ঋতু মীর : “A flower never thinks of competing with the other flower next to it, it just blooms”
১।
What makes you feel jealous? ছেলেটার এই প্রশ্নে কিছুটা থতমত খেয়ে যায় সত্যবতী। অপ্রতিভ হাসিতে সরাসরি তাকায় ছাত্রের দিকে। বুদ্ধিদীপ্ত চোখ কৌতুকে ঝকমক করছে। ঠোটের কোনে দুষ্ট হাসিটায় যেন কাউকে জব্দ করতে পারার মজা পাওয়া ভাব। ক্লাশে ‘ইমোশন’ (Emotion) এবং ‘ফিলিংস’ (Feelings) সংক্রান্ত পঁচিশ মিনিটের ভিডিওটা তখন প্রায় শেষ প্রান্তে। happy, sad, joy, love, anxiety, fear, depression, excitement, anger, lonely, jealous- ইত্যাদি ইমোশন বা ফিলিংস উদাহরণসহ সহজ ব্যাখা করে শিক্ষার্থীকে মূর্ত থেকে বিমূর্ত ধারণায় পৌঁছে দেয়ার যথেষ্ট আয়োজন আছে ভিডিওটাতে। নিজের অনুভূতি, আবেগকে যথার্থভাবে অন্যের কাছে তুলে ধরতে প্রায়শই ব্যর্থ হয় এমন মানুষের সংখ্যা চারপাশে কম নয়। আর প্রকাশ করতে না পারায় মনের মাঝে যে হতাশার জন্ম হয় তার বাহ্যিক প্রকাশটা ঘটে মানুষের অসঙ্গতিপূর্ণ আচরণে। বয়সন্ধিকালের শিক্ষার্থী শ্রেণীকক্ষে, করিডোরে, বন্ধুদের সাথে খেলার মাঠে বা জিমে কোন না কোন ইমোশন বা অনুভুতির আবেগে তাড়িত হয়েই চলে। কখনো সে অনুভুতি আনন্দের, উল্লাসের, উচ্ছ্বাস উত্তেজনার মত। আবার বিপরীতে কখনো দুঃখ, একাকীত্ব বোধ, ভয়, রাগ বা জেলাসির মত ব্যাপারগুলিও পারিপার্শ্বিক অনেক কারণেই শিক্ষার্থীর মনে ঘটতে পারে। স্পর্শকাতর এই বিষয়ের গুরুত্ব অনুধাবন করে অনেকটা সময় নিয়েই লেসনটা গুছিয়েছে সত্যবতী। শ্রেণী উপযোগী ভিডিও, সংশ্লিষ্ট তথ্য খুঁজে, গুছিয়ে লেসন এক্সপেকটেশন ঠিক করে নিতে বেশ সময় লেগে গেছে তার। তারপর শঙ্কা ছিল মানুষের ইমোশন এবং ফিলিংসের মত সুক্ষ বিষয়ের ব্যাখ্যা এবং মেসেজটা ঠিকভাবে শিক্ষার্থীর কাছে পৌঁছাতে পারবেতো সে? ধুম করে ছেলেটার ছুঁড়ে দেয়া প্রশ্নে ওর ম্যাচুরিটির ধাপটা বুঝে নেয় সত্যবতী। মানুষকে ‘read’ করতে পারার এক অলৌকিক ক্ষমতা বুঝি আছে সত্যবতীর। বাচনভঙ্গি, কণ্ঠের ওঠানামা, প্রক্ষেপণ, চোখের দৃষ্টি, মুখভঙ্গী, হাসি, চলাচল দেখে সত্যবতী ঠিক নাড়ী টিপে রোগ বের করার মত সেই মানুষটার পারসোনালিটি বা আচরণের গতি প্রকৃতিটা চট জলদি বুঝতে পারে। অন্য সব ফিলিংস বা ‘ইমোশন’ ব্যাখার বদলে ‘জেলাস’ এর মত ডেলিকেট ইস্যুটাকেই বেছে নিলো কেন ছেলেটা? ক্লাশের নানা কাজের ফাঁকে ছেলেটার পারসোনালিটির বিশেষ দিক, আচরণের ভিন্নতা ক্ষণে ক্ষণে সত্যবতীর মনোযোগের কেন্দ্রে হানা দেয়।

২।
