ফারহানা আজিম শিউলী : টরন্টোভিত্তিক শিল্প-সাহিত্য চর্চার প্ল্যাটফর্ম ‘পাঠশালা’র ৩৪তম ভার্চুয়াল আসরটি ফেব্রুয়ারি মাসের ২০ তারিখে অনুষ্ঠিত হয়। ভাষার মাসে, একুশ ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষ্যে আয়োজিত পাঠশালার এ আসরে ‘বাংলা খেয়াল’ নিয়ে আলোচনা করেন – বিশ শতকের নয় এর দশকে আধুনিক বাংলা গানে তুমুল অভিঘাত তোলা, হিন্দুস্তানি খেয়ালে প্রশিক্ষিত শিল্পী কবীর সুমন।
ইতিহাস থেকে জানা যায়, খেয়াল আঙ্গিকটির উদ্ভাবন হয়েছিল অষ্টাদশ শতাব্দীর দ্বিতীয় অর্ধে, সম্রাট মোহাম্মদ শাহ রঙিলের দরবারে। তাঁর সময় পর্যন্ত রাজদরবারে ধ্রুপদ গাওয়া হতো। ধ্রুপদ হচ্ছে রাগভিত্তিক এবং তালভিত্তিক গান, যেটা বড়ো করে গাওয়া হয়। ধ্রুপদে তান নেই, সারগাম নেই। ধ্রুপদের বিষয় সবসময়ই ছিল ভক্তিরস এবং ধ্রুপদে ছিল খুব কঠোর অনুশাসন। তবে আঙ্গিকটি খুবই প্রাচীন এবং খুব কদর ছিল ধ্রুপদের। আমাদের বাংলা ভাষাতেও ধ্রুপদের চর্চা হতো।
সম্রাট শাহ রঙিলের মনে হয়েছিল, ধ্রুপদ তাঁর দরবারের পক্ষে বড্ড বেশি গুরুগম্ভীর, আরেকটু লঘু কিছু চাই। তাঁর অনুরোধে তাঁর দরবারের দুই প্রধান সভাশিল্পী অদারঙ আর সদারঙ খেয়াল আঙ্গিকটি উদ্ভাবন করেন। আরবি আর ফার্সি ভাষায় খেয়াল মানে হচ্ছে কল্পনা। ধ্রুপদ থেকেই কিছুটা ধার দেনা করে খেয়াল আঙ্গিকটি সম্ভবত তৈরি হয়। কোনো কোনো ইতিহাসবেত্তা অবশ্য এও বলেন, হজরত আমির খসরু খেয়ালের জনক।
ধ্রুপদের মতো খেয়ালেও একটা মূল গান থাকে। এই মূল গানটাকে উর্দু, হিন্দি এবং বাংলাতেও বন্দিশ বলা হয়। এই বন্দিশে একটি স্থায়ী, একটি অন্তরা থাকে, ছোট, ধ্রæপদ আরো বড়ো। ধ্রুপদের মতো একেকটি রাগে একেকটি খেয়াল। অদারঙ ও সদারঙ হিন্দি প্রেমকাব্য পদুমাবতের ওপর ভিত্তি করে খেয়াল বন্দিশ বা খেয়াল গান রচনা করেন, সুরারোপ করেন এবং গাইতে থাকেন। এর সঙ্গে তান যুক্ত হয়, যুক্ত হয় সারগাম, স্বরবিস্তার। ফলে ধ্রুপদের যে ঘেরাটোপ ছিল, খেয়ালে সেগুলো আর রইলো না। খেয়ালে বিষয় হিসেবে এলো প্রেম, প্রকৃতি, নানান ধরনের আবেগ-অনুভব ইত্যাদি বিষয়। খেয়ালে স্থান পেলো কল্পনা আশ্রিত রস, একটু লঘুত্ব। এবং সেই লঘুত্ব শুধু বিষয়ে না, গায়কীর মধ্যেও প্রতিফলিত হলো।
সঙ্গীতাচার্য সত্যকিঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় প্রাণপণ চেষ্টা করেছেন বাংলা খেয়াল রচনা করতে এবং বাংলা খেয়ালের হয়ে প্রচার করতে। বিশ শতকের তিন ও চারের দশকে পশ্চিমবঙ্গের প্রবাসী, বসুমতী, যুগান্তর এবং আরও কিছু পত্রিকায় বাংলা খেয়ালের পক্ষ নিয়ে অনেকে কলম ধরেন। কিন্তু ধীরে ধীরে বাংলায় খেয়ালের চর্চা স্তিমিত হয়ে আসে।
