ঋতু মীর : ‘Isolation is a way to know ourselves’
১।
সত্যবতীর স্বভাবে দুই বৈপরীত্য বেশ প্রকট। একদিকে সে আপাদমস্তক সামাজিক। কোন কিছুর ‘সাতে পাঁচে’ নেই এমনটা তার সহজে মিশে যাওয়া স্বভাবের সাথে একেবারেই খাপ খায় না। বিপরীতে সে বাড়াবাড়ি ধরনের ঘরকুনো, অন্তর্মুখী এবং নিভৃতচারী। কাজের স্বার্থে বাইরে যাওয়া ছাড়া বাকি সময় ঘরে প্রায় ‘বিছিন্ন’ থাকাতেই যেন তার যত সুখ, যত স্বস্তি। নিজের চারদিকে এক অদৃশ্য বলয় তৈরি করে সে যেন আত্মরক্ষার নিপুণ কৌশলে ‘নিজেকে’ নিয়েই ভাল থাকার এক অবিমিশ্র সুখে বেঁচে থাকে। স্কুলে মার্চ ব্রেকসহ ‘করোনা’ ভাইরাসের সতর্কতা জনিত দুই সপ্তাহের উপরি ছুটির ঘোষণায় মন মেজাজ হাল্কা, ফুরফুরে। ছুটির প্রথম সকালেই আরামের চেয়ারে স্ট্রেস ফ্রী এক আয়েশি ভাব। সন্ধানী চোখ জানালার বাইরে অবাক বিস্ময়ে ছুটোছুটি করে। গাছে নতুন পাতায় নতুন প্রাণের ছন্দ। মুঠো মুঠো সোনালী রোদে প্রকৃতি বসন্তকে ধারণ করছে ধীরে। হাতের কাছে হরিশংকর জলদাস। কয়েকদিন ধরে তাঁকেই পড়ছে সত্যবতী। ‘দহনকাল’ ‘কৈবর্ত কথা’, ‘রামগোলাম’ এর জেলে, মেথর জীবনের চালচিত্র, রুপ, রস, গন্ধ মাখা, অবিস্মরনীয় সব উপন্যাস! প্রায় উড়ে উড়েই চলে যায় কয়েকটা দিন। আহা! কি ভীষণ নির্ভার আর আরামদায়ক বিচ্ছিন্ন এই সময়। নিজের মনেই বিড়বিড় করে সত্যবতী- ‘বিছিন্নতা’ বলে হয়তো কিছু নেই। জগতের দৃশ্যমান সবকিছুর সাথেই মানুষ এক অদৃশ্য শৃঙ্খলে বাঁধা । সব কিছুর সাথেই ভীষণভাবে যুক্ত এবং অবিছিন্ন।

২।
বাসায় একা? সময় কাটে কিভাবে? এই প্রশ্নে মনে কোন ‘Sensitivity’ অনুভব করে না সত্যবতী। ঠাট্টায় প্রসঙ্গটা বাতাসে উড়ায়-আহা! বড়ই শুন্য শুন্য দিন! সময় যে কাটেই না! কাব্য করে বলে- ‘অবশেষে জেনেছি মানুষ একা!’ একা হলেও যে মানুষের অবশ্য করণীয় কিছু গৎবাঁধা কাজ থাকে সেই ফিরিস্তি দেয়াটা অবান্তর মনে হয়। ‘করোনা’ ভাইরাসের স্বাস্থ্য ঝুঁকি, Self Isolation-সতর্কবাণীতে আতঙ্কের বদলে কেমন এক নির্লিপ্ত ভাব সত্যবতীর। অথচ ডাক্তার, অসুখ, মৃত্যু, শরীর-স্বাস্থ্য এইসব নিয়ে ভয়, দুশ্চিন্তা যে তার অস্থিতে, মজ্জায়! Isolation- সেতো সত্যবতীর সর্বকালের স্বেচ্ছা প্রণোদিত নির্বাসন আর স্বাস্থ্য সচেতনতা যাপিত জীবনের প্রথম প্রায়োরিটি। বাইরের খাবারে রসনা তৃপ্ত করার স্বাস্থ্য ধ্বংসকারী অভ্যাস তার নেই বললেই চলে। ‘করোনা’ পরিস্থিতির তুঙ্গের মাঝে ঘরে চাল