খুরশীদ শাম্মী : সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে গত কয়েকদিন ধরে বিভিন্ন পোস্ট দেখে মনে হয়েছিল ওরা ভাস্কর্য নিয়ে আবারও কা-কা-কা করছে। ভেবেছিলাম, করোনা কালে হয়তো ওদের শোরগোল দীর্ঘস্থায়ী হবে না। তবে, গত সপ্তাহে বাংলা বিবিসি নিউজ খুলতেই দৃষ্টি পড়ে “ভাস্কর্য বিতর্ক: কঠোর অবস্থান নেয়ার ইঙ্গিত দিচ্ছেন আওয়ামী লীগের নেতারা” শিরোনামের সংবাদটিতে। এক নিঃশ্বাসে পড়ে ফেলি সংবাদটি। সংবাদটি পড়ে জানতে পারলাম, প্রায় দুই মাস ধরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাস্কর্য নির্মাণ পরিকল্পনার বিরোধিতা করে আসছে অনেকগুলো ইসলামপন্থী দল। ওদের বিরোধিতা ও বিভিন্ন নেতিবাচক বক্তব্যে এতদিন আওয়ামী লীগের নেতারা তেমন কোনো প্রকার মন্তব্য করেনি। তবে ২৮ নভেম্বর ২০২০, শনিবার আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের ও যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুবুল আলম হানিফ ভাস্কর্য বিরোধী বক্তব্যের বিরুদ্ধে তাদের অবস্থান ব্যক্ত করেছেন। এর কারণ, ২৭ নভেম্বর ২০২০, শুক্রবার চট্টগ্রামের হাটহাজারীর এক সম্মেলনে বাংলাদেশ হেফাজতে ইসলামের শীর্ষনেতা তার বক্তব্যে বলে যে “ভাস্কর্য তৈরি করা হলে তা টেনে-হিঁচড়ে নামিয়ে ফেলা হবে।” অন্যান্য সংবাদপত্রেও প্রায় একই ধরণের কিছু সংবাদ এবং আওয়ামী লীগের অন্যান্য নেতাদের বক্তব্য ও মন্তব্য পড়ার সুযোগ হলো।

দীর্ঘদিন পরে হলেও আওয়ামী লীগের নেতারা যে এই বিষয়ে কথা বলার প্রয়োজনবোধ করেছেন, সেটা কিছুটা হলেও ভোরের পূর্বাভাস। ওবায়দুল কাদের বলেছেন, “ভাস্কর্য নিয়ে মনগড়া ব্যাখ্যা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও দেশের সংস্কৃতির প্রতি চ্যালেঞ্জ। দেশের মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, সংবিধান এবং রাষ্ট্রবিরোধী যে কোনও বক্তব্য বরদাশত করা হবে না। ধর্মীয় ইস্যুকে সামনে এনে ধর্মীয় সহনশীলতা বিনষ্টের যে কোনও অপচেষ্টা সরকার কঠোর হস্তে দমন করবে। সরকারের সরলতাকে দুর্বলতা ভাববেন না। জনগণের শান্তি বিনষ্টের কোনও অপচেষ্টা করলে জনগণই রুখে দাঁড়াবে।”

ওবায়দুল কাদেরের এই বক্তব্য আমার ভালো লেগেছে, তবুও তাঁর বক্তব্যকে ঘিরে প্রশ্ন ও সন্দেহ তাড়া করছে আমাকে, “এগুলো আবার লোক দেখানো রাজনীতি নয় তো?” আমার মনে সন্দেহ থাকার কারণও তো আছে ভূরি-ভূরি। কারণগুলো স্বচ্ছও বেশ। আমার সন্দেহের সবগুলো কারণ না হলেও দু’একটা নিয়ে আলোচনা করার প্রয়োজন বোধ করছি।
যেখানে মুক্তিযুদ্ধের প্রধান চেতনাই ছিল একটি অস¤প্রদায়িক সমতাভিত্তিক রাষ্ট্র ও সমাজ ব্যবস্থা, ১৯৭২ সালের গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের প্রথম সংবিধানের মূল চারনীতির একটি ছিল ধর্মনিরপেক্ষতা; সেখানে ১৯৮৮ সালে বাংলাদেশের সংবিধানের অষ্টম সংশোধনীর মধ্য দিয়ে ইসলামকে বাংলাদেশের রাষ্ট্রধর্ম ঘোষণা করা কি মুক্তিযুদ্ধের চেতনার প্রতি চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেয়া নয়? তখন অবশ্য প্রগতিশীল নাগরিকদের সঙ্গে রাষ্ট্রধর্ম ঘোষণার বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগসহ প্রধান অন্যান্য বিরোধী দলগুলো মিনমিনিয়ে রাজনীতির মুখস্ত বুলি আওড়িয়ে প্রতিবাদ করেছিল বটে। তবে ক্ষমতার মোহেই হোক আর নেতৃত্বের লোভেই হোক, কিছুদিনের মধ্যেই কণ্ঠের মিনমিন আওয়াজ বন্ধ করে রাজনৈতিক দলগুলো ধর্মকে মোয়া বানিয়ে রাজনীতি শুরু করে দিয়েছিল। তখন বাধ্য হয়ে প্রগতিশীল নাগরিকেরা রাষ্ট্রধর্ম বিধানের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে আদালতে রিট মামলা দায়ের করেছিলেন। রাজনৈতিক দলগুলোর পক্ষ থেকে যথার্থ গুরুত্বসহকারে দেখা হয়নি প্রগতিশীলদের সেই মামলা। প্রমাণ, ২০১৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় থাকাকালে রাষ্ট্রধর্ম বিধানের চ্যালেঞ্জ করে দায়েরকৃত রিট মামলা খারিজ করে দেয়া হয়।

