Home কলাম মন্ট্রিয়ল হত্যাকাণ্ড এবং সাদা ফিতা দিবস

মন্ট্রিয়ল হত্যাকাণ্ড এবং সাদা ফিতা দিবস

ফরিদ আহমেদ: ডিসেম্বর ৬, ১৯৮৯
মন্ট্রিয়ল, ক্যানাডা।
হিম হিম শীতের এক সময়।

বিকেল চারটার পরে ইকোল পলিটেকনিকে পোঁছালো মার্ক লেপিন। পঁচিশ বছর বয়সী এক যুবক সে। লেপিনের হাতে একটা প্লাস্টিকের ব্যাগ। ইকোল পলিটেকনিক, ইউনিভার্সিটি অব মন্ট্রিয়লের ইঞ্জিনিয়ারিং স্কুলের অধীন। দোতলায় রেজিস্ট্রারের অফিসে নিঃশব্দে বসে থাকে সে। অফিসের একজন কর্মচারী তাকে জিজ্ঞেস করে, তার কোনো সাহায্য লাগবে কিনা? এর কোনো উত্তর না দিয়ে অফিস থেকে বেরিয়ে যায় লেপিন। বিল্ডিং এর অন্য প্রান্তের দিকে চলে যায় সে ধীর পায়ে। ওই পাশে মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং এর একটা ক্লাস হবার কথা ছিলো। সেই ক্লাস রুমের মধ্যে ঢুকে পড়ে মার্ক লেপিন।

কেউই জানতো না, কী ভয়ংকর ঘটনা ঘটতে যাচ্ছে একটু পরেই। প্রায় ষাট জনের মতো ছাত্র-ছাত্রী ছিলো ক্লাসে। এদের উদ্দেশ্যে একটা সংক্ষিপ্ত ভাষণ দেয় সে। সেই ভাষণ ছিলো নারীবাদীদের বিপক্ষে। ছাত্র-ছাত্রীদের কেউ কেউ আধো কৌতূহলে তার কথা শোনে। কেউ তাকে উপেক্ষা করে যায়। এই পর্যায়ে গিয়ে মার্ক লেপিন সবাইকে সব কাজ বন্ধ করার নির্দেশ দেয়। ছেলেদের এবং মেয়েদের আলাদা হয়ে রুমের দুইপাশে দাঁড়াতে বলে সে। পাগলের প্রলাপ ভেবে কেউ গা করেনি তখনো।

হাতে রাখা প্লাস্টিকের ব্যাগ থেকে ছোট আকারের একটা রাইফেল এবং হান্টিং নাইফ বের করে মার্ক লেপিন। সে যে মশকরা করছে না সেটা বোঝানোর জন্য ছাদের দিকে প্রথম গুলি ছোড়ে সে। দুই সপ্তাহ আগে এক দোকান থেকে শিকারে যাবে এই ব্যাখ্যা শুনিয়ে রাইফেলটা আর ছুরিটা কিনেছিলো সে। তাকে রাইফেল বের করে গুলি করতে দেখে ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে ছাত্র-ছাত্রীরা। নিমেষের মধ্যে হাসি খুশি একটা ক্লাসরুম ভরে যায় ভয়ার্ত আর্তনাদে।
ষাট জনের মধ্যে মেয়ে ছিলো মাত্র নয়জন। লেপিন এদের আলাদা করে ফেলে।
“কী কারণে আমি এখানে এসেছি, জানো তোমরা?”
“না।” ভয়ার্ত গলায় একজন বলে।
“আমি নারীবাদের বিরুদ্ধে লড়াই করছি।”

“দেখো, আমরা মেয়ে। ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ছি। কিন্তু, এর মানে এই না আমরা নারীবাদী। রাস্তায় গিয়ে মিছিল করে পুরুষদের বিরুদ্ধে শ্লোগান ধরবো।” নাটালি নামের একটা মেয়ে বলে।
“তোমরা সবাই নারী। একদিন তোমরা ইঞ্জিনিয়ার হবা। কিন্তু, তোমরা সবাই নারীবাদী। আমি নারীবাদীদের ঘৃণা করি।” এই কথা বলে প্রবল ঘৃণায় মার্ক লেপিন নির্বিচারে গুলি ছুড়তে থাকে মেয়েদের উদ্দেশ্যে। নয়জন মেয়ের মধ্যে ছয়জনই সাথে সাথে মারা যায়। বাকি তিনজন গুরুতরভাবে আহত হয়। এদের মধ্যে নাটালি একজন।

