ঋতু মীর : “Breathing is the essence of life, breathe deeply, live fully”
১।
এলার্মের শব্দে ঘুম ভাঙ্গে সত্যবতীর। ধড়মড় করে উঠে বসে সে। ঘুমটা যেন পুরোপুরি সম্পূর্ণ হয়নি। চোখ দুটো ভীষণ ঘুমে জড়িয়ে আসছে। এলার্ম বন্ধ করে আবার চোখ বন্ধ করে সত্যবতী। কি এক কারণহীন অস্থিরতার ঝাঁকুনিতে বারবার জেগে যাচ্ছে সে। একটু পরেই কাজে ছুটতে হবে সেই উৎকণ্ঠায়ই হয়তো! খুব সকালে বিছানা ছাড়ার অভ্যাসটা এদেশে এসেই রপ্ত করেছে সত্যবতী। বরাবর সে রাতজাগা পাখী। নিশীথের গভীর টানটান নীরবতায় তলিয়ে যাওয়া একান্ত একাগ্রতায় জেগে থাকতে চায় সত্যবতী। যতক্ষণ খুশি! এখন জীবনের গতিবিধি পাল্টে গেছে। কাজের তাগিদে খুব সকালে বিছানা ছাড়তে হয় বলে রাত জাগাটা যেন এখন মনের বিলাসিতা। তবুও প্রায়শই পুরনো অভ্যাসের দাস হয়ে পড়ে সত্যবতী। গতরাতে গৃহস্থালির অবশ্যকরণীয় কাজ তড়িঘড়ি শেষ করে টেবিলে বসেছিল সে। সময়টা কখন যে নিথর স্থব্ধতায় পৌঁছে গেছে টের পায়নি। ঘড়িতে সময় দেখে ভিতরে ধুকপুক করে সত্যবতীর। এটা কি কিছু হোল? নিজের উপরই একচোট ঝাড়ে সত্যবতী। ঘুমের ঘাটতিতে কাল সকালে নিশ্চিত চোখ জ্বলবে। দেরী করে দিন শুরুর খেসারতে খেয়ে না খেয়ে, নাকে মুখে ছুটতে হবে। আর দিনশেষে রাজ্যের ক্লান্তি এবং অবশেষে এক ঝুড়ি অপ্রতিরোধ্য ‘ডিপ্রেশন’ এসে নির্ঘাত ভর করবে মনে।
কাজের উদ্দেশ্যে লম্বা পায়ে হাঁটতে হাঁটতে নিজেকে আবার শাসন করে সত্যবতী। পা দুটি ভীষণ ভারী ঠেকে তার। যেন পানি ভর্তি কোন ভারী ড্রাম পায়ে বেঁধে নিয়ে চলেছে সে! সাঁই করে নাকের ডগা দিয়ে বাসটা চলে যায়। সিগন্যালের অপেক্ষায় রাস্তার অন্যপাশে দাঁড়ানো সত্যবতীর সময়টাকে এক অনন্তকালের অপেক্ষা মনে হয়। পরের বাস ধরে স্টেশনে নেমে পড়িমরি দৌড় দেয় ট্রেনের দিকে। এবারেও প্রায় মুখের উপরই বগীর দরজাটা বন্ধ হয়ে যায়। পরের ট্রেনটা প্লাটফর্মে ঢুকেই একঘেয়ে সুরে ‘ট্রেন আউট অফ সার্ভিস’ ঘোষণা দিতে দিতে হুস হুস শব্দে কোথায় যেন চলে যায়। সবাই কি সন্ধি করে সত্যবতীর সাথে শত্রæতায় নেমেছে আজ? হলুদ লাইনের বিপদসীমায় যাত্রীদের জটলাতে দাঁড়িয়ে মাথার চুল ছিঁড়তে ইচ্ছে হয় সত্যবতীর। ঘাড়ের কাছে কুকরী লাগা ভেজা চুল ল্যাতপ্যাতে হয়ে আছে। হিম হিম ঠাণ্ডায়ও ঘাড়ের কাছটা ঘাম গরমে কেমন জবজবে লাগে। তাড়াহুড়ায় চুল ড্রাই করা