ঋতু মীর : “Silence isn’t empty, it’s full of answers”
১।
সেল ফোনটা সাইড টেবিলে অ্যালার্ম দিয়ে রাখতে গিয়ে হঠাৎ বেজে উঠতেই চমকে ওঠে সত্যবতী। সেট করে রাখা কল মিউজিকের মিষ্টি সুরটা এই মুহূর্তে যেন ধৈর্যহারা স্বরে অশুভ কাকের ডাক ডেকে চলেছে। রাতে ঘুমাতে যাওয়ার আগের প্রস্তুতি নিচ্ছিল সত্যবতী। সচরাচর কাজের দিনগুলোতে রাত নয়টার মধ্যেই ঘরকন্নাসহ নিজস্ব যাবতীয় কাজ শেষ করার আপ্রাণ চেষ্টা করে সত্যবতী। পরের দিনের ক্লাশের লেসন একঝলক দেখে নেয়া, আবহাওয়া বার্তা মাথায় রেখে পড়নের কাপড় ঠিক করা, হ্যান্ড ব্যাগে প্রয়োজনীয় সামগ্রী সাজিয়ে রাখা, টিফিন গোছানো, বাসা থেকে বের হয়ে কিছুদুর হেঁটে ঘড়ির কাঁটায় বাস ধরা এবং পথের নানা ঝামেলা পার হয়ে ঠিকঠাক ক্লাশের দরজায় দাঁড়ানো- সব কিছুই যেন সময় নামে এক ছকবাধা শিকলে আটকানো। একচুল এদিক ওদিক হলেই শিকলে টান পড়ে হুমড়ি খাওয়ার অবস্থায় পড়তে হয়। চিরদিন সে এক রাতজাগা পাখী। চরাচরের নিরব নিথর রূপ তাকে অন্যরকম এক উপলব্ধির জগতে পৌঁছে দেয়। আত্মপোলব্ধি বা নিজেকে বিশ্লেষণের মুহূর্ত বুঝি রাতের নীরবতায়ই ধরা দেয়। অথচ এখানকার যাপিত জীবন এখন সম্পূর্ণ অন্যখাতে বয় বলে রাত জাগার মত বিলাসিতাকে প্রশ্রয় দেয়ার কোন উপায় নেই। কাজে যাওয়ার লক্ষ্যে আগে ভাগেই বিছানায় যাওয়া এবং সূর্য ওঠার আগেই বিছানার আয়েস ছেড়ে দিন শুরু করা একরকম প্রাত্যাহিক নিয়মে দাঁড়িয়ে গেছে। এমন কি উইক এন্ডেও ‘কাজে বের হতে দেরী হয়ে যাচ্ছে’ এমন দুঃস্বপ্নে খুব সকালেই ঘুম ভেঙ্গে যায়। জীবন যেখানে যেমন! ভাবে সত্যবতী। রাতের প্রার্থনা শেষে বিছানায় বসেই সারাদিনের ঘটনা ‘রিফ্লেক্সন’ এবং ‘মেডিটেশন’ পর্ব শেষ করার পরে ফোন বা সোশ্যাল মিডিয়া থেকে নিজেকে দূরে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করে সত্যবতী। ঘুমানোর আগে এই ব্যাপারটা তাকে যেন এক আত্মশুদ্ধির রাস্তা বাতলে দেয়। যেন কোন এক মহাশক্তির কাছে নিজেকে সমর্পন করে আত্মতৃপ্তিতে ঘুমের এক স্বর্গীয় জগতে প্রবেশ করে সত্যবতী। প্রায় সময়েই গোধূলি এবং সন্ধ্যার সন্ধিক্ষনে বুকের মধ্যে চাপধরা ব্যাখাহীন অপ্রতিরোধ্য কষ্ট দুড়দাড় করে ঢুকে পড়ে সত্যবতীর মনে। বোনের মৃত্যুর এই মাসে তা যেন দুঃসময়ের স্মৃতিতে দ্বিগুণ হয়ে যখন তখন ছেঁকে