ঋতু মীর : “Family is anyone who loves you unconditionally”
১।
একমাথা ঘন কালো চুল ছিল সত্যবতীর। বশ না মানা উরুখুরু, ঝাঁকড়া, কোঁকড়া সেই চুল। পাড়ার তাবৎ ছেলেমেয়ের সাথে খেলাধুলা, হুড়াহুড়ি দৌড়ঝাঁপে দুরন্ত এক কৈশোর। ফ্রকের ঝুলে অসংখ্য চোরকাঁটা, ধুলায় মাখামাখি পা, হাঁটু। চুল পরিপাটীর ইচ্ছা বা সময় নেই মোটেই। বাঁধেনি বলে একদিন পিঠময় ঝাঁপানো চুল কান পর্যন্ত কেটে দেয়ার ব্যবস্থা হয়। থোপা থোপা চুল কাঁধ বেয়ে পড়ে একটা ছোট কালো ঢিবি হয়ে যায়। সত্যবতী কেঁদেছিল অঝোরে। চুলের জন্য নয়, শাসনের জন্যও নয়। কেঁদেছিল বাইরে অপেক্ষারত খেলার সাথীদের ‘পরিবার’ থেকে তাঁকে ‘চুল কাটবে’ বলে উঠিয়ে আনার জন্য। আসলে বরাবর সে মিষ্টি স্বভাবের সুশীলা, আসলে বড় পরিবারে বড় হওয়া শিষ্টাচার মানা শ্রীমতী সে, আসলে পরিবারের শাসন বিধি না মানা অভব্য সে কোনকালেই নয়, আসলে সোনালী গমের ক্ষেতের মত মসৃণ শৈশব উপহার দেয়া একান্নবর্তী পরিবারে আদরে আহ্লাদেই বড় হয়েছিল সে! কৈশোরে তাকে কেউ কেউ ডাকতো ‘ব্লাক ডায়মন্ড’! তারুণ্যের উচ্ছল সময়ে টগবগে যুবক প্রেমের খেলায় ডাকে ‘কালো ভ্রমর’! যৌবন রঙে রাঙানো ফাগুন সত্যবতীর দরোজায়ও কড়া নাড়ে। ছটফটে প্রজাপতি মনটা স্থিরতায় বসে না, উড়ে উড়ে বেড়ায়। এখনো মনে হলে খুব হাসি পায়- বড়দের হাত দেখা আসরে ছোট্ট হাত মেলে দিয়ে দাঁড়াতো সে- দ্যাখতো! আমার ছেলে মেয়ে কয়জন? একজন হেসে বলে- কয়টি চাই তোমার বালিকা? নিজের পরিবারের সবার মাথা গুনে নির্দ্বিধায় উত্তর দিতো সত্যবতী- এই এত্ত এত্ত!

২।
শীতের কমলালেবু রঙ রোদে নিমের বিশুদ্ধ বাতাস খেলে যাওয়া দক্ষিণের টানা বারান্দায় ভাইয়ের ঘর ঘেঁষে বসে থাকে সত্যবতী। ভাইয়ের সব কাজ নিজ হাতে নিপুণ করে দেয়ার জন্য তাকে আর কেউ ডাকে না কোনদিন। পৃথিবীর এক শক্তিধরের ইশারায় পরিবারের বড় ছেলেটা অকালে সবাইকে শোকে ভাসিয়ে অজানালোকে পাড়ি দেয়। জমজমাট পরিবারটা ভেঙ্গে ঠিক যায় না, তবে যতটুকু থাকে তার প্রতি ভাঁজেই থমকে থাকে অনির্ণীত দুঃখ, কষ্ট, যন্ত্রণা। থাকে শোকের কালো ছোপে ছাওয়া বাবা মায়ের অসহায় মুখ। বিশাল জাহাজের মত পুরনো বাড়িটার রন্ধ্রে রন্ধ্রে বাজে বেহাগের করুণ সুর। বাবার পেটের কাছে শীতের লেপের উষ্ণতায় বসে সত্যবতীর আর গলা সাধা, গান গাওয়া হয় না কোনদিন। ফরাশ তাকিয়া ফেলে বাড়িতে গানের জলশা আয়োজন করা গান পাগল