ঋতু মীর : “Sometimes it takes only one act of kindness and caring to change a person’s life”
১।
সত্যবতীর হাতে অব্যবহৃত ন্যাপকিনটা গুঁজে দিয়ে ছেলেটা ধীর পায়ে হেঁটে চলে। একেবারে দৃষ্টি সীমানার বাইরে নয়, আবার ঠিক সত্যবতীর পাশাপাশিও নয়, হাঁটতে থাকে সত্যবতীর থেকে একটু এগিয়ে, কখনো একটু পিছিয়ে। দেহ ভঙ্গিমায়, চোখের ভাষায় যেন কোন কিছুর সম্মতির অপেক্ষা! যেন এক্ষুনি একটা প্রশ্নের উত্তর দরকার তার! অদ্ভুত ব্যাপারতো! বিস্মিত সত্যবতী ন্যাপকিনটা খুলে ধরে। সুন্দর হস্তাক্ষরে সাদা ন্যাপকিনে সবুজ গ্লিটারস মাখা কালিতে লেখা – ‘I love you!” উচ্চতায় মাঝারী গড়ন, সুঠাম সাস্থ্য, ঠোঁট দুটি বিদঘুটে বেখাপ্পা পুরু। মাথার তালু ছুঁয়ে ছোট ছোট ঘুংরি মারা কোঁকড়ানো চুল। দেহের তুলনায় আকৃতিতে ছোট মাথাটা পাট সূতার বুনটে গোলাকৃতি বটুয়ার মত মনে হয় সত্যবতীর। গায়ের রঙ ঝুম কালো। একেবারে চিকচিকে কালো কষ্টি পাথরে গড়া মূর্তি যেন ! যেন ঘন ঘোর অমানিশার ভয়ঙ্কর সুন্দর খেলা চলছে ওই দেহে! গাত্র বর্ণ আর চেহারা কাছ থেকে সরাসরি দর্শনে একটু বিবমিষা লাগে সত্যবতীর। ইসস! এত্ত কালো! ‘শ্যামলা নয়, কালো’ – শুনে শুনে বড় হওয়া সত্যবতী বুঝি এই প্রথম এমন একজনের দেখা পেল যে তার চাইতেও কয়েক পোঁচ বেশিই কালো! ভাবনাকে দুই হাতে ঠেলে গভীরে তাকায় সত্যবতী। আরে! কোথায় দেখেছে? তাইতো! একটু আগেইতো ডাইনিং রুমে নানা কণ্ঠের গুনগুনানী শব্দের মাঝে তলিয়ে যেতে যেতে দুরের টেবিলে তাঁকে একা বসে থাকতে দেখেছে সত্যবতী। আনমনে চোখাচখিও হয়েছিলো কি! বয়সে ছেলেটা যে তার হাঁটুর বয়সী তা আঁচ করে সত্যবতী। বাহহ! কালো চেহারায় ঝকঝকে সাদা মুক্তো দাতের হাসিটা কি অদ্ভুত দুত্যি ছড়ানো! আয়তকার ভাসা ভাসা চোখে তারুণ্যের রোমাঞ্চ লাগা ভাবটা মুহূর্তেই সত্যবতীর মনোযোগ কাড়ে। স্নেহভরা মাধুর্যের এক সংজ্ঞাহীন ভালোলাগায় ভেসে যায় সত্যবতী।
২।
ছিমছাম অডিটোরিয়ামে উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের গুরুগম্ভীর আয়োজনে চকিতে চোখ বুলায় সত্যবতী। আঠাশটি দেশ থেকে প্রায় উনপঞ্চাশ জন প্রশিক্ষণার্থীর অংশগ্রহণে শুরু হচ্ছে ‘এডুকেশন এন্ড এডমিনিসট্রেসন ম্যানেজমেন্ট’ বিষয়ে চারমাসের ইন-সার্ভিস ট্রেনিং কোর্স। আর তাতে যোগ দেয়ার জন্যই ভারতের দিল্লিতে আসা সত্যবতীর। চাকরি সূত্রে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে যাওয়া তার নতুন নয়। ব্যক্তিগত এবং কাজের সূত্র মিলে এই ভারতেই তার সফরের সুযোগ হয়েছে বহুবার। জীবনে এইসব ট্রেনিং এবং শেখার সুযোগ পাওয়া সত্যবতী নিজেকে ভাগ্যবান মনে করে সবসময়। অনেকের মাঝ থেকে