ঋতু মীর : “Death is not the end, your soul continues. A great soul serves everyone all the time. A great soul never dies!”
১।
দ্যাখো! এই বাড়িটা দেখতে কি সুন্দর! ছোট্ট ছিমছাম। এই তাহলে আমার বাড়ি! ওই যে জঙ্গলের কোণে বড় বাড়িটা ওটা তাহলে আমার। ইসস! পছন্দের বলিহারি! কি বেখাপ্পা বড় বাড়িটা। বেহুদা এত্ত বড় একটা ব্যাকইয়ার্ড। গাছ গাছালির ডাল পালায় কেমন গা ছমছমে ঘন অন্ধকার। একটানা সুরে ঝি ঝি পোকা কেমন মন খারাপ করা সুরে ডাকছে দ্যাখো? বাতাসে পাতায় পাতায় ঘর্ষণের হিসহিস শব্দটা কি ভীষণ ভৌতিক! এই বাড়িতে নিশ্চয়ই ভুতের উৎপাত আছেগো! দিনে দুপুরেও কাল্পনিক ভুতের ভয়ে স্বামীর গা ঘেঁষে দাঁড়ায় সত্যবতী। তার স্বামীর কণ্ঠে ভুত উড়িয়ে দেয়া বলিষ্ঠ স্বর- বাড়ির পেছনের এই নির্জন জঙ্গল, গাছের পাতার এই ভয়ঙ্কর সুন্দর শব্দই যে আমাকে ভীষণ টানছে সত্য। বেছে বেছে ভয়ের জিনিষ মাথায় এমন সেটে রাখো কেন বলতো? জানতো! মানুষের মনে ভুত-প্রেত নিয়ে কাল্পনিক ভয়ের জন্ম হয় মনের একধরণের ‘insecurity’ থেকে। ভুত বলে কি সত্যি কিছু আছে? প্রিথিবীর যাবতীয় অলৌকিক অশরীরিতে বিশ্বাসী সত্যবতীর সদা ভীতু মনটা স্বামীর কথায় আশ্বস্ত হয় না, বরং এমন বাড়িকে সমর্থন করে তার প্রতি কঠিন কোন অবিচার হচ্ছে- এমন ভাবনায় দমে যায় সে। পথে পথে হেঁটে ‘এই বাড়ি আমার পছন্দের’, ‘ওই বাড়িটা আমার বাবার’ বলতে বলতে দু’জনের প্রবাসের সংগ্রামী জীবনের শুরুর অধ্যায়ের গল্পটা ছিল এমন। ভুত বলে সত্যি কি কিছু আছে? মানুষ মরে গিয়ে কি ভুতের ছায়া ধরে আবার ফিরে আসে? মনে মনে বলে সত্যবতী- নাকি ভুতের আদলে অবিনশ্বর আত্মারাই প্রতিনিধি হয়ে ‘আমরা আছি’ বলে জানান দিচ্ছে? নাকি ভুতেরাই আত্মাকে ধারণ করে নশ্বর পৃথিবীতে আবার ফিরে আসার আকুল আকুতিতে ভেঙ্গে পড়ছে? সব কিছুতেই ভয়ের আশঙ্কায় জড়সড় সত্যবতী এই বিভূঁইয়ে এসে যেন আমুল বদলে গেছে। ভয়ের সংজ্ঞাটা পাল্টে তার মন থেকে বাধ্যতামূলক প্রস্থান ঘটেছে অলৌকিক অশরীরিদের। এইসব কাল্পনিক ভাবনায় এখন আর ভয়ে কাঁপে না সত্যবতী। বয়সের, চিন্তার পরিপক্কতার গভীর অনুভবে নিজ অন্তঃস্থলে এখন অনেক বেশি শঙ্কাহীন, ভয়হীন সত্যবতী।
২।
‘হ্যালোইন’ দিবসে রক্তচোষা ড্রাকুলার সাজে সহকর্মী শিক্ষক ক্লাস সংলগ্ন করিডোরে দাঁড়িয়ে সবাইকে নকল ভয় দেখাচ্ছে। কথা বলে উঠতেই জীবের মাঝ বরাবর কাটা মোটা লাল দাগ সেলাই মত চোখে পড়ে সত্যবতীর। চোখে লাল লেন্সের শোণিত দৃষ্টি। ঠোঁট থেকে গলা বরাবর ছুরি কাটা গভীর ক্ষত। ঠোঁটের কষ বেয়ে রক্ত ঝরছে। ভাবখানা, এই মাত্র রক্ত খেয়ে