বাবা আর কখনোই কোন গান শুনে না। সত্যবতী ফিরে ফিরে তাকায় মায়ের চোখে, বাবার মুখে, ভাইবোনের চেনা অবয়বে- পরিবারের নিশ্চিত নিরাপত্তার ঝলমলে আলোটা আর কোথাও দেখে না সে। জীবনের পঁচিশটি বসন্ত পার হতে হতে, একাকী নির্জনতায় ভাঙতে ভাঙতে টের পায় সত্যবতী- জন্মাবধি সহজ সরল বালিকা মনটা যেন তার ধরাছোঁয়ার বাইরে এক উড়াল পাখী! এত্ত এত্ত ছেলেমেয়ে নিয়ে স্বপ্নের সংসার তাকে আর টানে না মোটেই। পণ করে সে – মাকে ছেড়ে, তাদের এই পরিবার ছেড়ে কোথাও যাবে না। আগলে রাখবে দুঃখিনী মা। ছেলে হারানো মায়ের ছেলে হবে সে। তাঁর কাজল চোখে প্রেমের মায়াবী আলো খেলা করে না। পুরুষতন্ত্রের যাবতীয় অনিয়ম, অপমানে কারণে অকারণে ক্ষোভ আর প্রতিবাদের বিদ্যুৎ ঝলকায় সেই চোখে। প্রতিনিয়ত বদলে যায় সত্যবতী। কিশোরী থেকে তরুণী এবং সম্পূর্ণ এক নারীতে পৌঁছানোর অমসৃণ ধাপগুলো প্রতিনিয়ত বদলে দেয় তাকে। কন্যা দায়গ্রস্থতার সব দায় থেকে মুক্ত বাবাও ততদিনে চলে গেছে কবরের নিরাপদ আশ্রয়ে। অভিভাবকহীন পরিবারটা অনিচ্ছয়তায় ভাঙে ঝুরঝুর। স্বামী, সন্তানহারা মায়ের কাঁধে সব দায়িত্ব, চোখে উৎকণ্ঠা- এই পরিবারে যে শুধুই মেয়ে! নারী স্বত্বার সবটুকু অহংকারে পণ করে সত্যবতী- বিক্রি হওয়ার দাঁড়িপাল্লায় কখনোই উঠবে না। অলৌকিক কোন আশীর্বাদে তাকে বিক্রি হতে হয় না। একটা নিশ্চিত জীবনের সুবর্ণ অধ্যায় শুরুর চুক্তিতে অন্য নতুন একটা পরিবারে অন্তর্ভুক্তি ঘটে সত্যবতীর।

৪।
বাইরের দরোজা খুলে ভিতর বারান্দায় দাঁড়াতেই হৃদপিণ্ড ধক করে উঠে সত্যবতীর। আসবাবপত্রহীন বাড়িটা খুব ফাঁকা, খুব বড় দেখায়। বারান্দার এক প্রান্তে নিজের ঘরটাকে নিঝুম কোন দ্বীপ মনে হয়। কেউ কোথাও নেই! থুপথাপ টলোমলো হাঁটা ঠোঁট ফুলানো আহ্লাদী শিশুটি বুঝি সত্যবতীর উপস্থিতি টের পায়নি আজ। তার আগমনে দৌড়ে কোলে উঠে অকারণে খুশি হয়নি কেউ। সত্যবতীকে যেন তার একান্তই ‘পাওনা’ কোন শাস্তি দিয়ে কিছু না বলেই এ বাড়ির সবাই চলে গেছে। বিভ্রম জাগে- বুঝি কোন অলীক মোহে অস্তিত্বহীন অস্তিত্বে ‘পরিবার’ নামের এক বজরায় আছড়ে পিছড়ে উঠতে চেয়েছিল সে। সেখানে আজ তাঁর জায়গার বড় অভাব! বিশাল বাড়িটা ঘিরে এক জমাট স্থবির শুন্যতা। চিরদিনের একা সত্যবতী অনন্ত কষ্ট বুকে নিয়ে আবার ‘একা’ হয়। নিজেকে পরিত্যক্ত, অনাবশ্যকীয় মনে হয়। অভিমানে বাঁধভাঙা প্লাবন নামে চোখে। দূর আকাশে সন্ধ্যা তাঁরাটা বেদনার সাক্ষী হয়ে জ্বলে। একসময় শান্ত হয় সত্যবতী। অবিচল এক সিদ্ধান্তে হঠাৎ দৃঢ় দেখায় চিবুক- থামবে না সে! একলার পথটা যে অনেক দীর্ঘ! আরও একবার বদলে যায় সত্যবতী।

