আতোয়ার রহমান : আগেই বাসা ভাড়া করা হয়েছে ড্যানফোর্থের ক্রিসেন্ট টাউনে, ভিক্টোরিয়া পার্ক সাবওয়ে স্টেশনের একেবারে লাগোয়া। মহারানি ভিক্টোরিয়ার নামে স্টেশন। ভিক্টোরিয়া পার্কে যাবার উদ্দেশ্যে ডাফরিন সাবওয়ে ষ্টেশনে আসলাম, সঙ্গে রাজু। আমার বন্ধুর ভাতিজা রাজু রায়ারসন ইউনিভার্সিটিতে ইঞ্জিনিয়ারিং-এ পড়ে। টরন্টোর রাস্তাঘাট, অলিগলি ওর একেবারে নখদর্পণে। তাই ওকে গাইড হিসেবে সাথে নিলাম। গরমের বিকেল, চমৎকার আবহাওয়া। প্রথম কোন পাতাল রেল দেখার ও পাতাল রেলে চড়ার কৌতূহলে ফারজানার সাথে আমিও তমা ও আদিত্যের মতো শিশু হয়ে গেলাম।
এমিরেটস এয়ারলাইন্সের অত্যাধুনিক সুপরিসর বিমানে দীর্ঘ ও ক্লান্তিকর ভ্রমণ শেষে টরন্টোর পিয়ার্সন বিমানবন্দরে যখন নামলাম তখন ঘড়ির কাঁটায় ঠিক বিকেল পাঁচটা। আগে থেকেই বিমানবন্দরে অপেক্ষা করা প্রকৌশলী মিজান ভাই এর দামি সিয়েনা কারে করে তার ভিয়েলা স্ট্রীটের বাসায় উঠলাম। সঙ্গে ফারজানা, তমা ও আদিত্য; শরীরে রাজ্যের ক্লান্তি। আনন্দেই কাটল কানাডার প্রথম দিনগুলো। সেন্টার আইল্যান্ডে ফেরি ভ্রমণ শেষে, নায়াগ্রার অপূর্ব জলধারায় সিক্ত হয়ে পল্লী কানাডার রুপ দেখলাম। এখন নতুন দেশে, নতুন আবহাওয়ায়, নতুন পরিবেশে নতুন জীবন শুরুর পালা।
আমরা ভিক্টোরিয়া পার্ক সাবওয়েতে পৌঁছে চলন্ত সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামলাম। সুপরিসর জায়গা, দুই পাশে আলোকিত দোকান, গেটওয়ে নিউজস্টান্ড, কফির দোকান, ভিতরের অংশটা দেখতে অনেকটা সড়কের মত। তিন দিকে বড় বড় স্বয়ংক্রিয় দরজা, উঁচু ঢেউ খেলানো ছাদ, বাইরে থেকে দেখতে চার্চের মতো। এটা অন্যান্য স্টেশনের মত পাতালে নয়, মাটির উপরে সমতলে। আচানক পাতাল থেকে মাটি ফুঁড়ে অজগর সাপের মত মাথা বের করে ভোঁস ভোঁস শব্দে বেরিয়ে আসছে ট্রেন। মনে হয় সেগুলো সাপের মত কোন গর্তে লুকিয়ে ছিল। আবার বিপরীত দিক থেকে আসা ট্রেন সাপের মত যেন ক্রমশ গভীর গর্তে ঢুকে পড়ছে। ডাফরিন স্টেশনের মত সঙ্কীর্ণ ও প্রায়ান্ধকার নয়, মনে হয় না এই যেনো মাথার উপর ভেঙে পড়বে। খোলামেলা, দেয়ালে বড় বড় কাঁচ, প্রচুর আলো বাতাস, সবুজ ছাদ। স্টেশন ঘেঁষেই উত্তর পার্শ্বে গলফ খেলার মাঠ। দেখতে পর্বত বা পাহাড়ের মত না হলেও অনেকটা উঁচু টিলার মতো, স্নিগ্ধ বৃক্ষরাজি ও দারুণ ঘন সবুজ ঘাস দ্বারা আচ্ছাদিত।
