মণিজিঞ্জির সান্যাল: আমরা আমাদের শরীরকে সাজাই। ভাল পোষাক পরি, ত্বকের অর্থাত বাইরের চামড়ার যত্নে ভরে তুলি প্রতিমুহূর্ত। কেউ কেউ এসব করেন নিজের ভাল লাগে বলে, অনেকে আবার করেন শুধুমাত্র অন্যের কাছে নিজেকে আকর্ষণীয় করে তুলবে বলে। অর্থাত এসব আমরা যা কিছুই করি, সবটাই কিন্তু বাইরের রূপকে ঝলমলে করে তোলার অভিপ্রায়ে।

কিন্তু আমাদের এই মন? তাকে আমরা যত্ন করি কি? তাকে ভালোবাসি কি? কাকে বলে মন?
মন আসলে বুদ্ধি এবং বিবেকবোধের এক সমষ্টিগত রূপ যা চিন্তা, অনুভূতি, আবেগ, ইচ্ছা এবং কল্পনার মাধ্যমে প্রকাশিত হয়। মন কি এবং কিভাবে কাজ করে সে সম্পর্কে অনেক রকম তত্ত¡ প্রচলিত আছে। এসব তত্ত¡ নিয়ে চিন্তা-ভাবনা শুরু হয়েছে মূলতঃ প্লেটো, অ্যারিস্টটল এবং অন্যান্য প্রাচীন গ্রীক দার্শনিকদের সময়কাল থেকে।

জড়বাদী দার্শনিকগণ মনে করেন যে, মানুষের মনের প্রবৃত্তির কোন কিছুই শরীর থেকে ভিন্ন নয়। বরং মানুষের মস্তিষ্ক থেকে উদ্ভূত শারীরবৃত্তিক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে মন গড়ে উঠে। মন এর সঠিক সংজ্ঞা সম্ভব নয়। তবে এই ভাবে বলা যেতে পারে, মন হলো এমন কিছু যা নিজের অবস্থা এবং ক্রিয়াগুলি সম্পর্কে সচেতন। মনের স্বরূপ লক্ষণ হলো চেতনা যার থেকে মনকে জড়ো থেকে আলাদা করা হয়।

আর শরীর? সেতো মনের খুব কাছেরই বন্ধু। একে অপরকে ছাড়া একেবারেই অচল। তাই সহজেই বলা যায় মন এবং শরীর পরস্পর পরস্পরের বন্ধু। মন ভালো থাকলে শরীরও ভালো থাকবে। আবার ঠিক উল্টোটা। শরীর ভাল না থাকলে মনটাও খারাপ থাকবে।
তাই কেউ যদি মনে করেন শরীরের ঠিকঠাক যত্ন নিলেই হল, মনটা যেমন কিছু একটা থাক। তাহলে সে যেমন ভুল করছেন, পাশাপাশি কোনো ব্যক্তি যদি ভাবেন মন খুব ভাল আছে, শরীরের যত্ন নিয়ে আর লাভ কি? তাহলে তার ভাবনাও কিন্তু একই রকম ভুল।
অনেকেই আছেন যাঁরা নিজেদের আর পরিবারের সদস্যদের স্বাস্থ্য নিয়ে সচেতন। দৈনন্দিন পরিচ্ছন্নতা, অসুখ-বিসুখ নিয়ে তাঁরা ভাবেন। সময়মতো ব্যবস্থা নেন। কিন্তু বেশির ভাগ সময় তাঁরা ভুলে যান যে স্বাস্থ্য মানে কেবল শরীর নয়, মনও স্বাস্থ্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এই ভুলের কারণে মনের যত্ন নিতে তাঁরা ব্যর্থ হন, মনের সমস্যাগুলো সহজে চিহ্নিত করতে পারেন না। আবার সামাজিক সংস্কারের কারণে মানতে চান না যে মনের রোগ হয়েছে। বিষয়টি লুকিয়ে রেখে সমস্যাটিকে আরও জটিল করে তোলেন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থায় শরীরের পাশাপাশি মনকেও গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। মানসিক স্বাস্থ্য অর্থ কিন্তু কেবল মানসিক রোগ নয়। শরীরে কোনো রোগ না থাকলেও শারীরিক সুস্থতার জন্য যেমন প্রতিদিন দাঁত ব্রাশ করতে হয়, স্নান করতে হয়, সুষম খাদ্য গ্রহণ করতে হয়, ব্যায়াম করতে হয়, অস্বাস্থ্যকর খাদ্য আর অভ্যাস থেকে দূরে থাকতে হয়। তেমনি মনের সুস্থতার জন্য নিয়মিত মনের যত্ন নিতে হয়, মনকে তার ‘খাদ্য’ দিতে হয়, মনের ‘ব্যায়াম’ করতে হয় আর মনের জন্য ক্ষতিকর অভ্যাস থেকে দূরে থাকতে হয়। নয়তো মন ভালো থাকবে না আর মন ভালো না থাকলে সার্বিকভাবে সুস্থ থাকা সম্ভব হবে না। মন আর শরীর পরস্পরের সঙ্গে গভীরভাবে সম্পর্কিত, তাই মনের সমস্যা হলে শরীরের ওপর এর প্রভাব পড়ে আবার শরীর খারাপ হলে মনও খারাপ হয়।

