ঋতু মীর : “The empowered women is powerful beyond measure and beautiful beyond description”
১।
শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত সুনসান অফিস ঘরটা পর্দা টানা আলোছায়ায় অস্বস্তিকর। অপরাহ্ণ অলসতায় স্ফীত বপু দেহ আরামদায়ক চেয়ারে প্রায় এলানো। চোয়ালের উপচে পড়া মেদে তেল চিকচিকে ভাব। অফিস ড্রেসকোড তোয়াক্কা না করে সার্টের বোতাম অশোভন ইঙ্গিতে বুক অবধি হা করে খোলা। দৃষ্টি আকর্ষণের অরুচিকর চেষ্টাকে উপেক্ষা করে সরাসরি তাকায় সত্যবতী- আমাকে ডেকেছেন? আত্মসন্মানের টনটনে অহমিকায় তার দাঁড়ানোর ভঙ্গি অনমনীয়, ঋজু । কাজের সময়ে শুধুই কাজ পাগল সত্যবতী অফিসের এই শেষ বেলায় যথারীতি ক্লান্ত। কিন্তু পিয়ন পাঠিয়ে ‘সেলাম’ দেয়া কেন এই অবেলায়? ঢুকতেই যেন আপাদমস্তক লেহন করে চোখে। আরে বস মেয়ে! এত কি কাজ? শাড়ি পড়নি যে আজ? শাড়িতে খুব ভাল দেখায় তোমাকে! মনের অজান্তে হাত চলে আসে ওড়নায়। অকারণেই টেনে স্বস্থানে আছে কিনা পরখ করে সে। কানে ঝা ঝা শীশার পারদ ঢালা অনুভূতি – বলতে ইচ্ছা হয় মেয়ে নই, একজন ডেসিগনেটেড অফিসার, যেমন আপনি! স্বভাবজাত সরল হাসিটা বদলে গিয়ে তখন বাঁকা, চোখে ঘৃণা, অন্তরে বিষের ছুরি। জড়তাহীন স্পষ্টতায় বলে সত্যবতী- কারও মনোরঞ্জনের জন্য নিশ্চয়ই অফিসে আসি না! তড়িঘড়ি ব্যাগ গুছায় সে। টেবিলে অসমাপ্ত কাজ মুখ থুবড়ে পড়ে থাকে। মনটা দুর্বিনীত বিদ্রোহে ফণা তুলে। শরীরটা যেন ধর্ষিতার অপমান, অসন্মানের নিগ্রহে দগ্ধ হয়, জ্বলতে থাকে সন্ত্রাসী আগুনের মত। সত্যবতী সেই নারী! এই আগুন তার দেহেই জ্বলে!

