আতোয়ার রহমান : আসলাম সাহেব গাজীপুরের শালবনের ভেতরের ছোট্ট রিসোর্টটির ম্লান আলোকিত পিছনের সরুগলি ধরে হাঁটলেন। বড় রাস্তা থেকে এবড়োথেবড়ো ইট বসানো পুরাতন ক্ষয়িষ্ণু রাস্তাটি বনের ভেতর দিয়ে উত্তর দিকে দুই কিলোমিটার নিচে নামলে রাস্তার পাশেই জঙ্গলের কেন্দ্রে একটুখানি ফাঁকা জায়গায় সবুজ বুনো ঘাসে মোড়া মাঠে অমসৃণ দেয়ালের ধুসর লাল ইটের তিনতলা পুরনো ভবন। গাছপালায় আর লতাগুল্মে মাকড়সার জালের মতো ঢেকে ফেলেছে এমন করে… পরিত্যক্ত বাড়িই বলা যায়। একটু উঁচু থেকে চোখ মেললে দেখা যায়, মাইলের পর মাইল ঘন বনে ছেয়ে আছে। এক সময় নবীনগরের কাছের শালবনের ভেতরের এক ভিড়-ঝামেলা-বিহীন জায়গাটি। প্রকৃতি যেন এখানে আত্মমগ্ন হয়ে সৌন্দর্যের আঁকিবুকি কাটে প্রত্যহ। সামনে কেয়ারী করা ফুলের বাগান। নীরব নিস্তদ্ধ চারদিক। কাছে কোন লোকালয় নেই। ছোট ছোট কিছু ফ্যাক্টরি দেখা যায় দূরে দূরে। রিসোর্টের সীমানা ঘেঁষে একটি শীর্ণ নদী সাপের মত এঁকেবেঁকে বয়ে চলেছে, পাড়ঘেঁষে আগাছা ও ফার্নগাছ ঘেরা একটি পুরনো জীর্ণ শ্মশান। ব্যবসায় ডুবে থেকে হাঁপিয়ে উঠে তিনি সেই আশির দশকের শেষের দিক থেকে মাঝে মাঝে এখানে এসে শহরের বাইরে নিরালা নির্জনে শহুরে মনের ভারকে লাঘব করে দেওয়ার জন্যে সাময়িক অবসর যাপন করেছেন। গাছে ছাওয়া রাস্তাটা ধরে বিকেলে হাঁটাহাঁটি করে ক্লান্ত হলে সামনের বিশাল কাঠগোলাপ গাছের নিচের বেঞ্চে বসে একটু জিরিয়ে নেন। আজও আধ ঘন্টা হাঁটার পর একটু বিশ্রাম নিলেন।
আসলাম সাহেব একটি পুরনো ধূসর দরজার কাছে এসে থামলেন এবং অদ্ভুতভাবে তার চাবিগুলি খুঁজতে লাগলেন। তিনি এখানে রুম ভাড়া করতেন তার মনে পড়ার চেয়ে বেশি সময় ধরে এবং চোখের পাতা প্রায় বন্ধ করে এই অঞ্চলটিতে হাঁটতে পারতেন। তার চোখের দুর্বল দৃষ্টিশক্তি এবং শারিরীক অবস্থার প্রেক্ষাপটে এটাকে ভালই বলতে হয়।
আসলাম সাহেব দরজা খুলে ভিতরে গেলেন। সামনের দরজার পিছনের কালো মোজাইক করা সিঁড়িটি সঙ্গে সঙ্গে তাকে দোতলার সর্ব দক্ষিণের উত্তরমুখী ঘরটিতে নিয়ে গেল, যা তিনি ভাড়া নিয়েছিলেন। ঘরটি উষ্ণ এবং ভরাট ছিল তবে তা আরামদায়কভাবে ছিল। দক্ষিণ দিকেও একটা দরজা আছে। দরজার সামনে একটি ছোট ব্যালকনি। দেয়ালে মরা মানুষের কঙ্কালের মাথার মতো দেখতে পুরনো একটি কাঠের ঘড়ি টিক টিক শব্দ করছিল। জানালার বাইরে মাথা