মার্ক লেপিনের নৃশংসতা তখনও শেষ হয়নি। এই রুম থেকে বের হয়ে আরেক রুমে যায় সে। সেখানেও আরেকজন ছাত্রীকে গুলি করে হত্যা করে সে। রুম থেকে রুমে গিয়ে গিয়ে মেয়েদের খুন করার মিশন চলতে থাকে লেপিনের। বিভিন্ন রুমের ভিতর দরজা আটকে দিয়ে লুকিয়ে ছিলো অনেক মানুষ। সেই সব রুমের ভিতরে লুকিয়ে থাকা মেয়েরাও রক্ষা পায়নি। দরজায় লাগানো কাঁচের ভিতর দিয়ে গুলি করেও সে হত্যা করতে থাকে বেছে বেছে মেয়েদের। চৌদ্দ জন মেয়েকে খুন করার পরে নিজের মাথায় গুলি করে আত্মহত্যা করে লেপিন।

এই হত্যাকাণ্ড মন্ট্রিয়ল ম্যাসাকার নামে পরিচিত। এটা কুইবেকসহ সমস্ত ক্যানাডাতে আতংক ছড়িয়ে দেয়। নানা ধরনের তর্ক-বিতর্ক এবং বিশ্লেষণ তৈরি হয় এই হত্যাকাণ্ডকে ঘিরে। হত্যাকাণ্ডের পিছনের কারণকে উদঘাটনের চেষ্টা করা হয়। কারো কারো মতে মার্ক লেপিনের ঘটনাটা একটা বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছিলো। এর কোনো সামাজিক গুরুত্ব নেই। মার্ক লেপিন কোনো কারণে উন্মাদ হয়ে এই হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে। অন্যদের কাছে, এটা ছিলো সমাজে নারীর অবস্থানের সাথে সম্পর্কিত। সমাজে নারীর সমতা ভিত্তিক অবস্থানকে সহ্য করতে না পারার ফলশ্রুতিতেই মার্ক লেপিন এই হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছিলো। এখানে তার মস্তিষ্ক বিকৃতি প্রধান না, বরং পুরুষেরা কোনো চোখে নারীদের দেখে, নারী-বিদ্বেষের শিকড় কতোটা গভীরে প্রথিত, সেটারই একটা রক্তাক্ত প্রতিফলন ছিলো এটা।

লেপিনের জ্যাকেটের ভিতর পকেটে একটা সুইসাইড নোট ছিলো। এই চিঠিটা পুলিশ কখনোই প্রকাশ করেনি। কিন্তু নানাভাবে এর বিষয়বস্তু বের হয়ে এসেছে পত্রিকায়। এই চিঠিতে কুইবেকের উনিশ জন নারীবাদী নারীর তালিকা ছিলো। এদেরকে হত্যা করার বাসনা ব্যক্ত করেছিলো লেপিন তার সুইসাইড নোটে।

এই সুইসাইড নোট এবং লেপিনের বেছে বেছে মেয়েদের হত্যা করা থেকে পরিষ্কার যে এই হত্যাকাণ্ড লিঙ্গভিত্তিক ছিলো। চৌদ্দ জন মানুষ সেদিন লেপিনের হাতে মারা গিয়েছিলো শুধুমাত্র মেয়ে হয়ে জন্মানোর অপরাধে। অপার সম্ভাবনাময় একগুচ্ছ কলি পুষ্প হয়ে ফোটার আগেই অকালে ঝরে গিয়েছিলো এক সাইকোপ্যাথ পুরুষের চরম ঘৃণার শিকার হয়ে।
নারীর প্রতি পুরুষের বিদ্বেষের জায়গাতেই শুধুমাত্র সচেতনতা তৈরি হয় এই ঘটনায় তা নয়। এর সঙ্গে বাস্তব কিছু নিয়ন্ত্রণও নেওয়া হয়। গান কন্ট্রোলের যে আইন ছিলো ক্যানাডাতে সেটাকে আরো কঠোর করা হয়। এই হত্যাকাণ্ডের পরেই কোয়ালিশন ফর গান কন্ট্রোল গঠিত হয়। এর ফলশ্রুতিতে ১৯৯৫ সালের নভেম্বর মাসে বিল সি-৬৮ গৃহীত হয়। এই আইনে সকল অস্ত্র মালিকদের তাদের অস্ত্র লাইসেন্স করতে বাধ্য করা হয়। অস্ত্রের মালিকদের ব্যাকগ্রাউন্ড চেক করা হয়। এবং গোলাবারুদ বিক্রির ক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা হয়।
ক্যানাডাতে এই দিনটাকে ন্যাশনাল ডে অব রিমেমব্রান্স এন্ড একশন অন ভায়োলেন্স এগেইন্সট উইমেন নামে পালন করা হয়। হোয়াইট রিবন ডে বা সাদা ফিতা দিবস হিসাবেও এটা পরিচিত।

পৃথিবীর কোনো প্রান্তে, কোনো দেশে, কোনো পরিবারে কিংবা কোনো খানেই শুধুমাত্র একটা নির্দিষ্ট লিঙ্গ নিয়ে জন্ম নেবার অপরাধে কোনো মানুষ যেনো কখনো আক্রান্ত না হয়, সেই কামনা রইলো।

Exit mobile version