অনলাইন ডেস্ক : করোনার টিকা নিয়ে মানুষের মাঝে যে ভয় ছিল তা অনেকটাই কেটে গেছে; তৈরি হয়েছে আগ্রহ। ভয়ভীতি ও গুজব ঠেলে টিকা নিতে কেন্দ্রগুলোয় ভিড় করছেন সাধারণ মানুষ। সমাজের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের টিকা নিতে দেখে সাধারণ মানুষের উৎসাহ বেড়েছে। টিকাদানের শুরুর প্রথম দুদিন থেকে গতকাল মঙ্গলবার কেন্দ্রগুলোয় ভিড় ছিল বেশি। তবে টিকা গ্রহণের কতদিন পর অ্যান্টিবডি তৈরি হয় এ নিয়ে নানা আলোচনা আছে। বাংলাদেশের বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ১৪ দিন পর অ্যান্টিবডি তৈরি হতে শুরু করে।

গতকাল ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়, মুগদা হাসপাতালসহ কয়েকটি হাসপাতালে টিকাদান কেন্দ্রে গিয়ে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মানুষকে দেখা গেছে। নিবন্ধনকারীর সংখ্যাও বেড়েছে আগের চেয়ে অনেক।

ঢাকা মেডিক্যাল কলেজে ষাটোর্ধ্ব এক নারী টিকা নিয়ে বেশ হাস্যোজ্জ্বল ছিলেন। আমাদের সময়ের সঙ্গে আলাপকালে তিনি বলেন, করোনা মানসিকভাবে তাকে খুবই ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। টিকা গ্রহণের পর অনেকটা নির্ভার লাগছে। এতদিন করোনা আক্রান্ত হওয়ার ভীতি থাকত। টিকা নেওয়ায় সেই দুশ্চিন্তা একেবারেই চলে গেছে।

কুয়েত মৈত্রী হাসপাতালেও গত দুদিনের তুলনায় টিকা নিতে আসা মানুষের ভিড় বাড়ার কথা জানান হাসপাতালের সমন্বয়ক ডা. শিহাব উদ্দিন। সাংবাদিকদের তিনি জানান, মঙ্গলবার ৪৫০ জনকে টিকা নিতে ‘অ্যাপয়েন্টমেন্ট’ দেওয়া হয়েছিল। তবে টিকা নিয়েছেন ৪৮৬ জন। রেজিস্ট্রেশন ছাড়াও অনেকে এসেছেন। তাদের তাৎক্ষণিক রেজিস্ট্রেশন করিয়ে টিকা দেওয়া হয়েছে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যমতে, গণপ্রয়োগ শুরুর তৃতীয় দিন গতকাল মঙ্গলবার টিকা নিয়েছেন ১ লাখ ১ হাজার ৮২ জন মানুষ। এর মধ্যে ৯৪ জনের শরীরে অল্পমাত্রার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। টিকার নিবন্ধন করেছেন আরও ১ লাখ ৭৮ হাজারের বেশি। এ নিয়ে নিবন্ধনকারীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৬ লাখ ৯০ হাজার ৬৩ জন।

