ঋতু মীর : ‘The greatest power is often simple patience’
১।
প্লেনে উঠে নিজের নির্ধারিত আসন পেয়েই ধুপ করে বসে পড়ে সত্যবতী। পা রাখার স্পেস, এক সীটের সাথে অন্য সীটের দূরত্ব এবং চলাচলের প্যাসেজটা এতোটাই সংকীর্ণ যে সোজা হয়ে হাঁটা একপ্রকার অসম্ভব। শরীরটা বাঁকা করে জিনিষপত্র সামলে বেশ কায়দা করেই লম্বা প্যাসেজটা পার হচ্ছিলো সত্যবতী। সীট নম্বর দেখে সামনে এগিয়ে যেতে মাথায় সুটকেসের গুতা লাগাতে দাঁড়িয়ে যায় সে। ক্ষুব্ধ দৃষ্টিতে সামনে তাকায়। প্যাসেজ জুড়ে দাঁড়ানো মোটাসোটা মানুষটা ততোধিক পেট মোটা ক্যারি-অন মাথার উপর মালপত্র রাখার বাঙ্কারে ওঠানোতে ব্যস্ত। উঁচুতে ওজন তোলার কসরতে হাঁসফাঁস করছে সে। স্ত্রী, যমজ শিশু সন্তান, বৃদ্ধা মা এবং হাতের মালপত্রসহ সত্যবতীর ঠিক সামনের আসনেই তার পরিবারের বিশাল লটবহর। সাথের লোকজনের উপর একঝলক চোখ বুলিয়ে সম্পর্কগুলো যেন মুখস্থ আবিস্কার করে নেয় সত্যবতী। ‘তোমার সীট তো তোমার জন্যই আছে, আগেভাগে বসার অযথা তাড়াহুড়োতেই না ব্যথা পেয়ে গেলে’! মোটা মানুষটা অবজ্ঞার হাসিতে নির্বিকার ভাব প্রকাশ করে নিজের অসমাপ্ত কাজে ব্যস্ত থাকে। নিজের সম্পর্কে এই মন্তব্যে রাগে গা জ্বলে যায় সত্যবতীর। কোনমতে আসন পর্যন্ত পৌঁছে হ্যান্ড ব্যাগ, ক্যারী-অন, কম্পিউটার, ভারী জ্যাকেটসহ আরও কিছু খুঁটিনাটি কোলের উপর নিয়েই বসে পড়ে সে। স্বামীর অবস্থান লক্ষ্য করে স্ট্রেস লেভেল চড়চড়িয়ে উঁচুতে উঠতে থাকে সত্যবতীর। স্বামীর চোখে অভিযোগের চোখ রাখে সত্যবতী- জিনিষপত্র ঝুপঝাপ তুলে জায়গা দখল না করে কেন যে অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে আছে? ঠিক মত রাখা এবং ব্যাঙ্কার এর শাটার বন্ধ না হলেতো সুটকেস অন্য কোথাও রাখার ব্যবস্থা হবে। ঔষধসহ আরও যাবতীয় জিনিষ যে সত্যবতীর মিনিটে মিনিটেই লাগে তা কি সাথের মানুষ জানে না? কি হতে পারে এই ভাবনার সাথে বাস্তব যেন কাকতালীয়ভাবেই মিলে যায়। যথারীতি অপরিসর বাঙ্কারে হাতের টানা সুটকেস রাখার স্থান সংকুলান হয় না। নির্ভরতার হাসিতে সুহাসিনী বিমানবালা সত্যবতীকে আশ্বস্ত করে। সত্যবতীর কোলে রাখা সুটকেসটা হাতে নিয়ে তাঁর বেতস লতার শরীর অনায়াসে তরতর করে সরু প্যাসেজ অতিক্রম করে পর্দার অন্যপাশে মিলিয়ে যায়। নিজের সুটকেস স্থানান্তরে স্ট্রেসের বিপরীতে এবার এক ‘বিস্ময়’ কাজ করে সত্যবতীর মনে। আসলে প্রতিটা মানুষ এক এক রকম কাজে একে অন্যের চেয়ে কি ভীষণ আলাদা যোগ্যতা এবং দক্ষতা সম্পন্ন। Air hostess এর চেহারাটা চিনে রাখার চেষ্টা করে সত্যবতী।