বাঙালি দীর্ঘকাল ধরে বাংলা খেয়ালের পথে এগোননি কিন্তু বাংলাদেশে প্রয়াত সঙ্গীতজ্ঞ আজাদ রহমান খুব চেষ্টা করেছেন বাংলা খেয়াল রচনা করে গাইতে এবং শেখাতে। আজাদ রহমান যখন বাংলা খেয়ালের চর্চা করেছেন ঠিক ঐ সময়টাতে পশ্চিমবঙ্গে কিন্তু ওরকম নাম করা কাউকে পাওয়া যায়নি।
তবে এখনও পর্যন্ত বাংলা খেয়াল গানগুলোর ভাষা ও অঙ্গ বেশ সাবেকীই রয়ে গেছে। রবীন্দ্রনাথ দুটি শব্দ তৈরি করেছেন ‘সাবেকিয়ানার মোহ’ ও ‘ক্লাসিকিয়ানার মোহ’। এই দুই মোহ থেকে খেয়াল কিংবা বাংলা খেয়াল বের হতে পারেনি।
ব্রজবুলি, ঠেট, মৈথিলি, ভোজপুরি, পাঞ্জাবি, মুলতানি, হিন্দি, উর্দু, রাজস্থানি, মারাঠি, দারি, পশতু ভাষায় অর্থাৎ উপমহাদেশের অন্তত ১০/১২টি ভাষায় খেয়াল রচনা হয় এবং গাওয়া হয়ে থাকে। একসময় বাংলাতেও হতো, দীর্ঘকাল হয়নি। আবার হচ্ছে।
কবীর সুমন ২০১৫ সাল থেকে নিয়মিত বাংলা খেয়াল রচনা করছেন, গাইছেন ও শেখাচ্ছেন। তিনি প্রাণপনে চেষ্টা করে চলেছেন বাংলা খেয়ালকে ‘সাবেকিয়ানা’ ও ‘ক্লাসিকিয়ানা’র মোহের ঘেরাটোপ থেকে মুক্ত করতে। বাংলা ভাষায় খেয়ালের প্রবল বিরোধিতা সত্তে¡ও তিনি বাংলা খেয়াল নিয়ে তাঁর লড়াই জারি রেখেছেন। কবীর সুমন তাঁরই রচিত বই ‘বাংলা খেয়াল’সহ বাংলা খেয়ালের আরো নানা দিক নিয়ে আলোচনা করেন পাঠশালার এ আসরে।
কবীর সুমনের লেখা ৭৩ পৃষ্ঠার ‘বাংলা খেয়াল’ বইটি ২০১৮ সালের জানুয়ারিতে কোলকাতার ‘কাগজের ঠোঙা’ প্রকাশনী থেকে বের হয়। বইটিতে প্রথমেই ২০ পৃষ্ঠা জুড়ে টেক্সটে খেয়াল ও বাংলা খেয়াল নিয়ে খুব প্রয়োজনীয় কথা লেখা আছে। আর আছে ২৯টি রাগের ওপর ৫৫টি খেয়াল গান বা বন্দিশ। এই গানগুলো কবীর সুমনের কণ্ঠে একটি সিডিতে আছে বইটির সঙ্গে। উল্লেখ্য, ‘বাংলা খেয়াল’ বইয়ে ছাপা ২৯টি রাগই নয়, কবীর সুমন এ পর্যন্ত প্রায় সাড়ে ৪০০ রাগের ওপর বাংলা খেয়াল গান রচনা করেছেন, এখনো রচনা করে চলেছেন। নিজে নতুন রাগ সৃষ্টি করেছেন। যেমন – আহির বৈরাগী, অবন-কথা, রবিশঙ্কর, জয় বাংলা, মধ্যম রঞ্জনী, দিন শেষ, আজাদ, সন্ধ্যা ইত্যাদি। ইতোমধ্যেই তিনি সংগ্রহ করেছেন প্রায়-বিস্মৃত কয়েকশো বাংলা খেয়াল। যেসব রাগে বাংলা খেয়াল তো দূরের কথা, কোনো খেয়ালই রচিত হয়নি, তেমন বেশ কয়েকটি রাগে (বাঁশির যাদুকর সঙ্গীতাচার্য পান্নালাল ঘোষ সৃষ্ট নূপুরধ্বনি ও দীপাবলী রাগ) তিনি বাংলা খেয়াল গান লিখেছেন।
আসরের শুরুতেই সিলেটের লিডিং ইউনিভার্সিটি ক্যাম্পাসের শহীদ মিনারের ছবি দেখানো হয়, যেখানে স্থপতি রাজন দাশ কবীর সুমনের ‘আমি চাই সাঁওতাল তার ভাষায় বলবে রাষ্ট্রপুঞ্জে’ গানের লাইন ব্যবহার করেছেন।