এদিকে টিকার নিবন্ধন করার জন্য এখনো চালু হয়নি অ্যাপস। তবে অনলাইনে নিবন্ধন চলছে। যারা অনলাইনে নিবন্ধন করতে পারছে না, তাদের টিকাদান কেন্দ্র থেকে নিবন্ধন কাজে সহায়তা করা হচ্ছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার কোভিড-১৯ টিকা ৭০ শতাংশ জনগণকে সুরক্ষা দিতে পারবে। প্রথম ডোজ টিকা নেওয়ার ১৪ দিন পরই টিকা গ্রহণকারীর দেহে অ্যান্টিবডি তৈরি হতে শুরু করে। টিকা ২১ দিন পর অ্যান্টিবডি শনাক্ত করার পর্যায়ে আসে। তবে এই অ্যান্টিবডি কত দিন পর্যন্ত স্থায়ী হবে তা এখনই বলা যাবে না।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যমতে, ঢাকার ৫০টি হাসপাতাল ও ঢাকার বাইরে সারাদেশে ৯৫৫টি হাসপাতালসহ মোট ১ হাজার ৫টি হাসপাতালে ২ হাজার ৪০০ টিম টিকাদান কার্যক্রম পরিচালনা করছে। এসব টিম গতকাল সকাল ৮টা থেকে দুপুর আড়াইটা পর্যন্ত ১ লাখ ১ হাজার ৮২ জনকে টিকা দিয়েছে। এ নিয়ে দেশে এখন পর্যন্ত টিকা গ্রহণকারী সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৭৯ হাজার ৩১৮ জন। এর পুরুষ ৭৪ হাজার ৫৮৬ জন ও নারী ২৬ হাজার ৪৯৬ জন রয়েছেন। এখন পর্যন্ত টিকা গ্রহণকারীদের মধ্যে ২০৭ জনের দেহে অল্পমাত্রার পাশর্^প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে।

বিভাগীয় পর্যায়ে রাজধানীসহ ঢাকা বিভাগে টিকা নিয়েছেন মোট ২৫ হাজার ২২০ জন। ময়মনসিংহ বিভাগে ৪ হাজার ৮৫৫, চট্টগ্রামে ২৩ হাজার ৫৪৪, রাজশাহীতে ১৩ হাজার ১১৪, রংপুরে ১০ হাজার ২৩৭, খুলনায় ১১ হাজার ৩৭২, বরিশালে ৪ হাজার ১৮১ এবং সিলেটে ৮ হাজার ৫৫৯ জন রয়েছেন। যারা গতকাল টিকা নিয়েছেন তাদের মধ্যে ৯৪ জনের শরীরের অল্পমাত্রায় পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা গেছে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যমতে, টিকা কার্যক্রমের শুরুর পর প্রথম দিনে নিবন্ধন করেন ১ হাজার ২৫৩ জন। এরপর একই ধারায় চলতে থাকে নিবন্ধন। পরে ৪ ফেব্রুয়ারি থেকে বাড়তে থাকে। ওই সময়ে ৩০ থেকে ৩৫ হাজার মানুষ টিকার জন্য নিবন্ধন করতেন। আর এখন প্রতিদিন করছেন ১ লাখের বেশি মানুষ।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হিসাব বলছে, গত ৮ ফেব্রুয়ারি একদিনে নিবন্ধন করেছেন ১ লাখ ৩ হাজার মানুষ। আর গতকাল নিবন্ধন নিয়েছেন ১ লাখ ৭৮ হাজার ৫৮ জন মানুষ। এই পরিসংখ্যান স্পষ্ট, দেশে করোনার টিকা গ্রহণে মানুষের আগ্রহ বাড়ছে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (প্রশাসন) অধ্যাপক ডা. নাসিমা সুলতানা বলেন, দেশে টিকা গ্রহণে আগ্রহী মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। বাড়ছে নিবন্ধন কার্যক্রম। যারা নিবন্ধন করতে গিয়ে কোনো সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছেন তারা টিকাদান কেন্দ্রে নিবন্ধন করতে পারছেন। ইতোমধ্যে আমাদের এই কার্যক্রম শুরু হয়ে গেছে।

বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া অঞ্চলের সাবেক উপদেষ্টা অধ্যাপক ডা. মোজাহেরুল হক বলেছেন, কোনো টিকা শতভাগ সুরক্ষা দেয় না। এ পর্যন্ত আবিষ্কৃত টিকাগুলো ৯৩ শতাংশ সুরক্ষা দিতে পারে। বাংলাদেশে প্রয়োগকৃত ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউটে প্রস্তুত টিকা ৭০ শতাংশ সুরক্ষা দিতে পারবে। তিনি আরও বলেন, এখন প্রশ্ন হচ্ছে এই সুরক্ষা কতদিন দিতে পারবে? এ বিষয়ে নিশ্চিত হতে হচ্ছে, আরও গবেষণা লাগবে। তবে টিকা নেওয়ার পরেও সংক্রমণের ঝুঁকি ও সংক্রমিত করার ঝুঁকি আছে ও থাকবে। বিস্তারিত জানতে বিশ্বকে আরও গবেষণার ফলের জন্য অপেক্ষা করতে হবে। তবে টিকা একটি বিরাট জনগোষ্ঠীকে সুরক্ষা দেবে কিন্তু তাদেরও স্বাস্থ্যবিধি কঠোরভাবে মেনে চলতে হবে।