সামনে বিশাল পার্কিং লট। ভিতরে অধিকাংশ যাত্রির মুখাবয়ব দেখে মনে হলো এটা যেন ঢাকার কোন একটা স্টেশন। কানাডায় একসঙ্গে এত বাঙালির মুখ এই প্রথম দেখলাম। পরে জেনেছি স্টেশনের আশপাশে দশ কিলোমিটার এলাকায় টরন্টোয় বসবাসরত আশি ভাগ বাঙালির বসবাস। এজন্য এলাকাটি কানাডার ‘মিনি বাংলাদেশ’ নামে পরিচিত। টরন্টোর পূর্ব প্রান্তের এই এলাকার অধিকাংশ লোকই এশিয়ার, বিশেষ করে দক্ষিণ এশিয়ার-বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তানের।
নিউজস্টান্ড থেকে বাচ্চাদের জন্য চকলেট বার, ডোনাট, মাফিন আর বিস্কিট কিনে ক্রিসেন্ট টাউনের অ্যাপার্টমেন্টের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিলাম। ছবির মতন সুন্দর স্টেশনটা দেখে তমা ও আদিত্যের মুড এত ভালো হয়ে গেল যে না চাইতেই তারা তাদের চকলেট ভেঙে রাজুকে খেতে দিল। ওরা খুশি হলে ওদের সবচেয়ে প্রিয় চকলেটও ভাগাভাগি করে। অন্য সময়ে ওরা আর কিছু যাই হোক, ওদের চকোলেটে কাউকে ভাগ বসাতে দেয় না।
স্টেশনে নেমে হেঁটে ক্রিসেন্ট টাউনের অ্যাপার্টমেন্টে এলাম। ছোট্ট ছিম ছাম আপার্টমেন্ট, চব্বিশ তলায়। যেরকম চেয়েছিলাম ঠিক সেরকম আমাদের নতুন এ অ্যাপার্টমেন্টটি। বাদামি রঙের শক্ত কাঠের মেঝে, সুপরিসর জায়গা, দক্ষিণের ব্যালকনি, বেশ খোলামেলা, আলোবাতাস, বাইরের ডেন্টোনিয়া পার্ক ও টেলর ক্রিক পার্কের হু হু হাওয়া। ফারজানার খুব পছন্দ হল, তমা ও আদিত্য খুশিতে ডগ মগ। দোকান থেকে প্রয়োজনীয় আসবাবপত্র, ওয়াড্রোব, সোফাসেট কিনলাম। হেলথ কার্ডের জন্য দরখাস্ত করলাম, ল্যান্ড ফোন, মোবাইল ফোন, ক্যাবল টিভি ও ইন্টেরনেট সংযোগ নিলাম।
এলাকাটা টরন্টো নগরীর পূর্বপ্রান্তে একটি সুন্দর ছোট্ট জায়গা, দীর্ঘ বৃক্ষরাজি ও শহুরে বন্যপ্রানী পরিবেষ্টিত। দারুন সবুজ, জাদুময় ও রহস্যময় জায়গাটা। এটা প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের এক বন্য ও দৃষ্টিনন্দন স্থান। নানা প্রজাতির পাখির কলরব, র?্যাকুনের এদিক সেদিক দৃষ্টিনন্দন দৌড়াদৌড়ি। সারা টরন্টো নগরীতে এরকম সৌন্দর্যময় জায়গা কমই চোখে পড়ে। কয়েকদিনের মধ্যে এখানকার পথঘাট চেনা হয়ে গেল। দিন দিন জায়গাটা আপন মনে হতে লাগল। দেশ থেকে এত দূরে, সাত সমুদ্র পারে, তারপরও আপন মনে হওয়ার কারণ কী? বুঝতে পারলাম না।
