ধ চুপচাপ বসে থাকে সত্যবতী। পুরানো তিক্ত প্রসঙ্গের এই ধার, ওই ধারের টানাটানিতে ততক্ষণে কিছুটা ক্লান্ত, বিমর্ষ অন্যপক্ষ কিছুটা ধুম করেই যেন গল্পের আসর ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়। সোফার খালি অংশে তাকিয়ে বিনা কারণেই নিজেকে হঠাৎ খুব ‘পরিত্যাজ্য’ মনে হয় সত্যবতীর। আপ্যায়নে ব্যস্ত মানুষটা অপ্রতিভ হাসিতে তাকায় সত্যবতীর দিকে। বলে- সবাই আরেকটু বসলে যে অনেক ভালো লাগতো! নির্ভেজাল আড্ডার বিমল আনন্দ মনের ঝুলিতে ভরে নিজের জায়গায় ফিরে যাওয়ার সুন্দর প্রত্যশাটা কেমন দুমড়ে মুচরে যায় সত্যবতীর। নিজের বাসার ছায়া ছায়া ঘরটার নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য হঠাৎ ভীষণ অভাব বোধ করে সে। জোনাকি কি জেগে আছে আজ? আতিথ্য গ্রহণ থেকে শুরু করে এই সময় পর্যন্ত ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো একে একে ব্যাখা করে সত্যবতী। কান্নায়, হতাশায় গলার স্বর আর্তনাদের মত শোনায়। শোন সত্য! আবেগকে সংযত করে যুক্তি দিয়ে পরিস্থিতি সামাল দেয়ার মধ্যেই আছে ম্যাচুরিটি। “Maturity is learning to walk away from people and situations that threaten your peace of mind, self respect, values, morals and self worth”। কিছু সম্পর্কের অবনতি, অনাকাঙ্খিত পরিণতি একের সাথে অন্যের immature, disrespectful আচরণের কারনেই ঘটে। এইসব পরিস্থিতিতে নিজেকে নীরবে সরিয়ে নেয়া ছাড়া আর কি কিছু বিকল্প থাকে? ভেবে দ্যাখো সত্য! যে সম্পর্কে নিজের অজান্তেই ইতি টেনেছ সেখানে হয়ত পারস্পরিক বিশ্বাস, শ্রদ্ধা, নির্ভরতার বিষয়গুলো অনুপস্থিত ছিল বলেই তা ভেঙ্গে গেছে। তিক্ত অভিজ্ঞতা পিছন ফিরে দেখে নিজের মনকে অশান্ত করলে নিজেকেই ভুগতে হয়। বরং অভিজ্ঞতার শিক্ষাটা নিজের মধ্যে ধারণ কর। জানোতো! ‘repair’ ব্যাপারটা কেবল জড় পদার্থ এবং মানুষের বিকল অঙ্গের জোড়া তালিতেই চলে। ‘মন’ যে অনেক গভীরে মানুষের ধরা ছোঁয়ার বাইরে দুর্বোধ্য কিছু। একবার ভেঙ্গে গেলে আর তা জোড়া দেয়া যায় না সত্য! মনে রেখো! ‘mind is a beautiful servant, but a dangerous master’। নিজের মনের সেই ‘দাস’ সেই ‘প্রভু’ তুমি নিজেই। ঘুমাও এবার! শুভরাত্রি সত্য! (চলবে)
Ritu Mir, Teacher, Toronto District School Board, Toronto, ritu.mir9@gmail.com