খুরশীদ শাম্মী: ইতিহাস বলে, মহামারী নতুন কিছু নয়; প্রতি একশত বছরে অন্তত একটি মহামারী তো দেখা-ই যায়। পূর্বে মহামারীগুলো বিশ্বের কোনো এক দেশ, মহাদেশ কিংবা গুটিকয়েক দেশ কিংবা মহাদেশে প্রভাব ফেললেও, এবারের করোনাভাইরাস (কোভিড-১৯) কিন্তু ছুঁয়ে দিয়েছে বিশ্ব মানচিত্রের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত পর্যন্ত। শুধু কি ছুঁয়ে দিয়েছে? কটমট করে ঘাড় ভেঙ্গে দিয়েছে বেশ কয়েকটি দেশের একটি পূর্ণাঙ্গ প্রজন্মকে; দাপটের সাথে নিয়ে গেছে লক্ষ-লক্ষ মানবজীবন। পাশাপাশি নিঃস্ব করে দিয়েছে বহু পরিবার, দেশ ও বিশ্বের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা। তবুও কি মানুষ হাল ছেড়েছে? না, মানুষ হাল ছাড়ে না। এক্ষেত্রেও মানুষ হাল ছাড়েনি।

পূর্বের মহামারীগুলোতেও চিকিৎসাবিজ্ঞানীরা প্রতিষেধক ও প্রতিকারক আবিস্কারের চেষ্টা করেছেন এবং সফল হয়েছেন। এবারও এর ব্যাতিক্রম হয়নি তেমন এবং হবেও না। ঠিকই প্রতিরোধক ও প্রতিকারক আবিষ্কার হবে। প্রায় প্রতিটি দেশের চিকিৎসাবিজ্ঞানীরা এ নিয়ে রাত-দিন কাজ করছেন, তাঁদের বিশ্রামের ফুরসত নেই। স্বেচ্ছাসেবকেরা জীবনবাজি রেখে তাঁদের গবেষণায় সহায়তা করছেন। জানা গেছে, বেশ কয়েকটি দেশে প্রথম-দ্বিতীয়-তৃতীয় ধাপে ভ্যাকসিনের পরীক্ষা চলছে। তবে রাশিয়া ইতোমধ্যে “Sputnik V” নামে প্রথম ধাপে তাদের প্রথম ব্যাচের টিকা উৎপাদন করছে, যদিও তাদের ফাইনাল ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল এখনও সম্পন্ন হয়নি। বিষয়টিতে আগে থাকার একটা প্রতিযোগিতা যেমন আছে, তেমন বিশ্ব রাজনীতির ধুমল গন্ধও যুক্ত আছে কিছুটা। ওদিকে চায়না বলছে, ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল পাশ কাটিয়ে জরুরিভাবে তারা প্রায় একমাস আগে থেকেই করোনাভাইরাস ভ্যাকসিন স্বাস্থ্য বিভাগের কর্মজীবীদের ওপর প্রয়োগ করছে।

হ্যাঁ, বিশ্ব রাজনীতি দিনদিন এমনই এক পর্যায়ে পৌঁছেছে যে মাহামারীও বাদ পড়ে না। বিশ্ব রাজনীতি থেকে মহামারী বাদ পড়বেই-বা কীভাবে? বিশ্ব রাজনীতি যে বহুরূপী! কখনো সে আঠালো, সব কিছুই আটকে ধরে; কখনো সে জালের মতো সুবিস্তৃত, গভীর থেকে ছোট-বড়-মাঝারি সকল বিষয়ই সম্মুখে তুলে নিয়ে আসে; আবার কখনো লেলিহান অগ্নিশিখা, স্বার্থের খাতিরে সবকিছু পুড়িয়ে ধ্বংস করে সম্মুখে চলে।

অবশ্য কোভিড-১৯ এর ক্ষেত্রে শুরু থেকেই রাজনীতির গন্ধটা ছিল তীব্র। প্রথমে তো যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রপ্রধান ডোনাল্ড ট্রাম্প কথায় কথায় বলতেন, করোনা ভাইরাস হচ্ছে ডেমোক্রেটিক পার্টির সৃষ্টি। পরবর্তীতে, তিনি এক পর্যায়ে ভাইরাসের নাম দিয়েছিলেন চাইনিজ ভাইরাস। অন্যদিকে, ভাইরাসটির জন্মলগ্ন থেকেই চায়না একটা লুকোচুরি চাদর মুড়িয়ে আছে। হ্যাঁ, দাপ্তরিক হিসাবে কোভিড-১৯ এর বয়স সাত শেষে আট মাস হলেও, কোভিড-১৯ এর প্রকৃত বয়স দশ থেকে এগারো মাস। কোভিড-১৯ এর বয়সের তারতম্যের পেছনে জন্মস্থান চায়নার ভূমিকা আছে কিছু।

