ঋতু মীর : “Embrace your grief! For there, your soul will grow”
১।
সে ছিলো! ছিল জীবন চলার প্রতি ঘটনায়, প্রতি পদক্ষেপে। সে এখন নেই! পৃথিবীর অমোঘ কঠিন নিয়মে সে চলে গেছে অনেক দূরে, ধরাছোঁয়ার বাইরে। বুঝিবা শত শত আলোকবর্ষের দূরত্বেও সে আর নেই! আর কিছুতেই কোথাও তাঁকে খুঁজে পায় না সত্যবতী। এই মনের অবহ বেদনা, কষ্ট, অপূর্ণতা একদিন সেই সমুদ্র হয়ে ধারণ করেছিল, শুষে নিয়েছিল অসাধারণ শোষণ ক্ষমতায়। বটবৃক্ষের কোমল ছায়ার নির্ভরতায়, আশ্বাসে বুক দিয়ে আগলে রেখেছিল যেন। কি এক অভিমানেই বুঝি চলে গেছে। টের পেতে দেয়নি সত্যবতীকে। নিপুণ অভিনয়ে তার কাছে আড়াল করে গেছে মৃত্যুঘাতী অসুস্থতা। আড়াল করে গেছে যন্ত্রণায় শরীর ক্ষয়ে ক্ষয়ে যাওয়া যুদ্ধের সেই গল্প। পাছে সত্যবতী উতলা হয়, পাছে সে অস্থিরতায় কাঁদে, পাছে অনাহুত কালবৈশাখীর পাগলা হাওয়ায় উড়ে যায় সত্যবতীর সাজানো জীবন! ভয়ে আশঙ্কায় থির থির কাঁপা সত্যবতীর এই দু’হাতের উপর এলিয়ে ছিল তাঁর মাথাটা। এক ঢাল কালো চুল জড়ানো মুখটা একটু কাঁত হয়ে সত্যবতীর বুকের কাছে নুয়ে ছিল। আগের রাতে চুল বেঁধে দেয়ার অবস্থায় ছিলো না। সারারাত সব বোনেরা মিলে বিছানার পাশে ঘিরে বসে ছিল তাঁকে। যেন মৃত্যুর পরোয়ানা বাহক কোন যমদূত তাঁকে ছিনিয়ে নিয়ে যেতে না পারে। কি ভীষণ কষ্ট হচ্ছিলো তাঁর শ্বাস নিতে। অক্সিজেন জারের দিকে পলকহীন তাকিয়ে ছিল সত্যবতী। আবার না হসপিটালের সব অক্সিজেন শেষ হয়ে যায়? ভরে দেয়ার জন্য আবার না কাউকে ডেকে না পায় সাথে সাথে? একটু বেখেয়াল হলেই বুঝি ধুক ধুক করা প্রাণপাখীটা সত্যবতীকে ফাঁকি দিয়ে উড়াল দেবে দূর আকাশে? আহা! নিজের শ্বাসটা যদি একটু ভরে দিতে পারতো বোনের ওই বুকে? যদি অনন্তকাল ওর দম নেয়া বাতাসটা ধরে রাখতে পারতো শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে, হাতের দুই মুঠিতে? মনের অবুঝ ভাবনায় দিশেহারা হয় সত্যবতী। সারা শরীরে তার অবসাদ আর যাত্রার ক্লান্তি। গলির মুখে আজন্মের চেনা বাবার সেই বাড়িটাতে সেদিন আর যাওয়া হয় না তার। হাসপাতালের ঔষধ, ফিনাইলের ঝাঁঝ মাখা গন্ধটা নাকে ঝাঁপটা মারে। লিফটের সামনে মানুষের অপেক্ষার লম্বা লাইনটা দেখে মাথাটা কেমন ঝিমঝিম করে ওঠে। বহুতল ভবনের কোন তলায়, কোন করিডোরের পাশ ধরে কোন রুমে শুয়ে আছে বোন? এ যে প্লেনে লম্বা যাত্রা পথ পাড়ি দেয়ার চেয়েও অনেক বেশি দীর্ঘ, প্রলম্বিত। পাগলের মত ছুটেছিল সত্যবতী। সাদা চাদরের বিছানায় লম্বালম্বি কে শুয়ে আছে এখানে? বোনের মুখটা যন্ত্রণার নীল নীল ছোপে কি ভীষণ অসহায় দেখায়। এত বড় পৃথিবীর ঝাঁক ঝাঁক মানুষের ভিড়ে এমন অসহায় আকুতি ভরা মুখ বুঝি আর একটাও দেখেনি সত্যবতী। একটি যুদ্ধের জীবন, একটি সংগ্রাম মুখর অধ্যায়ের শেষ পর্বে এক ঝঞ্জার সমুদ্র পারি দেয়া নাবিক বুঝি আজ আরেকটু ‘বাঁচতে চাই’ বলে ফ্যালফেলে চেয়ে আছে সত্যবতীর দিকে। কোন গহীন অরণ্যে লুকানো আছে বোনের সুস্থতার জীয়ন