এই এক ঝামেলা হোল দ্যাখোতো! সত্যবতীর স্বরে বিরক্ত ভরা অভিযোগের ক্ষোভ। মাথায় গুতা খাওয়ার মত আচমকা আবার কিছু ঘটে গেলো নাতো? সত্যবতীর স্বামীর চোখে ক্লান্তি এবং উত্কণ্ঠা। কতবার যে বললাম ঠিক মত সিটের অবস্থান বুঝে নিও। এখন হোলতো! যাত্রার পুরো সময়টাই কিন্তু এখন বাচ্চার কান্নায় নির্ঘুম কাটাতে হবে বলে দিলাম! চোখের ভাষায় সামনের সীটে বসা যাত্রীদের প্রতি কটু ইঙ্গিত করে সত্যবতী। অবোধ শিশু শারীরিক যন্ত্রণা বা অসুবিধার কথা বলতে পারে না বলে কান্নাকেই ভাষা প্রকাশের মোক্ষম অস্ত্র মনে করে। এইসব পরিস্থিতিতে বাবা মা বাচ্চা শান্ত করার ক্ষেত্রে একপ্রকার অসহায় সত্য! স্বামীর কণ্ঠে হতাশার বুলি। মুখের অভিব্যাক্তিতে সত্যবতীর বিরুপ মনোভাবের প্রতি এক ভিন্ন ব্যঞ্জনা খেলে যায়। নিরুপায় সত্যবতী ঠেসেঠুসে স্বল্প পরিসরের সীটে বসে থাকে। প্লেনের ভিতরটা হঠাত অক্সিজেন শূন্য মনে হয় সত্যবতীর। গলা শুকিয়ে কাঠ। এক ঢোক পানি খাওয়ার প্রবল বাসনায় চোখ জোড়া এদিক ওদিক মার্বেলের মত ঘুরে। ‘পানি নেই’ ভেবে শরীরটা যেন সেই মুহূর্তে দ্বিগুণ মাত্রায় de-hydrate হয়ে পড়ে সত্যবতীর। প্লেন উড্ডয়নের শুরুর মুখে বিমান কর্মীরা সবাই মহা ব্যস্ত।
কর্তব্যের হাসি ঠোঁটে ঝুলিয়ে ধোঁয়া ওঠা সফেদ সাদা ভেজা রুমাল সত্যবতীর হাতের উপর ঝটিতে ফেলে সেবিকা মেয়েটা অন্য যাত্রীতে মনোযোগী হয়। গলায়, মুখে উষ্ণ রুমালের ভেজা ছোঁয়ায় সেই মুহূর্তের ক্লান্তি, বিরক্তি কিছুটা হলেও হরণ হয় সত্যবতীর। সন্তুষ্টির মনে পাশের তিন সিটের জানালার ধার ঘেঁষে বসা যাত্রীর দিকে মনোযোগে তাকায় সে। নিজে ওই খুপরিতে ঢুকে বসার কথা জীবনেও ভাবতে পারেনা সত্যবতী। প্লেনে নড়া চড়া যেন এক অদ্ভুত কৌশলের ব্যাপার। প্লেন বা বাস, সল্প বা দীর্ঘ- যে কোন যাত্রাতেই সত্যবতী সবসময় ‘আইল’ বা ধারের সীট বাছাই করেই বসে। ধারের আসনের স্বাধীনতাই আলাদা। ভিতরে বসা মানেই নড়া, চড়া, পা টান করা অথবা ওয়াশ রুমে যাওয়া এক মহা বিড়ম্বনা এবং আরও অনেক স্বাধীনতা খর্ব হওয়া।
