বিদ্যুৎ সরকার : একটু আগেও স্নো পড়ছিলো। এখন ডেড্ স্টপ। এটাকে ফ্লুরিস বললেই সঠিক বলা হবে। ফ্লুরিস বন্ধ হয়ে এখন ঝলমলে রোদ। আবহাওয়ার পূর্বাভাসে এমনটাই বলা হয়েছিল। তবুও শংকা জাগে মনে।

এবারের উইন্টারের ভোগান্তিটা অন্যবারের তুলনায় একটু বেশিই বলতে হবে। এক নাগারে বেশ কিছু দিন স্নো – ফলের দরুন জনজীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। তার প্রমাণ রাস্তার দু’পাশে পুঞ্জিভূত বরফ রাশি। তবুও জীবন থেমে যায়নি বা মানুষের চলাচল বন্ধ হয়ে যায়নি একেবারে। জীবন ও জীবিকার জন্য মানুষকে চলতে হয়। অফিস-আদালত, হাঁট-বাজার, রেস্তোরাঁ -পাব সবই খোলা। বিশেষ প্রয়োজন ছাড়া কেউ সাধারণত বের হতে চায় না চরম এ ঠান্ডাকে উপেক্ষা করে। কিন্তু ‘পাব-গোয়াররা’ এর ব্যতিক্রম, কি তুষার ঝড় বা মুশুলধারায় বৃষ্টি -বাদল কোন দুর্যোগে তারা ঘরে বসে থেকে নষ্ট করতে চায় না। যে কোন পরিস্থিতিতে এরা পাব কিংবা বার – এ যাবেই। মাইক্যাল তাদেরই একজন। মাইক্যালের পুরো নাম মাইক্যাল গোমস্। বাবা গোয়ানিজ মা বাঙালি, একেবারে বাংলাদেশি বাঙালি। বলতে হবে মনে-প্রাণ বাঙালি। তাদের কম্বিনেশনটা আমার ভালো লাগে। আরো ভাল লাগে তাদের একমাত্র সন্তান মাইক্যালকে। মাইক্যালের জন্ম বাংলাদেশে। শৈশবের অনেকটা সময় তার বাংলাদেশে কেটেছে। স্কুলের পাঠ চুকিয়ে বাবা-মা’র সাথে পারি জমিয়েছে এ টরন্টো শহরেই। আন্ডারগ্র্যাড শেষ করে মিউজিক নিয়ে কিছু করতে চেষ্টা করে যাচ্ছে মনে প্রাণে।
বিভিন্ন মিউজিক্যাল ইভেন্টে ড্রাম বাজিয়ে থাকে পারিশ্রমিকের বিনিময়ে। ওর ড্রামের হাত যশ বেশ, যার দরুন খ্যাতি ও প্রসার লাভ করেছে ব্যবসায়ীক দিক থেকেও। তাই মাইক্যালের কাছে প্রিয় তিন হলো মিউজিক, অবসরে বেড়ানো আর পাব বা বার। তার রক্তে এ তিন মিশে আছে অটুটভাবেই। মাইক্যালের মিশ্র সংস্কৃতির প্রতি নিগুঢ় এ ভালোবাসা সত্যিই অবাক হওয়ার মতো। পূর্ব-পশ্চিমকে সত্যি সত্যি মনে- প্রাণে ভালোবাসে বলেই দু’সংস্কৃতিকে অন্তর দিয়ে ধারণ করে আছে সে। বাবা-মার প্রতি তার অগাধ শ্রদ্ধা-ভালোবাসা তাকে এমনটি ভাবতে উদ্বুদ্ধ করেছে। যেমন তার পছন্দ পশ্চিমা রক তেমনি পছন্দ পূবের বাউল। এমন উচ্ছল-উজ্জ্বল প্রাণবন্ত ছেলের বন্ধুত্ব সবারই কাম্য।

মাইক্যালের সাথে আমার পরিচয় এক অনুষ্ঠানে, অদ্ভূত ড্রাম বাজাচ্ছিল সে। তার সাথে একটু পরিচিত না হয়ে, কথা না বলে আর ফিরে আসতে চাচ্ছিলাম না। তাই, অনুষ্ঠান শেষে ওর সাথে পরিচিত হয়ে নিলাম এবং যোগাযোগের বিষয়গুলোও সেরে নিলাম এক ফাঁকে। এর পর থেকে প্রায়ই ওর অনুষ্ঠানগুলোতে সময় পেলে উপস্থিত থাকতাম ও শো শেষে দু’জনে কোন পাবে বসে কিছুক্ষণ আড্ডা দিতাম। এভাবেই মাইক্যাল ও আমি বন্ধুতে পরিণত হলাম কিছু দিনের মধ্যেই। বন্ধু মাইক্যাল স্বভাবতই ধির, স্থির এবং ভীষণ সহনশীল ও বন্ধু বৎসল।