প্রায় বাড়ন্ত। ভাত ছাড়া যে সত্যবতীর বাঁচাই মুস্কিল! খাদ্য নষ্ট না করার বিষয়ে মায়ের ছিল কড়া শাসন। খাবার ফেলার পরিস্থিতি তৈরি হলে প্রচণ্ড মানসিক চাপে পড়ে সে। প্রায়শই প্লেটের পড়ে যাওয়া ভাত খুঁটিয়ে আবার প্লেটেই তুলে নেয় সত্যবতী। ‘করোনা’ ইমারজেন্সী ফুড ষ্টক পরিস্থিতিতে নীরবেই থাকে সত্যবতী। কি বলতে কি বলবে, আবার কি না শুনতে হয়-তোমার আর চিন্তা কি! দু’জনের কতই আর লাগে? বসবাসের জায়গা নিয়মিত পরিচ্ছন্ন, গোছানো, পরিপাটী রাখা সত্যবতীর ‘প্যাসন’। খাটের নিচের লুকানো ময়লাই যে তাকে পীড়া দেয় বেশি! সর্বোপরি নিয়মবদ্ধ জীবন যাপনে অভ্যস্ত সত্যবতী তার মায়ের মতই এক মহা সংসারী! কেউ কেউ আবার সুযোগ বুঝে মনের গোপন কষ্টের জায়গাতে কথার কুঠার ঠুকে- এমন ছিমছাম! আসলে মানুষতো মোটে দু’জন, সবই সম্ভব। মন খুলেই হাসে সত্যবতী। যা শুনলে অন্যপক্ষের আত্মপ্রসাদ হতে পারে তাই বলে- আসলে নষ্ট করার মত কেউ নেই তো! তাই আদিকাল ধরে যেমন রাখি তেমনি থাকে- সাজাতে, গোছাতে, পরিস্কার করতে হয় না মোটেই! মনে পড়ে সেই কথোপকথন – আপনি তো মহা সুখী, ঝাড়া হাত পা, চিন্তা, ভাবনা নাই। জানেন! রাতে ঘুমাইতে পারি না! সঙ্কোচেই জানতে চায় সত্যবতী- ঘুম হয় না কেন? ভালো কাজ করেন, পুত্র, কন্যা নিয়ে ছোট্ট সুখের সংসার! তাহলে? দেশে পঁচিশতলা কমপ্লেক্সের ভিত্তি শুরু, এইখানে দুইটা দোকান আর বাড়ির মর্টগেজ দেয়া। বুঝেনই তো! সব ধরেন গিয়া ছেলেমেয়েরই জন্য! ভিতরে এক আত্মপ্রসাদ হয় সত্যবতীর- অন্তত ঘুম হরণের মত নির্বুদ্ধিতার রাস্তায় সে হাঁটে না বলে! মাঝে মাঝে ‘ফিগার’ নিয়েও মহা বিড়ম্বনার মুখোমুখি সে। হুম! ছেলেপিলে না হলে অবশ্য এমন ধরে রাখা সম্ভব। খাদ্যগ্রহণে পরিমিতিবোধ স্বাস্থ্যসম্মত তো বটেই, তাছাড়া বাঁকই যে দেহের কমনীয় সৌন্দর্য! ছেলেপিলে হলেই কি আর আয়েশি, বেঢপ মেদ এই শরীরে জমা হতে দিতো? কক্ষনোই না! কখনো আবার-টাকা দিয়ে করবে কি? দু’জনতো মোটে মানুষ! তাইতো! নিপাট, নিভাঁজ সত্যি! এবারও হাসে সত্যবতী, মুক্তমনেই। খরচ নেই মোটেই! দশমিকের পরে বেতনের খুচরা কয়টা পয়সাই শুধু যা খরচ, বাকি সব জমে জমে পাহাড়। কেউ আবার টিপ্পনী কাটে- আরে! দুইজন মিলে একটু ঘুরে, উড়ে বেড়ালেও তো হয়, কি আর চিন্তা! টাকা না দাম্পত্য সম্পর্কের রসায়ন- ঠিক কোনটা পরিমাপে এই উৎসাহের আতিশয্য তা বোঝার চেষ্টা করে না সত্যবতী। কষ্টের নিঃশ্বাস চেপে রাখে। বলে না যে, সাগরের