ঋতু মীর : ‘Since everything is a reflection of our minds everything can be changed by our minds’
১।
সবকয়টা আলো হঠাৎ একসাথে ঝুপ করে নিভে যায়। ঘন অন্ধকারে আবছায়া দেখায় ক্লাসরুমের চারপাশ। বেসমেন্ট বলে বাইরের আলো আসার উপায় নেই। চোখ সয়ে যেতে যেতে এদিক ওদিক ছায়ার মত সব দেহ দেখে সত্যবতী। পিনপতন নীরবতায় নিঃশব্দ চারপাশ। কি হচ্ছে কি? ইলেক্ট্রিসিটি কি ফেইল করলো? আজকাল এদেশেও আকসার এসব ঘটছে তাহলে! উপর থেকে ভয়েস মেসেজ ছড়িয়ে যায় গোটা স্কুলে- শুভ জন্মদিন সত্য! ক্লাসে বাতি জ্বলে উঠে সেই সাথেই। ছাত্রছাত্রী, সহকর্মীসহ প্রিয়মুখেরা এক সারিতে দাঁড়িয়ে, হেলেদুলে সমস্বরে পরিচিত গানটা গেয়ে উঠে – happy birthday to you…!! Are you 10…20…30..? ফ্যাকাসে হাসিতে শীতেও ঘামতে থাকে সত্যবতী- কত যেন হল বয়স? পরিমিত উচ্ছ্বাস আর ভদ্রতার চমক দিয়ে আপনা আপনি থেমে যায় কলরব- বাহহ!! ভালতো! মেয়েদের বয়স নাকি জানতে নেই। একজনের হাতে ছোট্ট একটা কাপ কেক। যে কয়টা মোম দেয়া যায় এই ছোট্টতেই পুতে রাখা। জ্বলছে! অভূতপূর্ব সারপ্রাইসড অনুভুতিতে আপ্লূত অভিব্যাক্তি সত্যবতীর। কৃতজ্ঞতায় তাকিয়ে থাকে সন্তানসম শিক্ষার্থীদের দিকে। আর দিন দুই বাদেই ছুটিতে ঢাকা যাবে সে। সহকর্মী প্রশ্ন করে – তোমার মায়ের জন্মদিন পাচ্ছ কি? পালন করবে নিশ্চয়ই ধুমধাম! ভীষণ কষ্টে ভিতরটা মোচড় দিয়ে ওঠে। সদা পালাই পালাই মন সেই মুহূর্তেই উড়াল পাখী হয়ে ছোটে মায়ের কাছে। জন্মদিন নয়- মা পাবেতো সে দেশে গিয়ে? জন্মদিন এলেই মাকে বিব্রত করার জন্য জড়িয়ে ধরে হুটোপুটি চালাতো সত্যবতী- মা! আজ আমার জন্মদিন! মা নরম হাতে মাথা ছুঁয়ে নির্মল হাসি উপহার দিত। সে নিশ্চিত বিশেষ দিন মায়ের মনে নেই। সংসারের নানা কাজে ব্যস্ত জগদাত্রি মা বলতেই পারবে না তাঁর কোন সন্তান কবে জন্মেছে। শুধু মায়ের কাছে কান পেতে গল্প শুনতো সত্যবতী- তাদের এই বিশাল দোতলা পুরনো বাড়িটাতে ভাই-বোনদের মধ্যে কেবলমাত্র সত্যবতীই জন্মেছে। সত্যবতীর পছন্দের খাবার প্রতিদিনই রাঁধে, সেদিন বিশেষ মনোযোগে খুঁটিয়ে জানতে চাইতো খেয়েছে কিনা! শুরু হত মাকে উৎপাত – মায়ের জন্মদিনটা জানা চাই, পালন করবে ঘটা করে। সংসারের এক সমুদ্র কাজে, সুখ দুঃখের নিরন্তর ঘূর্ণনে নিজের জন্ম তারিখ, সন্তানের জন্মদিন মনে রাখা, পালনের অবকাশ মায়ের কখনো হয়নি। মা শিশুর নিষ্পাপ হাসিতে পান মুখে নিয়ে পুরনো গল্পটা বলে যেতো- সবার জন্মদিন, সব তারিখ লেখা আছে তাঁর বাবার ডায়রিতে। তাহলে ডায়রিটা কোথায়? মায়ের মুখে কপট ভীতি খেলে যেতো। কারুকাজ করা ভারী পাল্লার সেগুন কাঠের আলমারিতে নাকি রাখা আছে সেই ডায়রি। মেজাজী, রাশভারী, অতি গুছানো বাবার জিনিষে হাত দেয়ার সাহস নাকি কারোর ছিল না!

