ভজন সরকার : ‘বাংলাদেশ এখন ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে’ -স্বাধীনতার পর থেকেই এ কথাটা শুনে শুনে মুখস্থ হয়ে গেছে। কিন্তু বাংলাদেশের সেই কথিত ক্রান্তিকাল যেন শেষই হচ্ছে না। স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্ণ হলো। পদ্মা-মেঘনা-যমুনা -ধলেশ্বরী-বুড়িগংগা দিয়ে অনেক জল গড়াল। ৭ কোটি মানুষ মাত্র ৫০ বছরেই বেড়ে প্রায় ৩ গুন হলো। যার প্রায় একক নেতৃত্বে দেশ স্বাধীন হলো, সেই কালজয়ী মানুষটাকেই হত্যা করা হলো।
রাজনীতির কত চড়াই-উৎড়াই পেরোল। জীবনযাত্রার পরিমাপক সূচকের উন্নতিতে সারা বিশ্ব চমকেও উঠলো। অনুন্নত থেকে উন্নয়নশীল দেশে রূপান্তরিত হলো বাংলাদেশ। নিম্ন আয়ের দেশ থেকে মধ্যম আয়ের দেশের এক চমকপ্রদ উন্নতির সোপান পেরোলো। দাতাসংস্থার রক্ত চক্ষুকে বৃদ্ধাংগুলি দেখিয়ে হাজার হাজার কোটি টাকার মেগা প্রজেক্ট নিজের অর্থায়ণেই বাস্তবায়ন করছে বাংলাদেশ। এককথায়, বাংলাদেশবিরোধী কিংবা বাংলাদেশের চরম শত্রুও বলতে পারবে না যে, বাংলাদেশের উন্নতি হয়নি।
এতো সব উন্নয়ন সত্বেও বাংলাদেশের সাথে ওই “ক্রান্তিকাল” শব্দটি যেন কিছুতেই পিছু ছাড়ছে না। যুদ্ধবিধ্বস্ত একটি দেশ, সাথে অনভিজ্ঞ রাজনীতিবিদ এবং প্রশাসনযন্ত্র। আভ্যন্তরিন এবং বিদেশী ষড়যন্ত্র। মাত্র ২ বছরেই সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশকে পরাজিত শক্তির ঘনিষ্ঠ দোসর আরেকটি পরাশক্তি এক চরম শিক্ষা দিলো। কৃত্রিম এক দুর্ভিক্ষাবস্থা তৈরী করে স্বাধীনতার নেতৃত্বের ক্ষমতাসীন দল এবং সরকারকে বুঝিয়ে দিলো যে, তারা ইচ্ছে করলে অনেক কিছুই করতে পারে।
পরাজিত পাকিস্তানের দোসররা যে ইচ্ছে করলে অনেক কিছুই করতে পারে সেটি বাস্তবায়ণ করে দেখাল মাত্র ১ বছর পরেই। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট স্বাধীনতার স্থপতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করে বুঝিয়ে দিল সেটি। একটি রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে প্রাপ্ত একটি দেশের স্বাধীনতার নেতৃত্বদানকারী নেতাকে মাত্র ৩ বছর পরে এমনভাবে হত্যা করা যায়- এর চেয়ে ক্রান্তিকাল আর জাতির জীবনে কি থাকতে পারে?