নীল চোখে মেখে নীলগিরি চূড়ায় ঘুরতে নয়, মন সত্যিই পড়ে থাকে দেশে, যায় প্রতিবছর, দু’জনেই! অসুস্থ, শয্যাশায়ী মা, বাবা আর ভাইবোন পথ চেয়ে বসে থাকে- দু’জনেরই! বলে না যে, মায়ের চিকিৎসার ব্যয়বহুল খরচ, প্লেন ভাড়া, মায়ের জন্য ঔষধসহ যাবতীয় প্রয়োজনের জিনিষ কিনতে উজাড় হাতে খরচ করবে বলে তার সত্যিই ঝাঁপি ভরা টাকার দরকার। মা আর নেই এখন। প্রতিবার বিদায়ের কষ্টে ছিঁড়ে খুঁড়ে যাওয়া দগদগে লাল ক্ষত সময়ে মা’কে বলা উচ্চারিত অঙ্গীকার মনে করে চোখ ভিজে আসে নিভৃতে। একা মায়ের ছবির সামনে নিঃশব্দে কাঁদে সত্যবতী- এইতো স্কুল ছুটি হলেই আসছি মা!

৩।
ছেলেটার গায়ে হাত দিয়ে চমকে উঠে সত্যবতী, বেশ জ্বর! ছোট, দুর্বল, অপরিণত দেহে নানা সমস্যা নিয়ে এক বিচিত্র উপায়ে বেঁচে আছে। নানারকম স্বচালিত যন্ত্রপাতির হুইল চেয়ার নিয়ে চোখের পলকে ঘুরে বেড়ায় ক্লাসময়। আজ কেমন নেতিয়ে গেছে। অফিসে জানানো, জরুরি নম্বরে ফোন, বাসায় পাঠানো সব কিছুই দ্রুত সিদ্ধান্তে ঘটে। ‘করোনা’র এই আগ্রাসী সময়ে জ্বর, কাশি, কফ ওঠার বিষয়টা ঘাবড়ে যাওয়ার মতই যে! মনটা ভার ভার লাগে। হঠাৎ বিস্ময়ে খুশির চমক লাগিয়ে শেষ দিন আবার চলে আসে ক্লাসে। দাপিয়ে বেড়ায় হুইল চেয়ার। নিজের মত নিজের ‘একা’ সময়ে ‘বিচ্ছিন্ন’ হয়ে যায় ক্লাসের এক কোণে। Structured, Organized, Goal-oriented, Independent প্রোগ্রামে ওর দিনটা হয়ে ওঠে আনন্দময়, অর্থবোধক! সত্যবতীর চোখে প্রশান্তির খেলা, অন্তরে মায়ের স্বর্গীয় মঙ্গল কামনা-সুস্থ থাকুক সন্তান! প্রতিহত হোক ‘করোনা’!

ইন্টারভিউ বোর্ডের ঘটনাটা মনে পড়ে যায়- এই ক্লাশের স্পেশাল নীড (Special Need) শিক্ষার্থীদের জন্য তুমি বাস্তবমুখী কি পদক্ষেপ নিতে পারো? অবিচল কণ্ঠ সত্যবতীর-‘স্পেশাল বাচ্চাদের শিক্ষক হিসেবে আমার ড্রিম একটাই। একা, নিজস্ব সময়কে ইন্ডিপেন্ডেন্টলি চালিয়ে নেয়ার, উপভোগ করার যাদুকরী ক্ষমতাটা যাতে অবশ্যই অর্জন করতে পারে- সেই প্রোগ্রাম তৈরি করা’। জোনাকি! জানো! ‘Reflective Practice’ বিষয়টা আজকাল বেশ ভাবি। “we do not learn from experience, we learn from reflecting on experience”। নিজেকে জানার, প্রতিফলনের, পরিবর্তনের, সংশোধনের এই বুঝি এক সুবর্ণ সময়! ‘করোনা’ ক্রান্তিকালের এই নিরবিচ্ছিন্ন, একান্ত একা সময়!

Ritu Mir, Teacher, Toronto District School Board, Toronto, ritu.mir9@gmail.com