দূরে থাক, হাতের কাছে কিল্পটাও খুঁজে পায়নি যে আঁট করে বাঁধবে। কাজের জায়গায় ফোন করবে বলে ব্যাগের চেনে হাত রাখে সত্যবতী। ব্যাগের চৌদ্দ গুষ্টির অভ্যন্তরে হাত চালিয়েও সেল ফোনটা উদ্ধার করতে পারে না। তবে কি ফোন ফেলেই এলো বাড়ীতে? তাড়াহুড়া এবং অন্যমনস্কতায় অন্যদিনের মত ফোনটা ফ্রিযে ঢুকিয়ে রেখে আসেনিতো? কতবার ভেবেছে যে আবশ্যকীয় জিনিষের তালিকা ছবিসহ মেইন দরজায় সেঁটে রাখবে। বিশেষ করে চুলা বন্ধের বিষয়ে সে একপ্রকার ‘অবসেসনে’ ভোগে। প্রায়শই ‘চুলা’ বন্ধ না খোলাই রইল এই স্ট্রেস মাথায় নিয়ে নিঃশ্বাস বন্ধ করে দৌড়ে ছুটে সত্যবতী। ছুটতেই হয় সত্যবতীকে! ফোনের ভবিষ্যৎ অন্ধকারে ছুঁড়ে আগত ট্রেনে দ্রুত উঠে বসে সে। গিজগিজে ভিড়ে দাঁড়াবার জায়গারও ভীষণ অভাব আজ। মাথার উপরের রডে ফাঁসির আসামীর দড়ির মত ঝুলে থাকা হ্যান্ডেল ধরে ঝুলে দাঁড়িয়ে পড়ে সে। ট্রেনের গতির সাথে শরীরটা সামনে পিছনে ঝুঁকে এঙ্গেলে ঘুরে যায়। সামনের যাত্রীর গায়ের উপর পড়তে পড়তে নিজেকে সামলে নেয় সত্যবতী। দুই হাতে রড জাপটে ধরার জায়গাটা ফাঁকা হতেই তড়িৎ গতিতে সেটা আঁকড়ে শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে সে। গন্ত্যব্য না আসা পর্যন্ত কিছুতেই নড়বে না এখান থেকে। কিন্তু বগীর দরজার দূরত্ব দেখে ভিতরে আবার সেই পিনপিনে স্ট্রেস। এত ভীর ঠেলে নামতে পারবেতো? এতো আর বাস নয় যে ‘গেট অফ প্লিস, প্লিস’ বলতে বলতে লাফিয়ে ঝাঁপিয়ে নেমে পড়বে। ট্রেনে ছোট ঘর মত জায়গাটার জানালায় ‘স্টপ’ পর্যবেক্ষণের কাজে নিযুক্ত ঞঞঈ কর্মীদের দেখে প্রায়ই এক আজাইরা টেনশনে ভোগে সত্যবতী। আচ্ছা জোনাকি! এই লোকগুলো এমন একটা কাজ প্রতিদিন কিভাবে করে বলতো? কয়েক সেকেন্ড পর পরই স্টেশন, এই দরজা খোল, এই সিগন্যাল দিয়ে আবার দরোজা বন্ধ কর! কাজটা আপাত সহজ মনে হলেও যথার্থভাবে করা কি চাট্টিখানি কথা? চলমান ঘটনায় প্রতিমুহূর্তে প্রহরীর মত সজাগ থাকার ব্যাপারটা কিন্তু অসাধারণ এক ক্ষমতা। ঠিক কি না বল জোনাকি! লাঠি বা ধিষশবৎ হাতে বয়স্ক মানুষ অথবা ট্রেন মুখী দ্রুত বেগে ছুটে আসা কোন মানুষ দেখলে আমি হয়তো দরজা বন্ধের সিগন্যাল বাঁটনটা চাপ না দিয়ে আজীবন যাত্রী ওঠার অপেক্ষায়ই থাকতাম! জোনাকির সাথে স্বগতোক্তির মনগড়া কথোপকথনে নিজেকে বিশ্লেষণের আয়নায় দেখে সত্যবতী।
