ভজন সরকার : (৭)
স্মৃতিকাতরতা জিনিসটা বড়ই গোলমেলে; অনেকটা অসম্পাদিত লেখার মতো। সব কেমন জানি হাবিজাবি, উল্টোপাল্টা, আকাশ-কুসুম বাস্তব-কল্পনার অবিমিশ্র এক দলা হ-য-ব-র-ল। জানি না, মনোবিজ্ঞান এরকম জগাখুচূড়িকে কিভাবে সঙ্গায়িত করেছে। তবে একজন কল্পনাপ্রবন মানুষের মনের কথোকতা যদি অসম্পাদিত ভাবে প্রকাশ করা যেতো, তবে সেটা যে এক অপূর্ব বিষয়সম্ভার হতো-সেটা নির্দ্বিধায় বলা যায়।
ভাবুন তো, একা একা নিজের সাথে যে সব বিষয় নিয়ে সারাক্ষণ তর্ক করেন, একা একাই প্রশ্ন করেন, একাই সেসবের উত্তর ও সিদ্ধান্তে উপনীত হোন, সেসব যদি নির্দ্বিধায় ও নিঃসঙ্কোচে প্রকাশ করা যেতো তবে কী লঙ্কাকান্ডটাই ঘটে যেতো প্রতিদিন আমাদের চারিদিকে।
আমাদের চারিদিকে যে অশুভ কাজকারবার হচ্ছে, কার না-ইচ্ছে করে সে সব ভেঙেচুরে চুরমার করে দিই। কার না- ইচ্ছে করে যে যেমন চাই,যেভাবে চাই – তা পেতে। আসলে সব কি পারা যায় কিংবা করা যায় যে যেভাবে ভাবি? যায় না কিংবা করাও উচিত নয়।
আসলে মানুষের নিজের মধ্যেই এক ধরনের ফিল্টার বা অবদমনের যন্ত্র আছে যা মানুষকে স্বনিয়ন্ত্রিত করে রাখে। এই অবদমনের যন্ত্রটির কার্যকরণ নিয়ন্ত্রণ করে মানুষের শিক্ষা-দীক্ষা-সমাজ-সভ্যতা বা এক কথায় সংস্কৃতি।
তাই তো সকল শিশুর ব্যবহার প্রায় একই কিন্তু সকল বয়োঃপ্রাপ্ত মানুষের ব্যবহার কিন্তু এক নয়। শিশু থেকে মানুষ বেড়ে ওঠে। মানুষের এই যে বেড়ে ওঠা বা পথচলা, সেটাই যেন সমগ্র মানবজাতির পথচলা, সমগ্র মানবসভ্যতার এগিয়ে যাওয়া।
মোদ্দা কথা, এই যে বিশ্বসভ্যতা, সমাজের এই যে এগিয়ে যাওয়া সব কিছুর পেছনেই থাকে প্রত্যেকটি ব্যক্তিমানুষের চিন্তা ও কল্পনা স্বতন্ত্রভাবে এবং সকল মানবজাতির চিন্তা ও কল্পনা সামগ্রিকভাবে। তাই স্মৃতিকাতর কল্পনা যে সব সময় ফেল্না সেটা কিন্তু নয়।
তবুও একটি জাতির কিংবা জনগোষ্ঠীর চিন্তাপ্রসূত কল্পনার রাজ্য গড়ে ওঠার পেছনে অনুকরণীয় এবং অবশ্যই অনুসরণীয় কিছু দৃষ্টান্ত প্রয়োজন। পরিবার তো প্রাথমিক সোপান। কিন্তু প্রত্যেকটি পরিবারের মূল্যবোধকে সামগ্রিকভাবে একটি গোষ্ঠীগত মূল্যবোধের সাথে “মেলাবে –মিলিবে” রকমের সংযোজনের মাধ্যমেই একটি আদর্শ সমাজ গড়ে উঠে। সে ক্ষেত্রে পরিবারের পরেই একটি আদর্শ শিক্ষা ব্যবস্থার প্রয়োজনের কথা মনে পড়ে।
“বাল্যশিক্ষা” বা “আদর্শলিপি” পড়তেই হবে তেমনটি নয়। কিন্তু শিক্ষা এবং আদর্শ শিক্ষাটা জরুরী। আর সেটা শিশু-শিক্ষার প্রতিষ্ঠান এবং পাঠ্যপুস্তকের মাধ্যমেই দেয়া উচিত।
ব্যক্তিগতভাবে আমার মনে হয়, রবীন্দ্রনাথের বিপুল বিশাল সাহিত্যভাণ্ডার থেকে “শিশু” কাব্যগ্রন্থের কবিতাগুলো প্রত্যেকটি মানুষের বেড়ে ওঠার সময়ে আবশ্যিক পাঠ্য। একবার ভাবুন তো, যে শিশু “খোকা”, “জন্মকথা”, “খেলা”, “খোকার রাজ্য” কিংবা “বীরপুরুষ” কবিতা পড়ে বড় হয়ে ওঠে,তার আদর্শ মানুষ হওয়ার সোপানের ভিত্তিটা মজবুত তো হবেই।
শুধু রবীন্দ্রনাথই পড়তে হবে সেটা নয়, কিন্তু শিশু-বিকাশের সহায়ক রচনাগুলো পড়তেই হবে। অথচ আমাদের শিশুতোষ পাঠ্যপুস্তক থেকে একে একে এ সব রচনাগুলো সরিয়ে ফেলা হচ্ছে। খুউব সুপরিকল্পিত সিদ্ধান্ত বা চক্রান্ত এসবের পেছনে কাজ করছে।