জলরঙের ব্যবহারে ছাত্রদের করা আর্টের কাজগুলির রঙের উজ্জ্বলতা আর শৈল্পিক কারুকাজ দেখে শিক্ষক হিসেবে সত্যবতীর চোখে, মুখে এক চোরা গর্ব আর তৃপ্তি ছায়া ফেলে। গতকাল ক্লাসে আর্ট প্রজেক্ট শেষ করার পর সত্যবতী সেগুলোকে ক্লাসরুমের দেয়ালে সেঁটে বিন্যস্ত করে রাখছিল। ক্লাসরুমটা একটা জমজমাট আর্ট গ্যালারীতে রুপ নিচ্ছিল। ভাল মন্দ কাজ মিশিয়েই দেয়ালটা সাজিয়ে তুলছিল সত্যবতী। ছেলেটা নীরবে কখন পাশে এসে দাঁড়িয়েছে লক্ষ্য করেনি। হাতে ধরা একটা চিরকুট সত্যবতীর দিকে এগিয়ে দিয়ে প্রশ্নভরা চোখে উত্তরের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে থাকে। বিশেষ পছন্দের মেয়ে বন্ধুর পাশে তার নিজের আর্টটা কেন রাখা হলো না? বদলে অন্য একজন ছেলের আঁকা কাজ কেন জায়গাটা দখল করলো? তাঁদের দুইজনের আর্টের কাজ পাশাপাশি রাখলে যে দেয়ালটা আরও আকর্ষণীয় লাগবে- এই বিষয়টা কি সত্যবতী একটু ভেবে দেখবে? ছেলেটার হাতে লেখা চিরকুটে সুক্ষ অভিযোগের আবেগঘন ভাষায় বিস্মিত হয় সত্যবতী। ভিতরের অনুভুতিকে মুখে ঠিকমত গুছিয়ে বলতে পারবে না ভেবেই লিখে এনেছে। হিংসা বা জেলাসির প্রছন্ন ছায়ায় বুদ্ধিদীপ্ত মুখটা খানিকটা অসহায় এবং বিবর্ণ। ‘অধিকার’ আদায়ের এক ছেলেমানুষি সংকল্পও যেন ছেলেটির ঠোঁটের প্রান্ত ছুঁয়ে আছে। মানব চরিত্রের সুক্ষ, স্পর্শকাতর, জটিল মনোজাগতিক আচরণের বহিঃপ্রকাশটা সত্যবতীকে মুহূর্তেই ভাবনার সমুদ্রে ফেলে দেয়। মানুষকে বুঝতে পারার অলৌকিক ক্ষমতাটাকে সেই মুহূর্তে কেমন অকেজো মনে হয়। সেকি আসলেই বুঝতে পারছে যে বয়ঃসন্ধির ওই বালকের মনে কিসের ঝড় বইছে? ভালোবাসা, ভয়, অধিকার, আধিপত্য, দম্ভ, দ্ব›দ্ব অথবা জেলাস- কোন অনুভুতির চোরাবালিতে আঁটকে বসে আছে নরম কোমল একতাল কাদার মত ওই মন? শিক্ষক হিসেবে এই মুহূর্তে কি করা উচিত সত্যবতীর? ঠিক যেভাবে চাইছে সেভাবেই কি পছন্দের মানুষের পাশে ওর কাজটা টাঙ্গিয়ে দেবে সত্যবতী? এক্ষেত্রে অন্য একজনের আর্ট স্থানান্তর করে আরেকজনের ইচ্ছাকে প্রাধান্য দেয়াটা কতটা যৌক্তিক? প্রতিটা আর্টের দিকে চোখ ফেলে সত্যবতী। শিক্ষার্থীদের কাজগুলোর শীর্ষমান বিচারের সময়তো এটা নয়। এই মুহূর্তে প্রত্যেকের কাজের সমমান স্বীকৃতি দিয়ে আত্মবিশ্বাস বাড়ানোর কাজটাকেই গুরুত্বপূর্ণ মনে করছে সত্যবতী। ‘ফিলিংস’ বা ‘ইমোশন’ এর মত বিষয়ে সত্যবতী নিজেও যে উত্তরহীন প্রশ্নের চোরা স্রোতে ঘুরপাক খায় প্রতিনিয়ত। ‘দুঃখ’ ‘ভয়’ ‘স্ট্রেস’ বা জেলাসীর এর মত ব্যাপারগুলো প্রায়শই ভারসাম্যহীন, টালমাটাল অবস্থায় ফেলে দেয় তাকে। প্রিথিবীর কোন কিছুই কার্যকারণ ছাড়া ঘটেনা জানে সত্যবতী। অথচ প্রায়শই নিজের মধ্যে উদ্ভূত এই সব অনুভূতি চোরকাটার মত অন্তরের গভীরে বিঁধে থাকে, কষ্ট দেয়।’ বুকের ভিতরে আজ কিসের আশঙ্কা ধুকপুক করছে? অথবা আজ সকালের রোদ উজ্জ্বল মনটা বিকেল সন্ধ্যায় এমন মেঘাচ্ছন্ন লাগছে কেন? জিহŸার স্বাদে আজ এমন বিষাদের টক টক ভাব কেন?- এইসব প্রশ্নের অন্তর্নিহিত কারণ অজানাই থেকে যায় সত্যবতীর। একসময় অনুভূতিটা হারিয়ে যায়, মিশে যায় অনন্ত কোলাহলে এবং আবার একসময় বুদ্বুদের মত ফুস্কুরিতে ভেসে ওঠে জলধির গভীর তলদেশ থেকে। ছেলেটাও বুঝি সত্যবতীর মতই মনের আবেগিক অনুভুতিতে ভারসাম্যহীন, নিয়ন্ত্রণহীন কোন আবর্তে পড়ে গেছে আজ।