গতকাল বিকেলে, গতকাল, আমি স্টেশনে যাওয়ার রাস্তা ধরে হাঁটছিলাম, বসন্তের আগমনে আনন্দিত পাখির কলরব শুনছিলাম, আশপাশের ওক আর ম্যাপল লিফ গাছে পাখিদের হাট বসেছিল। মনে হল বসন্তের রুপ, উচ্ছাস সব জায়গায় একই রকম- তা হোকনা বাংলাদেশ অথবা কানাডা। এটা ছিল বৃহস্পতিবার বিকেল, আমার অর্ধ-দিন। আমি কাজ করি ‘কিংস’ বেকারিতে’, কেনেডি স্টেশন থেকে দশ মিনিট হাঁটার দুরুত্বে। কিংস বেকারি নাম হলেও এখানে রাজা রানীদের জন্য খাবার তৈরি হয় না, এখানে তৈরি হয় কম দামি শুকনো রুটি, বিস্কিট, রেইসিন। নিম্ন আয়ের লোকরাই যার প্রধান খদ্দের। তিন শিফটে কাজ হয় এখানে। আমি সকালের শিফটে এখানে কাজ করি, আর রাতে পিজা ডেলিভারির কাজ করি। সপ্তাহে পাঁচ দিন বেকারিতে কাজ করি। তাই সপ্তাহে কমপক্ষে পাঁচ দিন আমাকে ভিক্টোরিয়া পার্ক স্টেশনে আসতে হয়। ইদানিং কেন জানিনা মাঝে মাঝে আমার মনটা খারাপ হয়ে যায়। এখানে আসলে মনটা ভাল হয়। তাই সময় পেলে এখানে চলে আসি, এক কাপ কফি খাই, সময় কাটাই। এভাবে অনেক সময় কাটিয়েছি এখানে।
সেদিন কাজ শেষে হয়ে বিকেল তিনটায় বাসার উদ্দেশ্যে ভিক্টোরিয়া পার্কে নামলাম। নিউজ স্ট্যান্ডে তমা ও আদিত্যের জন্য চকোলেট কিনছি। তমাদের বয়েশি বেশ কয়েকজন স্কুল ফেরত ছেলেমেয়েও দোকানের সামনে। চেহারা দেখে মনে হল বাংলাদেশি মা বাবার সন্তান। আগ্রহভরে ওদের দিকে তাকালাম, ওদের কথা শোনার চেষ্টা করলাম। ওদের মুখ থেকে একটি বাংলা কথাও শুনতে পেলাম না। নিজেদের মধ্যে যখন কথা বলছে, তখনো ইংরেজিতে কথা বলছে, অ্যাক্সেন্টাও বাংলাদেশি নয়। বিষণ্ণ মনে বাসায় ফিরলাম। আমার তমা ও আদিত্যের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে মনের মধ্যে শঙ্কার দানা বাঁধতে লাগলো।
আমার সন্তানরাও দেখি ইদানীং বাংলা বলতে চায়না। হয়তো আর কিছুদিন পরে ভিক্টোরিয়া পার্কে দেখা ছেলেগুলোর মত ওরাও বাংলা ভুলে যাবে। ইংরেজিতে দুর্বলতার কারনে দেশে ভাল চাকরি হয়নি, পরে চাকরি হলেও পদোন্নতি হয়নি। অভাবের সঙ্গে যুদ্ধ করতে করতে পরাজিত হয়ে একদিন দেশ ছেড়েছি। আর সেই আমার তমা ও আদিত্য এখন ইংরেজি শিখে বাংলা প্রায় ভুলতে বসেছে। এটা আমার কাছে ভাগ্যের পরিহাস বলেই মনে হয়।
‘আমার জীবন যুদ্ধের কথা, সংগ্রামের কথা, আমার অনুভুতির কথাগুলোকে এদের জানাব কী করে আমি?’ নিজেকে জিগ্যেস করি। এরা কি তবে নাড়ির সম্পর্ককে ছিন্ন করবে, বাংলা ভাষা, বাংলাদেশ, ইতিহাস, ঐতিহ্যসহ সব কিছুকে একসময় ভুলে যাবে ভিক্টোরিয়া পার্কে দেখা ওই শিশুগুলোর মতো? ভাবতে ভাবতে দুই চোখের পাতা ভিজে আসে।