কবীর সুমন একুশ নিয়ে বেশ কয়েকটি খেয়াল গান রচনা করেছেন, গেয়েছেন। কোলকাতার শিশির মঞ্চে ২১শে ফেব্রæয়ারি ২০২০ সালে, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষ্যে আয়োজিত খেয়ালের অনুষ্ঠানে বাহার ও বসন্ত রাগের ওপর একুশ নিয়ে তিনি কয়েকটি খেয়াল গেয়েছেন। যেমন বর্ণমালার সুরে বাংলা ভাষায় গান, পল্লবে পল্লবে সেজেছ তুমি ফাল্গুন, ফিরে ফিরে আসো একুশে ফেব্রুয়ারি ইত্যাদি। এর মধ্যে ‘বর্ণমালার সুরে বাংলা ভাষায় গান, এ ভাষাতেই খেয়াল গাওয়া আবহমান। অমর শহীদের স্মৃতি একুশ তার ডাক পাঠায়, বাঙালি যেন তার মুখের বাংলাতেই খেয়াল গায়’ এই গানটির একটি ভিডিওক্লিপ দেখানো হয়।
এরপর কবীর সুমন ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীত হিসেবে ধ্রুপদ থেকে খেয়ালের শুরু, খেয়াল আঙ্গিকটির বিস্তারিত ব্যাখ্যা, বাংলা খেয়ালের সঙ্গে তাঁর পথ পরিক্রমা, বাংলা খেয়াল নিয়ে তাঁর ভাবনা, তাঁর কাজ, বাংলা খেয়ালকে জনস্বীকৃতির জায়গায় আনতে সঙ্গীতাচার্য সত্যকিঙ্কর বন্দোপাধ্যায়ের লড়াই, খেয়ালের অচলায়তন, বাংলা খেয়ালের রূপ-ভাষা-আঙ্গিক — এ বিষয়গুলো নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেন।
কবীর সুমন বলেন, “আমি প্রথম বাংলাদেশে গান গাইতে গিয়েছিলাম বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ যাদুঘরের আমন্ত্রণে ১৯৯৬ সালে। আমার আধুনিক বাংলা গান বলাই বাহুল্য। আমি তো আধুনিক বাংলা গানই রেকর্ড করেছিলাম। দীর্ঘ দিন গেয়েছি। এখনও মাঝে মাঝে গাই ইচ্ছে হলে। সেই গানগুলো নিয়ে আমি গিয়েছিলাম বাংলাদেশে। ৫টি কনসার্ট হয়েছিল মুক্তিযুদ্ধ যাদুঘরের তহবিল তোলার জন্য। আমি ডঃ জাকিউর রহমানের তত্ত¡াবধানে ছিলাম। একদিন উনি আমাকে শিল্পকলা একাডেমিতে নিয়ে গেছেন। এক যুবতী এসে আমায় প্রণাম করে বললেন, ‘আমার বাবার নাম আবদুল মতিন।’ এটা শুনেই আমার পিঠ দিয়ে শিরশির করে একটা কী যেন নামল। যুবতীটি অদ্ভুত আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বললেন, ‘আপনি যাঁর কথা ভাবছেন তিনিই। বাবা আপনার সঙ্গে দেখা করতে চান।’ ভাষা মতিনের সঙ্গে আমার দেখা হবে, এটা তো আমার জন্য একটা ঘটনা! জাতীয় যাদুঘরে একটা কনসার্ট হলো। অনুষ্ঠান শেষে আমন্ত্রণকর্তাদের একজন, আমার বন্ধু আসাদুজ্জামান নূর আমায় বললেন, ‘ভাষা মতিন এসেছেন।’ আমি তাঁর সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। থরথর করে কাঁপছিলাম আমি। এক মূর্তিমান ইতিহাসের সামনে দাঁড়িয়ে আমি। আমি তাঁকে প্রণাম করলাম। তিনি শান্তভাবে সেই প্রণাম গ্রহণ করলেন, মাথায় হাত রেখে আশীর্বাদ করলেন। আমি বললাম, ‘আপনি এত কষ্ট করে এলেন?’ তিনি বললেন, ‘সুমন, একজন ভাষা সৈনিক আরেকজন ভাষা সৈনিকের কাছে যাবে এটা প্রকৃতির নিয়ম।’ এই কথাটা যেখানে উচ্চারিত হতে পারে, তার নামই বাংলাদেশ। এই কথাটা আর কেউ বলবে না, আর কোথাও শোনা যাবে না বাংলা ভাষায় এইভাবে একটি বাক্য। তখনও আমার নাম কবীর সুমন। এই নামটি আমি আনুষ্ঠানিকভাবে ভারতের আইনের সাহায্যে, সংবিধানের সাহায্যে গ্রহণ করেছি ২০০০ সালে। আমি ১৯৯৬ সালের কথা বলছি। তখন আমি সুমন চট্টোপাধ্যায়। এখন আর সেটা আমার নাম নয়।
“ধ্রুপদের পদ অর্থাৎ কথাগুলির অধিকাংশই হিন্দু দেব দেবী দিয়ে। অথচ ধ্রæপদের যেসব সেরা শিল্পী, সারা উপমহাদেশে সারা পৃথিবীতে যাঁদের নাম, তাঁদের বেশিরভাগই কিন্তু তথাকথিত সংগঠিত ধর্মের দিক দিয়ে মুসলমান। যেমন ডাগর ব্রাদার্স ইত্যাদি। আবার হিন্দুরাও ধ্রুপদ গেয়েছেন। হয়তো খৃষ্টানরাও গেয়েছেন, শিখরাও গেয়েছেন। এটা ধর্মের ব্যাপার না। কিন্তু হিন্দু দেব দেবীর নামেই বেশিরভাগ ধ্রুপদের পদ। গাইছেন পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়া, রোজা রাখা মুসলমান। এই বিষয়টা আমাদের উপমহাদেশের জন্য খুব জরুরি। একটা উদাহরণ দিই। একটা রাগ আছে, নাম স্বরস্বতী। এটা কর্ণাটক পদ্ধতির রাগ। এই রাগে কোনো বাংলা গান সেই অর্থে নেই। এই রাগটির কথা আমরা বাঙালিরা সবাই জানতে পেরেছি অনেক পরে। আমাদের আগের প্রজন্মের যাঁরা রচয়িতা ছিলেন, তাঁরা স্বরস্বতী রাগটির সঙ্গে অতটা পরিচিত ছিলেন বলে মনে হয় না। হলে যেমন কাজী নজরুল ইসলাম নিশ্চয়ই স্বরস্বতী রাগে কোনো না কোনো গান লিখতেন। উনি কিন্তু একাধিক দক্ষিণী/কর্ণাটকী রাগে গান রচনা করেছেন। স্বরস্বতী একটি হিন্দু দেবীর নাম। ইন্টারনেটে দেখা যায়, পাকিস্তানের ধর্মে মুসলমান অন্তত দুতিনজন শিল্পী স্বরস্বতী রাগ গাইছেন। আবার কিংবদন্তী শিল্পী সঙ্গীতাচার্য সালামত আলি খান যখন স্বরস্বতী গাইছেন, তাঁর তো কোথাও কোনো সমস্যা হচ্ছে না। এটা আমাদের উপমহাদেশ। কিন্তু আমরা ব্যাপারটা নিয়ে ভাবি না। সঙ্গীতাচার্য সালামত আলি ও নাজাকাত আলি কী না করেছেন একসময়। পৃথিবী কাঁপিয়ে দিয়েছেন তাঁদের গান, বিশেষ করে তাঁদের তান-সারগাম দিয়ে। তাঁরা হিন্দু দেব দেবীর নামে লেখা ধ্রুপদ গাইছেন। অনেকেই জানেন না, পাকিস্তানের মহা শিল্পী আচার্য মেহেদী হাসান কিন্তু ধ্রুপদ শিল্পী। তেমনি পাকিস্তানের অধিকাংশ ক্ল্যাসিক্যাল শিল্পী যেমন সালামত আলি খান সাহেব, নাজাকাত আলি খান সাহেব ওঁরা প্রত্যেকে ধ্রুপদ শিখেছেন। যেটা কিন্তু ভারতে না, বাংলাদেশেও আমার জানা মতে, না। অথচ ধ্রুপদের পদগুলো কিন্তু হিন্দু দেবদেবীর নামে। খুব আগ্রহ উদ্দীপক এই জায়গাটি। এখনকার সব নেতিবাচক জিনিসের মধ্যে এটা একটা আশার বাতিঘর হয়ে জ্বলছে আমাদের সবার জন্য।
