অনলাইন ডেস্ক : গত জানুয়ারিতে অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির গবেষকরা যখন নভেল করোনাভাইরাসের ভ্যাকসিন নিয়ে গবেষণা শুরু করেন, তখন খুবই সামান্য পরিমাণে ছড়াচ্ছিল এর সংক্রমণ; এমনকি সুনির্দিষ্ট কোনও নামও ছিল না তার। পরের ছয় মাসে ভাইরাসটি যখন ছয় লাখ মানুষের প্রাণ কেড়েছে, তখন এটি থামাতে ভ্যাকসিন তৈরির মিশনে নেতৃত্ব দিচ্ছে অক্সফোর্ডের সেই দলটিই। ব্রিটিশ-সুইডিশ ওষুধ কোম্পানি অ্যাস্ট্রাজেনেকার কাঁধে রয়েছে তাদের সেই ভ্যাকসিন উৎপাদনের দায়িত্ব। করোনার হাত থেকে বিশ্বকে রক্ষায় শত শত কোটি ডোজ তৈরির উদ্যোগ নিয়েছে তারা। এরপরও দু’টি প্রশ্ন থেকেই যায়: ভ্যাকসিনটি কি নিরাপদ? এতে কাজ হবে তো?
প্রথম প্রশ্নের উত্তর ২০ জুলাই মেডিকেল জার্নাল ল্যানসেটে প্রকাশ করেছে অক্সফোর্ড। গত এপ্রিলে এক হাজার স্বেচ্ছাসেবকের ওপর শুরু হওয়ায় ট্রায়ালের ফলাফল প্রকাশ করেছে তারা।
অক্সফোর্ডের জেনার ইনস্টিটিউটের পরিচালক এবং ল্যানসেটে প্রকাশিত প্রতিবেদনের অন্যতম লেখক আড্রিয়ান হিলের তথ্যমতে, তাদের ভ্যাকসিন শক্তিশালী রোগপ্রতিরোধী প্রতিক্রিয়া তৈরি করছে এবং এটি বেশ সহনশীল ও নিরাপদ মনে হচ্ছে। ভ্যাকসিনটি অ্যান্টিবডি এবং ‘একটি দুর্দান্ত’ টি-সেল প্রতিক্রিয়া তৈরি করেছে। অ্যান্টিবডি এবং টি-সেল হচ্ছে শরীরে রোগপ্রতিরোধ ব্যবস্থার প্রধান দুই হাত। এরা জীবাণু শনাক্ত করে তাদের নিষ্ক্রিয় করে দেয় এবং আক্রান্ত কোষ মেরে ফেলে মানবদেহে রোগের বিস্তার বন্ধ করতে সাহায্য করে।
ডা. হিল বলেছেন, প্রাকৃতিক সংক্রমণের ক্ষেত্রে অ্যান্টিবডির মাত্রা এবং টি-সেলের প্রতিক্রিয়া যেমন থাকে, ট্রায়ালে তার সঙ্গে প্রচুর মিল পাওয়া গেছে। তার কথায়, অক্সফোর্ডের ভ্যাকসিনটি আমেরিকান বায়োটেক ফার্ম মডার্নার তৈরি ভ্যাকসিন থেকে অনেক ভালো।
করোনাভাইরাস প্রতিরোধে টি-সেলকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করা হচ্ছে। কারণ একে অত্যন্ত দীর্ঘস্থায়ী রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি করতে দেখা গেছে। সিঙ্গাপুরের ডিউক-এনইউএস স্কুলের সাম্প্রতিক এক গবেষণায় দেখা গেছে, প্রায় ১৭ বছর আগে সার্স সংক্রমণে ভুক্তভোগীদের শরীরে এখনও টি-সেল ভিত্তিক রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা রয়েছে। নভেল করোনাভাইরাস সার্সেরই সমগোত্রীয় একটি ভাইরাস।