জানালার কোন ঘেঁষে বসা তরুণ ছেলেটা আধো ঘুম আধো জাগরণে কেমন নিশ্চিন্তে বসে আছে। ওর ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা চেহারার সহিষ্ণু ভাবটাকে গভীরতায় পরখ করে সত্যবতী- সে কি পারবে এমন হতে? হঠাত মিসরীয় মহিলা সহযাত্রীর কথা মনে পড়ে যায় সত্যবতীর। বাচ্চা কোলে নিয়ে জানালার পাশে নিজের নির্ধারিত আসনে মাঝের যাত্রী এবং সত্যবতীকে ডিঙ্গিয়ে বসতে গিয়ে সেকি হুলুস্থুল অবস্থা। কোলের শিশু হাত পা ছুড়ে তারস্বরে চিত্কার করছে, কিছুতেই বন্ধ জায়গায় থাকবে না সে। বিব্রত মা সত্যবতীকে অনুরোধ করে জানালার পাশ থেকে ধারের সীট বদল করে। ঘটনার প্রেক্ষাপটে জানালার ধারে বসতে বাধ্য মহা বিপদগ্রস্ত সত্যবতী ধৈর্য পরীক্ষার এক পর্যায়ে বাচ্চাটিকে নিজের কোলে নিয়ে আবার ধারের সীটে এসে বসে। সেও মন্দের ভালো! অতীত স্মৃতিতে ভেসে যেতে যেতে বাস্তবে ফিরে সত্যবতী। সীট বেল্ট খুলে ওয়াস রুমের দিকে অস্থিরতায় আগায় সে। প্লেন উড়ার আগেই ধোঁয়ামোছা ওয়াসরুম সেরে নেবে সে। দুদ্দাড় বেগে Air hostess ছুটে আসে। বেল্ট বাঁধো! এখন কিছুতেই উঠবে না ম্যাম! কি মুশকিল! আরেকটু আগে এই চোখ এড়িয়ে কেন উঠে গেল না সে! নিজের পাশের শুন্য দুই আসনে দৃষ্টি রাখে সত্যবতী। আহা! যদি জায়গাটা এভাবেই যাত্রীহীন শুন্য থাকতো! সরু প্যাসেজ ঠেলে মধ্যবয়সী মহিলাকে এগিয়ে আসতে দেখে সে। সবাই নিজ নিজ স্থানে বসে যাওয়ার কারণে এ মুহূর্তে প্যাসেজে ভিড় নেই। অন্য যাত্রীর সাহায্যে হাতের ক্যারি-অনটা ঠিক জায়গা মতই রেখে দিলো মহিলা। আশ্চর্য! এত দেরীতে হেলেদুলে এসেও কিনা সুটকেসের সু-বন্দোবস্ত হয়ে গেলো! আর সত্যবতীর বেলায় কিনা- সবই কপাল! চার সিটের আরেক ধার ঘেঁষে বসে পড়ে মহিলা। যাক! পাশের লাগোয়া সীটটা তাহলে খালিই যাচ্ছে আজ। প্লেনও আকাশে উড়বে এক্ষুনি। নিজের পাশের খালি সিটের দখলদারিতে তত্পর হয় সত্যবতী। মধ্যবয়সী মহিলা টুপ করে নিজের কম্বল, মাথার স্কার্ফ শুন্য সিটে নামিয়ে রাখে। ভারী মজা! মনে মনে বিড়বিড় করে সত্যবতী। দুই সিটের কমন হ্যান্ডেলে বাহু রেখে গ্যাঁট হয়ে বসে থাকে সে। ভাবখানা সিট নাও কিন্তু হাতল রইল আমার দখলে।
দখলদারীর নীরব খেলায় মহিলার কিছু আসে যায় বলে মনে হয়না সত্যবতীর। যতোসব গণ্ডগোলে ভাবনায় বুঝি সে একাই হাবুডুবু খায়! মাথায় হিজাব, আজানু লম্বা ড্রেস, ভারী চেহারার সাস্থ্যবতী মেয়েটিকে তড়িঘড়ি এগিয়ে আসতে দেখে মনে মনে প্রমাদ গুণে সত্যবতী। নরম কোমল হাসিতে সত্যবতীর দিকে তাকিয়ে নিজের আসনে বসার আয়োজন করে সে। ক্যারী-অন অন্য কোথাও রাখার ব্যাবস্থা হয়। হাতে ঝুলানো জ্যাকেট, বিশাল সাইজের হ্যান্ড ব্যাগ, ডিউটি ফ্রী সপ থেকে কেনা তিন চারটে প্যাকেট হাতে নিয়ে ঠেলেঠুলে নিজের আসনে বসে। স্বাভাবিক ভদ্রতায় ফ্যাকাশে হাসিতে নিজের পাশে তাকে আমন্ত্রণ জানায় সত্যবতী। জ্যাকেটটা