দোলাচ্ছে বোগেনভেলিয়া, রডেনডনড্রন। একটু দূরে শালগাছগুলির বড় বড় পাতা হাতির কানের মতো দুলছে। দরজা ও জানালাটি সারাদিনরাত বন্ধ থাকে। রিসোর্টের বর্তমান কেয়ারটেকার সুরেশ তাকে ওগুলো খুলতে নিষেধ করেছেন। রাতের বেলায় রহস্যময় শুন্যতায় ভরা এই দরজা ও জানালা আসলাম সাহেবের ভেতরে একটা ব্যাখ্যাতীত অনুভূতির সৃষ্টি করে। বছরের পর বছর ধরে, আসলাম সাহেব পুরো বিল্ডিংয়ের মালিকানা নেওয়ার জন্য যথেষ্ট পরিমাণে ভাড়া দিয়ে আসছেন। তবে এটি ঘটেনি এবং তিনি তা নিয়ে ভাবেন না।
আসলাম সাহেব সিঁড়ি বেয়ে উঠে ছোট রান্নাঘরে প্রবেশ করলেন। পুরানো চুলাটি চালু করলেন এবং রাতের খাবারের জন্য স্যুপের একটি ক্যান প্রস্তুত করতে শুরু করলেন। তিনি বেশি কিছু খাননি এবং সাধারণত বেশিরভাগ দিন একই ধরণের খাবার খান। টিনজাত স্যুপ এবং সাদা রুটি। এটা তার জন্য কেনাকাটা সহজ করে তুলেছিল।
রিসোর্টের কর্মচারীদের আসলাম সাহেবকে স্মরণ করতে বেশ কষ্ট হয়েছিল যদিও বহুদিন থেকে এখানে তার যাতায়াত। তারা এখানে এক নাগাড়ে বেশি দিন থাকেন না। এটা তাকে না চেনার কারণ হতে পারে। তিনি শান্ত, অল্প কথার মানুষ।
তবে তার একটি ইতিহাস ছিল, একটি দীর্ঘ বিস্মৃত ইতিহাস যা তিনি সফলভাবে বছরের পর বছর জুড়ে লুকিয়ে রেখেছিলেন। সত্যিকার অর্থে, আসলাম সাহেব একদা সফল ব্যবসায়ী ছিলেন এবং একটি গার্মেন্ট কারখানার মালিক ছিলেন যা এক সময় কাঠগড়া রোডের পূর্বতম প্রান্তে অবস্থিত ছিল। সেটি এক সময় উত্তর-পূর্ব সাভারে সবচেয়ে বড় গার্মেন্ট কারখানা ছিল। তিনি তার স্ত্রীকে নিয়ে এই ব্যবসা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। দু’জন মিলে দীর্ঘ সময় ধরে কাজ করেছেন এবং তাদের ঘামঝরা পরিশ্রমের মধ্যে দিয়ে তারা একটি গার্মেন্ট সাম্রাজ্য তৈরি করেছিলেন যা প্রায় সাড়ে তিনশ শ্রমিককে চাকরিতে নিযুক্ত করেছিল। এক সময় বছরের পর বছর ধরে, কারখানাটি ঝুঁকিপূর্ণ হতে শুরু করল, শ্রমিকদের তিন মাসের বেতন নাই এবং ব্যবসা টিকে রাখতে কিছু শ্রমিক ছাটাই করতে হল। শ্রমিকরা প্রতিবাদ ও বিক্ষোভ মিছিল শুরু করল। একদিন সেখানে রহস্যজনকভাবে আগুন ধরেছিল যাতে ফ্যাক্টরির বেশিরভাগ অংশ ভস্মীভূত হয়েছিল। কুড়িজন শ্রমিক জীবন্ত পুড়ে মরেছিল। আরো প্রায় কুড়িজন মারা গিয়েছিল সরু সিঁড়ি বেয়ে হুড়োহুড়ি করে নামতে গিয়ে। পুরনো কাঠামোর যা