ধারণা ছিল, মহামারীর ক্ষেত্রে অনিচ্ছাকৃত ভুল শুরুতে একটু-আধটু হতেই পারে। তবে, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বিষয়টি সূ²ভাবে পর্যবেক্ষণ করে যত দ্রুত সম্ভব জন্মক্ষণ, জন্মস্থান, উৎস ও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের অনিচ্ছাকৃত ভুলগুলোর সংশোধনী প্রকাশ করবে। দেরী করে হলেও জনস্বাস্থ্য নিরাপত্তার লক্ষ্যে কোথাও কোথাও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাকে সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করতে দেখা গেলেও বাস্তবে শতভাগ সংশোধন করা হয়নি, বরং কোনো কোনো ক্ষেত্রে তাদের নিরপেক্ষতার অভাব পরিলক্ষিত হয়েছে।

যতই দিন যাচ্ছে কেন যেন বারবার মনে হচ্ছে, বিশ্বের শক্তিশালী রাষ্ট্রগুলোর রাষ্ট্রপ্রধানেরা কোভিড-১৯ কে বৃত্তাকার বল বানিয়ে নেড়েচেড়ে দেখছেন এবং পরস্পর পরস্পরকে দেখাচ্ছেন। আবার কখনো কখনো উপরের দিক ছুড়ে মারছেন, ধরছেন এবং গোলপোস্টের দিক তাক করে নীতিহীন প্রতিযোগীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করছেন। এই যেমন ভ্যাকসিন রাজনীতি, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাকে অর্থায়ন, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার বিকল্প পরিকল্পনা, ইত্যাদি।
বিশ্ব রাজনীতির রাজপথ মাড়িয়ে আলোচনা নিয়ে যাওয়া যায় তো বহুদূর! তবুও ফিরে আসি মহামারী কোভিড-১৯ কালীন আমাদের সাধারণ জনগণের জীবনে। সাধারণত বিশ্বের প্রতিটি দেশের সাধারণ জনগণের চাওয়া-পাওয়ার যোগ-বিয়োগ-গুণ-ভাগ শেষে ফলাফল প্রায় একই- হয়, শূন্য – নতুবা, যোগবিয়োগ এক অথবা দুই। সাধারণ জনগণের সরল জীবন অংকের ফলাফল মহামারীতেও ভিন্ন কিছু নয়। এবারের মহামারীতে ওয়াল্ডো মিটারের হিসেব অনুযায়ী আজ পর্যন্ত মোট আক্রান্তের সংখ্যা ২ কোটি, আটত্রিশ লক্ষ, আটান্ন হাজার, একশত ছয় জন (২,৩৪,৫৮,১০৬) এবং মোট মৃত্যু সংখ্যা আট লক্ষ, নয় হাজার, নয় শত, নয় জন (৮,০৯,৯০৯)। যদিও এই নাম্বারগুলো সম্পূর্ণ সঠিক নয় বলে আমাদের অনেকেরই ধারণা; তবুও এই নাম্বারগুলোতে মিলেমিশে আছি আমি, তুমি, সে, আপনি, তিনি, আমরা সকলেই। হ্যাঁ, করোনাভাইরাসে আমরা অনেকেই হারিয়েছি আপনজন, কেউ কেউ আক্রান্ত হয়ে আবার সুস্থ হয়ে উঠেছি, অথবা খুব কাছের কেউ ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ায় ব্যথিত থেকেছি দীর্ঘ সময়। কেউ কেউ এখনও আক্রান্ত অবস্থায় আছেন এবং আক্রান্ত হচ্ছেন। তবুও জীবনের তাগিদে কর্মজীবীদের অধিকাংশকেই কাজ করতে হচ্ছে, হোক তা- ঘরে বসে কিংবা কর্মস্থানে সশরীরে পৌঁছে। তবে, দীর্ঘদিন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও তুলনামূলকভাবে কম-প্রয়োজনীয় ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ ও সামাজিক কার্যকলাপ নিষিদ্ধ ও সীমিত থাকা প্রকৃতির জন্য ছিল কিছুটা মঙ্গলজনক ও আরামদায়ক। শান্ত ছিল আকাশপথ, পানিপথ ও কাঁচা-পাকা মেঠোপথগুলো। রাসায়নিক বর্জ্য পদার্থ ও কালো ধোঁয়া ছিল অনেক কম। আমাদের শাঁই-শাঁই অহেতুক ব্যস্ত জীবনে খানিক ভাটা পড়ায় পরিবার ও প্রকৃতির আসল সোঁদা গন্ধটা হৃদয় স্পর্শ করেছিল যেন। আমাদের অনেকেই প্রকৃত সরল জীবন বিষয়টা উপলব্ধি করার সুযোগ পেয়েছিলাম এই প্রথম। কিন্তু পুঁজিবাদের চাপে মৌলিক চাহিদার বাইরেও তো কম চাহিদা গড়ে ওঠেনি আমাদের। তাই বাধ্য হয়ে ভ্যাকসিন আবিস্কারের পূর্বেই ধীরে ধীরে বিশ্ব ফিরে চলেছে পুঁজিবাদী স্বাভাবিক গতিতে। নানানভাবে জনগণকে অনুপ্রাণিত করা হচ্ছে চলমান জীবনে ফিরে যেতে। এবাদতের জন্য ধার্মীকেরা জড়ো হচ্ছেন উপাসনালয়ে, পিতামাতা সন্তানকে চাইন্ড কেয়ারে রেখে কাজে ফিরে যাচ্ছেন, বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন শহরের বিদ্যালয়গুলো খুলে দেয়ার প্রস্তুতি মাঝপথে, কোলাহল প্রিয় মানুষ আমরা পার্টি করছি মধ্যরাত পর্যন্ত, বন্ধু ও আত্মীয়দের সাথে মিলিত হচ্ছি নানান অজুহাতে। এর সাথে সাথে খুলে যাচ্ছে কিন্তু সকল অন্যায়, অবিচারও। প্রায় তিন-চার মাস বিরতির পর গ্রেটার টরন্টোতে এখন প্রায় প্রতিদিনই গোলাগুলিতে এক বা একাধিক মানুষের মৃত্যু হয়। রাস্তাঘাট ফাঁকা থাকলেও অসাবধান, নেশাগ্রস্ত চালকেরা গাড়িচাপা দিয়ে মেরে যায় পথচারীদের কিংবা বড় বড় দুর্ঘটনার কারণ হয়। দুর্বৃত্তরাও প্রকাশ্যে ফিরেছে তাদের উদ্দেশ্যমূলক বিভাজন সূচক কর্মকাণ্ডে। গত তিনমাসে একাধিক বার টরন্টোর প্রাণকেন্দ্রে ডাউনটাউনের মসজিদে জানালা ভেঙেছে ও বর্ণবাদী শব্দ লিখে রেখেছে দুর্বৃত্তরা। টরন্টোর মতো সারা বিশ্বের দুষ্কৃতিকারীরাও ফিরছে তাদের অকল্যাণকর ধ্বংসাত্মক কাজে। এই তো, এই আগস্টের চার তারিখে-ই-তো লেবাননের বৈরুতে বিস্ফোরণে দুই শতাধিক মানুষের মৃত হয়েছে।

এ-তো যৎসামান্য উদাহরণ মাত্র। তবে দীর্ঘদিন যাবত এই সকল বিষয়গুলোই আমাদের সরল জীবনকে যৌগিক করে তুলেছে। আমরা নিজেকে ও নিজ পরিবারকে সুরক্ষা করতে ব্যর্থ হচ্ছি, হোক তা দৈনন্দিন জীবন কিংবা মহামারী প্রতিরোধ। আর সর্বদা এর নেপথ্যে থাকে ময়লা রাজনীতি, নীতিহীন স্বার্থপর নেতৃত্ব ও মানুষের অন্ধত্ব। এই রাজনীতি এমনভাবে মিশে গেছে আমাদের জীবনে যে ইচ্ছে করলেই এর থেকে বের হওয়া সম্ভব নয়, যেমনটি সম্ভব হয়নি কোভিড-১৯ মহামারী কালেও।
খুরশীদ শাম্মী, টরন্টো, অন্টারিও, কানাডা