ধরে। ঘুমানোর আগের নানাবিধ আয়োজন সত্যবতীর অশান্ত মনটাকে কিছুটা শান্ত, স্থিত হতে সাহায্য করে। জীবন এক বহতা নদী। সুখ, দুঃখ, হাসি, কান্না, ভালোবাসা, বিচ্ছেদের পাশাপাশি মোহ, আকাক্সক্ষা, ঘৃণা, আক্ষেপ, অপ্রাপ্তি, অপূর্ণতা সে নদীর সাথে মিশে যাওয়া এক চলমান স্রোত। থেমে যাওয়া বা থামিয়ে দেয়ার উপায় নেই। জড়া, মৃত্যু, শোকের মত অবস্যম্ভাবী অনেক কিছুই মানুষের নিজের আয়ত্তে বা নিয়ন্ত্রণে নেই। ‘কি হতে পারে’ এমন আশঙ্কায় ভরা জীবন কারো কাছেই কাম্য নয়। যতদিন প্রাণ আছে ততদিনই নিয়মানুবর্তিতায়, সুস্থতায়, সঙ্গতিতে, সম্পর্কে, সামাজিক আদান প্রদানে, কাজ কর্মে ভারসাম্য বজায় রেখে চলাটাই জীবনের যৌক্তিক সিন্ধান্ত বলে বিশ্বাস করে সত্যবতী।

২।
ফোনটা অবিরাম বেজেই চলেছে। ঘুমের প্রস্তুতির প্রক্রিয়া থেকে নিজেকে একপ্রকার জোর করেই তুলে আনে সত্যবতী। কলার আইডির দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। অন্যপ্রান্তের মানুষটি সত্যবতীর আদ্যপান্ত চেনা খুব কাছের একজন। সম্পর্কের অলিখিত অধিকারেই ফোন করেছে। কল রিসিভ করার উচিৎ অনুচিত বোধটা প্রচণ্ড এক ‘অবিøগেসন’ এ ফেলে দেয় সত্যবতীকে। সদালাপী, বাকপ্রিয়, বন্ধুবৎসল, সদা কোলাহলমুখর সত্যবতীর যে এই মুহূর্তে কোন কথাই বলতে ইচ্ছে হচ্ছে না। কিন্তু ফোনের ওপাশে অস্থির কেকা অপেক্ষা বা অন্যের সময়ের এফোঁড় ওফোঁড় কিছুই মানে না! জানে সত্যবতী! ইচ্ছা, অনিচ্ছার ঝুলন্ত মুহূর্ত লম্বা না করে চট জলদি ফোনটা হাতে নেয় সে। কথা ‘সংক্ষিপ্ত’ করবে এমন সংকল্প মাথায় রেখে চেনা সম্বোধনে আন্তরিক হয়। ওপাশের কণ্ঠে কেমন উষ্মার আভাস! কেমন যেন অভিযোগের, ক্ষোভের স্বর সেই কণ্ঠে ঝনঝন বাজে। ফোন রিসিভ করতে সত্যিই একটু দেরী হয়ে গেছে সত্যবতীর। সে কারণেই কি? ওপাশের খাপছাড়া কথার মর্ম উদ্ধারে হিমসিম খায় সত্যবতী। কে, কার, কোন বিষয়কে কেন্দ্র করে কি নিয়ে আক্ষেপ তা ধরতে পারে না কিছুতেই। কোন কার্যকারণ ছাড়াই সত্যবতীর সামাজিক সম্পর্কের আঙ্গুরলতা ধরে একে একে টান দেয় অন্যপাশ। শ্লেষ মিশ্রিত উচ্চস্বরের বাক্যে একতরফা অনাহূত প্রসঙ্গ তুলে সম্পর্কে শ্রদ্ধার সীমারেখাটা লঙ্ঘন করে চলে। প্রশ্নবিদ্ধ আঙ্গুল তুলে ধারালো ছুরিতে যেন দ্বিখণ্ডিত করতে চায় সত্যবতীকে। অনাকাক্সিক্ষত পরিস্থিতিতে ক্ষতবিক্ষত হয় সত্যবতী। উত্তরহীন সত্যবতী আহত অভিমানে স্থব্ধ হয়।