অবশিষ্ট ছিল তা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। বছরের পর বছর ধরে, যে ব্যবসায়টি নিজের প্রসারের পাশাপাশি সে সময়ের ছোট শহর সাভারের বৃদ্ধি ও প্রসার ঘটিয়েছিল, যেটি পরবর্তীতে মিউনিসিপ্যাল শহরে পরিণত হয়েছিল। সময়ের পরিক্রমায় সেই গার্মেন্ট ফ্যাক্টরিটির কথা মানুষ এক সময় মূলত ভুলেই গিয়েছিল।
খাওয়া শেষ হতে অনেক রাত হলো। আসলাম সাহেব তার গরম স্যুপটি একটি স্ন্যাক টেবিলে রেখে টিভিটি চালু করলেন।
ভাদ্রের প্রচন্ড গরমের অমাবস্যার রাত, প্রায় সাড়ে বারটা। তুমুল বৃষ্টি। দূরদুরান্তে আলোর চিহ্নমাত্র নেই, শুধু মাঝে মাঝে আকাশের বুক চিরে বিদ্যুত চমকাচ্ছে। বাইরে হাওয়ার শোঁ শোঁ আওয়াজ, আর্তনাদের মতো শোনাচ্ছে। মাঝে মাঝে দমকা হাওয়ার ঝাপ্টা। বাতাস যেন তার সমস্ত ক্ষোভ উগরে দিচ্ছে। দমকা হাওয়া বারান্দা হয়ে মশারির ভেতর পর্যন্ত হালকা শীতল আমেজ ছড়িয়ে দিলো। মাঝরাতের টিভি সংবাদটি বিরক্তিকর এবং একঘেয়ে তাই আসলাম সাহেব বাতাসের ছটায় ঝিমুতে-ঝিমুতে বালিশে হেলান দিয়ে তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে পড়লেন। তবে তার হালকা ঝিমুনি হঠাত একটি পরিচিত কণ্ঠস্বর দ্বারা বাধাগ্রস্ত হলো যা টিভি থেকে এসেছে বলে মনে হলো।
“আসলাম, আসলাম” বলে ডাক পড়ার সাথে সাথে ঝাঁকুনি খেয়ে তিনি জেগে উঠলেন। ঠিক তখনই টিমটিম করে জ্বলে উঠে বাতিটা নিভে গেল।
‘আসলাম আপনি আমাকে খুন করেছেন কেন?’ কন্ঠস্বরটি শুরুতে শান্ত ছিল তবে ক্রমশ তা ভয়সঙ্কুল হয়ে উঠল। ঘরের মধ্যে অদৃশ্য স্বত্বার উপস্থিতি টের পেয়ে তার বুকটা কিঞ্চিত হলেও খানিক কেঁপে উঠলো। একবার মনে হচ্ছে পানির পিপাসা হচ্ছে আবার পর মুহূর্তেই মনে হচ্ছে-না পানির পিপাসা না-অন্য কিছু। রুমাল দিয়ে কপালের ঘাম মুছলেন।
“কে, কে তুমি ওখানে?’ ভীত গলায় জিজ্ঞাসা করলেন আসলাম সাহেব।
তিনি ভয়ে উদ্বিগ্নভাবে সাজানো গোছানো রুমটির চারিদিকে তাকালেন। বাইরে কালো বিড়ালের মতো নিশ্চুপ অন্ধকার। এর মধ্যদিয়ে টর্চলাইটের আলোও ভেদ করতে পারে না। তার বুকটা এক অজানা আশঙ্কায় কেঁপে উঠল। তিনি জলদি জলদি আয়াত-উল-কুর্সি পড়তে লাগলেন, কিন্তু মাঝখানে এসে আটকে গেলেন, যদিও পুরো আয়াতটা তার মুখস্ত। আর যত দোয়াদরুদ জানা আছে সব পড়লেন।
“এখানে কে আছে আপনি তা ভালো করেই জানেন।” জবাবটা টিভি থেকে এল বলে মনে হল।
