Home কলাম মমতাময়ী মা সুখ প্রভা সিকদার (‘মা দিবস’ উপলক্ষে স্মৃতিচারণ)

মমতাময়ী মা সুখ প্রভা সিকদার (‘মা দিবস’ উপলক্ষে স্মৃতিচারণ)

স্বপন কুমার সিকদার : মা নিয়ে দুইজন প্রখ্যাত গীতিকারের দুইটি কালজয়ী গানের কলি –
“এই দুনিয়ায় নয়ন মেলে, মাগো তোমায় দেখেছি
তোমার বুকে হেসে খেলে, তোমার কথাই শিখেছি”। – খান আতাউর রহমান

“তার মায়ায় ভরা সজল দিঠি, সেকি কভু হারায়,
সে যে জড়িয়ে আছে ছড়িয়ে আছে, সন্ধ্যা রাতের তারায়,
সেই যে আমার মা, বিশ্ব ভুবন মাঝে তাহার নেইকো তুলনা”। – প্রণব রায়

আমাদের মমভাময়ী মা সুখ প্রভা সিকদার ২০১৮ সনের ৮ই নভেম্বর বিকাল ২-৩০ ঘঃ শুভ দিনে ও শুভক্ষনে এই পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে পরপারে চলে যান। ঐ দিন ছিল পবিত্র বৃহস্পতিবার ও শুক্ল পক্ষের প্রতিপদ তিথি। মৃত্যু কালে উনার বয়স হয়েছিল ৯৫ বৎসর। উনার উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস বা অন্য কোন ক্রণিক অসুখ ছিল না। তিনি ছিলেন বেশ সাদাসিদে, খুবই ধার্মিক মনের এবং সপ্তাহে দুই দিন (বৃহস্পতি ও রবি) উপোস করতেন। উনার চিন্তা-চেতনায় সবসময় ছিল স্রষ্টার প্রতি ঐকান্তিক বা অকৃত্রিম ভক্তি। উনি মনেপ্রাণে যা চাইতেন বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাষায় বলতে গেলে বলতে হয় –
“ধায় যেন মোর সকল ভালোবাসা
প্রভু, তোমার পানে, তোমার পানে, তোমার পানে”।

উনার অনেক গুণের মধ্যে বিশেষ গুণ বা বৈশিষ্ট্য যেটা লক্ষ্য করেছি তা হলো উনি কখনও অর্ঘ্যের উপকরণ ছাড়া নিজের জন্যে কোন কিছুর প্রয়োজন বলেন নাই। উনি ছিলেন সর্বাবস্থায় সুখী মানুষ। বলা যায় –
“ঘুরে এলাম কত দেখে এলাম, অশান্ত মনে আমি ছুটে গেলাম!”
আমার মায়ের মতো কভু দেখিনি
সে যে আমার প্রিয় জননী, সে যে আমার সুখী জননী।- (গাজী মাজহারুল আনোয়ারের কালজয়ী গান অনুসরণে)।
উনি যেন মনে করতেন-
“এই জ্যোতিঃসমুদ্র-মাঝে, যে শতদল পদ্ম রাজে
তারি মধু পান করেছি, ধন্য আমি তাই ” – রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। অতএব, উনার যেন আর কিছুর প্রয়োজন নেই।

উনার একটাই চাওয়া ছিল – তা হলো সবার কল্যাণ। আমাদের সমাজে সবার কাছে উনি ছিলেন গ্রহণযোগ্যা ও সম্মানিতা। উনার মুখ দেখলে হৃদয় কন্দরে ভিড় করতো সেই মূল্যবান কথাগুলো- “জননী ও জন্মভূমি স্বর্গ হতে শ্রেষ্ট” বা “মায়ের পদতলে সন্তানের বেহেশৎ”।
চক্ষু ছলছল করতো যখন ভাবতাম-
“তুমি যেদিন থাকবে না মা, সেদিন আমার হবে কি
সুখে থাকি দুঃখে থাকি, কাহার আসবে যাবে কি”। – খান আতাউর রহমান

নিজেকে হারিয়ে ফেলি যখন “মায়ের মত আপন কেহ নাইরে, মায়ের মত আপন কেহ নাই” কথাগুলো মনের গহীনে নীরবে বাজতে থাকে।
মানুষ ভালোবেসে উনাকে বলতেন, “সন্দেহ নেই যে আপনি স্বর্গে যাবেন”। একবার পিতৃব্য স্থানীয় এক পড়শী বলেছিলেন, “তোমার মা অতি ভাগ্যবতী”। উত্তরে আমি বলেছিলাম, “আমি মনে করি, আমি ভাগ্যবান। কারণ আমি নিরভিমানিনী, নির্লোভ, ধৈর্য্যশীলা অর্থাৎ একজন মহিয়সী মা পেয়েছিলাম”।
পৃথিবীর অমোঘ নিয়মে বা মহাডাকে সাড়া দিয়ে মা চলে গেছেন।

কাব্য কথায় –
“জীবনেরে কে রাখিতে পারে।
আকাশের প্রতি-তারা ডাকিছে তাহারে।
তার নিমন্ত্রন লোকে লোকে
নব নব পূর্বাচলে আলোকে আলোকে”। – রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

উনি যখন আমাদের ছেড়ে পরপারে চলে যান তখন ছিল হেমন্ত কাল। তাপমাত্রা ছিল নাতিশীতোঞ্চ। মাঠে ছিল সোনালী ধানের ঢেউ-নাচন। গাছপালায় সবুজের সমারোহ। বাতাসে ছিল পাকা সোনালী ধানের মিষ্টি গন্ধ। ‘দেশ মাতার মুক্তিকামী’ কৃষক তখন তাদের প্রিয় ফসল – ধান ঘরে তোলা, মহান নবান্ন উৎসব উদযাপন, খেজুরের রসে রসনা তৃপ্ত করা কিম্বা পিঠা খাওয়ার মহোৎসবের জন্যে মানসিক প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। সব দিকে যেন মহা আনন্দের বন্যা – পরিপূর্ণতার ছাপ। আমাদের ধর্মীয় পন্ডিতগণের মতে কেবলমাত্র মহাত্মারা এবং অতি পূণ্যবান ব্যক্তি এই সুন্দর সময়ে এবং এত সুন্দরভাবে এই পৃথিবী থেকে বিদায় নেন। উনি বলতেন, “এই পৃথিবীতে চিরদিন কেউ থাকে না। আমাকেও যেতে হবে”। মনে করতেন আত্মার বিনাশ নাই। অনেকটা এই ধরনের –
“কে বলে গো সেই প্রভাতে নেই আমি।
সকল খেলায় করবে খেলা এই আমি”- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

আমি প্রায় প্রত্যেক দিন উনার স্বাস্থ্যের খোঁজ খবর নিতাম। হঠাৎ কানাডায় রাতে ফোন পেলাম উনি নেই। সাথে সাথে ওয়ান ওয়ে, ওয়ান ষ্টপ বিশেষ টিকেট জরুরিভাবে ক্রয় করে উনার সৎকার অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকার জন্যে পরের দিন রওনা দিই। বড় ছেলে হিসাবে সৎকার অনুষ্ঠানে আমার কর্তব্য বেশি। আত্মীয়স্বজন ও শুভানুধ্যায়ীগণকে টেলিফোনে ও এলাকায় মাইক যোগে প্রচারের মাধ্যমে সকলকে উনার মহাপ্রয়াণের বিষয়টি অবগত করানো হয়। সকল স্তরের লোকের উপস্থিতিতে উনার সৎকার অনুষ্ঠান হয় বাবার সমাধি মন্দিরের পাশে পারিবারিক শ্মশানে আমাদের নিজ গ্রামে। উনার মহাপ্রস্থানের পর উনার শ্রাদ্ধানুষ্ঠানে তথা শ্রদ্ধা জানানো ও শুভ কামনায় অনুষ্ঠানে সহৃদয় হয়ে বীর মুক্তিযোদ্ধা আলহাজ্ব মোঃ নজরুল ইসলাম চোধূরী, সম্মানিত সংসদ সদস্য, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দ, বিএডিসির প্রাক্তন কয়েকজন কর্মকর্তা ও সকল স্তরের লোক উপস্থিত ছিলেন। শ্রাদ্ধানুষ্ঠানের সময় আলাদাভাবে শ্রাদ্ধস্থান থেকে অনতিদুরে বিশিষ্ট ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব দিয়ে পরিচালনার মাধ্যমে গীতা পাঠের আসর অনুষ্ঠিত হয় ও মার তীর্থ ভ্রমণসহ মার জীবনের বিবিধ গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাবলীর উপর জীবন আলেখ্য (ভিডিও চিত্র) প্রদর্শন করা হয়। পরবর্তীতে চট্টগ্রাম জেলা পরিষদ মিলনায়তনে শিক্ষাবিদ, রাজনীতিবদ ও ধর্মীয় ব্যক্তিত্বসহ সকল স্তরের নাগরিকবৃন্দের উপস্থিতিতে নাগরিক শোক সভা অনুষ্ঠিত হয়। সকল মায়ের জয় হউক। ধন্যবাদ

Exit mobile version