২।
নারী নির্যাতন, ধর্ষণ, মৃত্যুর মত অনভিপ্রেত ঘটনার স্মৃতিতে সত্যবতী তাড়িত হয় প্রায়ই। জঙ্গলে পড়ে থাকা ধর্ষিতা রূপার রক্তাক্ত লাশের ছবি দেখে মাথায় আগাছার মতো অসন্তোষ গিজগিজ করে। নিস্ফল আক্রোশে মনটা বিক্ষিপ্ত হয়ে যায়। পুরুষতান্ত্রিক সমাজে বড় হওয়া জীবনে কত শত ঘটনায় পরোক্ষ বা প্রত্যক্ষ অপমান, মানসিক নির্যাতনের শিকার হতে হয়েছে তাকেও। ঠিক একই রকম যেন! শুধু প্রেক্ষাপট আর মাত্রাটাই যা একটু ভিন্ন। মফস্বলের কর্মস্থল থেকে ঢাকায় বাসে ফেরার পথে রাজেন্দ্রপুর জঙ্গলের কাছে ভয়ে কেমন কুঁকড়ে যেত সত্যবতী। যদি এই ভর সন্ধ্যায় গাড়িটা বিকল হয়ে যায় এখানে? পাশে বসা পুরুষ যাত্রী যদি সুযোগ নেয় গা ঘেঁষে বসার? ঘুমের ভান করে কাঁধে, গায়ের উপর এলিয়ে পড়তে চায় যদি? সরীসৃপ, পিচ্ছিল স্পর্শের গোপন হাত চালায় যদি দেহের এদিক ওদিক? অনাকাঙ্খিত ঘটনার সম্ভাবনায় বাসটা ঠিক কতটা নিরাপদ এই দুশ্চিন্তায় বহুবার চাকরী ছেড়ে দিতে ইচ্ছে হয়েছে। আজ নারী ধর্ষণ, নির্যাতন এবং মৃত্যুর ঘটনা পড়ে মনের মধ্যে টুকরা টুকরা, ঘৃণার অতল গর্ভে ছুড়ে দেয়া, প্রায় তলিয়ে যাওয়া ঘটনাগুলো কি এক রাসায়নিক বিক্রিয়ায় বিস্ফোরিত হয়ে উঠে আসে। রূপার ধর্ষকদের ধরা পড়ার খবরটা বারবার পড়ে সত্যবতী। জ্বালামুখ এক আগ্নেয়গিরি বুকের ভেতর লাভা ছড়ায়। এই মুখ, দেহ, দেহের প্রতিটি বাঁকে নিস্পাপ সৌন্দর্য, পবিত্র নির্জনতা হরণ এবং সব শেষে খুন করার ক্ষমতা, অধিকার কে, কেন, কখন, কিভাবে পেলো? তিক্ত স্মৃতির খোলা পাতাটা বন্ধ হয় না সত্যবতীর। মনে পড়ে- মফস্বলে একটা প্রশিক্ষণের সমন্বয়কারীর দায়িত্বপ্রাপ্ত পরবর্তী তিক্ত ঘটনা। কোর্স আনুষঙ্গিক জিনিষপত্র এবং সর্বোপরি নিজের সংসারটা গুছিয়ে রেখে তবেই রওনা। কর্মস্থলে পৌঁছে প্রস্তুত হয়ে বের হতেই চোখে পড়ে হোন্ডা পাশে ঢ্যাঙ্গা মতন একজন। দৃষ্টিতে শেয়ালের ধূর্ততা, দাঁড়ানোর ভঙ্গিতে মাতব্বরি, মহা আবদার আর অভিভাবকত্ব গলার সুরে। বলে- চলেন ম্যাডাম! আপনেরে হোন্ডায় স্কুলে পৌঁছাইয়া দেই। সত্যবতীর চোয়ালে ত্বরিত কাঠিন্য, গলার স্বরে স্বভাব বিরুদ্ধ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার আদেশ। বলে- রিক্সা ডাকুন, আমি একাই যেতে পারবো। সারদিনের ব্যস্ততায়, যাত্রার ধকলে ক্লান্ত শরীর। রেস্ট হাউসে থাকার নিরাপদ ব্যবস্থায় মনে স্বস্তির আনন্দ। অথচ ঘুমাতে যাওয়ার উপায় নেই। ঘর জাঁকিয়ে বসে আছে মহিলা সঙ্গলোভী পুরুষ এবং সকালের সেই হোন্ডাধারী টাউট। প্রতিবাদী হয় সত্যবতী। একপর্যায়ে উঠে যেতে বাধ্য পুরুষ আহত হিংস্র নেকড়ে যেন। পিচ্ছিল কণ্ঠে, নোংরা হাসিতে শরীর কাঁপিয়ে সরু চোখে তাকায় সত্যবতীর দিকে। বলে – আপনি এমন কি সুন্দরী হইলেন যে…! এই স্পর্ধার যোগ্য জবাবের রুচি বা ক্ষমতা সেদিনের সত্যবতীর ছিল না।