আসলাম সাহেব চেয়ার থেকে উঠে ভয়চকিত হয়ে ঘুরে ঘুরে চারিদিকে দেখলেন। দক্ষিণের জানালার ঠিক বাইরে ঝাউগাছের দিক থেকে ভেসে আসছে একটা মেয়েলি গলার চাঁপা আর্তচিত্কার। তিনি কানখাড়া করে শুনলেন, চমকে গেলেন। গলা শুকিয়ে কাঠ হয়েছে। ওদিকে এগিয়ে জানালার ঝোলানো পর্দা সরিয়ে তাকাতেই দেখতে পান সাদা পোশাকের এক নারীর ছায়ামূর্তি। রিসোর্টের একেবারে ধারঘেঁষে একটা টেলিফোনের খাম্বার নিচে দাঁড়িয়ে আছে। বৃষ্টি আর বিদ্যুতের আলোআঁধারিতে নারীমূর্তির চোখমুখের প্রতিটি রেখা স্পষ্ট দেখা যায়। স্বরটা অগ্নিকান্ডে নিহত সুইং অপারেটর জরিনা বেগমের গলার স্বরের মতো মনে হলো। তার বুকটা ধক করে উঠল। আসলাম সাহেব চমকে উঠে স্থিরভাবে দাঁড়িয়ে সেই নারীর চোখের দিকে তাকায়, সেখানে দেখতে পায় রাগ, বিদ্রুপের হাসি; আর ঘৃণা যা প্রকট হয়ে তাকে যেন নিঃশেষ করে দিতে থাকে। নারীমূর্তির মুখ দেখে মনে হয় সে কিছু একটা বলতে চায়। ভাল করে দেখলেন। কিন্তু কিছু না বলেই সেই এলোচুল, উন্মাদিনি কেঁদে, বুক চাপড়ে ছোটাছুটি করতে করতে বনের ভিতরে চলে গেল। ক্রমশ নারীটির আর্তনাদ ক্ষীণ হয়ে আসে… তিনি ভয়ে অনুভূতি রহিত এক নির্জীব, নিস্তেজ জড় পদার্থের মতো দাঁড়িয়ে রইলেন। কাঠগোলাপ গাছের নিচ থেকে একটা ছোট বাচ্চার কান্নার মিহি সুরের শব্দ ভেসে আসছে। সেটা কাঁদতে কাঁদতে জঙ্গলের দিকে মিলিয়ে গেল। কান্নার করুণ সুর বিস্তৃত শালবনে প্রতিধ্বনিত হতে লাগল। কোথাও দূরে একদল খেঁকশেয়াল হুক্কা হুয়া ডেকে উঠল আপনখেয়ালে। কয়েকটা নিশাচর পাখি কর্কশ স্বরে ডাকতে ডাকতে ডানা ঝাপ্টিয়ে বনের ভিতরে মিলিয়ে গেল।
এটা হতে পারে না। এটি হওয়ার কোনও উপায় নেই।
‘মামুন, এটা কি তুমি?’
“হ্যাঁ, আসলাম আমি আপনাকে দেখতে এসেছি। কেন আপনি আমাকে সেই আগুনে মরতে রেখেছিলেন তা জানতে আমি ফিরে এসেছি।’
ঘরের চারপাশে হাঁটতে হাঁটতে আসলাম ঘামতে শুরু করলেন, সারা শরীর অবশ হয়ে আসছে, তার মাথার চুল খাঁড়া হয়ে গেল, গলা শুকিয়ে গেল। আস্তে আস্তে রান্নার জায়গায় ঢুকে ঢকঢক করে গ্লাসের পানিটা খেয়ে নিলেন। তার শির দাঁড়া বেয়ে একটা ঠান্ডা শ্রোত নেমে গেল।
‘তুমি এখানে থাকতে পারবে না। তুমি মৃত, তুমি কারখানার আগুনে মারা গেছ।”
“আমি কি মরে গেছিলাম? আমার লাশ কখনো পাওয়া যায়নি, আসলাম সাহেব। আপনি কীভাবে নিশ্চিত হতে পারলেন যে আমি মৃত?”