কাঠিটা? কোন অজানা পাহাড়ের সবুজ গায়ে বিছিয়ে আছে বোনের সমস্ত যন্ত্রণার অবসান? সেই মুহূর্তে কি ভীষণ অসহায় সত্যবতী! কিছু না করতে পারার অসহায়ত্ব বুঝি অনন্ত যাত্রায় শরিক হওয়ার প্রস্তুতিতে যুদ্ধরত ওই দেহটার চাইতেও অনেক বেশি। কোলাহলে সরগরম হাসপাতালটা ধীরে ধীরে নিস্পন্দ, শান্ত একসময়। রাতটা গভীর থেকে গভীরতর স্থব্ধ, নিশ্চল। সকালে ‘কোমায়’ চলে যাচ্ছি বলে বোন কেমন বিদায় নিয়ে নিলো সত্যবতীর কাছে। ‘কোমা’ শব্দের উচ্চারণ এত স্পষ্ট ওই কণ্ঠে! কে বলে সে চলে যাচ্ছে? শুধু একটু ঘুমাক! গত কয়েক রাত ধরে যে একবারও ঘুমায়নি। শ্বাস কষ্টে জেগে গেছে বারবার। সংসারের হাল ধরা দায়িত্বে কর্তব্যে, প্রিয়জনের অসুস্থতায় আরও কত শত রাত ঘুমায়নি সে। যেন কত আকাঙ্খিত একটা যাদু দণ্ড সত্যবতীর হাতে! যেন এক্ষুনি তার পরশে একটু শান্তির ঘুম এনে দেবে বোনের নির্ঘুম চোখে। একটু পরেই সত্যবতী তাঁকে ঘুম থেকে ডেকে তুলে খাওয়াবে। কি নির্বোধ ভাবনায় ডুবে গিয়েছিল সত্যবতী। সারাটা দিন পার হয়ে এতটা রাত অব্দি ‘কোমায়’ যাওয়া দেহটা যে আর একবারও চোখ মেলে তাকায়নি। কত রাত হোল এখন? মধ্যরাত? তাহাজ্জদ নামাজের সময় কি? ঘড়ির কাটা কোন সময়ে স্থির এখন? একদৃষ্টে বোনের মুখে তাকিয়ে থাকে সত্যবতী। ওই তো নিঃশ্বাস বইছে এখনো! বইছে কি নিঃশ্বাস? এক বিছানায় পাশাপাশি ঘুমে, একসাথে জড়াজড়ি বড় হওয়া, একসাথে খেলায়, পড়ালেখায়। কি আপন, কি চেনা এই নিঃশ্বাস! এই চোখ, ঠোট, চিবুক, এই গ্রীবা! ওকি সত্যি চলে যাচ্ছে সত্যবতীকে ছেড়ে? ঠোঁট দুটো হঠাৎ নড়ে ওঠে, জিহŸার আভাসে শেষবারের মত কি বলতে চাইলো সত্যবতীকে? এই তো নুয়ে যাওয়া মাথাটা কেমন এলিয়ে গেল ধীরে- সত্যবতীর এই হাতের উপর চিরনিদ্রায় চলে গেল সে। একেবারে অর্ধেক করে দিয়ে চলে গেল সত্যবতীকে। একেবারে চুরমার করে, একেবারে শুন্য করে দিয়ে গেল যে!
২।
দুই বোন, দুই ভিন্ন সত্ত্বা, দুই ভিন্ন মানুষ। তবুও কি ভীষণ এক, কি ভীষণ মিল! এক বৃন্তে ফোঁটা দুই ফুলের মিলে মিল! বয়সের মধ্যবর্তী গ্যাপটা খুব কম ছিল তাদের। ছোটবেলায় তাদের দুজনকে দেখে লোকে যমজ বলতো। একরকম জামায়, এক রঙের ফিতায়, চুলে একই রকম বিনুনীর গাঁথুনিতে এক স্কুলে, এক ক্লাশে, এক ঘরে একই বিছানায় জড়াজড়ি জীবন, একসাথে বড় হওয়া। একসাথে গান, এক সাথে পড়ালেখা, একসাথেই পরীক্ষার জন্য তৈরি হওয়া। কে বড় তোমাদের মধ্যে? সেই প্রশ্ন উঠলেই সত্যবতীর হাত নিজের হাতের মধ্যে ধরে একটু এগিয়ে গিয়ে বোন বলতো- আমি বড় আর ও আমার ছোট বোন! একজন দেখতে গোলগাল স্বাস্থ্যে ভরাট মুখের, অন্যজনের ছিপছিপে বেতস লতার দেহবল্লরী। একজনের ভাসা চোখের বোকা বোকা অভিব্যাক্তিতে অজানা স্বপ্ন, অন্যজনের চোখে কৌতূহল আর বুদ্ধিমত্তার ঝকঝকে তলোয়ার। কিশোরী সত্যবতী অধোবদনে লাজুক, প্রিয়ভাষিণী, বিপরীতে বোন ধারালো কণ্ঠে যুক্তিপূর্ণ কথায় শঙ্কাহীন, নির্ভীক! সমর্পণে, গ্রহণে সত্যবতী মোম গলা নরম, আর অন্যায়ের প্রতিবাদে, সংকল্পে