ঋতু মীর : “Difficult roads often leads to beautiful destination”
১।
অন্যমনস্কতায় বাসের গন্তব্যের রাস্তাটা ধরে তাকিয়ে থাকে সত্যবতী। অপেক্ষা ব্যাপারটা কেন যেন ধাতে নেই তার। যাতায়াতে বাসের চেয়ে ট্রেন ধরলে বিরক্তির মাত্রাটা কম হয় কারণ ট্রেন বাসের চেয়ে কম অপেক্ষায় রাখে বলেই। মনে আছে এখানে আসার পর শেয়ার হাউসের পাশের রাস্তায় চলা বাসের জন্য অপেক্ষার অত্যাচারে জর্জরিত সত্যবতী বাসটার ‘not in service’ দেখে ‘most frequent service’ বলে গালি দিত। এক হাঁটু স্নোতে দাঁড়ানো সত্যবতী তখনো নর্থ আমেরিকার মাইনাস টেম্পেরেচারে অভ্যস্ত হয়ে ওঠেনি। চারদিক সাদা জমাট বাঁধা তুষারে আবৃত। ব্ল্যাক আইসে পিছলে পড়ে যাওয়ার সতর্কবাণীতে প্রায় হামাগুড়ি দিয়ে বাস স্ট্যান্ডে পৌঁছে গিয়েছিল সত্যবতী। তীব্র ঠাণ্ডা বাতাসের সাথে লম্বা শলাকার মত স্নো চোখে আঘাত করতে থাকে। হাত দুটি জ্যাকেটের পকেটে হাত মোজাতেও জমে বরফ ঠাণ্ডা। সেই সাথে প্রচণ্ড ব্যাথার অনুভুতিতে মনে হয় বুঝি কেটেই ফেলতে হবে হাত। বাসের দিকে মুখ করে দাঁড়ানোর কসরতে একটু পিছন ফিরতেই হুস করে বাসটা নাকের ডগা দিয়ে চলে যায়। সত্যবতী স্পষ্ট ড্রাইভারের মুখটা দেখে, চকিত দৃষ্টি বদলও হয়। পৃথিবীর পাষণ্ড, নিষ্ঠুর মানুষের তালিকায় তাকে ফেলে সত্যবতী অঝোরে কাঁদে সেদিন। চোখের পানি গাল বেয়ে নামতে না নামতেই আইসিকেল হয়ে জমে নাকের পানিতে এক মোহনায় মিশে যায়। পরবর্তী বাসের অপেক্ষায় ঘড়ির সময়টা যেন এক প্রাগৈতিহাসিক বরফ যুগের স্তব্ধতায় দাঁড়িয়ে থাকে। আবহাওয়া দেখে বের হওয়ার অভ্যাসটা তখনো রপ্ত হয়নি সত্যবতীর। গন্তব্যে পৌঁছাতে ভীষণ দেরী হয়ে যায়। ভাগ্যকে দোষারোপ করতে করতে স্বামীর উপরও এক পাহাড় অভিমান জমে সত্যবতীর। সেতো বাসার পাশে ফাস্টফুডের দোকানের কাজেই মহা উৎসাহী। মনে স্বপ্নের পাখীরা কেমন ডানা মেলছিল- আহা! সামান্য কিছু ডলার হাতে পেলেই এক ছুটে দেশে মায়ের কাছে চলে যাবে সে! কেন তাকে এই ‘স্কিলস ফর চেঞ্জ’ এর দরজায় জোর জবরদস্তি ঠেলে দেয়া? প্রিন্সিপাল এপ্লিক্যান্ট হিসেবে স্কিল ক্যাটাগরীতে মনোনীত হয়ে সেকি এদেশে পা রাখেনি? শুরুর ‘শুন্য’ বিন্দুটাকে সংখ্যায় ঠেলে নিতে এই এক জীবনে আর কত স্কিল জড় করতে হবে তাকে? ইংলিশ ল্যাঙ্গুয়েজ এবং অন্টারিও স্কুল টিচিং ব্রিফিং কোর্সের ক্লাসরুমে পৌঁছে দেখে উপস্থিতি জমজমাট। প্রাকৃতিক এই দুর্যোগেও প্রায় প্রত্যেকেই সময়মত পৌঁছে গেছে। সবারই চোখে মুখে আশার আলো, সেই সাথে এক ফ্যাকাশে শূন্যতাও গোপনে মিশে আছে। আটলান্টিকের কালো পানি পাড়ি দিয়ে জীবনের তরীটা ‘শুন্য’তে ভিড়িয়ে এই দেশে পা