“মামুন, আমি তোমাদের হত্যা করিনি। আমি, আমি তোমাকে খুঁজে বের করার অনেক চেষ্টা করেছি, কিন্তু আগুনটি খুব শক্তিশালী ছিল।”
“মিথ্যাবাদী! আপনি জানতেন আমি কোথায় ছিলাম। আপনার সাহায্যের জন্য সকলে আর্তচিত্কার করেছিলাম এবং আপনি আমাদের ডাকে সাড়া দেননি, আমাদের বাঁচানোর কোন চেষ্টাই করেননি। এমন কি ফ্যাক্টরির দরজাগুলো ভালোভাবে বন্ধ করে রেখেছিলেন যাতে আমরা বের হতে না পারি।”
“মামুন, এটি সত্য নয়। তুমি সবসময় আমার একজন পছন্দের সুপারভাইজার ছিলে, আমি তোমার যতু নিয়েছিলাম। আমি এখনও তোমার সম্পর্কে যতুশীল …
“না, আপনি শুধু লাভের কড়ি গুনেছিলেন। টাকা, ফ্যাক্টরিতে যে বীমা ছিল তার যতœ নিয়েছিলেন। এজন্যই আপনি আগুনের খেলা শুরু করেছিলেন। আমাদের অবহেলা করেছেন, নিরাপত্তার কোন ব্যবস্থায়ই নেননি।”
কথাগুলো শুনে এ প্রচন্ড গরমেও কনকনে একটা ঠান্ডার শ্রোত তার শরীরটাকে কাঁপিয়ে দিয়ে গেল।
“না মামুন। এটা সত্যি না।”
“আসলাম সাহেব, টাকা কোথায়? আমাদের টাকা কোথায় লুকিয়ে রেখেছেন?”
ঘরের আশেপাশে চোখ পড়তে গিয়ে আসলাম আগের চেয়েও বেশি ঘামছিলেন।
“এটি ঠিক এভাবে ঘটনি। আগুন প্রায় তিরিশ বছর আগে লেগেছিল…” বিড়বিড় করে আসলাম সাহেব।
“আমি, আমি তোমাদের টাকাপয়সা নষ্ট করিনি। আমি তা পারি না।” উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করতে গিয়ে আসলাম সাহেব থরথর করে কেঁপে উঠলেন। তিনি টিভির সুইচটি ‘অফ’ করে দিয়েছেন তবে কন্ঠস্বরটি তখনো শোনা যাচ্ছিল।
“আপনি এটি ব্যয় করতে পারবেন না কারণ আপনি এটির পূজা করেন। এর সামান্যও ব্যয় করার চিন্তাভাবনা আপনি সহ্য করতে পারবেন না।”
ঝড় থেমে গেছে। বিদ্যুত চলে গেছে। টেবিল ল্যাম্প-আলো-আঁধারিই এখন ভরসা। ঠিক যেন পঞ্চাশ বছর আগের ঘুটঘুটে অন্ধকারে মিটমিটে কুপির শেষ দীর্ঘশ্বাস ছড়ানো মৃতপ্রায় ফ্যাকাশে আলো।
আসলাম সাহেব আশেপাশে তাকালেন, কি বলবেন তা জানেন না। অদৃশ্য কণ্ঠটি আবারও কথা বলল। ঘরের চারপাশে বিভিন্ন রঙের গোলক ভেসে উঠল। ছায়াগুলি মেঝে এবং সিলিং জুড়ে হামাগুড়ি দিতে লাগল… সিঁড়ি এবং করিডোর থেকে কানে ভেসে এল ভারী পায়ের শব্দ। কিন্তু তা মানুষের পায়ের শব্দ বলে মনে হল না। টিভিটি এলোমেলো ও স্বয়ংক্রিয়ভাবে চালু বা বন্ধ হচ্ছিল।
“আসলাম সাহেব, আপনি জানেন আপনাকে কী করতে হবে। এটা অনেক আগের ঘটনা। আপনার অবশ্যই ভুলের সংশোধন করা উচিত, সকলের ক্ষতিপূরণ দেয়া উচিত। আমাদের সন্তানরা এখনও খুব কষ্টকর জীবনযাপন করছে।”