কিছু দিন আগেও -৩৫ ডিগ্রি পর্যন্ত ঠান্ডার দৌরাত্ব ছিল, এখন সে অবস্থার অবসান হোয়েছে। তবুও ঠান্ডা একেবারে চলে যায়নি। দিনে -৫ ডিগ্রি থাকলেও রাতে ঠান্ডা অনেক বেড়ে যায়। মাইক্যাল এ ধরনের ঠান্ডায় কখনো বিচলিত নয়। এতো বছরের ঠান্ডায় থাকার অভ্যাসটা তাকে এতোটা সহনশীল করে তুলেছে। মাইক্যালের পাশে থাকলে আমারও ঠান্ডাটা কম অনুভূত হয়। এ জন্যই ঘটা করে মাইক্যালের প্রসঙ্গ এখানে টেনে আনলাম। শুধু যে ঠান্ডাতেই অবিচল থাকে তা কেন কোথাও বেড়াতে গেলে চরম গরম, ব্যথা – বেদনা তাকে এতটুকুও কষ্ট দেয় না, ধৈর্যচ্যুতি ঘটায় না। যার দরুন সহযেই বলে দেয়া যায় মাইক্যাল একজন অতিশয় সহনশীল ব্যক্তি।

ডাউন টাউনের বারগুলো স্বভাবতই বেশি জমজমাট থাকে বিশেষ করে উইক এন্ড ও ছুটির দিনগুলোতে, স্পেশাল খানা ও পিনা সাথে লাইভ মিউজিক। সাধারণত এ দিনগুলোতে ওসব বারগুলোতে ছুটে যাই লাইভ মিউজিক শুনতে।

মাইক্যাল মাঝে মধ্যে এসব বারেও বাজাতে আসে। সেদিন এমনই এক বারে ড্রাম বাজাতে দেখলাম ওকে। আমি ওকে দেখে আনন্দিত হয়েছিলাম। গান শেষ হলে বেশ কিছুক্ষণ আড্ডা দেয়া যাবে এটা ভেবেই। যে মেয়েটা একের পর এক গান গেয়ে যাচ্ছিল তাকে কেন জানি আমাদের অঞ্চলের বলে মনে হচ্ছিল বার বার। শুধু একটি গিটার নিয়ে ড্রামের দ্রæত লয়ে উচ্চ স্বরে সমকালীন রক ধাচের ইংরেজি ও স্পেনিশ গান গেয়ে যাচ্ছিল সে। বেশ কিছুক্ষণ পর চটুল হিন্দি গানে মাতিয়ে দিল। উপস্থিত অনেকেই গানের তালে তালে নাচছিল মনের আনন্দে। তখন অনেকটাই নিশ্চিত হয়ে গেলাম মেয়েটি নির্ঘাত এশিয়ান। গানের পালা শেষ হলে মাইক্যাল আমার টেবিলে একটি চেয়ার টেনে বসলো। পরক্ষণেই গান গাওয়া মেয়েটি মাইক্যালের পাশে এসে বসলো। ওকে আমার সাথে পরিচয় করিয়ে দিতে উদ্যত হলে নিজ থেকেই ও হাত বাড়িয়ে দিয়ে বললো, ‘আই এম কেকা, নাইস টু মিট ইউ’। মাইক্যাল বললো, কেকা ইয়র্ক ইউনিভার্সিটিতে সোস্যাল ওয়ার্ক সাবজেক্ট নিয়ে পড়াশোনা করছে। ইন্টারন্যাশনাল স্টুডেন্ট হিসেবে ভারত থেকে আসা। গান গাওয়াটা তার পেশা নয় নেশা বলতে পার। কেকা আরও যোগ করলো, ‘এতে করে আমার বারতি হাত খরচের যোগান হয় বৈকি’! অল্প সময়ের মধ্যে কেকার চঞ্চলতা ও সরলতা আমাকে কিছুটা মুগ্ধ করেদিল।
এর পর থেকে আমরা সময় পেলেই তিনজনে মিলে কোথাও বেড়াতে যাই, ছবি তুলতে বা কনসার্টে যাওয়ার প্রোগ্রাম করে থাকি। কেকা ভীষণ এক প্রাণবন্ত মেয়ে, বয়সের উদ্যমতা তাকে আরো উদ্যমী করে তুলেছে। ও সাথে থাকলে কখনো মন খারাপ করে থাকার উপায় নেই। কিছু দিনের মধ্যে আমরা পরস্পরের ভাল বন্ধু হয়ে গেলাম। যত দিন যাচ্ছিল আমাদের বন্ধুত্বের বন্ধন দৃঢ় থেকে দৃঢ়তর হতে থাকলো। যেখানে চাওয়া -পাওয়ার কিছু ছিল না, একমাত্র অনুভবের অনুভূতি ছাড়া। আমরা পরস্পরের ভাবনা চিন্তাগুলো অনুভব করতে শিখলাম, একে অপরকে চিনে নিতে শুরু করলাম। সময়ের সাথে সাথে আমরা তিনে মিলে এক বৃন্তের সহচরি হয়ে গেলাম অজান্তেই। একদিন তিনজনের আলাপচারিতায় ইচ্ছে করেই কেকার কাছে জানতে চেয়েছিলাম লাইভ – শোগুলোতে কেন সে বাংলা গান গাওয়ার চেষ্টা করে না? তার সওয়াল জবাব বারে উপস্থিত অধিকাংশেরই চয়েজ দ্রæত লয়ের ও হাই ভলিউমের মিউজিক্যাল গানগুলো যেটা বাংলা গানে খুব কমই দেখা যায়। ব্যক্তিগতভাবে আমার কিন্তু বাংলা গান ভীষণ পছন্দ, যেখানে ন্যুনতম সুযোগ থাকে সেখানে বাংলা গানই আমার ফার্স্ট চয়েজ। শ্রোতাদের বিষয়টিও ভাবনায় থাকে বৈকি!
: বাংলা গানে তোমার প্রিয় শিল্পী কে?
: এ একটা কঠিন প্রশ্ন ছুড়েছো কিন্তু!
: তোমার জন্য খুব কি কঠিন হলো বিষয়টি?