২।
ঘুম ভাঙতেই সত্যবতী দেখে খুব ভোর নেই আর। মন ভার করা মেঘলা আকাশ, মাথার কাছে জানালায় ম্যাপেলের বড় গাছটার ঘন সবুজ পাতা বেয়ে টুপটুাপ বৃষ্টি ঝরার শব্দ। একটু সকাল সকাল বিছানা ছাড়ার অভ্যাসটা বিদেশে এসেই রপ্ত হয়েছে সত্যবতীর। চিরকাল সে রাতজাগা পাখী। রাতের গভীরের সুনসান নিরবতায় ঢুকে যেতে যেতে জীবনের অলিখিত প্রশ্ন উত্তরের ঝাঁপিটা উদ্বেগহীন খুলে বসা যায়। মনে পড়ে, সে আর পিঠেপিঠি বোন সারা দিন সন্ধ্যা পার করে রাত জেগে পড়া তৈরি করত বলে বাবা কতই না শাসন বারণ করতো। এখন সময় বদলেছে। কাজের সূত্রে খুব ভোরে ওঠার তৈরি অভ্যাসে টের পায় দিনের শুরুটা যত তাড়াতাড়ি হয় ততই যেন আবশ্যকীয় কাজগুলোকে গুছিয়ে আনা সহজ হয়। আড়মোড়া ভাঙ্গে সত্যবতী। ঘরের দরজাটা খোলা, বুঝে নেয় স্বামী বের হয়ে গেছে কাজে। মাথার কাছে ফোনটা হাতে নিতে আধ ঘুম চোখে স্বামীর মেজেস ভেসে আসে- শুভ জন্মদিন! ‘বিশেষ দিবস’ পালন বিষয়টা সত্যবতীকে নাড়া দেয় না কখনোই। ‘আপনারে লয়ে বিব্রত রহিতে’ কবিতাটা এই দিনে কেন যে এত মনে হয়! মায়ের মত সেও নিজের জন্মদিনসহ অন্য সবার জন্মদিন বা বিশেষ দিনের কথা ভুলে যায় একপ্রকার। এ হয়তো ভুলে যাওয়া নয় জোনাকি! বিস্মৃতির অতল গহ্বরে নিজেকে সমর্পণ করে আমার ‘আমি’ কে ভুলে থাকা। জোনাকি জানো! এই দিনে নীরবে নিভৃতে মাকেই মনে করতে ভাল লাগে। নিজের এবং ছেলে মেয়েদের জন্ম তারিখ ভোলা মা তাঁর বড় সন্তানের মৃত্যু দিনটা- ক্ষণটা কি একবারও ভুলতে পেরেছিল বল? কত সন্ধ্যায় নিভৃত আড়ালে আচলে চোখ মুছেছে মা। সন্তান হারানোর জমাট কষ্টটা বুকে ভারী পাথরের মত বহন করেও পালন করে গেছে সংসার ধর্ম। সব যে সত্যবতীর দেখা! সব যে তার মুখস্থ ইতিহাস! তার জীবন গল্প! কি ভীষণ ধন্য সে এমন মায়ের কোলে জন্মে। মাগো! মাথায় হাত বুলিয়ে দাও! সব ভুলিয়ে দাও, ভুলে যাই সব! জন্ম! জরা! শোক! মৃত্যু!