এখানে আসার শুরুর দিকে একদিন স্টেশন থেকে বের হয়ে বরফে জমাট বাধা এক সাইড স্ট্রীটে এসে পড়েছি। আমি দিক ভুলো হয়ে গেছি। পশ্চিম দিক কোন দিকে তা বের করতে পারছিলাম না। তাই আমি গায়ে পশমের কোট পরা এক মহিলাকে পশ্চিম কোন দিকে তা জিজ্ঞেস করলাম।
‘আমার সঙ্গে কথা বলো না’ রাগত স্বরে চিৎকার দিল, হাত তুলে একদিকে দেখাল। “চলে যাও, চলে যাও-ঠিক এ পথ বরাবর হাঁটো।”
আমি ওই পথ বরাবর হাঁটতে থাকলাম। ভবঘুরে সাহায্য প্রার্থীরা সাহায্য চাইতে থাকল।
‘তুমি কি চার আনা পয়সা দিতে পার?’ ‘যেকোন চেঞ্জ, স্যার?’ তারপর আমার জন্য শুভ দিন কামনা করে আমাকে আমার শরীরের প্রতি যত্ন নিতে বলল। কোন দিন দেখি এক বৃদ্ধ, মগ হাতে বসে আছে। মগের গায়ে লেখা হোমলেস, অর্থাৎ সে ভিখারি, সাহায্য প্রার্থী। বুঝতে পারলাম টরন্টোতেও গরিব ও অসহায় মানুষ আছে, যদিও সংখায় তা নগন্য।
আজ সারাদিন ধরে থেমে থেমে বৃষ্টি হলো। ভিক্টোরিয়া অ্যাভিনিউয়ের রাস্তা ধরে বাইসাইকেল স্ট্যান্ডের পাশঘেঁষে ষ্টেশনের প্রবেশ পথ ধরে ভিতরে ঢুকে কিংস্টনে যাওয়ার উদ্দেশ্যে ১০ নং বাসের অপেক্ষা করছি। মাইক্রোফোন থেকে ভেসে আসা গানের মিষ্টি সুরে অপেক্ষার একঘেয়েমি অনুভূত হলোনা। প্লাটফর্মের এক কোনে অথবা প্রবেশ দ্বারের পাশে মাঝে মাঝেই টিটিসি গায়ক দলের হাওয়াইয়ান ড্রামার, কখনো গিটারিস্ট বা ভায়োলিনিস্টরা গান গায়। বেহালার মন কাড়া সুরের গান শুনে বিমোহিত হই। গান গাওয়ার সময় তারা সামনে একটা বিছানা পেতে রাখে। দিনের শেষে কর্মক্লান্ত ঘরে ফেরা যাত্রীদের কেউ কেউ দাঁড়িয়ে তাদের গান শোনে, খুশি হয়ে তাদেরকে লুনি দেয়, আমিও দেই। টরোন্টোর এই নগর বাউলরা আমার অনেক তুষার ভেজা বিষণ্ণ সকালকে চাঙ্গা করেছে, দীর্ঘ ও ক্লান্ত সন্ধ্যার উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা, প্রবাস জীবনের একাকিত্ব, নিঃসঙ্গতা দূর করেছে।
একেক দিন স্টেশনে আসি, নতুন কিছু একটা চোখে পড়ে, যা আগে দেখা হয়নি, বা দেখা হলেও চোখে হয়ত সে ভাবে পড়েনি। যেমন আজ লক্ষ্ করলাম স্টেশনের দুই প্লাটফর্মের মাঝখানে কোন পিলার নেই, বøর-ড্যানফোর্থ লাইনের অন্য স্টেশনে এরকম সাধারনত চোখে পড়ে না। দিনের বেলা কাঁচের জানালা গলে আসা রোদের আলোতে প্লাটফর্মের উভয়পার্শ্বকে খোলা মাঠের মতো মনে হয়। ভিক্টোরিয়া পার্ক এভিনিউ থেকে উত্তরপশ্চিম কোনের সিঁড়ি বেয়ে প্লাটফর্মে উঠার সময় হাতের ডানে দেয়ালে একটা সুন্দর মুর?্যাল চোখে পড়লো যার শিরোনাম ‘রুট’ বা ‘শেকড়।’