: মূল ব্যাপারটি হলো কাকে দূরে ঠেলে দিয়ে কার নাম বলবো। যারা গান গাচ্ছে তারা প্রত্যেকেই নিজ নিজ ভুবনে আলোকিত। আর একই ধরনের গান একের অধিক শিল্পী গাচ্ছে। তা আবার পুরুষ ও মহিলা শিল্পীগণ রয়েছে। এ বিভাজনের মুখোমুখি হওয়া আমার পক্ষে কখনো সম্ভব হবে না। আসলে সব ধরনের গান যেমন আমার পছন্দ তেমনি, সব শিল্পীর গানও আমার পছন্দ। নিজ দেশের গান যেমন আমার রক্ত কণিকায় মিশে আছে তেমনি ভিন দেশের সংগীত আমাকে বিভিন্নভাবে প্রলুব্ধ করে, সংগীতের বিশালতা অপরিসীম। কোন সীমা রেখা টানা কখনো সম্ভব নয়। ‘আজ তবে এইটুকু থাক বাকী কথা পড়ে হবে….’। চল বøাফার্সে যাই। : এ সময় বøাফার্সে কি মনে করে?

: কেন আজতো পূর্ণিমা, বøাফার্সের লেকে চাঁদের প্রতিচ্ছবি দেখবো।
: চাঁদ দেখতে দেখতে গান শোনাবো, ‘ও চাঁদ সামলে রাখো জ্যোৎস্নাকে, কারোর নজর লাগতে পারে…. ’।
: কেন এমনওতো হতে পারে, ‘চাঁদ দেখতে গিয়ে আমি তোমায় দেখে ফেলেছি…..’!
এই প্রথম আলোকিত জ্যোৎস্নায় কেকাকে অন্যভাবে দেখার সুযোগ হলো। তার মুখের একটি পাশ চাঁদের আলোয় আলোকিত, সফেদ। যেন রূপালী ইলিশের ঝিলিক খেলে গেছে কোন সকালে কেউ তা জানে না। উদাস দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে লেকের টল মল জলের গভীরে। যেখানে চাঁদ হাসছে, জলে ভাসছে দোদুল দোলায়। ‘চাঁদের হাসি বাঁধ ভেঙেছে……।’ কেকার মন কতটা আলোকিত, কতোটা পুলকিত আলোকেরই ঝর্না ধারায়? কখনো কখনো কেকাকে ভীষণ উদাস মনে হয়, আনমনে কী যেন ভাবে একা একা! কেপে উঠা ঠোঁটের ভাজে কী কথা থাকে কে জানে? উচ্ছল, উজ্জ্বল তারুণ্যের চঞ্চলতা যার মনে তার হঠাৎ করে বদলে যাওয়াটা কেমন জানি বেমানান। কোন দুঃসংবাদ পেলে বা দুঃখজনক কিছু ঘটতে থাকলে কেকা এমন বদলে যায়। ওকে এমনটি হতে এর আগেও কয়েক বার দেখেছে মাইক্যাল। শুনে আমার মনটাও কেমন জানি হয়ে গেল। ঘন্টাখানেক বাদে বøাফার্স থেকে আমরা ফিরে এলাম। একটি ইন্ডিয়ান কুজিনে ঢুকে তিনজনে রাতের ডিনার শেষ করে যার যার ঘরে ফিরে এলাম।