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের সেই ক্রান্তিকালের ব্যাপ্তি যেন আরো ৪৫ বছর ধরে চলছে। এই ৪৫ বছরে নামে-বেনামে সামরিক শাসকেরা প্রায় ৩ দশক রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় থেকেছে। গনতন্ত্রের মূল কাঠামোগুলোকে তো ধ্বংস করেছেই, সেই সাথে যে চেতনার উপরে বাংলাদেশের স্বাধীনতা এসেছিল সেই চেতনার মূলকেও উপড়ে ফেলে দিয়েছে। বাহ্যিকভাবে এই অপকর্মগুলোকে তেমন গুরুত্বপূর্ণ মনে না হলেও এর দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব ভয়ঙ্কর এবং আধুনিকতার বিপক্ষে।
বাঙালির ভুল এবং অনুশোচনার ফিরিস্তি বিশাল। দূর অতীত তো বটেই ১৯৪৭ সালের দেশভাগ বিবেচনায় নিলেও অনুশোচনার ফিরিস্তি লিখতে কয়েক দিস্তা কাগজ লেগে যাবে। দ্বিজাতিতত্তে¡র প্রতি বাঙালির আনুগত্য ছিল প্রশ্নাতীত। শেরে বাংলা ফজলুল হক, মওলানা ভাসানী কিংবা হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দি কেউই পাকিস্তানের বিপক্ষে ছিলেন না। এমনকি পূর্ববঙ্গের প্রায় সব নেতাই পক্ষে ছিলেন হাজার মাইল দূরের পশ্চিম পাকিস্তানের সাথে যুক্ত হয়ে একটি পূর্ণাঙ্গ পাকিস্তান রাষ্ট্র গঠনের।
পূর্ববঙ্গের পাকিস্তান-পছন্দ জনগোষ্ঠীর ভুল ভাঙ্গতে এক বছরের বেশী সময় লাগেনি। পরের বছরই গন পরিষদে বাংলা ভাষার উপর আঘাত আসে। মূল আঘাত আসে ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি। দেশভাগের পরে বাঙালির প্রথম ভুলের বলী সালাম, রফিক, বরকতসহ ভাষা শহীদেরা। এর পরের ইতিহাস তো সবার জানা। বাঙালির অনুশোচনার পাহাড় জমতে জমতে শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ, বাঙালির মুক্তিসংগ্রাম। একটি স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের অভ্যুদয় তো বাঙালির ঠেকে শেখার ফসল, বাঙালির ভুল শুধরে নেওয়ার প্রায়শ্চিত্ত।
তাই বলে কি ১৯৭১-এ বাঙালির আত্মশুদ্ধির চূড়ান্ত বোধদয় ঘটে? না, অবশ্যই নয়। মাত্র ৪ বছর পরে ১৯৭৫ সালেই স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্নদ্রষ্টা মুক্তিসংগ্রামের অগ্রনায়ক জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করা হয়। হত্যা করা হয় জাতীয় চার নেতাকে, যাঁরা ১৯৭১ সালে বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব দিয়ে দেশ স্বাধীন করেছিলেন। যতই সামরিকবাহিনির কিছু বিপদগামী এবং উচ্চাভিলাষী অফিসারের দোষ দেওয়া হোক, যতই আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের কথা বলা হোক; এটা তো অস্বীকার করার উপায় নেই যে সে সময়ের ক্ষমতাসীন দলসহ দেশের সকল রাজনৈতিক দল তখন নিশ্চুপ ছিল।
নিশ্চুপ ছিল বললেও কম বলা হবে, সে সময় অধিকাংশই এতবড় একটা নৃশংস হত্যাকান্ডের প্রতিবাদ পর্যন্ত করার সাহস দেখায়নি। স্বাধীন দেশে স্বাধীনতার স্থপতিকে এমনভাবে হত্যা করা হলো, অথচ তাঁর নিজের হাতে গড়া বিশাল রাজনৈতিক দল আওয়ামি লিগ তো প্রায় নিশ্চুপ থাকলো? এ অনুশোচনা এবং ব্যর্থতা থেকে বাঙালি এখনো বেড়িয়ে আসতে পেরেছে কি?