অনেক সময় ‘মানসিক স্বাস্থ্য’ আর ‘মানসিক রোগ’ বিষয় দুটোকে অনেকে এক করে ফেলেন। মানসিক রোগ বা মানসিক সমস্যা হচ্ছে মনের কোনো অস্বাভাবিক অবস্থা, যার জন্য উপযুক্ত চিকিত্সা নিতে হয়। কখনো ওষুধ নিয়ে চিকিত্সা করতে হয় আবার কখনো ‘সাইকোথেরাপি’ গ্রহণ করতে হয়। কিন্তু মানসিক স্বাস্থ্যের বিষয়টি সর্বজনীন। যার কোনো মানসিক সমস্যা বা মানসিক রোগ নেই, তাকেও তার মানসিক স্বাস্থ্যের পরিচর্যা করতে হয়, মনের যত্ন নিতে হয়, যাতে সে মানসিক রোগ বা সমস্যা থেকে মুক্ত থাকতে পারে। সার্বিক সুস্বাস্থ্যের জন্য পরিবারের সবারই মনের যত্ন নিতে হবে। মনের যত্নের জন্য আমাদের প্রতিনিয়ত যা করতে হবে, যেমন–

দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন–
সবার আগে এই বোধটি তৈরি হতে হবে যে ‘মন’ স্বাস্থ্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। শরীরের পাশাপাশি মনের যত্বও নিতে হবে।

নিয়মমতো ঘুম–
প্রতিদিন নিয়ম করে ঘুমাতে হবে। কারও ঘুম বেশি আবার কারও কম, সেটা সমস্যা নয়। জরুরি হচ্ছে রাতের বেলা ঘুমাতে হবে আর দিনে কাজ করতে হবে। যদি এর উল্টোটা হয়ে যায়, তবে মস্তিষ্কের ‘বায়োলজিক্যাল ক্লক’ এলোমেলো হয়ে যায় আর মনের পরিবর্তন ঘটে, মানসিক সমস্যা দেখা দেয়। কোনো যুক্তি দিয়েই ‘রাতে জাগা’ আর ‘দিনে ঘুমানো’কে সমর্থন করা যাবে না, তাই ঘুমের জন্য বেছে নিতে হবে রাতকেই।

পারিবারিক সুসম্পর্ক–
সামাজিক দক্ষতা মনের স্বাস্থ্যের গুরুত্বপূর্ণ সূচক। সামাজিক দক্ষতা বাড়াতে সবার আগে পরিবারের সদস্যদের মধ্যে পারিবারিক বন্ধন দৃঢ় রাখতে হবে। অন্তত একবেলা সবাই একসঙ্গে খাওয়া, সপ্তাহে নিয়ম করে একসঙ্গে আড্ডা দেওয়া, বেড়াতে যাওয়া পারিবারিক বন্ধনকে দৃঢ় করতে পারে। পারিবারিক আড্ডায় ইতিবাচক অর্থাত পজিটিভ আলোচনা বাড়াতে হবে, অপরের সমালোচনা কখনোই নয়।

সামাজিক দক্ষতা–
সমাজের সঙ্গে মানিয়ে চলতে পারা, সামাজিকতা বাড়ানো,এগুলো সবই সামাজিক দক্ষতার অংশ। সামাজিকভাবে দক্ষ হলে মনের ওপর চাপ কম পড়ে, মন সুস্থ থাকে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বেশি সময় ব্যয় না করে বাস্তব সামাজিক অনুষ্ঠানগুলোতে সক্রিয় অংশ নেওয়া প্রয়োজন।

হালকা ব্যায়াম–
প্রতিদিন হালকা ব্যায়াম মাংসপেশির শিথিলতা বা দৃঢ়তাকে নিশ্চিত করে। মনের স্বাস্থ্যের জন্য এই ‘রিলাক্সেশন’ খুব উপকারী; যা নিয়ম মেনে হালকা ব্যায়ামের মাধ্যমে করা যায়।