এলাম। কঙ্কালের মাথা, চোখ থেকে আলো বিচ্ছুরিত নেকলেস, কিম্ভূতকিমাকার সিংহ মুখ বেঙ্গেল, আংটি। ভুতের ছবি সম্বলিত লং ড্রেস। একেবারে পারফেক্ট হ্যালোইন সাজ! ‘happy haloween’ বলে সহকর্মীর দিকে তাকিয়ে হাসে সত্যবতী। স্কুলে হ্যালোইন উৎসব পালনের প্রয়োজনে নিজেকেও বড় বড় নখ, দাত আর কালো চোঙ্গা হ্যাট পড়ে ‘ডাইনি বুড়ী’ সাজ দিতে হয়েছে। নিজের মনেই গজ গজ করে সত্যবতী-পয়সা খরচ করে কিনা রাক্ষুসী, ডাইনী সাজ? ভুত, কঙ্কাল, মাকড়সা জাল, পামকিন, ‘জ্যাক- ও -ল্যানটার্ন’ (Jack-o-Lantern)সহ আরও কত শত জিনিষ দিয়ে সাজাও ক্লাশরুম, সাজাও বাড়ি, নিজে সাজো যেমন খুশি, পিলে চমকে যাওয়া শব্দে নাচো ভুতের নাচ! আলো ছায়ার ভূতুড়ে অন্ধকারে ড্রামের কানফাটানো শব্দ, তালের সাথে উদ্দাম নৃত্যের ‘হ্যালোইন’ আসরে নানা অঘটন ঘটার গল্পও আছে কত। এদিকে Trick or Treat, Scavenger hunt হ্যালোইন উৎসব খেলায় পোশাক, জুয়েলারী, বাক্স বাক্স ক্যান্ডির সাজ সাজ রবের আড়ালে চলে মুনাফারখোরদের অবাধ বাণিজ্য! আসলেই! ভাবে সত্যবতী- জীবন যেখানে যেমন!
৩।
কন্সট্রাকসন পেপার, কটনবার, আঠাসহ স্কেলিটন (Skeloton) বানানোর নানা সরঞ্জাম টেবিলে গুছিয়ে রাখে সত্যবতী। ক্লাসটা যেন একটা এক্যুরিয়াম, একঝাক রঙিন মাছের ছোটাছুটিতে ব্যস্ত, প্রাণবন্ত। Personality, ability, learning style, strength, weakness, need এর মাপকাঠিতে প্রত্যেক শিক্ষার্থীই যেন ভিন্ন, ইউনিক এক স্বত্বা! ব্যস্ত হাতে বোর্ডে ‘হ্যালোইন’ সংশ্লিষ্ট শব্দ লিখে চলে সত্যবতী- ghost, skeleton, human, bodz, bone, pumpkin, lantern, light, dark! আসো! গুনে নাও স্কেলিটন বোন- আহ্বান জানায় সে। হৃদপিণ্ডের খাঁচাটা বানাতে তাহলে কয়টা কটনবার লাগছে? আর দুই হাত, পা মিলিয়ে কয়টা আঙ্গুল? প্রমেথিয়ান বোর্ডে কঙ্কালের ছবিতে দৃষ্টি আকর্ষণ করে সত্যবতী। দ্যাখো! দুই হাতে দশ আঙ্গুল। একটা কটনবার যদি দুই ভাগ কর তাহলে দুই হাতে কয়টা লাগছে? মেধাবী বালিকা ছুটে এসে গুনে নেয় ঠিকঠাক। চোখে দুষ্টুমি মেখে অন্যজন গোনে- এক-দুই-তিন হলেই চলে। বেশ! গোন তোমার আঙ্গুল। তিনটা নিলে দুইভাগে হল ছয়, তোমার বাকি চার আঙ্গুল কই গেল? আমি আজ ‘ডাইনী বুড়ী’ কিন্তু! টিচার দেখো! এই কঙ্কালের পায়ে আঙ্গুল নেই মোটেই। এক্যুরিয়ামে একসাথে খলবলিয়ে হেসে ওঠে সব রঙ্গিন মাছ! সত্যবতীকে বিস্ময়ে অবাক করে non verbal মেয়েটা মাস্ক পড়িয়ে দেয় কঙ্কালের মুখে। কভিড কালের হ্যলোইন মেসেজটা যেন ওই বলে দিলো। ‘Learning must be differentiated to be effective’- ইন্সট্রাকশনে ডি-আই (DI) তত্ত¡টা