করোনা ভাইরাসের কমিউনিটি ট্রান্সমিশনের পরিপ্রেক্ষিতে উদ্ভূত চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার লক্ষ্যে গঠিত সরকারের ‘জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটির’ সদস্য ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম আমাদের সময়কে বলেন, করোনার টিকা গ্রহণের দুই সপ্তাহ পর দেহে অ্যান্টিবডি তৈরি হতে শুরু হবে। প্রথমে অ্যান্টিবডি কম হবে, ধীরে ধীরে বাড়তে থাকবে। টিকা নেওয়ার ১৫ দিন পার হওয়ার পর টেস্ট করলে সেটি ডিটেক্টেবল লেভেল পাওয়া যাবে। প্রথমে যারা টিকা নেবে তাদের অ্যান্টিবডি টেস্ট করে দেখা উচিত। তাহলে আমরা টিকার কার্যকারিতা বুঝতে পারব।

অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম বলেছেন, আমরা যদি অ্যান্টিবডির রেসপন্সটা দেখতে পারতাম, তাহলে আমাদের হাতে একটি রেকর্ড থেকে যেত। আমরা যেসব টিকা দিয়েছি, সেটি পপুলেশনে অ্যান্টিবডি রেসপন্স এত দিন শুরু হয়, এত দিন পর এই লেভেলে আসে- এগুলো আমরা পেয়ে যেতাম। এই অ্যান্টিবডি দেখার জন্য কয়েকটি গ্রুপে (যেমন- ৫৫ থেকে ৬০ বছর, ৬০ থেকে ৭০ বছর, ৭০ থেকে ৮০ বছর) ভাগ করে প্রতিটি গ্রুপ থেকে ২৫-৩০ জনের টেস্ট করা যেতে পারে। এটি তা হলে আমরা জানতে পারতাম। সেই কাজের প্রস্তুতি দেখছি না। আইইডিসিআরকে এগুলো করার পরামর্শ দিয়েছি। এগুলো পরামর্শ দিয়ে করাটা অনেক সময়ের ব্যাপার। যেহেতু টিকা প্রদান শুরু হয়ে গেছে, তাই অ্যান্টিবডি রেসপন্স দেখার জন্য এই কাজ দ্রুত শুরু করা দরকার।

রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডা. এএসএম আলমগীর আমাদের সময়কে বলেন, করোনার টিকার প্রথম ডোজ নেওয়ার ১ সপ্তাহ পর অ্যান্টিবডি তৈরি শুরু হবে। ৩ সপ্তাহ পরে ডিটেক্টবল হবে। আর দ্বিতীয় ডোজ নেওয়ার ১ সপ্তাহ পরই মোটামুটি অ্যান্টিবডি তৈরি হয়ে যাবে। প্রথম ডোজের ২১ দিন আর দ্বিতীয় ডোজের ৭ দিন পর অ্যান্টিবডি পাওয়া যাবে। করোনা টিকার দুটি ডোজ নিলে ৭০ থেকে ৯০ শতাংশ অ্যান্টিবডি তৈরি হবে। করোনার টিকা নেওয়ার পর কিছু মানুষ সংক্রমিত হতে পারে। তবে তারা সংক্রমিত হলে মারাত্মক হবে না। এ কারণে টিকা নিলেও মাস্ক পরতে হবে।