স্বভাব বিরুদ্ধ কঠোর নীরবতায় ফোন রেখে দেয় সে। এক সুক্ষ অপমানবোধ চিনচিনে ব্যাথার মত ভিতর থেকে বুদবুদের মত উঠে আসে। সুপ্ত আগ্নেয়গিরির হঠাৎ অগ্ন্যুতপাতের প্রস্তুতিহীন বিপর্যয় সত্যবতীকে এক অবমাননার উপত্যকায় ফেলে দেয়। ঘুম যেন এক দুরন্ত উড়াল পাখী। সত্যবতীর দুচোখের পাতাকে নির্ঘুম রেখে জানালা ঘেঁষা বড় গাছটার ডালে বসে সে পাখি যেন তামাশায় হাসে। দু’চোখের প্লাবনে ভেসে যায় সত্যবতী। এতদিনের সম্পর্কে নিমেষেই যেন যোজন দূরত্বের ব্যবধান তৈরি হয়ে যায়- সেই সময়ের জন্য, বুঝিবা চিরদিনের জন্য! আনন্দ ঝলমলে স্বাভাবিক একটা সম্পর্কে মহাপ্রলয়ের অকাল পরিণতি ঘটে যায় বুঝি সেই মুহূর্তেই! জোনাকি! জোনাকি! হাহাকারের আকুলতায় আশ্রয় খোঁজে সত্যবতী- যে কোন সম্পর্কেই ভালোবাসা, অধিকারের পাশাপাশি একে অন্যের প্রতি ‘শ্রদ্ধাবোধ’ থাকাটা ভীষণ জরুরি তাই না? সম্পর্কে ‘বিশ্বাস’ ব্যাপারটা কেবল তখনই মজবুত ভিত্তিতে দাঁড়িয়ে যায়। শোন জোনাকি! ‘Something cannot be fixed, they can only be carried’। কিছু কিছু সম্পর্ক এমন বাঁকেই মোড় নেয়, সেই পথেই খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলে। আমিও আজ সেইরকম কিছুর মুখোমুখি। সত্যবতীর গলার স্বর হতাশায় কান্নার মত শোনায়। মনোযোগী শ্রোতা জোনাকি অনেকক্ষণ পরেই মুখ খুলে। শোন সত্য!

‘Sometimes silence is a perfect answer when words fail you’। পরিস্থিতি উদ্ভূত সমস্যাকে মোকাবেলা করার কৌশল বোধহয় তোমার জন্য এই মুহূর্তে এটাই। জানতো! ‘Silence is a great source of strength’ কথা তখনই বল সত্য- only when you feel that your words are better than your silence। জানালায় চোখ রাখে সত্যবতী। শেষ রাতের চাঁদটা এককোণে হেলে পড়েছে। ভোরের আলো ফোঁটার আগের এই সময়টা কি ভীষণ স্নিগ্ধ আর পবিত্র! নীরব চরাচরের বিমূর্ত ভাষায় কান পাতে সত্যবতী- “listen to silence, it has so much to say অবসন্ন মনটা এখন বাইরের প্রকৃতির মত কোমল আর শান্ত। “the most beautiful sound of the world is silence”। বিছানা ছেড়ে উঠে পড়ে সত্যবতী। এই বেলায় আর ঘুমাবে না সে। (চলবে)

Ritu Mir, Teacher, Toronto District School Board, Toronto, ritu.mir9@gmail.com