। ‘রুট’ বা ‘শেকড়’ শব্দটি প্রায় পঞ্চাশটিরও অধিক ভাষায় একটা বড় বৃত্তাকার রঙিন পাথরে খোদাই করা, আর বৃত্তের একেবারে কেন্দ্রে বাংলা অক্ষরে লেখা ‘শেকড়’ শব্দটি জ্বলজ্বল করছে। টরন্টো নগরীর পূর্ব প্রান্তের এই এলাকাটি বহুজাতিক মানুষ অধ্যুষিত, যার প্রধান বা জ্বলন্ত চরিত্র বাংলাদেশিরা। অথবা বলা যায় এই এলাকায় বসবাসকারী অধিবাসীদের শেকড়ে পরিনত হচ্ছে বাঙালিরা। ঠিক এই বিষয়টি সুন্দর ভাবে ফুটে উঠেছে শিল্পকর্মটিতে।
দক্ষিন-পশ্চিম দিকের সিঁড়ি বেয়ে নিচে থেকে উপরে ইস্টবাউন্ড প্লাটফর্মে উঠার সময় স্টেশনের দেয়ালে চোখে পড়ে পৃথিবীর চিত্রকল্পে বৃক্ষ আকৃতির একটি বিশাল মুর?্যাল। শাদা টাইলসের উপরে সবুজ রঙের আঁচড়ে শিকড় থেকে শাখা-প্রশাখা, ডালপালা বেরিয়ে লতার মত চারিদিকে বিস্তৃত হয়ে পড়েছে। সঙ্গে কাব্যিক বর্ণনা ‘টরন্টো- একটি নগর যেখানে বিভিন্ন শেকড় থেকে আগত মানুষ একসঙ্গে মিশতে পারে একটি জটিল এবং উদ্দিপনাময় বহুসংস্কৃতির বাগানে।’ মুর্যালের অন্তর্নিহিত তাৎপর্য ইংগিত করে ভিন্ন ভিন্ন সাংস্কৃতিক পটভুমি থেকে আগত যাত্রীদেরকে যারা নিকটস্থ লোকালয়ে বাস করে অথবা টরন্টো নগরীতে বসবাসকারী মানুষদেরকে যাদের ‘শেকড়’ গাড়া রয়েছে বিশ্বের নানা প্রান্তে। আসলেই কানাডার সংস্কৃতিকে বলা যায় বহুসংস্কৃতির মিথস্ক্রিয়া–বহুসংস্কৃতির একটা মোজাইক যা অভিবাসী, ফার্স্ট নেশন্স এবং কয়েক প্রজন্ম ধরে এখানে বসবাসকারী মানুষের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য থেকে উদ্ভুত।
আজ সোমবার। সপ্তাহ শুরুর এ দিনটিতে অন্যান্য দিনের চেয়ে সাধারনত যাত্রীদের ভিড় বেড়ে যায় এবং একটু আগেভাগেই স্টেশন এলাকা সরগরম হয়ে পড়ে। বাসে আগত, বিভিন্ন প্রবেশ পথ দিয়ে ভিতরে আসা অফিসগামি ব্যস্ত যাত্রীদের দৃষ্টি নিজের পায়ের বুড়ো আঙুল আর চলন্ত সিঁড়ির দিকে নিবদ্ধ, যন্ত্রের মত সামনে এগিয়ে চলছে, অন্য কোন দিকে তাকানোর ফুরসত যেন তাদের নেই। আমিও চলন্ত সিঁড়ির দিকে যাচ্ছি, এমন সময় ডেন্টোনিয়া অ্যাপার্টমেন্টের দিকের রাস্তা ধরে কায়সারকে এগিয়ে আসতে দেখি। কায়সার আমার বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের বন্ধু। ওকে ভিড়ের মধ্যে দেখে প্রথমে চিনতে পারিনি। পরনে কালো প্যান্ট ও গায়ে লাল শার্ট। প্রকৃত বয়সের চেয়ে কম বয়েসি দেখাচ্ছে ওকে। অথচ তরুন বয়সে ও দেখতে বয়স্ক লাগতো, এজন্য আমরা ওকে ‘মুরুব্বি’ বলে ডাকতাম। অথচ ও যদি আজ আমাকে ‘আঙ্কেল’ বলে সম্বোধন করতো, লোকজন বিশ্বাস করতো। বেঁচে থাকার জন্য অর্থের সংস্থান, তার অনিশ্চয়তায় হাহাকার আর হতাশার মূর্তিমান আতঙ্কে দিন দিন অকাল বৃদ্ধ হয়ে যাচ্ছি আমি। আসলে একধরনের লোক আছে যারা তরুন বয়সে দেখতে বৃদ্ধের মত দেখায়, আবার বৃদ্ধ বয়সে দেখতে তরুনদের মত লাগে। কায়সার এধরনের মানুষ।
কায়সার চার বছর আগে কানাডায় এসেছে। ভ্যাঙ্কুভারে দুই বছর থেকে এখন টরন্টোতে এসেছে। এ বছরের শেষে ক্যালগারিতে যাওয়ার পরিকল্পনা করছে। ওখানে নাকি তেলের কোম্পানিতে কাজ পাওয়া যায়, পয়সাও বেশি। কবির সেই গানটি মনে পড়ল, হেথা নয়, হোথা নয়, অন্য কোথাও.. অন্য কোথাও..
কায়সারের মত অনেকেই এখানে দেশের ভিতরেই মাইগ্রেসনে ব্যস্ত থাকে। দেশে থাকতেও ও প্রথমে রিয়াল স্টেট, পরে পত্রিকায় এবং সবশেষে শিক্ষকতা করত। আমাকেও তাগিদ দিল ওর সঙ্গে ক্যালগারিতে যেতে।
‘তুই কেমিস্ট্রির ছাত্র, ক্যালগারিতে গিয়ে যদি একটা তেল বিষয়ে শর্ট কোর্স করিস, তাহলে তোর চাকরির বাজার হট কেক’, ট্রেনে কেনেডির দিকে যেতে যেতে তার রোদে পোড়া আত্মবিশ্বাসী চোখে আমার দিকে তাকিয়ে বললো কায়সার। আমার মন সায় দিল না। আর যেতে চাইলেই কি যাওয়া যায়? আমি জানি ফারজানা, তমা, আদিত্য ওরা যেতে চাবে না। ওদের কাছে এই এলাকাটা বড্ড ভাল লেগেছে। ক্যালগারি দুরের কথা, মেইন স্ট্রীট বা উডবাইনেও এখন ওরা যেতে চাবে না।
কায়সারের মত আভ্যন্তরীণ মাইগ্র্যান্টদের সংখ্যাও এখানে অনেক। আজ এ শহর তো কাল ও শহর, আজ এ প্রদেশ তো কাল ও প্রদেশ, আজ এক চাকরি তো কাল আর এক চাকরি। কায়সারকে এতক্ষন ধরে নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করলাম। ওকে আগের চেয়ে অনেক বেশি গোছানো ও আন্তবিশ্বাসী মনে হলো। স¤প্রপ্তি কানাডিয়ান পাসপোর্টও পেয়েছে ও।
একই বগিতে যেতে যেতে বেরি অসবর্ণের সাথে পরিচয়, পরিচয় থেকে এক সময় তা বন্ধুত্বে গড়ায়। ষাটোর্ধ অসবর্ণ লরেন্স অ্যান্ড মিডল্যান্ডে একটা নির্মাণাধিন কন্ডোতে নিরাপত্তা কর্মীর কাজ করে। কানাডিয়ান টায়ারে দীর্ঘ বিশ বছর চাকরি করে অবসরে যাওয়ার পর এখন নিরাপত্তা কর্মীর কাজ করে, সারা রাত জেগে নির্জন কন্সট্রাকশন সাইট পাহারা দেয়। পাশেই ব্রেন্টন স্ট্রীটে বাসা। থ্যাঙ্কসগিভিং ডে তে তার বাসায় নিমন্ত্রিত হই। টার্কি এবং কদু খেয়ে তার জার্মান স্ত্রী জুলিয়ার বানানো গ্রীন টি খেলাম।