শুধু অক্সফোর্ডেরই নয়, ইতিবাচক ফল দেখা যাচ্ছে আরও চারটি ভ্যাকসিনের ট্রায়ালে। মডার্না এবং ফাইজার ইতোমধ্যেই তাদের গবেষণার প্রাথমিক তথ্য প্রকাশ করেছে। সোমবার ক্যানসিনো বায়োলজিকস নামে একটি চীনা কোম্পানিও তাদের তথ্য জানিয়েছে।
এধরনের ট্রায়ালে অবশ্যই সবার চেয়ে এগিয়ে অক্সফোর্ডের ভ্যাকসিন। ব্রিটেনে তাদের ট্রায়ালের জন্য ১০ হাজার রোগী জোগাড় প্রায় শেষের পথে, ব্রাজিলেও দ্রুত এগিয়ে চলেছে স্বেচ্ছাসেবক সংগ্রহ। দক্ষিণ আফ্রিকায় অক্সফোর্ডের ট্রায়াল মাত্র শুরু হয়েছে, কিছুদিনের মধ্যে আমেরিকায়ও আরেকটি ট্রায়াল শুরু হতে যাচ্ছে। সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে আগস্টের শেষেই গবেষকরা পুরোপুরি নিশ্চিত হতে পারবেন, ভ্যাকসিনটিতে কতটা কাজ হবে।
তবে, অক্সফোর্ড ভ্যাকসিনের প্রথম ট্রায়ালের ফলাফল ইতিবাচক পাওয়া গেলেও নীতিনির্ধারকদের সিদ্ধান্ত নিতে হবে, আরও পরীক্ষার আগে জরুরি অনুমোদনের জন্য তাদের কাছে পর্যাপ্ত তথ্য রয়েছে কি না। অবশ্য অক্টোবরের শুরুর দিকেই তা ঘটতে পারে।
অক্সফোর্ডের তথ্যপ্রকাশের দিন কোভিড-১৯’র আরেকটি সম্ভাব্য চিকিৎসার কথাও জানা গেছে। সিনায়ারগান নামে একটি ব্রিটিশ বায়োটেক কোম্পানি ঘোষণা দিয়েছে, ইন্টারফেরন বেটা নামে একটি বস্তু করোনার চিকিৎসায় কার্যকর প্রমাণিত হয়েছে। ট্রায়ালে ওষুধটি ১০০ রোগীর শরীরে প্রয়োগের পর তাদের মধ্যে আইসিইউতে নেয়ার সংখ্যা ব্যাপকহারে কমে গেছে, ৭৯ শতাংশ রোগীর আর ভেন্টিলেটর সহায়তার দরকার পড়েনি। ওষুধটি প্রয়োগে রোগীদের সুস্থতার হার দুই থেকে তিনগুণ বেড়ে গেছে। শিগগিরই এ বিষয়ে গবেষণালব্ধ বিস্তারিত তথ্য প্রকাশ করা হবে বলে জানিয়েছে ব্রিটিশ প্রতিষ্ঠানটি।
তবে সিনায়ারগান কীভাবে তাদের ট্রায়াল চালিয়েছে বা কী ধরনের রোগীর ওপর পরীক্ষা চালানো হয়েছে সে বিষয়ে তারা এখনও কিছু জানায়নি, কিংবা তাদের গবেষণার ফলাফল বিশদ পর্যালোচনাও হয়নি। এ কারণে এ তথ্যের সত্যতা নিয়ে এখনও নিশ্চিত নন অন্য গবেষকরা। তারপরও, যদি এ দাবি সত্য প্রমাণিত হয়, এটি হবে করোনাভাইরাস মোকাবিলায় অসাধারণ অগ্রগতি। ফলে সব মিলিয়েই আশা করা যাচ্ছে, চলতি বছরের মধ্যেই করোনা মহামারি থামানোর সুনির্দিষ্ট পদ্ধতি বেরিয়ে আসছে।
(দ্য ইকোনমিস্ট থেকে অনূদিত)