৩।
তেজী ঘোড়ার মত ঘাড় বাঁকিয়ে বসে থাকে ছেলেটা। উদাসীনতা আর অবজ্ঞার ক্ষোভ অবয়বে। টেবিলে ছড়িয়ে থাকা “বাবা দিবস” কার্ড বানানোর সরঞ্জাম পড়ে থাকে অবহেলায়। ছুঁয়েও দেখে না। জেদি কণ্ঠে ঘোষণা করে – আমার বাবা নেই! আজন্ম শিক্ষক সত্যবতী। শিক্ষার্থীর মন বোঝার জটিল খেলাটা খেলতে হয় প্রতিনিয়ত। ওকে একবারও আর জোর করে না কার্ড বানাতে। কেবল কাগজের একটি কার্ড বানানোই যে আজকের পাঠের প্রত্যাশিত লার্নিং এক্সপেকটেশন নয়। ক্রিয়েটিভ কিছু করার মধ্য দিয়ে মিনিংফুল মেসেজ নরম কাদার মত মনে গেঁথে দেয়ার লক্ষ্যেই না সত্যবতী ক্লাশ নামে জাহাজটির মাস্তুল ধরে দাঁড়িয়ে আছে। শিক্ষার্থীর লার্নিং স্টাইল, লেভেল বুঝে বোধগম্যতার সহজ মাত্রায় এক অভিজ্ঞ মনোবিশারদের মত এগুতে থাকে সে। শুধু একটি বিশেষ দিন নয়, সব দিনেই বাবা, মা, ভাই, বোন, বন্ধু কাছের, দুরের সবার জন্য ‘ভালোবাসা’ অথবা ‘শুভ কামনা’ অথবা ‘ভাল চাওয়া’ যে অনেক জরুরি তাই না! দেখো! আমাদের আশে পাশেই সেই সব মানুষ। প্রতিদিনের সূর্যোদয় সবার কাছে একরকম নয় কিন্তু! মনের গভীরে কত কষ্ট, ঝড় লুকিয়ে থাকে, পাশে থেকেও হয়তো তা টের পাওয়া যায় না। এই যে বিশেষ দিনের একটা ছোট্ট ‘উইশ’ সম্পর্ককে কত কাছের করে দেয় তাইনা? যদি প্রতিদিন এই রকম কিছু ঘটে কেমন হয়? নাহ! প্রতিদিন নিচ্ছয়ই কার্ড বানানো যাবে না, মেসেজ দেয়া বা পয়সা খরচ করে ফুল অথবা উপহার কেনাও নয়! শুধু প্রতিদিন আমাদের জীবনে তাঁদের প্রয়োজন অনুভব করবো, খবর নেবো, কথা বলবো অথবা যোগাযোগ রাখবো এবং অনেক অনেক ‘ভালোবাসবো’! লেসন র‌্যাপ -আপ করার পর্বে অবাক বিস্ময়ে অভিভুত সত্যবতী। ঘাড় বাঁকানো সেই তেজি ঘোড়া তার খুব কাছে দাঁড়িয়ে। আনত মুখ, হাতে ধরা কার্ডটি এগিয়ে দিয়ে বলে- টিচার! তোমাকে ভালোবাসি! পৃথিবীর যাবতীয় দুঃখ, কষ্ট, প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি এক মুহূর্তে অতিক্রম করে যায় সত্যবতী। এই মুহূর্তের বিশাল প্রাপ্তিটা হাতে নিয়ে চোখের নীরব ভাষাতেই বলে- ভালোবাসি!! আমিও! A teacher affects eternity, he can never tell where his influence stops” (চলবে)
Ritu Mir, Teacher, Toronto District School Board, Toronto, (ritu.mir9@gmail.com)