দু’দিন কেকার সাথে দেখা হয়নি। মাঝে-মধ্যে এমন হয়েই থাকে, তাতে ভাবনার কিছু থাকে না। কিন্তু এবারই তার ব্যতিক্রম। সাধারণত কাজের জায়গায় ফোন বন্ধ রাখি। তাই, কাজ থেকে বাসায় ফেরার পথে ফোন অন করতেই কেকার একটি মেসেজ পেলাম কেকা দেশে ফিরে যাচ্ছে, ওর বাবা ভীষণ অসুস্থ। ঘরে ঢুকেই মাইক্যালকে ফোন করলাম। সাথে সাথেই ওকে পেয়ে গেলাম। তার কাছ থেকে একই খবর শুনলাম। দু’জন বিষয়টি নিয়ে কিছুক্ষণ কথা বললাম। হঠাৎ-আসা এমন একটি সংবাদ আমাদের কিছুটা বিচলিত করে দিল।ওর ফোনে কল করেও সংযোগ পাওয়া সম্ভব হয়নি।এরই মধ্যে হয়তো তার প্লেন ছেড়ে গেছে। এ অল্প দিনের পরিচয়ে তার সম্পর্কে ও তার পরিবার সম্পর্কে অনেক কিছুই তার কাছ থেকে শোনা সম্ভভ হোয়েছে। ওর মতো সহজ-সরল এমন একটি মেয়ে আজ কাল খুঁজে পাওয়া ভার। কেকার বাবা একজন সফল ব্যবসায়ী। একক প্রচেষ্টায় সে তার ব্যবসাকে এক ইর্শনীয় পর্যায়ে নিয়ে এসেছে কিছু সময়ের মধ্যে, এ কথাও কেকা আমাদের বলেছে গল্পের ছলে। শুধু তার উপার্জনের টাকায় ছোট ভাই, ও’র পড়া-লেখা ও সংসারের যাবতীয় খরচাদি চলে থাকে।

তার পৌঁছানোর খবর দিয়ে একটি মেসেজ পাঠিয়েছে আজ। তাতে ওর বাবার প্রসংগও রয়েছে সংক্ষিপ্ত আকারে। বাবা আই সি ইউ তে ভর্তী, মেসিভ হার্ট অ্যাটাক। এ ছোট্ট মেসেজটা মুহূর্তের মধ্যে বুকে কতোটা কম্পন সৃষ্টি করে দিয়েছে তা কেবল আমিই জানি। একটি শংকা,একটি অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ থমকে আছে যেন সময়ের করিডোরে। ছোট ভাই ও কেকার লেখাপড়া, ওদের ছোট্ট সাজানো সুখের নীড়ে যদি ঝড় এসে কড়া নাড়ে যখন তখন? মাইক্যালের সাথে কথা বলে একই জবাব মিললো। আমরা দু’জনেই কেকার ভবিষ্যতের কথা ভেবে সত্যি সত্যি দুর্ভাবনাগ্রস্ত হয়ে গেলাম যেন।

আর যদি কেকা ফিরে না আসে! ওর ইউনিভার্সিটি, লেখাপড়া, লাইভ – শো, সর্বোপরি আমাদের স্বার্থহীন ভালবাসা, শর্তহীন ত্রিভুজ বন্ধুত্বের বন্ধন – এ সমস্ত কিছুর কী হবে? ভাল লাগার সরলীকরণ, ভালবাসার উত্তাপ কী হীম ঘরে স্থানান্তরিত হবে অসময়ের দুর্বার আকর্ষণে?
আমার স্মৃতিময় পুরনো চিঠির মতো নির্বাসনে চলে যায় ভাবনাগুলো। এক দীঘি শূন্যতায় বুক ভরে উঠে।সব কিছুর ন্যায় ভালোলাগাগুলো, ভালোবাসাগুলো কি ফসিল হয়ে যায় এক সময়?
বিদ্যুৎ সরকার : লেখক ও আলোকচিত্রী, টরন্টো, কানাডা