৩।
স্টাফ লাউঞ্জে ‘ওমেন এবিউজ’ এর পোস্টারে অন্যমনস্কতায় চেয়ে থাকে সত্যবতী। চোখের নিচে আঘাতের কালো কালশিটে দাগ, ঠোটের কষে রক্ত, দৃষ্টিতে আতঙ্ক, হতাশাগ্রস্থ এক নারীর মুখ। জানো জোনাকি! বিশ্বের বহু নারীই এখনও ঘরে বা বাইরে, শারীরিক বা মানসিক কোন না কোন ভাবে নির্যাতিত। আধুনিক, প্রগতিশীল এই শতাব্দীতে ‘নারীর ক্ষমতায়ন’ নিয়ে গাল ভরা বুলি তাহলে কি প্রতিনিধিত্ব করে বল? সেকি শুধু বিশেষ দিন পালনের আড়ম্বরে নারীকে কালের যাত্রায় আরও এক ধাপ বন্দী রাখার আয়োজন? সেকি নারীকে নিয়ে বিপণন কায়দায় মুনাফা লুটেরার আগ্রাসী কোন পুঁজিবাদের বিস্তার? সেকি কিছু স্পর্শকাতর চটকদার বাণিজ্যিক প্রচেষ্টার অবিরাম ঢাক পেটানো? সেকি চোখে আঙ্গুল দিয়ে বুঝিয়ে দেয়া যে নারীর কোন অবস্থান নেই, অধিকার নেই, ছিল না?

শোন জোনাকি! ক্ষমতায়নের নামে নারীর ‘ক্ষমতায়িত’ হবার সুক্ষ বিষয়টা আজ আয়োজনের ঢাকঢোলে সুকৌশল এক পর্দার অন্তরালে কেমন ঢাকা পড়ে যায়। নারী উন্নয়ন নামের সেই মহামূল্য সংবিধানটি হয়ে পড়ে অরক্ষণীয়। ক্ষোভের উত্তেজনায় সত্যবতীর মুখটা গনগনে দেখায়। জোনাকির বুদ্ধিদীপ্ত চোখে যুক্তি আর কথার খেলা। দ্যাখো সত্য! সভ্যতার শুরুতে নারী পুরুষের যৌথ বসতির পৃথিবীটা কিন্তু এমন ছিল না বরং মানুষ হিসাবে মানুষের বাঁচার, বিকশিত হবার শ্রেয়োবোধটি ছিল প্রধান। দিনে দিনেই নারী ছিটকে পড়েছে ‘মানুষ’ নামের বিশেষণ থেকে। মানুষ হিসেবে মানুষের কিছু অধিকার জন্মগত। তা অর্জনের বা কারো কাছ থেকে হাত পেতে নেয়ার বিষয়তো নয়। ক্ষমতায়ন! সেতো ঘটবে নারীর মন থেকে, তাঁর চেতনা থেকে, তাঁর সমাজ ও ঘর থেকে। জীবনের সব ক্ষেত্রে নারীর নিজস্ব চিন্তা, শক্তি ভাবনার প্রতিফলন ঘটলে সর্বোপরি জীবনকে অন্যের নিয়ন্ত্রণ মুক্ত রাখার যোগ্যতা সৃষ্টি হলে তবেই তো হবে ক্ষমতায়ণ! “nothing can dim the light which shines from within”- জোনাকির চোখে স্থির উজ্জ্বল দৃষ্টি রাখে সত্যবতী।

শোন! সামাজিক অধিকারের হিস্যা নয়, এই মুহূর্তে নারীর মানবিক অধিকারের হিসাবটাই বূঝে নেয়া জরুরি। নির্যাতন সেটা শারীরিক বা মানসিক যে মাত্রায়ই হোক জীবনের অপ্রীতিকর, অনাকাঙ্খিত ঘটনা প্রকাশে নারীকে অবশ্যই মুখ খুলতে হবে।

হে পুরুষ! পুরুষতন্ত্রের উত্তারাধিকারে পাওয়া সেই শ্রেষ্ঠত্বে নয়, বিবেক শাসিত ঐশ্বরিক ক্ষমতায় অর্জন কর নারীকে, হয়ে ওঠো পুরুষোত্তম। নিন্দিত নরকের দুয়ার ভেঙ্গে অনিন্দিত আবহে নারী বিকশিত হবার সুযোগ পাবে, শরীরে ও মনে হয়ে উঠবে পরিপূর্ণ এক নারী। অভয়ারণ্য হবে রুপার পৃথিবী- আজ সেই কথাটাই দাও!
উৎসর্গ- ধর্ষিতা! তোমাকে!

Ritu Mir, Teacher, Toronto District School Board, Toronto, (ritu.mir9@gmail.com).