ভারসাম্যতায় ঠিকমত দাঁড়িয়ে অনেকক্ষণ পর স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে সত্যবতী। ঠিক সামনেই বসা তরুনীর দিকে তাকিয়ে কৌতূহলে চোখে ঝিলিক খেলে যায়। দুই পাশে দুই পুরুষ যাত্রীর মাঝখানে ঠেসে বসা মেয়েটার কোলে মাঝারী সাইজের খোলা বিউটি বক্স। অবয়ব জুড়ে নির্বিকার এক অভিব্যাক্তি। প্রসাধনে ব্যবহারের নানা জিনিষ থরে থরে পরিপাটি সাজানো বাক্সটাতে। হাতের তালুতে ক্রীম নিয়ে প্রসাধন চর্চার প্রথম ধাপ শুরু করে মেয়েটা। চামড়ায় বেস বা ফাউন্দেসন তৈরির দুই তিন রকম কালার শেড তর্জনীর আগায় নিয়ে হাতের উপরের অংশে ঘষে পরীক্ষা করে। আঙ্গুলের ডগায় করে সারা মুখের চামড়ায় তা বিছিয়ে দিয়ে ঘষে ঘষে চলে। মেয়েটার আঙ্গুলগুলো যেন শিল্পীর হাতের নিপুণ এক তুলি! কি অদ্ভুত ভাবেই না চামড়ায় ফটফটে ভাব এনে চেহারাটা বদলে দিচ্ছে! ক্ষণিক আগের তৈলাক্ত নিস্প্রভ ভাবটা চামড়া থেকে একেবারে উধাও। কালো পেন্সিলে নিখুঁত ভাবে ভ্রু আর চোখ আঁকে মেয়েটা। চোখের পাতায় নীল সোনালী কম্বিনেশনে আইশেড লাগানোর সুচারু কৌশলে ছোট চোখ দুটি যেন যাদুর পরশে হঠাৎ ঢলো ঢলো মায়াবী দেখায়। যাত্রীদের অনেকেই কৌতূহলে অপাঙ্গে মেয়েটাকে দেখে। একেবারে পাশে ছেলেটা নিরেট ভদ্রতায় চেপেচুপে বসে আছে। তার মুখে ‘নড়া চড়া নিষেধ’ এমন এক ভাব! প্রসাধনরত মেয়েটা ভ্রুক্ষেপহীন! ফোলা ফোলা ঠোঁট দুটিতে নিপুণ হাতে লাইন এঁকে লিপস্টিক দেয়। দ্রুত হাতে চুল পরিপাটি করে। পুরো মুখে হাল্কা গোলাপি ব্লাসন ব্রাশ করে প্রসাধনে ফাইনাল টাচ দেয় মেয়েটা। আড়ালে আবডালে বা অপাঙ্গে নয়, একেবারে নির্লজ্জ অভদ্রতায় মেকাপের পুরো প্রক্রিয়াটা নেশা লাগা ঘোরে পর্যবেক্ষণ করে সত্যবতী। নিজে কবে এভাবে মেকাপে সেজেছে মনে পড়ে না। বিয়েতে পাওয়া লাল রঙ বিউটি বক্সটা অব্যাবহারে জং পড়ে ফেলে দেয়ার উপযোগী হয়ে গিয়েছিল সেই কবে – কিছুতেই আর মনে পড়ে না সত্যবতীর। মেয়েটা নিশ্চয়ই কোন ফ্রন্ট ডেস্কের কাজে যুক্ত। কিছু কিছু কাজের ক্ষেত্রে শর্তানুযায়ী নিজেকে আপাদমস্তক presentable হতে হয়। হয়তো সত্যবতীর মত রাত জাগা অভ্যাসে মেয়েটিরও সকালে ঘুম ভেঙ্গেছে দেরীতে। হয়তো তৈরি হওয়ার পর্যাপ্ত সময়টা ওর হাতে ছিল না। অথবা মেয়েটা প্রসাধনের মত নিরিবিলি কাজটা ট্রেনে বসেই শেষ করে প্রতিদিন। মেয়েটার প্রতিক্রিয়াহীন স্নায়ুর জোর