অসবর্ণের দুই ছেলে মেয়ে স্বামি স্ত্রী নিয়ে নর্থ ইয়র্কে থাকে। দুই চার মাস পর আসে, দেখা করে যায়। ‘বসে থাকার চেয়ে কাজ করা ভাল, শরীর, মন দুই-ই ভালো থাকে, তাই এই বয়সেও নিরাপত্তা প্রহরির কাজটা করি,’ বলে অসবর্ণ। অসবর্ণ বললো ‘বেকারিতে কাজ করছো, ভালো কথা। চোখ মুখ বন্ধ করে শুধু গাধার মত কাজ করে যেও না। কাজটা ভালভাবে শেখো, ফুড প্রিপারেসনের উপর রাতের ক্লাস করো, একটা শর্ট সার্টিফিকেট নাও। এ এলাকায় ভাল বেকারি নাই, নিজেই একটা বেকারি দাও, দেখবে ভালো চলবে।’ অসবর্ণের পরামর্শটা ভাল লাগলো আমার।
আজ তমা ও আদিত্যকে নিয়ে ওদের স্কুলে গেলাম। ঘুরে ঘুরে দেখালাম। স্কুলটি বিদেশি ছাত্রে পরিপূর্ণ, সুপরিসর জায়গা। সারি সারি ম্যাপল ও ওক বৃক্ষ পরিবেষ্টিত অপূর্ব দৃশ্যপট।পূর্বে ভিক্টোরিয়া পার্ক অ্যাভিনিউ, রাস্তার ওপারে গলফ কোর্ট, একটু দক্ষিণে ভিক্টোরিয়া পার্ক স্টেশন। স্কুলের জানালার কাঁচের ভিতর দিয়ে সব দেখা যায়। আদিত্য ও তমা স্কুলের পারিপার্শ্বিক আবহে মুগ্ধ হলো। স্কুলের অফিস কক্ষে গেলাম, প্রিন্সিপালের সঙ্গে দেখা করে তমা আদিত্যকে ভর্তি করানো হলো। প্রিন্সিপাল অ্যাডামসন মধ্যবয়সি, গাম্ভীর্যপূর্ণ চেহারা, আচরণে অমায়িক।
তমা ও আদিত্য আগ্রহভরে স্কুলে যাওয়া শুরু করল। বার্ষিক পরীক্ষায় আদিত্য ভালো করল। ইংরেজিতে ১০ নং বোনাস পেল অর্থাৎ ১০০ তে ১১০ পেল। এখানে পরীক্ষায় ভাল করলে ছাত্রদের বোনাস নং দেয়ার প্রচলন রয়েছে। তমা পড়াশুনায় ভাল করছেনা। তবে গান, নৃত্য ও সামাজিক স্কিল গুলোতে ও ভালো। নতুন নতুন বন্ধুদের বাসায় নিয়ে আসছে। যাহোক সারাদিন হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রমের পর রাতে বাসার ড্রইং রুমে বসে আমি আর ফারজানা নিত্য নতুন পরিকল্পনা করি কিভাবে আমাদের আয় আরো বাড়ানো যায়, টরন্টোর কঠিন জীবন সংগ্রামে টিকে থাকা যায়, কিভাবে আর একটা বাবু নেয়া যায়।
সাবওয়ে ট্রেন ছুটে চলছে, এক স্টেশন থেকে আর এক স্টেশনে-ভিক্টোরিয়া পার্ক, ওয়ার্ডেন, কেনেডি। ট্রেন কেনেডিতে থামল এবং দরজা খুলে গেল। আসন থেকে দ্রæত উঠে ট্রেন থেকে বেরিয়ে পড়লাম। চলন্ত সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠছি আর ভাবছি নতুন ও চমৎকার এক জীবনের স্বপ্ন পুরনের যে রাস্তায় আমি হাঁটা শুরু করেছি, তার এখনো অনেক বাকি এবং সে রাস্তার সবচেয়ে জটিল আর কঠিন অংশটিতে হাঁটা সবে মাত্র শুরু হয়েছে।
আতোয়ার রহমান : কবি ও কথাসাহিত্যিক, টরন্টো, কানাডা