৩।
What makes you feel jealous? উত্থাপিত এই প্রশ্নের উত্তরটা গুছিয়ে বলতে শুরু করে সত্যবতী। জানো! আমার মনে হয় ‘জেলাসী’ বা ‘ঈর্ষা’ ব্যাপারটা বয়সের এক এক প্রান্তে এক এক রকম থাকে। যেমন- ছোটবেলায় উৎসবের কাপড় নিয়ে, খেলনা নিয়ে বন্ধুদের সাথে ‘হিংসা’ ব্যাপারটা ঘটে যেত। আবার পরিবারে ভাই বা বোনের প্রতি মা বাবার আদরের ভাগাভাগিটা নিজের দিকে ‘কম’ না ‘বেশি’ এই প্রশ্নে ঈর্ষা হত। বাবা মায়ের কাছে সব সন্তান দাঁড়িপাল্লার হিসেবে সমান, কেউ বেশি বা কম নয়- মায়ের এই কথাটা গল্পের মত করে বলে যায় সত্যবতী। আগের মত এইসবে এখন আর কিন্তু ‘জেলাস’ হয় না। এখন আবার কিছুটা অদ্ভুত কারণে জেলাস হয়। মনে কর, কেউ খুব স্বাস্থ্য সচেতন, সেই ব্যাক্তির সাস্থ্য বিধি মেনে চলার সবল দিকটা আমাকে মাঝে মাঝেই জেলাস করে। কেন জানো? কারণ আমি স্বাস্থ্য সচেতন ঠিকই কিন্তু সেই ব্যাক্তির মত নিয়ম মেনে চলার গুনটা আমার মধ্যে নেই। মানুষের বিশেষ ‘গুন’ কে নিজের মধ্যে দেখার জন্য যে জেলাস বা ঈর্ষা সেটা কিন্তু ব্যাক্তি মানুষের ‘ক্ষতি’ করে না, অথবা এর মধ্যে কোন ‘অসুস্থ’ প্রতিযোগীতাও নেই। you can only be jealous of someone who has something you think you ought to have yourself- শিক্ষার্থীর মুখে সন্ধানী চোখ ফেলে যথার্থ উদাহরণে বিষয়টা ব্যাখা করে সত্যবতী। Jealousy is just a lack of self-confidence- জানতো! ঈর্ষা হোল একধরণের মানসিক ব্যাধি যা মানুষের আত্মবিশ্বাসকে ধ্বংস করে দেয়। নিজেকে ছোট বা অযোগ্য ভাবার বিন্দুটা থেকেই কিন্তু জেলাসীর উৎপত্তি। জেলাসির পিছনে মানুষের মনে কোন বিষয় সম্পর্কে অহেতুক ‘ভয়’ এবং ‘নিরাপত্তাহীনতা’ সক্রিয় ভাবে কাজ করে। “happiness is found when you stop comparing yourself to other people”- এখানেই থামে সত্যবতী। নন-ভারবাল কিউ (non-verbal que) সত্যবতীর সারা অভিব্যাক্তিতে। সারা ক্লাশে এক পিনপতন নীরবতা। অপাপবিদ্ধ মুখগুলোতে উপলব্ধি আর বোধগম্যতার নিবিড় ছায়া। প্রশ্নকরা ছেলেটার চোখে চোখ রাখে সত্যবতী। বড় স্নিগ্ধ, সহিষ্ণু আর শান্ত দেখায় সেই মুখ। ‘লার্নিং এক্সপেকটেশন’ আড়চোখে একঝলক দেখে নেয় সত্যবতী। এক গর্ববোধ আর তৃপ্তির ছায়া আরেকবার ঢেউ খেলে যায় সত্যবতীর মুখে। দেয়ালে টাঙ্গানো জলরঙে আঁকা ছবিগুলোর দিকে তাকিয়ে হেনরি এডামসের অসম্ভব প্রিয় উক্তিটা মনে মনে আওড়ায় সত্যবতী- “A teacher affects eternity, he can never tell where his influence stops” । (চলবে)

Ritu Mir, Teacher, Toronto District School Board, Toronto, ritu.mir9@gmail.com