বই পড়ার অভ্যাস ও বিনোদন–
পড়ার বই বা অফিসের দরকারি ফাইলের বাইরে প্রতিদিন কিছু না কিছু পড়তে হবে। বাড়িতে একটি ছোট পারিবারিক পাঠাগার এই পড়ার অভ্যাস তৈরিতে সাহায্য করতে পারে। এর পাশাপাশি নিজস্ব সংস্কৃতির চর্চা, সংগীত, ছবি আঁকা, নাচ করা মনের অন্যতম খোরাক। তাতে মনের পরিচর্যা আরও সুসংহত হবে। হাস্যরসের চর্চা করা, হাসিখুশি থাকা ইত্যাদি মনের যত্নের জন্য গুরুত্বপূর্ণ।

সঠিক খাদ্যাভ্যাস—
সুষম খাদ্য আর প্রচুর জল পান করতে হবে। সময়মতো খেতে হবে। অনিয়ম করে খাওয়া শরীরে মানসিক চাপ সৃষ্টিকারী হরমোনের নিঃসরণ বাড়াবে, যা মনের স্বাস্থ্যর জন্য ক্ষতিকর। ধীরে ধীরে সময় নিয়ে চিবিয়ে খেতে হবে।

মনের জন্য ক্ষতিকর বিষয় আর অভ্যাস পরিত্যাগ–
পারিবারিক দ্ব›দ্ব-কলহ, মাদকের নেশা, অহেতুক হিংসা-কুটিলতা, অন্যায্য শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে নিজের মতো প্রতিষ্ঠার চেষ্টা, পেশাজীবনে অনৈতিকতার চর্চা ইত্যাদি নিজের ও পরিবারের অন্য সদস্যদের মনের ওপর বাড়তি চাপ তৈরি করে, যা মনের পরিচর্যার অন্তরায়। এ বিষয়গুলোকে অবশ্যই পরিহার করতে হবে।

মানসিক সমস্যার চিকিত্সা গ্রহণ–
মানসিক সমস্যা যে কারও যেকোনো সময় হতে পারে। বিষয়টিকে এড়িয়ে না গিয়ে, লুকিয়ে না রেখে সঠিক বিজ্ঞানসম্মত চিকিত্সা গ্রহণ করতে হবে। এ জন্য মানসিক সমস্যার সাধারণ লক্ষণ যেমন, ঘুমের সমস্যা, আচরণের পরিবর্তন, কথাবার্তার পরিবর্তন, আবেগের পরিবর্তন, অহেতুক মন খারাপ, অতি উত্কণ্ঠা, অতি উত্তেজনা, ভাঙচুর, ভ্রান্ত বিশ্বাস, সমস্যাকে অস্বীকার করা, সম্পর্কের জটিলতা, শিশুর অবাধ্যতা বা অতিচঞ্চলতা, রাগ নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থতা ইত্যাদি দেখা দিলে অযথা দেরি না করে মনোরোগ বিশেষজ্ঞের পরামর্শ গ্রহণ করতে হবে। প্রয়োজনে চিকিত্সকের পরামর্শে ওষুধ খাওয়ার পাশাপাশি ‘সাইকোথেরাপি’ বা ‘কাউন্সেলিং’ গ্রহণ করতে হবে।

মানসিক সমস্যায় ওষুধের ভূমিকাকে ইতিবাচকভাবে গ্রহণ করা উচিত–
অনেক সময় ভ্রান্ত ধারণা আর বিভ্রান্তমূলক অপপ্রচারের কারণে মানসিক রোগের চিকিত্সায় ওষুধ গ্রহণে নিরুত্সাহিত হয়ে যেতে পারেন কেউ কেউ। এ বিষয়ে সঠিক জ্ঞান নেই এমন ব্যক্তির পরামর্শে ওষুধ বন্ধ করে দিয়ে সমস্যাটিকে জটিল করে তুলতেও দেখা যায়। এটা মনে রাখতে হবে, শরীরের সুস্থতার পাশাপাশি মনের সুস্থতাও কিন্তু ভীষণরকম প্রয়োজন। তাই মন এবং শরীর দূটোকেই সমানভাবে যত্ন নিতে হবে এবং ভালোবাসতে হবে।
মণিজিঞ্জির সান্যাল : কথা সাহিত্যিক
শিলিগুড়ি, দার্জিলিং, পশ্চিমবঙ্গ, ভারতবর্ষ