বাংলাদেশ নামক ভূখন্ডটুকুর সাথে বিশ্বাসঘাতকতা শব্দটার যোগসূত্র খুব নিবিড়। পলাশি প্রান্তরের সেই “মীরজাফরী”- কয়েক শত বছর পেরিয়েও কীরকম উজ্জ্বল উপস্থিতি! খুব মোটা দাগে কোনো রকম ভনিতা ব্যতিরিকেই বলা যায়, ১৯৪৭, ১৯৫২, ১৯৭১,১৯৭৫-এ ফিরে ফিরে এসেছে বিশ্বাসঘাতকদের কালো থাবা।
১৯৮০-র দশক কিংবা ১৯৯০ দশকের প্রথমার্ধ্বে একটি কথা খুব প্রচলিত ছিল, যখন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্ম-কথাকেই বিকৃতির অন্ধকারে ঢেকে দেয়ার চেষ্টা চলছিল। কথাটি হলো, যারা স্বাধীনতার ভুল ইতিহাস বলছেন, তারা কি নিজের সন্তানদের এ কথাগুলো শিক্ষা দিতে পারবেন? কেননা, পিতা-মাতা যতোই খারাপ হোন, নিজের সন্তানকে অন্তত মিথ্যে শেখাবেন না, যদি-না তাঁরা নিকৃষ্ট আর নরাধম না হোন। কিন্তু সে সব মানুষ নামের অযোগ্য মানুষের দাপট কিন্তু দেখা গেছে অনেক অনেক দিন এবং এখনো তা চলছে কখনো ধর্মের নামে, কখনো বা রাজনীতির নামে।
ইদানিং সে সব কিছুটা নেপথ্যে চলে গেছে। কিন্তু শুরু হয়েছে অন্য রকম বিকৃতি। এবার স্বাধীনতা বা মুক্তি সংগ্রাম নয়। বরং তার চেয়েও ভয়ঙ্কর; ধর্মীয় অনুভূতি নিয়ে খেলা। ধর্ম নিতান্ত ব্যক্তিগত বিশ্বাস। অথচ সেটাকে আমাদের-ওদের নামে বিভাজন করে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মকে বিভেদের লক্ষণ রেখার বাতাবরণে ঢেকে দেয়ার চক্রান্ত। সেটার মোক্ষম জায়গা পাঠ্যপুস্তক। ঠিক সে জায়গাতেই বিশ্বাসঘাতকদের এবারের হাত।
কী ভয়ঙ্কর ভাবে একটি দেশের বিদ্যালয় পর্যায়ের গোটা পাঠ্যপুস্তকেই একটি ধর্মীয় গোষ্ঠী তাদের নির্দেশিত রচনাগুলো ঢুকিয়ে দিতে সমর্থ হয়েছে। এই ধর্মীয় গোষ্ঠীর মূল কাজই ধর্মকে ব্যক্তিগত বিশ্বাসের স্তর থেকে বের করে এনে রাষ্ট্র পর্যায়ে নিয়ে যাওয়, যেটা আধুনিক সমাজে ব্রাত্য শুধু নয়, বাংলাদেশের জন্মের সাথেও অসামঞ্জয্যপূর্ণ। অথচ মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বকারী দলটিই এখন ক্ষমতায়।
কিন্তু ওই যে বলছিলাম, বিশ্বাসঘাতকতা বাংলাদেশ নামক ভূখন্ডের সাথের সাথী। কখনো বাহ্যিক ভূগোলে আবার কখনো অন্তরের চেতনার স্তরে জিঘাংসার ব্যাপ্তি ছড়িয়েই আছে বছরের পর বছর, যুগের পর যুগ। “মীরজাফর”-দের স্মৃতি শুধু নয়, ব্যক্তি “মীরজাফর” গংও ফিরে ফিরে এসেছে এবং আসবে এ বংগীয় ব-দ্বীপে। কিন্তু চেতনার শুদ্ধতা, কৃষ্টি-সংস্কৃতি আর ঐতিহ্যের অহংকারই এ অঞ্চলের মানুষকে পথ দেখাবে, অতীতে যেভাবে দেখিয়েছিল, ঠিক সেভাবেই।
সুড়ংগের ওপাশে আলো কিন্তু সুড়ংগের অন্ধকারটুকু বড়ই বিদ্ঘুটে। মনুষ্যত্বের প্রতি বিশ্বাস আর শেকড়ের প্রতি ভালোবাসা দিয়েই ক্ষণিক এ বিচ্যূতি থেকে বাংলাদেশকে রক্ষা করতে হবে এবং সেটা হবেই। কারণ, ধর্মীয় কিংবা স¤প্রদায়গত ক্ষুদ্রতা কিংবা বিভাজন কখনোই শাশ্বত আর মানবিক মূল্যবোধের চেয়ে বড় হ’তে পারে না।
(ভজন সরকার : কবি, কথাসাহিত্যিক ও প্রকৌশলী। হ্যামিল্টন, কানাডা )