৫।
‘ফ্যামিলি-ডে’ (Family day) এর লেসনটা গভীর মনোযোগে তৈরি করে সত্যবতী। জীবনের গল্প থেকে খুঁজে নেয় রসদ, চমৎকার উদাহরণ। ওয়েব সাইট খুঁটে বের করে যথার্থ ভিডিও, ওয়ার্কসীট। ফ্যামিলি ট্রি, জয়েন্ট, নিউক্লিয়ার, সিঙ্গেল প্যারেন্ট ফ্যামিলি- আলোচনায়, ব্যাখ্যায় খুব ধীরে এগোয় সে। সামনে বসা মুখগুলোতে নিবিড় মনোযোগের ছায়া। ধুম করেই প্রশ্ন ছুঁড়ে বয়ঃসন্ধির বালক- সিঙ্গেল প্যারেন্ট কি তাহলে পরিবার? বাবা তো অন্য পরিবারে! আমাদের পরিবারটা কি বাবার পরিবার নয়? এমন প্রশ্ন উঠতে পারে, পারে বইকি! পরিবার জয়েন্ট, নিউক্লিয়ার বা সিঙ্গেল যে ফর্মেই হোক অবশ্যই তা পরিবার-স্পষ্ট উচ্চারণে বলে সত্যবতী। সিঙ্গেল পরিবারে বাবা বা মায়ের কেউ একজন লালন করছে সন্তান, হয়তো বাবা বা মায়ের কেউ একজন কাজের সুত্রে পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন আছে, হয়তো বাবা বা মায়ের মতের ভিন্নতায় একসাথে থাকার বিষয়টা হয়ে উঠছে না। পরিবারের প্রতি ‘ভালোবাসা’ ‘মমতা’ ‘দায়িত্ব’ ‘শেয়ার’, ‘কেয়ার’, আদর্শ, মূল্যবোধ, দৃষ্টিভঙ্গি- প্রতিটা শব্দের ব্যাখা এক গভীর ব্যাঞ্জনায় সত্যবতীর কণ্ঠে উচ্চারিত হয়। দ্যাখো! গোটা বিশ্বই যে আমাদের পরিবার। আমরা প্রত্যেকে এক বিশ্ব পরিবারের সদস্য। “A family doesn’t need to be perfect; it just needs to be united”- উপসংহার টানে সত্যবতী। পাঠ শেষের ‘রিফ্লেক্সন’ এ আনমনা হয় সত্যবতী-অনুর চেয়েও ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র এক ‘পরমাণু’ পরিবারে তার নৌকা বাঁধা। সাজানো, গোছানো নিখুঁত পরিপাটী। ভালোবাসা, মমতা, দায়িত্ব, কর্তব্য, যত্ন, আদর, সোহাগের স্বর্গীয় উত্তাপে মাখামাখি। ‘… the family is a link to our past, a bridge to our future’-বিশ্বাসের এই বোধে সংকল্পবদ্ধ সত্যবতী। জীবনের কোন অপূর্ণতা, অপ্রাপ্তি আর ছোঁয়না তাকে। শিশির পতন নীরবতায় নিঃশব্দে উচ্চারণ করে সে- ‘ভালোবাসি এবং কিছুতেই আরও ভালো না বেসে পারি না’!
আমরা সবাই এক বিশ্ব পরিবারের সদস্য। নিজের পরিবারের জন্য যে মমত্ব ঔদার্য, দায়িত্বশীলতা আমরা দেখাই, বিশ্বজনের প্রতি আমাদের তেমনই দৃষ্টি ভঙ্গি হোক’।