নির্বাচিত হওয়ার ব্যাপারটা তার ‘Self Esteem’ কে পর্বত শৃঙ্গের অবিশ্বাস্য উচ্চতায় পৌঁছে দিয়েছে বারবার। চেহারা, শারীরিক গঠন, পোশাক, খাদ্য অভ্যাস, ভাষা সর্বোপরি ভিন্ন সংস্কৃতি- সব মিলিয়ে আগত প্রশিক্ষণার্থী দলটাকে একটা ছোটখাটো চিড়িয়াখানা মনে হয় সত্যবতীর। কত শত বিচিত্রতা নিয়ে মানুষ এই পৃথিবীতে! চেহারা, শারীরিক গঠন ছাড়াও আচরণের ভিন্নতায় সত্যবতী যেন হোঁচট খেতে খেতে শিখে চলে। শেখার, অংশগ্রহণের প্রক্রিয়ায় প্রতিনিয়ত acceptance বা ‘গ্রহণ’ এর পথটাই বেছে নেয় সত্যবতী। আজ সকালে উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের পরে কি কাণ্ডটাই না হোল! একে অন্যের সাথে পরিচিত হওয়ার জটলায় চঞ্চল পায়ে ঘুরে বেড়াচ্ছিল সত্যবতী। শ্রীলঙ্কা, মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড, মঙ্গলিয়া, লাউস, ভিয়েতনামের নরম আদলের চেহারাগুলো ইতিউতি দেখে সাবধানে এগুচ্ছিল সে। আফ্রিকান বিশাল দেহী, ভারী ভারী চেহারার ছেলে মেয়েদের দলটার দিকে এগিয়ে যাবে কিনা ভাবতেই ক্যামেরুনের কালো লম্বা চওড়া কিংকং টাইপ ছেলেটা একপ্রকার বগলদাবা করেই সত্যবতীকে নিজেদের জটলায় নিয়ে আসে। ওর সাথে হাঁটতে যেয়ে নিজের দেহভারকে একটা রসুনের ছিলকা মনে হয় সত্যবতীর। যেন দমকা হাওয়ায় কেউ তাকে উড়িয়ে নিয়ে চলেছে! ধুম করে সত্যবতীর গালে গাল ঠেকিয়ে দরাজ কণ্ঠে সেই জায়েন্ট কিংকং বলে- হেই! আমি এই! তুমি? ভ্যাবাচেকা খাওয়া সত্যবতী নিজেকে মুহূর্তে সামলে নেয়। নিজের হাতটা ‘ভীমসেন’ পাঞ্জাওয়ালা হাতগুলোর সাথে মিলাতে মিলাতে মানুষগলোর অসম্ভব দৈহিক শক্তিটা অনুভব করে সত্যবতী। এশিয়ান হিসেবে তারা বোধহয় দৈহিক শক্তিতে এদের কাছে নস্যি! পোশাক পরিচ্ছদের ঝকঝকে পরিচ্ছন্নতা আর গায়ে ইন্দ্রিয় ছুঁয়ে যাওয়া সুগন্ধের ব্যাপারটাও ক্ষণিকেই সত্যবতীকে মুগ্ধ করে। হাতে ‘ন্যাপকিন’ গুঁজে ‘I love you!’ বলা ইঁচড়ে পাকাকে তখন এদের দলে দেখেছে বলে মনে পড়ে না সত্যবতীর।
৩।
আচ্ছা! তোমার স্বামী যদি তোমার গালে কখনও থাপ্পর মারে তাহলে তুমি কি করবে সত্য? বালকসুলভ এই প্রশ্নে জোরে হেসে ওঠে সত্যবতী। বলে-আর যাই করি তোমার কাছে যে চলে আসবো না এটা নিশ্চিত। চকিতেই আহত এক অভিমান ছায়া ফেলে ছেলেটার চোখে। পরিচয়ের আলাপে ইতিমধ্যেই ওরা একে অন্যের কাছে বন্ধুত্বে উন্মোচিত এবং সহজ। ফ্রেঞ্চ কলোনি ভুক্ত দেশ থেকে আসা ছেলেটার ইংরেজি ভাষা শুদ্ধ, উচ্চারণ স্পষ্ট। ক্লাশে গ্রুপে কাজ করার সময় হেসে সত্যবতীকে বলে- আমি বাংলা শিখতে চাই! ‘লাভ’ শব্দটা বাংলায় কিভাবে বলে শেখাওতো! আর ‘কেয়ার’ সেটার বাংলা? মুহূর্তেই কিশোর সুলভ দুষ্টুমিতে হাতে থাকা ন্যাপকিনে ‘I love you! Love me please!’ লিখে আবার সত্যবতীর হাতে গুঁজে দেয়। তুমি আসলে ইঁচড়ে পাকা! শুধু আমি নই, আমরা ‘এশিয়ান’ রা কিন্তু প্রচণ্ড আবেগপ্রবণ এবং ঘোর সংসারী। আমার ভালবাসার মানুষ দেশে অপেক্ষায় আছে। জানোতো! আমাদের মস্তিষ্কের রন্ধ্রে রন্ধ্রে প্রিয় মানুষের জন্য সেই ‘অপেক্ষা’ কাজ করে। আর বয়স জানো আমার? তুমিতো মোটে আঠাশে পা রেখেছো! জীবনকে এখনও যুক্তি দিয়ে বিশ্লেষণ করতে শেখোনি! দৃষ্টির গভীর স্বচ্ছতায় ওর দিকে তাকায় সত্যবতী। এক অভাববোধের কষ্ট আছে যেন ওই মনে! খোলামেলা আলাপচারিতায় ওর চিন্তার ম্যাচিউরিটির ধাপগুলোতে সতর্ক পা ফেলে চলে সত্যবতী। ‘তোমার বয়সটা জানি যেভাবে তুমি আমারটা জানো’! গড়গড়িয়ে বয়সের অঙ্কটা নির্ভুল প্রকাশ করে বিব্রত বিড়ম্বনায় ফেলে দেয় সত্যবতীকে। বয়স কি আসলেই কোন ব্যাপার সত্য? এই প্রশ্নের উত্তরটা তাৎক্ষণিক মাথায় আসে না সত্যবতীর। প্রসঙ্গক্রমে চাকরি, দেশ, জীবন, পরিস্থিতি, প্রেম নিয়ে তুমুল গল্প হয়। কথায় কথায় সত্যবতী জানে দেশে ওর প্রেমিকা আছে। এখান থেকে ফিরে যাওয়ার পর সংসার শুরু করবে। কিছুটা কৌতূহলী হয় সত্যবতী। ঠাট্টায় বলে- মিস করছো না প্রেমিকাকে? হ্যাঁ! হয়তো করছি! হয়তো নয়! উত্তরে সন্তুষ্ট হয় না সত্যবতী। দ্যাখো! ভালোবাসার প্রশ্নে ‘সততা’ ‘বিশ্বাস’ আমার কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। এই যে তুমি ‘ভালোবাসি! ‘ভালোবাসো!’ বলে এভাবে আমার মত কাউকে জ্বালাচ্ছ এর মানেটা কি? নীরব অভিব্যাক্তিতে সুদুরে হারায় ছেলেটা। জানো সত্য! আমার কাছে ‘love meant that you care for another person’s happiness more than your own, no matter how painful the choices you face might be’। তোমার আচরণ, চলা ফেরা বলা সবকিছুতেই ‘কেয়ারিং’ পারসোনালিটির প্রতিফলনটা খুব স্পষ্ট সত্য! এশিয়ান জোন থেকে তুমি যখন ‘ভিপি’ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছো তখন দেখেছি তুমি প্রায় সবার ঘরে ঘরে যেয়ে সুবিধা অসুবিধার খবর নিয়েছো। ডাইনিং চালানো কমিটির সাথে দেন দরবার করে আফ্রিকান কমিউনিটির জন্য খাবার বিশেষ করে মাংশের সরবরাহ আরও বাড়াতে চেষ্টা করেছো। আর তুমি সারাক্ষণ সবার মনের গহীনে হানা দিয়েছো। জানতে চেয়েছো মন, জানতে চেয়েছো দেশে কাছের মানুষেরা কে কেমন আছে। প্রথম দিনই আমি তোমাকে দেখেছি সত্য। তোমার সৌন্দর্য, বয়স, পোশাক, সাজগোজ বা স্ট্যাটাস দেখিনি মোটেই! দেখেছি তোমার চোখ, চোখের ভাষা, তোমার শুভ্র হাসি, তোমার কথা, তোমার আচরণ। কি ভীষণ মায়াময় তুমি সত্য! কি ভীষণ এক ‘আশ্রয়’ দেয়া ভাব তোমার