রেখেছে নতুন করে আবার শুরু করবে বলে। শরীর মন ভেঙ্গে আসা স্ট্রেসের ক্লান্তিতে একপ্রকার নুইয়ে পরে সত্যবতী। সমন্বয়কারী ইন্সট্রাক্ট্রর আন্তরিকতায় ক্লাশে ডেকে নেয়। ভেজা জ্যাকেট হ্যাংগারে ঝুলিয়ে রাখতে রাখতে মনটা ঝুলন্ত কোন উদ্যানে অনিশ্চয়তার প্যান্দুলাম হয়ে দুলতে থাকে। ইন্টারন্যাশনাল টিচার সংক্ষেপে ‘আই-টি’ সম্বোধনে বুকে এক ক্ষীণ আশার প্রদীপ ধিক ধিক জ্বলে সত্যবতীর। পিছনে ফেলে আসা বিশ বছরের শিক্ষকতার অভিজ্ঞতাটা হঠাৎ জং ধরা এক টিনের কৌটা মনে হয়। যেন খুব জোরে শক্ত কিছু দিয়ে উপড়ে ফেলে মুখটা খুলে ফেলতে হবে এবার! ক্যানাডিয়ান স্কুল সিস্টেম, শিক্ষাদান পদ্ধতি, স্কুল কালচার, ক্যানাডিয়ান এক্সসেন্ট, colloquial, সমাজ নিঃসৃত প্রবাদ, প্রথা, ট্যাবু, রেসিজম ইস্যু এবং রেস্যুমে, ইন্টারভিউ স্কিল তৈরির লম্বা কারিকুলাম লিস্টে হাবুডুবু খায় সত্যবতী। দেশে ফেলে আসা কোলাহল, গরমে, জবজবে ঘামে ভেজা সহজ সরল সহকর্মী, বয়সন্ধির নিস্পাপ চাউনির দুষ্টুমি ভরা কোমল মতি শিক্ষার্থী, ক্লাসরুম, চকের গুড়ার সাদা ধুলায় ছাওয়া ব্ল্যাক বোর্ড, মলিন মলাটে পাঠ্য বই আর ক্ষয়ে ক্ষয়ে যাওয়া চেহারা, এবড়ো থেবড়ো দাতের হাসিতে ‘আপামনি’ বলে ডাকা ঘণ্টা বাজানো দপ্তরীর স্মৃতিতে কেমন তলিয়ে যেতে থাকে সত্যবতী। এই সময় কি ফুরাবে? এই বরফ পিছল কঠিন মাটিতে ভারসাম্য রেখে দাঁড়ানোর স্কিলটাই যে প্রথমে আয়ত্তে আনতে হবে! পারবে কি সত্যবতি? জঞ্জাল সরানোর ভঙ্গিতে হঠাৎ ঝাঁকুনিতে সোজা হয়ে বসে সত্যবতী। পারতেই যে হবে তাকে!
২।
স্মৃতির মহাসমুদ্রে অবগাহন শেষে বাস্তবতায় ফিরে সত্যবতী। আহা! বাসটা এখনও যে এলো না। স্কুলে সময়মত পৌঁছানো প্রচণ্ড জরুরি। এই রাস্তায় বাস চলে একটাই। আরেকটু সামনে এগিয়ে গেলেইতো বড় রাস্তায় তিন চারটি বাস পেয়ে যেত সে। কেন যে স্মৃতিরা যখন তখন যেখানে সেখানে এমন জেঁকে ধরে সত্যবতীকে! স্মৃতি বিলাসিতায় মনে মনে নিজেকে কঠিন কথা শোনায় সে। সামনে দাঁড়ানো মহিলা, ক্যারিবীয়ান হবে হয়তো। সাজগোজে ফিটফাট তবে বাহুল্য নেই কোথাও। বেশ শক্ত পোক্ত সুঠাম স্বাস্থ্য। কারও সুন্দর মজবুত শরীর স্বাস্থ্য সত্যবতীকে কৌতূহলী এবং কখনও একটু জেলাসও করে। আগ বাড়িয়ে জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছা হয় তার জীবন যাত্রার স্টাইল, খাদ্য অভ্যাস! মহিলা কণ্ঠে চকিতে তাকায় সত্যবতী- ‘তোমার ব্যাগটা খুব সুন্দর!’ ব্যাগের প্রসঙ্গে অপ্রতিভ ফিকে হাসিতে তাকায় সত্যবতী। ঠিক বলছে কি? আহামরি কিছুই নয় যে! আবার মন রক্ষার বা খুশি করার সম্পর্কও তো নেই ওর সাথে। প্রিন্টেড কাপড়ে জিপার লাগানো সুবিধাজনক কিছু পকেট আর কাঁধ, গলা বরাবর গলানো যায় এমন ফিতা। হাত দুটি সম্পূর্ণ স্বাধীন থাকে এমন লম্বা ফিতার ঝুলানো ব্যাগ ছাড়া সত্যবতীর চলে না। সারাদিনের জন্য কাজে বের হতে গেলে যে গোটা সংসারটাই ব্যাগে বহন করতে হয়। অনেক কিছু বহনের মত মেয়েদের এই ভারও বহন করতে হয় বইকি! ‘এত কি যে লাগে তোমাদের?’- এই প্রশ্নে স্বামীর সাথে প্রায়শই অম্ল মধুর বাকবিতণ্ডা চলে সত্যবতীর। দ্বিধা কাটিয়ে সত্যবতী বলে- জানো! এটা ডলার স্টোর থেকে কেনা। পিঙ্ক ফ্লরাল ডিজাইনে আমার অন্য আরেকটা আছে। সত্যবতীকে অবাক করে দিয়ে ঝকঝকে হাসে মহিলা- কি সুন্দর তাই না! আমিও কিনেছি তোমার মত এবং দুটোই! প্রয়োজনের তুলনায় যদিও একটু ছোট তবুও দ্যাখো কেমন লম্বা ফিতা। সত্যবতীর মুখের কথা কেড়ে নিয়ে বলে- আর সেলফোন, কার্ডের মত জরুরি জিনিষ ব্যবহারে হাত দুটো ফ্রী রাখাটা রাস্তাঘাটে কত জরুরি তাই না? আর সস্তাও বটে! আমাদের শরীরে ক্যাঙ্গারুর মত পকেট থাকলে কি যে ভাল হত তাই না? স্বতঃস্ফূর্ত রসিকতায় উচ্চস্বরে হেসে ওঠে দু’জনে। গলার স্বর সামান্য খাঁদে নামিয়ে সাবধান বাণীতে মহিলা বলে- ভাল কি জানো? শরীরে লেগে থাকে বলে এই ব্যাগ হাইজ্যাকের কোন সুযোগ নেই। সাত সকালে একজনের হাত থেকে মোবাইল ছিনতাইয়ের ঘটনাটা সবিস্তারে শুনতে শুনতে আতঙ্কিত হয় সত্যবতী। বল কি! এইখানেও এমন হচ্ছে নাকি দিনে দুপুরে? হ্যাঁ হচ্ছে তো! বাস দেরী করে আসার বিরক্তিটা আর টের পায় না সত্যবতী। বদলে যায় সময়, বদলে যায় জীবন যাত্রা, বদলায় মানুষ! রাস্তায় দাঁড়িয়ে শীতে ঠক ঠক কাঁপা সেদিনের সত্যবতীও এখন বদলেছে ঢের! স্বল্প পরিচয়ের এই অনির্ধারিত, আগলখোলা, আরামদায়ক কথোপকথনে ভিতরে ‘ওম’ ধরা শান্তির পরশ অনুভব করে সে। মহিলা জানতে চায়- কোথায় থাকো? কোথায় কাজ কর? শিক্ষকতায় আছি বলেই পরম উৎসাহে আত্মতৃপ্তির হাত তুলে নিজের বাড়ির আঙ্গিনা দেখায় সত্যবতী। ওই যে! সারি সারি, গায়ে গায়ে লাগানো একটু বস্তি মত লাল ইটের বাড়িগুলো দেখছো! ওখানেই থাকি। ও আচ্ছা! এখানে এসেছি অনেকবার। ভেতরটা গাছ গাছালীতে কেমন গ্রাম গ্রাম শান্তি শান্তি ভাব তাই না? বিস্ময়ে অভিভূত সত্যবতী। অচেনা এই মানুষের সাথে আজ সবেতেই যেন কেমন মিলে যাওয়া গন্ধ। অদম্য উচ্ছ¡াসে ভেসে যায় সত্যবতী- জানো? আমার প্রতিবেশীরা না খুব ভালো! খুব সাধারণ! আমার খুব পছন্দ সবার জন্য এক আঙ্গিনার এই আবাস, মিলেমিশে থাকা এই সঙ্গ, মাথাগোঁজার এই একচিলতে অস্তিত্ব! ডলার ষ্টোরের ব্যাগটার মত খুব সাধারণ বলেই! একটুও টানটান ‘পশ’ নয় বলেই! (চলবে)
Ritu Mir, Teacher, Toronto District School Board, Toronto. ritu.mir9@gmail.com