মাথায় রেখে ধাপে ধাপে এগোয় সত্যবতী। মানুষ! মানুষ! সব আলাদা! ইউনিক! ডেলিকেট! আপাত একরকম, তবুও কেউ কারও মত নয়। তাঁকে বুঝো, জানো, নাড়াচাড়া কর- হৃদয় দিয়ে! মন দিয়ে! অবিস্মরণীয় অভিজ্ঞতায় শিক্ষক জীবনের শ্রেষ্ঠ ‘আহহা (Ahaa!) লেসনের wrap-up পর্বে এসে থামে সত্যবতী। কেবল চরিত্র বেছে নিয়ে ‘হ্যালোইন’ সাজ, ‘ভুত’ কঙ্কাল নিয়ে কাল্পনিক সংলাপ, পোশাক, জুয়েলারী, সাজগোজসহ তাবৎ জিনিষের ভয়, ভয় আয়োজনই কি কেবল এই উৎসবের মর্মার্থ? লেসনের ভ্যালু (value) বা দৃষ্টিভঙ্গী (attitude) কি হওয়া উচিত? ভাবনার গভীরে তলিয়ে যাওয়ার অবকাশ পায়না সত্যবতী। ত্বরিত পায়ে বোর্ডে লেখা হ্যালোইন শব্দগুলোর পাশে লাল কালিতে ‘soul’ শব্দটা যোগ করে সে। চোখের সামনে বয়ঃসন্ধির কোমলমতি শিক্ষার্থী। একতাল কাঁদার মত মনে তুলির নরম আঁচড় টেনে টেনে lessson concept চিত্রায়িত করার মহান দায়িত্ব যে আজ সত্যবতীর! কি এক আত্মবিশ্বাসে উজ্জ্বল দেখায় সত্যবতীর মুখ। যথার্থ উদাহরণ টেনে ‘সহজ থেকে কঠিন (simple to complex), ‘বাস্তব থেকে বিমূর্ত’ (concrete to abstract) এর ধারনায় শিক্ষার্থীকে পৌঁছে দিতে থাকে সে। শোন! মানুষের দেহটা নশ্বর কিন্তু আত্মা বা soul যে অবিনশ্বর। মৃত মানুষটাকে আমরা আর দেখি না ঠিকই কিন্তু আমাদের হৃদয়ে তার আত্মার অস্তিত্বকে অনুভব করি। প্রশ্ন জাগতে পারে মনে- আত্মা তাহলে কোথায় থাকে? আত্মারা মিশে আছে ভাল কাজে, মিশে আছে মাটির এই পৃথিবীতে তাদের মুল্যবান অবদানে। তাঁদের কাছে আছে সুদিনের খবর। আছে সাফল্যের চমৎকার সব গল্প। দ্যাখো! অন্ধকারে লণ্ঠন জ্বেলে তারা কেমন পথ দেখাচ্ছে আমাদের। এককোণে বসা দুষ্টমতি চঞ্চল বালকটি এখন বেশ সুবোধ শান্ত। ঝকঝকে চোখে উৎসাহের উদ্দীপনা। বলে- এখানে সবাই কিন্তু খুব ভাল ভুত! কেউ harmful নয়, উপকারী। বিশেষ মনোযোগে ওকে দেখে সত্যবতী। ভালো মন্দ যাচাই, বাছাই হবে তোমার ভাল কাজে, পৃথিবীতে তোমার মহৎ অবদানে তাই না? পরিতৃপ্ত মন আর আবিস্কারের মুগ্ধতায় আপ্লূত সত্যবতী একা ঘরে আনমনে তাকিয়ে থাকে জানালার বাইরে, বহুদূরে। কাছের দূরের মৃত মানুষের আত্মারা ভিড় করে আসে তার চারপাশে। সত্যবতী এখন কি ভীষণ নির্ভীক! প্রিয়জন হারানোর বেদনায় ক্ষয়ে ক্ষয়ে যাওয়া অবুঝ অভিমানী মনটা তার এখন কত স্থিত! বয়সের, চিন্তার, বাস্তবতার পরিপক্কতায় এখন সে উপলব্ধি করে এবং সর্বান্তকরণে বিশ্বাস করে- ‘The highest tribute to the dead is not grief but gratitude” (চলবে…)।
Ritu Mir, Teacher, Toronto District School Board, Toronto,
ritu.mir9@gmail.com