বোন ছিল জেদি, হার না মানা এক যোদ্ধা। অঙ্কের হিসাবে সদা ভয় পাওয়া সত্যবতী মুখস্ত বলা কবিতা আর মুক্তোদানা হাতের লেখায় পারদর্শী। আর বোন জটিল সব গণিতের হিসাব বোঝা বুদ্ধিতে, দক্ষতায় যোগ্যতায় মনোযোগ কাড়া। কেউ টের পায়নি কখন সেই তেজস্বিনী বয়সের সব সীমাবন্ধতাকে ডিঙিয়ে, মেয়ে হয়ে জন্মানোর সামাজিক প্রতিবন্ধকতাকে অতিক্রম করে একটা দুর্দশাগ্রস্থ অভিভাবকহীন পরিবারের অলিখিত অভিবাবক বনে গিয়েছিল। পারিবারিক গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তে কি করতে হবে আর হবে না এমন হুকুম যেন তাঁর কণ্ঠেই শোভা পেতো। অসীম মনোবল আর সাহসের বুক দিয়ে সংসার আগলে রাখার মন্ত্রটা সংসার না করেও নিজের মধ্যে কিভাবে ধারণ করেছিল ভেবে পায় না সত্যবতী।
৩।
অদ্ভুত এক যাদুকরী জীবনীশক্তি নিয়েই যেন বেঁচে আছে সত্যবতী। বেঁচে আছে নশ্বর দেহে অবহ এক কষ্ট বহন করে। বেঁচে আছে পৃথিবীর চিরায়ত বিধানকে মেনে নিয়ে। বেঁচে আছে মরে যাওয়া যায় না বলেই! দাবানলের হু হু আগুণের মত শোকের তাপে ভিতরটা পুড়ে পুড়ে ছাই হয়েছে। অন্ধ আবেগে মন পাগলের মত ছুটেছে সেই বোনের জন্য। যদি কেউ থাকে তাঁর মত এমন মরমী! এমন দরদী! যদি অশান্ত মনটা বোনের সহমর্মিতায়, সান্ত¡নায় একটু প্রবোধ মানে? যদি- যদি- অন্য গল্পে, অন্য কথায় ছোঁয়া পেয়ে যায় বোনের! মানুষ! মানুষ! কত ভিড় সত্যবতীর চারপাশে। কত ভালবাসা, কত হাসি, কত সুখের চকমকি আয়োজন। চারদিকে এত সুখ, এত আনন্দ ময়ূরকণ্ঠী রঙে পেখম তুলে নাচে। দুঃখ ভুলে দুহাত ভরে আনন্দ কুড়াও! উল্লাসে, আনন্দে, সুখেই বাঁচো সত্যবতী! দ্যাখো জোনাকি? কি বোকা, কি অবুঝ এই মন। নিজের অস্তিত্ব ভুলে কোন অলীক সুখের আলোর ঝলকানিতে পতঙ্গের মত ঝাঁপিয়ে পড়েছে? প্রতিটা মানুষ, প্রতিটা সম্পর্ক যে ইউনিক বা একক কোন স্বত্বা। একজনের বিকল্প কি অন্যজনে পূরণ হয়? মানুষের ভিতরে ঘটে যাওয়া কষ্টের ক্ষরণ কি অন্য মানুষ বোঝে? একজনের কান্নার অন্তরালে যে গভীর জলধি ভাসিয়ে নেয়, ডুবিয়ে দেয় তা বোঝার ক্ষমতা কি অন্য মানুষ সত্যিই রাখে? বিধাতা মানুষকে সেই ক্ষমতাটা কি সত্যি দিয়েছে? কেবল সমমাপের কোন শুন্যতা, কোন কষ্ট দিয়েই হয়তো এক মানুষ অন্য মানুষকে বুঝে নেয় তাই না? জোনাকি! আমাদের চারপাশে এমন মানুষ কয়জন থাকে যে অন্যের গভীর কষ্টের লাল রঙ ক্ষতে শান্তির ‘মলম’ যতেœর হাতে লাগিয়ে দিতে পারে? শোন সত্য! সমবেদনায় ভরাট কণ্ঠ জোনাকির। নিজের হাতের স্পর্শে টেনে নেয় সত্যবতীর হাত, বলে-নিজের ভিতরের কষ্টে নিজেকে নিঃশেষ করোনা সত্য! ‘healing’ এর রাস্তাটা যে তোমাকেই খুঁজে নিতে হবে। নিজেকে জানো, নিজেকে ভালোবাসো, নিজের দিকে ফিরে তাকাও এইবার। শোককে ‘শক্তি’ তে রুপান্তরিত কর। দেখবে বোন তোমার পাশেই আছে তাঁর আত্মার অস্তিত্বে। সে মিশে আছে তোমার সুখে, তোমার দুঃখে, তোমার আত্মার একদম একান্তে!
Ritu Mir, Teacher, Toronto District School Board, Toronto, ritu.mir9@gmail.com