মধ্যে! যা আমাকে টেনেছে, টানছে প্রতিনিয়ত! শোন সত্য! ‘Kindness is a language which the deaf can hear and the blind can see’। তুমি সেই মানুষ যার সাথে আমার আর কখনই দেখা হয়নি you care too much in a world that cares too little! নিজের সম্পর্কে এই বিশ্লেষণে বিমোহিত হয় সত্যবতী। অসম বয়সী ছেলেটার চিন্তার, ম্যাচুরিটির গভীরতায় বিস্মিতও হয়। ভিতরটা কি এক মায়ায় কুল কুল করে ওঠে। চোখে জলের সুক্ষ আভাস লুকাতে দ্রুত প্রসঙ্গ পাল্টায় সত্যবতী।
অসমাপ্ত গল্পের মত সময়টা যেন হঠাৎ থেমে যায়। কোর্সের নির্ধারিত প্রোগ্রাম ধাপে ধাপে তখন শেষ পর্বে। অন্তিম লগ্নের ব্যস্ততায় অন্য সবার মত সত্যবতীরও হিমশিম অবস্থা। ডাইনিং বা ক্লাশের জটলায় ছেলেটাকে আর খুব একটা দেখে না সত্যবতী। বিদায় পর্বের কালচারাল প্রোগ্রামে মঞ্চে গান গাইতে উঠে সত্যবতীর চোখ কেবল একজনকেই খুঁজে বেড়ায়। সত্যবতীর শাড়ী, সাজগোজ, কপালের টিপ আর হাত ভর্তি চুড়ির রিমঝিম শব্দের প্রশংসায় সদা মুখর ছেলেটা আজ অভিমানে কোথায় হারালো? ‘গোল্ডেন ভয়েস’ বলে উচ্ছ্বাসে কেউ যে আর সত্যবতীর গানের প্রশংসা করছে না! নাকি করছে? সত্যবতীর শ্রবণ ইন্দ্রিয় বুঝি একটা কণ্ঠ শোনার প্রতীক্ষায়ই আছে! তিনদিন ধরে প্রশিক্ষণার্থীরা যে যার গন্তব্যে একে একে বিদায় নিচ্ছে। গাড়িতে ওঠার আগে অধোবদনে দূরে দাঁড়ানো তাঁকে দেখে ছুটে যায় সত্যবতী। কি দায়িত্বজ্ঞান তোমার বলতো? আমার নোট বইটা যে নিলে কিছু লিখবে বলে সেটা ফেরত দাও এক্ষুনি! সিরামিকে কালোর উপর সোনালী ডিজাইনের প্রিয় চুরিটা নিজ হাত থেকে খুলে ওর হাতে দেয় সত্যবতী। এটা তোমার জন্য! তোমার প্রেমিকাকে দিও কেমন! ক্লান্ত, ভারাক্রান্ত সত্যবতী গাড়ির সিটে গা এলিয়ে দেয়। খোলা নোট বইটা কোলের উপর। ঝাপসা চোখে লেখাগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকে সে- “In life we always meet people as we go by, those we love most, appreciate most, admire and those who always remain at our hearts. Dear! I don’t know what to say but you have done it all. Your pleasant smile, tender care and attitude shall always remain at my heart. The day is too busy, hours too fast and seconds remaining too few, I realize you have to go, to go with no clear hope of when and where to meet again” ।
চোখের পানিতে লেখার বাকি অংশ ভেসে যায়। আবেগের অনুভবে নিঃশব্দে কাঁদে সত্যবতী। ভালোবাসি! ভালো থেকো বন্ধু! নিঃশব্দেই বলে সত্যবতী! (চলবে)
Ritu Mir, Teacher, Toronto District School Board, Toronto. (ritu.mir9@gmail.com)