দেখে মুগ্ধ হয় সত্যবতী। বাহ! ট্রেনের দুলুনিতেও ওর হাতের পেন্সিলটা লিপ লাইন বরাবর কতটা স্থিত! সকাল থেকে এতক্ষণের যুদ্ধ যুদ্ধ সময়টা বেশ দর্শনযোগ্য উপভোগ্য লাগে সত্যবতীর। এই যে গায়ে গা লাগা ভিড়, আশেপাশের মানুষের তাকিয়ে থাকা, কোলাহল কোন কিছুই যেন লক্ষ্য থেকে মেয়েটাকে বিচ্যুত করতে পারছে না। ঝটিতেই ‘কোমোনিচ’ বলে ডাকা রুমানিয়ার মিষ্টি মেয়ে নাদিয়ার কথা মনে পড়ে যায় সত্যবতীর। হাতে সবসময় মোটাসোটা একটা বই নিয়ে ট্রেনিং সেশনের পিছনের বেঞ্চে বসতো নাদিয়া। আচ্ছা ‘কোমোনিচ’! এভাবে ক্লাশের অঙ্ক, স্ট্যাটিস্টিক, ভূগোলের পরিমাপ বিষয়ের ভারী ভারী লেকচার দেয়া লক্কর ঝক্কর হাটবাজারে বসে গল্পের বইটা পড়ছ কিভাবে? না অঙ্ক, না স্ট্যাটিস্টিক না ভূগোলের স্কেলের পরিমাপ- আমার মাথায় যে কিছুই ঢুকছে না! ক্লাসের সময়টা কি বোরিং! তুমিতো জানি ইতিহাসের ছাত্রী। অঙ্কের মাপ, পরিমাপের হিসাব বোঝার কায়দাটা আমাকে একটু শিখিয়ে দাওনা গো! শান্ত সরোবরের মত চোখ তুলে তাকায় নাদিয়া- আমার কাছে present moment এর করণীয় বিষয়টা অনেক বেশি ইম্পরট্যান্ট সত্য। এই যে এত দীর্ঘ সময় ধরে লেকচার যাতে আমার বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই তা নিয়ে মাথা ঘামিয়ে সময় নষ্ট করা কেন? পরীক্ষার জন্য যতটুকু দরকার ততটুকু নিজের সময়ে নিজেই বুঝে নেবো। চারপাশের পরিবেশ যে সবসময়েই তোমার অনুক‚লে বইবে এমন প্রত্যাশা কিন্তু ঠিক নয়। ‘সুইচ অন’ (switch on) এবং ‘সুইচ অফ’ (switch off) বিষয়টা জানোতো সত্য? আশেপাশে যাই ঘটুক মানুষকে নিজ মনের ঘরের সুইচটি যথাসময়ে ‘অন’ এবং ‘অফ’ করতে জানতে হবে। সেদিক থেকে- I am strong enough to handle my challenges, wise enough to find a solution to my problems and capable enough to do whatever needs to be done. তুমিও তাই হও সত্য! Just Breathe! নির্ধারিত স্টেশনে ট্রেনটা থামে। প্রতিদিনের মত আর ঊর্ধ্বশ্বাসে ছোটে না সত্যবতী। ঘড়ির সময় দেখে ধীর পায়ে রাস্তায় মুক্ত আকাশের নীচে দাড়ায়। অনেকক্ষণ পর যেন বুকভরে নিঃশ্বাস নেয় সত্যবতী। এই মুহূর্তে নাদিয়াকে খুব মনে পড়ে তার-‘জীবন চলার পথে ‘Switch off! এবং Switch on’ করতে শেখো সত্য!’ (চলবে…)
Ritu Mir, Teacher, Toronto District School Board, Toronto, ritu.mir9@gmail.com