১৯৭৫ সালের রাজনৈতিক পরাজয়ের কুফল তো বাংলাদেশ পেয়েছে। একটি জাতিগোষ্ঠী ১৯৭১ সালে ত্রিশ লক্ষ মানুষের জীবন এবং লক্ষ-লক্ষ মা-বোনের চরম আত্মত্যাগের বিনিময়ে যা অর্জন করেছিল, ১৯৭৫-এ জাতির জনকের হত্যাকান্ডের মধ্যে দিয়ে তা প্রায় নিঃশেষ হয়ে গিয়েছিল। নিঃশেষ তো হতোই যদি না জাতির জনকের কন্যা সন্তানদ্বয় বিদেশে থাকার কারণে অলৌকিকভাবে প্রাণে বেঁচে না যেতেন।
১৯৭৫ থেকে আবার অবক্ষয়ের শুরু এবং তা চলছিলো অপ্রতিরোধ্য গতিতে। ১৯৭৫-এর পরেও দেখি রাজনৈতিক নেতৃত্বের ব্যর্থতা, অনেক রাজনৈতিক নেতার নিঃশর্ত আত্মসমর্পন সামরিক একনায়কের কাছে। এই অধঃপতন তো চলতোই যদি বংগবন্ধুর কন্যা শেখ হাসিনা ফিরে না আসতেন, পিতার রক্তের ঋণ শোধ করতে যদি বাঙালির পাশে না দাঁড়াতেন।
তবুও কি থেমেছে বিশ্বাসঘাতক বাঙালির ষড়যন্ত্র? বঙ্গবন্ধুর কন্যা শেখ হাসিনা বারবার আক্রান্ত হয়েছেন। বংগবন্ধুর কন্যা শেখ হাসিনার জীবননাশের চেষ্টা হয়েছে অসংখ্যবার। দীর্ঘ ২১ বছর লেগেছে বাঙালির ভুল বুঝতে, অনুশোচনায় অনুতপ্ত হতে।১৯৯৬ সালে মুক্তিযুদ্ধের সরকার ক্ষমতায় এসেছে। তবুও কি আত্মঘাতী বাঙালি ভুল শুধরে সঠিক পথ নিয়েছে? মাত্র ৫ বছর পরে ২০০১ সালে আবার সা¤প্রদায়িক শক্তি, মুক্তিযুদ্ধের পরাজিত শত্রু বিএনপি-জামায়াত ক্ষমতায় এসেছে নানা ষড়যন্ত্রে। আবার চলেছে পেছন যাত্রা, আবার রথের উল্টো টান।
এবার তো ১৯৭৫ সালের অসমাপ্ত কাজকে প্রায় সমাপ্ত করে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের নাম-নিশানাই মুছে ফেলার চেষ্টা করা হয়েছে ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট। গ্রেনেড হামলা করে বংগবন্ধুর কন্যা শেখ হাসিনাকে হত্যা করার উদ্দেশ যদি সফল হতো, তবে বাঙালির আশা-আকাংক্ষার সলতে চিরতরে নিভে যেতো। এবারেও বংগবন্ধুর কন্যা শেখ হাসিনা প্রাণে বেঁচে যান। ক্ষমতাতেও আসেন বাংলাদেশের মানুষের বিশাল সমর্থন নিয়ে ২০০৮ সালের নির্বাচনে।
১৯৭৫ সালে যে প্রদীপ স্তিমিত হয়েছিল তা আবার জ্বলে উঠেছে। পরপর ৩ বার রাষ্ট্র ক্ষমতায় আছে স্বাধীনতার নেতৃত্বদানকারী দল বাংলাদেশ আওয়ামি লিগ। বাংলাদেশে উন্নয়ন হয়েছে অভাবনীয়। কিন্তু অবনমনও হয়েছে অনেক ক্ষেত্রেই। ধর্মীয় মৌলবাদ এবং সা¤প্রদায়িকতা মাথা চারা দিয়ে উঠেছে। মানুষের নৈতিক অবক্ষয় হয়েছে। জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক চক্রান্তে জংগীবাদও গঁজিয়ে উঠেছিল; যদিও তার বিষদাঁত ভেংগে দেওয়া হয়েছে আগেই। কিন্তু তার রেশ তো কিছু রয়ে গেছেই।
১৯৭১ সালের পরাজিত শক্তি কী করে ডালাপালা গজিয়ে নতুন করে বেঁচে উঠলো, সে তাত্তি¡ক আলোচনা হবে এবং করাও যাবে ভবিষ্যতে। কার দায় বেশী, কার দায় কম সে চুলচেঁড়া বিশ্লেষণও করা যাবে। অনুশোচনার আত্ম-উপলব্ধি এবং আত্ম-সমালোচনার সময়ও পড়ে আছে। কিন্তু এখন সময় হয়েছে এই ধর্মীয় মৌলবাদী সা¤প্রদায়িক শক্তিকে প্রতিরোধ করার। উপড়ে ফেলতে হবে সা¤প্রদায়িক এই বিষবৃক্ষের শেকড়। এটাই হোক ২০২১ সালের ১৫ আগস্টে বাংলাদেশের অঙ্গীকার। জয় বাংলা।
ভজন সরকারঃ কবি, লেখক, কথাসাহিত্যিক এবং প্রকৌশলী। হ্যামিল্টন, কানাডা