আসলাম সাহেব তার রুমের মধ্যে আবারও কোনও প্রকৃত শারীরিক সত্বার সন্ধানের চেষ্টা করে ঘরে ঘুরে বেড়াতে লাগলেন। আশেপাশে কাউকে দেখতে পেলেন না। তবে মনে হল কেউ একজন দক্ষিণের বারান্দায় নরম পায়ে নীরবে ও খুব সন্তর্পণে হেঁটে রুমের দিকে আসছেন। আসলাম কে, কে বলতেই হাঁটার শব্দ থেমে গেল। তার বুঝতে বুঝতে বাকি রইলো না যে এটা কোন অপরিচিত আত্মা। আসলাম সাহেব কাঁপতে কাঁপতে খাটে বসেন।
প্রেতাত্মাটা কর্কশ স্বরে কথা বলতে শুরু করল।
আসলাম সাহেব আস্তে আস্তে শান্ত হতে শুরু করলেন। নিজেকে একটু সামলে নিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, “কে, কে তুমি? তুমি কি ফারুক? যে আমার সবচেয়ে বিশ্বস্ত কর্মী ছিল।”
“হ্যাঁ, আমি ফারুক, আমি আপনাকে অনেক দিন ধরে খুঁজছি। আমি এখনও ভেবে পাই না আপনি কিভাবে আমার সাথে এত বড় বিশ্বাসঘাতকতা করতে পারলেন? টাকার লোভ দেখিয়ে কারখানায় আমাকে দিয়ে আগুন দেওয়ালেন। অথচ যখন আমি আগুনে পুড়তে লাগলাম, আপনি কারখানায় থেকেও আমাকে বাঁচানোর কোন চেষ্টাই করেননি।”
“না, না, ফারুক, তুমি সত্য বলছো না। আমি তোমাকে উদ্ধারের অনেক চেষ্টা করেছি। ভাগ্য খারাপ। সে সময় সাভারে কোন দমকল অফিস ছিল না। টঙ্গী থেকে দমকল আসার সময় তুরাগ সেতুর কাছে ট্রাফিক জ্যামে আটকা পড়ায় তোমাকেসহ কুড়িজন শ্রমিকের জীবন বাঁচাতে পারিনি। আমি মনে করেছিলাম, শুধু ভবনটি পুড়ে যাবে, আমি ইন্স্যুরেন্সের অনেক টাকা পাব। কিন্তু এতগুলো মানুষের মৃত্যু হবে তা আমার ভাবনাচিন্তাতে আসেনি।”
“মিথ্যা কথা, বিশ্বাসঘাতক। আপনার এসব কথা একটা শিশুও বিশ্বাস করবে না। আপনি যদি এতই ভাল মানুষ হতেন, আমাগো কথা ভাবতেন তবে অন্তত আমার পরিবারকে ক্ষতিপূরণের টাকা দিতেন। আমাদের পোলামাইয়াগুলি এখনও ভিক্ষা কইরা বেড়াইতেছে…।”
একটা অপরাধবোধে ভুগতে শুরু করলেন আসলাম সাহেব। তিনি বিচলিত হয়ে পড়লেন। বিকারগ্রস্তের মতো ছোট চামড়ার ব্যাগে বিমার কাগজটা খুঁজতে লাগলেন। অনেক দিনের পুরনো কাগজ, ঝাপসা হয়ে আসা চশমার কাচ ভেদ করে ঠিকমত পড়তে পারলেন না। তিনি দ্রুত রান্নাঘরে ঢুকে একটা কলম তুলে নিলেন। নোটটি সংক্ষিপ্ত ছিল কারণ বলার মতো খুব বেশি কিছু ছিল না। তিনি কলমটি নামিয়ে পুরানো গ্যাসের চুলার কাছে গেলেন। যেন একটা ঘোরের মধ্যে, আসলাম সাহেব বার্নারগুলির সমস্ত নব চালু করে দিলেন এবং ঘরটি গ্যাসে ভরে দিলেন। তিনি বাতিকগ্রস্তের মতো মাটিতে পড়ে ঘরের প্রাচীরে হেলান দিয়ে বসলেন।
পরের দিন ভোরে দমকল বিভাগ ও পুলিশ রিসোর্টে আসলো, ভবনে গ্যাসের দুর্গন্ধের জন্য ৯৯৯ ফোন পেয়ে তারা এখানে আসে। বিল্ডিংয়ের গ্যাস বন্ধ করে দেওয়া হলো এবং দমকল কর্মীরা দরজা ভেঙ্গে ঘরে ঢুকল। আসলাম সাহেবের নরম লাশটি সেন্টার টেবিলটার এক পাশে উপুড় হয়ে পড়ে আছে। বেসিনে জমাট বেঁধে আছে রক্ত। লেখক: গল্পকার