এরপর আসি ২০১৪ সালের ইসলামিক ফাউন্ডেশনের ৩৯তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যে। সেদিন তিনি বলেছিলেন, “মদিনা সনদ ও মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সাঃ)-এর বিদায় হজের ভাষণের নির্দেশনা অনুসারে দেশ চলবে। এই সরকার পবিত্র কোরআন এবং সুন্নাহবিরোধী কোনো আইন পাস করবে না।”- এই বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে নিরপেক্ষ নাগরিকদের মনে প্রশ্ন জাগা খুব স্বাভাবিক, তবে বাংলাদেশের অন্যান্য ধর্মের নাগরিক, যারা মুক্তিযুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করেছিলেন, তাদের কি মূল্যায়ন করা হচ্ছে যথার্থভাবে? উত্তর : না। তবে বঙ্গবন্ধুর কন্যা হয়ে, বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ধারণ করেও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কেন এই বক্তব্য দিলেন? রাজনীতিতে কারণ থাকে বহুমুখী, বহুরূপী। কারণ সে যা-ই-হোক, তিনি কিন্তু মুসলমানদের খুশি করতে তাদের কাক্সিক্ষত বক্তব্য দিয়ে প্রগতিশীল ও অন্যান্য ধর্মের জনগণের মন ও বিশ্বাস দু’টোই ভেঙ্গে দিয়েছিলেন সেদিন।

আমরা ভুলিনি ২০১৭ সালের কথাও। বছরের শুরু থেকে গ্রিক দেবীর ভাস্কর্য অপসরণের দাবি ও হুমকি চালাচ্ছিল বাংলাদেশ হেফাজতে ইসলামের আমির। ভোটের রাজনীতির কাছে পরাজিত হয়ে ১১ এপ্রিল রাতে গণভবনে কওমি মাদ্রাসার বিভিন্ন পর্যায়ের প্রতিনিধিদের এক সাক্ষাতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছিলেন যে তিনি উচ্চ আদালত প্রাঙ্গণে স্থাপিত গ্রিক দেবীর ভাস্কর্য সরানোর পক্ষে। তিনি বলেছিলেন, “আমি নিজেও ব্যক্তিগতভাবে মনে করি এটা এখানে থাকা উচিত নয়।” প্রধানমন্ত্রী আরো বলেছিলেন, “আমাদের হাইকোর্টের সামনে গ্রিক থেমিসের এক মূর্তি লাগানো হয়েছে। সত্য কথা বলতে কি, আমি নিজেও এটা পছন্দ করিনি। কারণ, গ্রিক থেমিসের মূর্তি আমাদের এখানে কেন আসবে।”

প্রধানমন্ত্রী শুধু বলেই ক্ষান্ত হননি, ধর্মভিত্তিক কয়েকটি রাজনৈতিক দলের ক্রমাগত দাবির মুখে ওই বছর রমজান মাস শুরুর ঠিক একদিন পূর্বে সুপ্রিম কোর্ট চত্বর থেকে ভাস্কর্য সরানো হয়েছিল মে মাসের ২৫ তারিখ শেষ রাতে। হ্যাঁ, ওইদিন মধ্যরাতে ভাস্কর্য সরানোর কাজ শুরু করে রাত চারটার দিকে ভাস্কর্যটি সরিয়ে নেয়া হয়েছিল পুরোপুরিভাবে। তারা অপেক্ষা করেনি পরের দিনের ভোরের আলোর জন্য। কথায় আছে, অন্যায্য দাবি অন্ধকারেই পূরণ করতে হয়। কেননা, আঁধার সাক্ষী নিয়ন্ত্রণ করার শক্তি রাখে। সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গণ থেকে সরিয়ে নেয়া ভাস্কর্যটি সেখানকার অ্যানেক্স ভবনের সামনে পুনঃস্থাপন করা হয়েছে, যেখানে দর্শনার্থী ভাস্কর্যটি দেখার সুযোগ পাবে না। দুঃখজনক হলেও সত্যি, সুপ্রিমকোর্ট সম্মুখের ভাস্কর্য অপসরণের কাজে নিযুক্ত করা হয়েছিল ভাস্কর্যটির নির্মাতা মৃণাল হককেই। অথচ, একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটিসহ বিভিন্ন সংগঠন ও প্রগতিশীল ব্যক্তিবর্গ ভাস্কর্যটি অপসারণের বিরোধিতা করে আসছিলেন। সরকার পক্ষ প্রগতিশীল নাগরিকদের দাবির কোনো মূল্য দেয়নি, বরং উপেক্ষা করা হয়েছিল তাদের দাবি।