উপরে তুলে রাখার প্রস্তাব দিতেই স্মিত হাসিতে তা নিজের কাছে রাখার ইচ্ছা জানায় মেয়েটা। পায়ের কাছে একগাদা জিনিষ রেখে তার উপর পা মেলে দেয়। সামনের যাত্রীর হেলান দেয়া সীট প্রায় মেয়েটার নাকের ডগায়। টিভি স্ক্রীনে চোখ রেখে নির্বিকার বসে থাকে মেয়েটা। রাতের খাবার তৃপ্তিতে শেষ করে অন্যরকম আন্তরিকতায় খাবারের সাথে দেয়া ডেসার্ট রেসিপি সত্যবতী জানে কিনা তা জানতে চায়। কিছুক্ষণ বই পড়ে। একসময় পরম নিশ্চিন্তে গভীর ঘুমে তলিয়ে যায় মেয়েটা। সত্যবতীর চোখ টান টান নির্ঘুম! পার্শ্ববর্তীনীর দিকে ঈর্ষার চোখে তাকায় সে। মেয়েটার কোলের উপর স্খলিত ব্যাগ। খোলা চেন দিয়ে ভিতরের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র উঁকি ঝুঁকি দিচ্ছে। চরম অস্বস্তিতে সত্যবতী নিজের ব্যাগের চেন বন্ধ আছে কিনা পরীক্ষা করে। সীটের হাতলে সত্যবতীর হাত ঘেঁষে মেয়েটার গোলগাল মোটা হাত। সাবধানতায় নিজের হাতটা সরিয়ে আনে সত্যবতী। নিঃশ্বাসের একটানা মৃদু শব্দ কানে আসে। কোলনের মৃদু সুবাসে নাম না জানা অর্কিডের বুনো মিষ্টি গন্ধটা বেশ লাগে সত্যবতীর। সামনের সিটে গাদাগাদি করে বসা পরিবারটির দিকে তাকায় সত্যবতী। দুই জমজ সন্তান কোলে নিয়ে অকাতরে ঘুমিয়ে আছে শিশুদের মা। হাঁসফাঁস করা মোটা মানুষটার ঘুমন্ত মুখটা প্লেনের ভিতর্রে আলো আধারী ছায়ায় ভীষণ নিস্পাপ দেখায়। ঘুমন্ত যাত্রী, সুনসান করিডোর, বিশ্রামরত বিমান কর্মীদের দেখতে দেখতে প্লেনে ওঠার পর থেকে সব ঘটনাবলী ছবির মত একে একে মনে ভাসে সত্যবতীর।
জীবন এক বহতা নদী। চলিষ্ণু জীবনে কিছু বাঁধা, কিছু অসঙ্গতি, কিছু কিছু বিষয়, পরিস্থিতি অনেক সময়েই মানুষের নিজের নিয়ন্ত্রণের বাইরে থেকে যায়। যাত্রার এই সময়টা দীর্ঘ প্রলম্বিত হলেও সেটা তো আর কারোর জন্যই অনন্তকালের নয়। এই যে ধৈর্য স্বল্পতা বা অল্পতেই অসহিষ্ণু হয়ে পড়া- চরিত্রের এই বৈশিষ্ট্য নিজের মধ্যে আঁকড়ে না রেখে ছোট বড় অসংগতিকে মোকাবেলা করার মানসিকতা অর্জন করা বা অপেক্ষা করার নামই হয়তো ধৈর্য। ‘Patience is not simply the ability to wait- it’s how we behave while we are waiting’। এক দুই তিন করে করে যাত্রার অনেকগুলো ঘণ্টা গুনে চলে সত্যবতী। আর মাত্র কয়েক ঘণ্টার উড়ন্ত সময়! ‘Patience is the art of concealing your impatience’। ধীরে ধীরে ঘুমের অতল গভীরে হারায় সত্যবতী। (চলবে)।
Ritu Mir, Teacher, Toronto District School Board, Toronto, ritu.mir9@gmail.com