নাদিরা তাবাস্সুম : সাফিদের বন্ধু মুকিত। মুকিতের ছোট বোনের বিয়েতে সাফিদ গিয়েছে বহু মূল্যবান উপহার নিয়ে। বিয়ের অনুষ্ঠান খুব ধুমধাম জমকালো আয়োজনে করা হচ্ছে। নিয়ম মতো সকল আচার অনুষ্ঠানের মাঝে সাফিদ লক্ষ্য করেছে মুকিতের অস্বাভাবিক আসা-যাওয়া। কিছুক্ষণ পর পর মুকিত কোথাও দূরে একটু কোণে লুকিয়ে যায় আবার ডাকাডাকি হলে ফিরে আসে মলিন মুখে। মুকিতের বাবা মা মারা যাওয়ার পর পরিবারের পুরো দায়িত্ব মুকিত একাই পালন করেছে তাই হয়তো ছোট বোনের জন্য মন খারাপ হয়েছে। বিষয়টি সাফিদ কিছু সময় ধরে লক্ষ্য করার পর চুপিসারে মুকিতের পিছু পিছু গিয়ে দেখে মুকিত কোথায় যায় এবং কি করে। সেখানে গিয়ে দেখে এক কোণে দাঁড়িয়ে অঝোর ধারায় কাঁদছে আর চোখের পানি মুছছে। এমন একটি আনন্দঘন বিয়ের অনুষ্ঠানে মুকিতের কিসের এত কষ্ট কিসের এত বেদনা? সাফিদ কাছে গিয়ে জানতে চায়। অমনি মুকিত ডুকরে কেঁদে কেঁদে বলে “আজ ছোট বোনটার বিয়েতে মা-বাবা এবং ভাইবোন অনেকে বেঁচে নেই। তারা বেঁচে থাকলে অনেক খুশী হতেন।” তারা যেন একজন একজন করে আমার কাছে এসে বলে, “কিরে সব ঠিকঠাক আছে তো? দেখিস মেয়েটা যেন কোন কষ্ট না পায়, ওর যেন কোন দুঃখবোধ না থাকে।” তারা বেঁচে থাকলে তাদের ছোট মেয়েকে বরপক্ষের কাছে তুলে দিতেন। এই দায়িত্ব আজ আমাকে পালন করতে হচ্ছে।
সাফিদ – আমি যা জানি ও দেখেছি, তোর মা-বাবা মারা যাওয়ার পর ছোট ভাইবোনদের লেখাপড়া থেকে শুরু করে সকল দায়িত্ব পালন করেছিস। এখন বেশ ধুমধাম করেই ছোটবোনের বিয়েটাও দিয়ে ফেলেছিস। এতে অবশ্যই ওপারে থেকে ওনারা আজ অনেক খুশী হয়ে গেছেন।
মুকিত – আমি পরিবারের জন্য যা কিছু করতে পেরেছি সবই সৃষ্টিকর্তা আল্লাহতায়ালার দয়া। তিনি আমায় যথেষ্ট সাহায্য করেছেন বলেই সম্ভব হয়েছে। আমি সেজন্যে তাঁর কাছে হাজারো কৃতজ্ঞতা জানাই। সে যাই হোক আজ আমি সন্তুষ্ট এবং নিজেকে সুখী ভেবে মা-বাবার কথা বেশি মনে হচ্ছে ও কান্না পাচ্ছে।
সাফিদ – একই সাথে সৃষ্টিকর্তাকে এবং মা-বাবাকে খুশী করতে পারা কঠিন কাজ যেটা সৌভাগ্যবানরাই পারে। তাছাড়া একজন কৃতজ্ঞ বান্দা হিসাবে অনেক পূণ্যবান। কিন্তু বন্ধু এখন একটু কান্নাকাটি থামিয়ে ও দিকটায় গিয়ে বোনকে বিদায় দেয়ার ব্যবস্থা নেয়া উচিত। সবাই তোর জন্য অপেক্ষা করছে।
মুকিত – সেদিন ভালোভাবেই বোনের বিদায় অনুষ্ঠান শেষ করেছিল। কিন্তু সাফিদ এ বিষয়ে অনেক চিন্তা করেছে। মুকিতের অন্যান্য ভাইবোনেরা ছিল যারা মুকিতের মতো এত উদার মনের হয়নি এবং পরিবারের জন্য এমন ত্যাগ স্বীকার করেনি বরং অনেকে ঈর্ষা করেছে ও দুর্ব্যবহার করেছে। তাহলে মনে হয়, পরিবারে বা সমাজে আল্লাহতায়ালা সবাইকে সব দায়িত্বভার দেন না। নির্দিষ্ট কিছু মানুষকে নির্দিষ্ট কিছু দায়িত্ব দিয়ে পাঠান যা তারা শত কষ্ট হলেও পালন করে যান সারাজীবন ধরে। যুগে যুগে মহামানবেরা এমনই মানুষের কল্যাণের জন্য আত্মত্যাগের মাধ্যমে প্রকৃত সুখ খুঁজে পেয়েছেন, এতে সন্তুষ্ট থেকেছেন আর শান্তি পেয়েছেন। প্রকৃতপক্ষে সন্তুষ্টি, সুখ, শান্তি এবং কৃতজ্ঞতা বিষয়গুলো পরস্পর সম্পর্কযুক্ত। সন্তুষ্টি হচ্ছে সুখী ও সন্তুষ্ট থাকার একটা অবস্থা। কাউকে ধন্যবাদ প্রদানের সময় যখন মনে করা হয় ‘আমি সব বিষয়ে কৃতজ্ঞ’, তখন মনে সন্তোষ বোধ অনুভূত হয়। এতে শুধু এক প্রকার সুখ অনুভূত হয় তাই নয় –তার চেয়ে বেশি মনে শান্তি ভাব হয়। এজন্যেই মহান আল্লাহতায়ালা কৃতজ্ঞতা বা আরবী ভাষায় ‘শোকর’ বিষয়ে পবিত্র কোরআনে বলেছেন ‘এবং যখন তোমার রব ঘোষনা করেন, কৃতজ্ঞ হলে অধিক দিব আর অকৃতজ্ঞ হলে আমার শাস্তি হবে বড়ই কঠিন’ (সূরা ইব্রাহীমঃ আয়াত ৭)। তিনি আরও বলেছেন ‘ যদি তোমরা শোকর কর আর বিশ্বাস কর, আল্লাহ কৃতজ্ঞদের মূল্যদানকারী মহাজ্ঞানী’ (স্রূা নিসাঃ আয়াত ১৪৭);’ অত এব তোমরা আমাকে স্মরণ কর,আমি তোমাদেরকে স্মরণ করবো আমার প্রতি কৃতজ্ঞ হও,অকৃতজ্ঞ হয়ো না’ (সূরা বাকারাঃ আয়াত ১৫২);’ আর আল্লাহ তোমাদেরকে মাতৃগর্ভ হতে এমন অবস্থায় বের করেছেন যে,তোমরা কিছুই জানতে না। আর তিনিই তোমাদেরকে শ্রবণশক্তি, দৃষ্টিশক্তি ও হৃদয় প্রদান করেছেন ,যাতে তোমরা তাঁর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে পার’ (সূরা নাহল ঃ আয়াত ৭৮)।