অনলাইন ডেস্ক : স্মরণকালের কঠিন ও ভয়াবহ আর্থিক মন্দায় পড়ছে বৃটেন। ২০০৮ সালের আর্থিক সংকটের পর এমন কঠিন মন্দায় পড়তে যাচ্ছে জি-৭ভুক্ত দেশটি। চার বছর ধরে অনিশ্চয়তায় বেক্সিট সংকট। ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও বৃটেনের মধ্যে ব্রেক্সিট-পরবর্তী বাণিজ্য চুক্তি সংক্রান্ত আলোচনায় ঐকমত্যের সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না৷ ইউরোপীয় পার্লামেন্ট বিলম্বের পরিণাম সম্পর্কে সতর্ক করে দিচ্ছে৷ আগামী ১জানুয়ারি বৃটেন পাকাপাকিভাবে ইইউ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বে৷ দুই পক্ষের মধ্যে চুক্তি স্বাক্ষরিত না হলে অর্থনীতি মারাত্মক ধাক্কা খাবে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন। চুক্তি অনুমোদনের সময় নিয়েও দুশ্চিন্তা বাড়ছে৷ ২৭টি ইইউ সদস্য দেশ ও ইউরোপীয় পার্লামেন্ট চুক্তি অনুমোদন না করলে সেটি ১জানুয়ারি কার্যকর হবে না৷
বেক্সিট সংকট ও করোনাভাইরাস মহামারীর ফলে সৃষ্ট এ মন্দা ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়াবহ মন্দা হিসেবে আবির্ভূত হচ্ছে। প্রাণঘাতী করোনার ছোবলে একেবারে ছানাবড়া দশা। বড়দিনের ছুটির ফলে পরিস্থিতি আরও জটিল হতে পারে৷ গত এক যুগ পর বৃটেন এমন কঠিন পরিস্থিতি মোকাবেলা করছে। নড়বড়ে হয়ে গেছে অর্থনীতি।
আমদানী-রপ্তানী খাতে সবচেয়ে বেশি সংকট সৃষ্টি হয়েছে। এর ফলে বড় ধরনের ধাক্কা লাগতে পারে ভারত ও বাংলাদেশ সহ এশীয় অঞ্চলের দেশ সমূহে। বৃটেন যাদের গুরুত্বপূর্ণ রপ্তানী গন্তব্য।
বৃটেনে ৪ সপ্তাহের চলমান ন্যাশনাল লকডাউন শেষ হচ্ছে আগামী ২ ডিসেম্বর। লকডাউন শেষ হওয়ার আগেই পরবর্তী পরিকল্পনা প্রকাশ করেছেন প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন। ক্রিসমাস তথা বড়দিনকে সামনে রেখে লকডাউন উঠানোর পাশাপাশি রাত ১০টা পরের কারফিউ উঠে যাবে বলে ঘোষণা দিয়েছেন। সোমবারের ঘোষণায় প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, বুদ্ধিমান সাবধানতা ছাড়া উপায় নেই। শীতকালীন এবং নতুন বছরের শুরুতে ভাইরাসের উত্থান ঘটতে পারে। ২ ডিসেম্বর লকডাউন শেষ হলে ক্রিসমাসের ব্যবসায়ে সুযোগ দিতে জিম, অবসর কেন্দ্র এবং হেয়ারড্রেসার, সেলুন, পাব ও রেস্তোরাঁ সমূহ আবার খোলার অনুমতি দেয়া হবে। পাশাপাশি উপাসনা এবং বিবাহ অনুষ্ঠান পুনরায় শুরু হবে।
বৃটেনে ভ্রমণকারীদের জন্য কোয়ারেন্টিনের সময়ও কমছে। বিদেশ ফেরত ব্যক্তিদের আগে ১৪ দিন সেলফ-আইসোলেশনে থাকতে হত। গত ৮ জুন থেকে দুই সপ্তাহের বাধ্যতামূলক কোয়ারেন্টিন পদ্ধতি কার্যকর হয়। নতুন নিয়ম অনুযায়ী ডিসেম্বরের ১৫ তারিখ থেকে ভ্রমণকারীদের মাত্র ৫দিন সেলফ-আইসোলেশনে থাকতে হবে। পরিবহনমন্ত্রী গ্রান্ট শাপস বলেন, এর ফলে আমরা ভ্রমণ শিল্পকে সাহায্য করছি। মহামারির ধাক্কা কাটিয়ে এ শিল্প ধীরে ধীরে যাতে পুনর্গঠিত হয়। আমাদের নতুন পরীক্ষা পরিকল্পনা ভ্রমণকারীদের আরও স্বাধীনভাবে চলাচল, প্রিয়জনের সঙ্গে সাক্ষাৎ এবং আন্তর্জাতিক ব্যবসা পরিচালনায় সাহায্য করবে।