তিন বছর পর, আজ জাতির জনক শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশত বার্ষিকী উপলক্ষে রাজধানীর প্রবেশ দ্বার ধোলাইপাড় চত্বরে বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য নির্মাণের পরিকল্পনার বিরোধিতা করছে ওরাই। শুধু কি বিরোধিতা? ওরা রীতিমত হুমকি দিচ্ছে বিভিন্ন পদ্ধতিতে। অথচ এ বছরই চট্রগ্রাম হালিশহর বড়পুল মোড়ে নির্মিত হয়েছে “ব্রজ্রকণ্ঠ” নামকরণে বঙ্গবন্ধুর সুবিশাল ভাস্কর্য। গত বছর কুষ্টিয়া কালেক্টর চত্বরেও নির্মিত হয়েছে বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য। ওদের এই হুমকি কি ওদের অপশক্তির দাপট প্রমাণ করে না? এখনও কি আমাদের বুঝতে অসুবিধা হয় যে ওরা বাংলাদেশের শত্রু, ওরা ধর্মের দোহাই দিয়ে মূলত মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও বাংলা সংস্কৃতি বিনাশ করায় সচেষ্ট।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী যখন দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের কথা বলেন, আনন্দে চোখ ও মন জ্বলজ্বল করে, আশার আলো দেখি। কিন্তু যখন মোল্লাদের চাপে তাঁকে বাংলাদেশের মাদ্রাসা শিক্ষা নিয়ে অতিরিক্ত উত্সাহ প্রকাশ করতে দেখি, তখন দুশ্চিন্তা হয় ভীষণ। কারণ, মাদ্রাসাগুলোতে আমাদের দেশের জাতীয় সঙ্গীত গাওয়া ও শেখানো হয় না, জাতীয় পতাকা উত্তোলিত হয় না, মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে পড়ানো হয় না; শেখানো হয় না ভাষা দিবস, স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস সম্পর্কে। সেখানে বাংলা সংস্কৃতি ও মুক্তচিন্তা চর্চাও প্রশ্নবোধক অবস্থানে।

বর্তমানে বাংলাদেশ হেফাজতে ইসলামের আমিরসহ ইসলামপন্থী দলগুলো বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য নির্মাণের বিরোধিতা করছে এমনভাবে যেন ধর্মের গায়ে কেরোসিন ঢালা হয়েছে। ভাস্কর্য বিশ্বের কোথায় নেই? মুসলিম রাষ্ট্রগুলোতেও তো কত ধরণের দৃষ্টিনন্দন ভাস্কর্য ও ম্যুরাল রয়েছে। সেইসব দেশেও তো ধার্মিক নাগরিক বসবাস করে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, বাংলাদেশ হেফাজতে ইসলামের আমির ও ইসলামপন্থী দলগুলো কি সমগ্র ভাস্কর্যের বিরোধিতা করছে? না কি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাস্কর্যের বিরোধিতা করছে? না কি ভাস্কর্যকে ঘুঁটি বানিয়ে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে আঘাত করে নোংরা রাজনীতি করছে? বিভিন্নভাবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে অস্বীকার করা তো দেশদ্রোহিতা বলেই আমার মনে হয়। সুতরাং ইহা স্পষ্ট, ভাস্কর্যকে ঘুঁটি বানিয়ে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে আঘাত করে নোংরা রাজনীতি করছে ওরা।

প্রধানমন্ত্রী এবারও যদি ওদের অন্যায় দাবির উচিত জবাব না দিয়ে নীরব থাকেন কিংবা ধর্মের দোহাই দিয়ে ওদের খুশি করায় ব্যস্ত হয়ে পড়েন, তবে সেটা হবে খুবই দুঃখজনক ব্যাপার। প্রগতিশীল, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের ও অন্যান্য ধর্মের নিরীহ জনগণের প্রতি করা হবে অবিচার। সংকটে পড়বে বাংলার অস্তিত্ব।