গত এপ্রিল–জুন মাসেই বৃটেনের অর্থনীতি মারাত্মক ভাবে সংকুচিত হয়েছে। আশা করা হয়েছিল, মহামারীর কারণে জারি করা লকডাউন শিথিল হলে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড জোরেশোরে শুরু হবে। ঘুরে দাঁড়াবে অর্থনীতি। কিন্তু পরিস্থিতি হয়েছে উল্টো। অবস্থা দিনকে দিন খারাপের দিকেই যাচ্ছে। চ্যান্সেলর রিশি সুনাক স্বীকার করেছেন, ইতোমধ্যেই বহু মানুষের চাকরি চলে গেছে। আরো বেশি চাকরি হারানোর আশংকা রয়েছে। বাধ্য হয়ে আনুষ্ঠানিক ভাবে বৃটেন রিসেশন বা অর্থনৈতিক মন্দা ঘোষণা করেছে।
বৃটেনের কারী শিল্পে ধ্বস নেমেছে। এখানে এশীয় ১৮ হাজার রেস্তোরাঁর মধ্যে ১০ হাজারই বাংলাদেশি মালিকানাধীন। সবচেয়ে বেশি বিপর্যস্ত হচ্ছে এই হসপিটালিটি সেক্টর। এক্ষেত্রে প্রায় ২০ শতাংশ জিডিপি সংকুচিত হয়েছে। অফিস ফর ন্যাশনাল স্ট্যাটিসটিকস (ওএনএস) সুত্রে জানা গেছে, ইতিমধ্যে প্রায় ৩ লাখ মানুষ কর্মহীন হয়েছেন। এই সংখ্যা আরও বেশি বলে মনে করছে অভিজ্ঞ মহল। বিরোধী লেবার পার্টির মতে বৃটেনে ১ মিলিয়নের বেশি মানুষ বেকার হয়েছে।
আর্থিক মন্দায় অনুন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলোতে বৈদেশিক সাহায্য কমিয়ে দিচ্ছে বৃটেন। জাতীয় আয়ের শূন্য দশমিক ৭ শতাংশ বৈদেশিক সাহায্য খাতে খরচ করা হত। ২০১৫ সালে আইন করে এটা নির্ধারণ করা হয়েছিল। কিন্ত ২০২০–২১ অর্থবছরে তা জাতীয় আয়ের শূন্য দশমিক ৫ শতাংশ করা হয়েছে। সম্প্রতি মধ্যবর্তী বাজেট পর্যালোচনা বক্তব্যে চ্যান্সেলর এই তথ্য জানিয়েছেন। অর্থের হিসাবে এ বাজেট কর্তনের পরিমাণ প্রায় ৪ বিলিয়ন পাউন্ড, যা গত বছর খরচ হওয়া অর্থের চেয়ে প্রায় ২৯ শতাংশ কম। ২০১৯ সালে বৃটেন বৈদেশিক সাহায্য খাতে ১৪ দশমিক ৬ বিলিয়ন পাউন্ড খরচ করেছে। ঋষি সুনাক বলেছেন, করোনাভাইরাস মহামারির কারণে চলতি বছর বৃটেনের বাজেট ঘাটতির পরিমাণ বেড়ে হবে ৩৫০ বিলিয়ন পাউন্ড। ঘাটতির এমন চাপ সামলাতে কেবল চলতি বছরের জন্য এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে এ সহায়তার পরিমাণ আগের অবস্থায় ফিরিয়ে নেয়া হবে।
প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন ২০১৯ সালের জানুয়ারিতে পররাষ্ট্রমন্ত্রী থাকা অবস্থায় যুক্তরাজ্যের দেওয়া বৈদেশিক সাহায্য নিয়ে নিজের অসন্তোষের কথা প্রকাশ করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, কেবল সাহায্য হিসেবে নয়, যুক্তরাজ্যের জাতীয় স্বার্থ বিবেচনায় এ অর্থ ব্যয় করা উচিত। প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর তিনি নিজের চাওয়া পূর্ণ করেছেন। চলতি বছরের জুন মাসে বৈদেশিক সহায়তা বিতরণে নিয়োজিত ‘আন্তর্জাতিক উন্নয়ন দপ্তর‘ (ডিএফআইডি)-কে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে একীভূত করার ঘোষণা দেন। সেই ঘোষণা অনুযায়ী গত সেপ্টেম্বরে ডিএফআইডি বিলুপ্ত হয়। আর পররাষ্ট্র ও কমনওয়েলথ দপ্তরের নাম বদলে হয় ‘পররাষ্ট্র, কমনওয়েলথ ও উন্নয়ন দপ্তর’।
এই দপ্তরের তথ্য অনুযায়ী বাংলাদেশে বর্তমানে যুক্তরাজ্যের সহায়তায় স্বাস্থ্য, শিক্ষা, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা সহ মোট ৪২টি প্রকল্প চালু রয়েছে। ২০২০–২১ অর্থবছরে এসব প্রকল্পের জন্য নির্ধারিত বাজেট প্রায় ২১৬ মিলিয়ন পাউন্ড। ২০২১–২২ অর্থবছরে কমিয়ে ধরা হয়েছে প্রায় ১০০ মিলিয়ন পাউন্ড। আর ২০২২–২৩ অর্থবছরের জন্য নির্ধারিত বাজেট মাত্র ৫০ মিলিয়ন পাউন্ড। ভয়াবহ আর্থিক মন্দার ফলে আরো অনেক ক্ষেত্রে বাজেট সংকোচন হতে পারে।