“আরেকটা জরুরি জায়গা হচ্ছে আমাদের কীর্তন। আমাদের পদাবলী কীর্তন, যেমন ‘বলো বলো সখা কুশল মানি, তোমার কুশলে কুশল মানি।’ এই কীর্তন আমাদের বাঙালির ক্ল্যাসিক্যাল মিউজিক হবার কথা। উড়িষ্যায় যেমন ক্ল্যাসিক্যাল মিউজিক খেয়াল, ঠুমরি, ধ্রুপদ না – ওঁদের নিজেদের গান। অনেক বাঙালি ভাদু, টুসু, বাউল গানের সঙ্গে কীর্তন জুড়ে দেন। কীর্তন কিছুতেই লোকসঙ্গীত নয়। কীর্তন ক্ল্যাসিক্যাল মিউজিক। তাতে বিভিন্ন বড়ো বড়ো তাল আছে। ছোটো দশকোষী, বড়ো দশকোষী। এসব তালগুলো শিখতে জীবন বেরিয়ে যায়। আমার মা পদাবলী কীর্তন গাইতেন। আচার্য পঞ্চানন ঘোষাল মা’কে শেখাতেন। আমি আড়ালে আবডালে শুনতাম তাঁর গান। যেমন একটি গান ‘দেখে এলাম তারে সখী দেখে এলাম তারে। একই অঙ্গে এত রূপ নয়নে না ধরে।’ তুলনাহীন একটা কীর্তন এবং এটা গাইতে গেলে দীর্ঘ অধ্যবসায়, দীর্ঘ অনুশীলন দরকার। যেটা খেয়ালের চেয়ে কম নয় বরং বেশি।
“প্রশ্ন আসে, বাঙালির পেছনে কী আছে? ১০০০ বছরের বাঙালির ইতিহাসে চর্যাপদ থেকে নিয়ে একটা মস্ত জায়গা জুড়ে রয়েছে কাব্য। দীর্ঘকাল ধরে কাব্য আমাদের চালিত করেছে। তার মধ্যে রাধা-কৃষ্ণ আছেন কিন্তু রাধা-কৃষ্ণর মধ্যে সবসময় সেক্যুলার ব্যাপারটা নেই। আমাদের বাংলা ভাষায় প্রথম সেক্যুলার প্রেমকাব্য পেলাম ‘ইউসুফ জুলেখা।’ যেমন ‘পিরিত রতন পিরিত রতন পিরিত গলার হার, পিরিত কাঞ্চন পাইল যে জন সফল জনম তার রে, দুনিয়া পিরিতের বাজার।’ কিংবা ‘ইউসুফ নবীর প্রেমে পাগল, হাল দেখো না জুলেখার।’ এই ইউসুফ নবীর গল্প আমাদের কাছে এলো এক সাংস্কৃতিক নদী দিয়ে। সেটা পারস্যের। তাহলে প্রশ্ন জাগতে পারে, উপমহাদেশের অন্যান্য ভাষার কি এই ট্র্যাডিশনটা নেই? এতো জাগ্রতভাবে নেই। নিশ্চয়ই আছে। যেমন পদুমাবত। হিন্দী প্রেমকাব্য পদুমাবত থেকে যেমন সম্রাট মহম্মদ শাহ রঙিলের দরবারের দুই সভাশিল্পী অদারঙ আর সদারঙ তাঁদের খেয়াল গানের কথা সংগ্রহ করে নিলেন, তেমনি আমাদের বাংলার কবি সৈয়দ আলাওল তাঁর পদ্মাবতী কাব্যটি লিখেছেন ঐখান থেকে। এটা খুব জরুরি একটা জায়গা। বাঙালি কাব্য ছাড়া বাঁচে না, বাঁচবে না। তাহলে অন্যরা? অন্যরা এতটা না। আমরা ছন্দ মিলিয়ে কথা বলি, ছন্দ মিলিয়ে লিখি, এটা আমাদের স্বভাব। আমরা বিয়েতে বই বা কিছু উপহার দিই ওপরে ছন্দ মিলিয়ে কিছু একটা লিখে। আগে আমাদের ছেলেবেলায় দেখতাম, বিয়ে হলে একটা টিনের রঙিন তোরঙ্গে সুন্দর করে লেখা থাকত ‘যাও পাখি বলো তারে, সে যেন ভোলে না মোরে।’ এর মধ্যে ছন্দ কাজ করছে। এটা কি অন্যদের নেই? নিশ্চয়ই আছে। কিন্তু বাঙালির খুব স্পষ্টভাবে আছে। যেমন পশ্চিমবঙ্গে বিয়ের সময় কনের নানী বা দাদী পাত্র-পাত্রীকে নিয়ে একটা পদ্য লিখতেন। জানিনা এখনো সেটা পশ্চিমবঙ্গে কিংবা বাংলাদেশে চালু আছে কিনা। আমি এমনটা বাংলাদেশেও দেখেছি। এখন হয়তো সেটা দূর্বল হয়ে গেছে, কিন্তু হারিয়ে যায়নি। এই যে দাদী বা নানী বসে বসে মাথা খাটিয়ে, ছন্দ মিলিয়ে মিলিয়ে, এমনকি অন্তঃমিল দিয়ে দিয়ে, নানারকম অলঙ্কার দিয়ে দিয়ে কয়েকদিন ধরে একটা কাব্য লিখলেন, এটা তো ইংরেজরা করেন না। কাশ্মিরিরা করেন বলে জানা যায় না।
পাঞ্জাবিদের জীবনে গানের বিশাল ভূমিকা। বিয়ে হলো কি গান আরম্ভ হয়ে গেল। বাঙালিদের চেয়ে খুব একটা কম না। কিন্তু নানী-দাদীরা বসে বসে পদ্য লিখছেন, এর জুড়ি সবসময় পাওয়া যাবে না। অর্থাৎ বাঙালির জীবনে শুধু সুর না, কথারও অনেক গুরুত্ব। যেমন রাধাকৃষ্ণের উপাখ্যান। সেই উপাখ্যানগুলোতে রাধা-কৃষ্ণ কি হিন্দুদের পৈত্রিক সম্পত্তি? একেবারেই না। পঞ্চদশ শতাব্দী থেকে, অর্থাৎ আমাদের মধ্যযুগে অন্তত ৫৫ জন বাঙালি মুসলমান কবি ছিলেন যাঁরা বৈষ্ণব পদ লিখতেন। তাঁদের একজনের নাম ছিল শেখ কবীর। এই বৈষ্ণব পদকর্তা কবীরের নাম থেকে আমি আমার প্রথম নাম নিয়েছি কবীর। সন্ত কবীর না। শেখ কবীর একজন ধর্মপ্রাণ মুসলিম ছিলেন। কিন্তু এটাকে তিনি অধর্ম বলে মনে করছেন না। এটা বাঙালির আত্মা। খুব বড়ো জায়গা এটা। এর জুড়ি পৃথিবীতে কোথাও নেই। এইজন্য আমাদের ক্ল্যাসিক্যাল মিউজিক খুব সেক্যুলার। কীরকম সেটা? যেমন সঙ্গীতাচার্য বড়ে গোলাম আলি খান ছিলেন একজন ধর্মপ্রাণ মুসলমান। ৫ ওয়াক্ত নামাজ, রোজা, সমস্ত পালা-পার্বণ তিনি করতেন। সেইসঙ্গে পুজো আর্চাও করতেন। তিনি পাহাড়ি রাগে ঠুমরি তৈরি করলেন ‘হরি ওম তৎসত, হরি ওম।’ এটা গাইতে তাঁর কোনো অসুবিধা হচ্ছে না।
শ্রোতাদেরও হচ্ছে না। এটা খুব জরুরি একটা জায়গা। এবং আমাদের ধ্রæপদ বা খেয়ালের স্পিরিট বা বাংলার গানের স্পিরিটকে বুঝতে গেলে এটাকে ধরতে হবে। কিন্তু আমরা ব্যাপারগুলো নিয়ে ভাবি না। এত সম্পদ আমরা পেয়েছি কিন্তু আমরা তো তাকে সম্মান দিতে শিখলাম না। আমার গুরু প্রয়াত কালিপদ দাস একজন অসামান্য মানুষ। উনি আমায় খেয়াল শিখিয়েছেন। তার মধ্যে একটা গান ছিল সালাগ বরারি তোড়ি রাগে। গানের কথাটা ছিল ‘সুমির সাহব সুলতান আলম, নিজামুদ্দিন আলিয়া মন্।’ এটা দিল্লীর নিজামউদ্দিন আউলিয়ার মাজারেও গাওয়া হয়।
আমার মাস্টারমশাই কালিপদ দাস একজন ধর্মপ্রাণ হিন্দু ছিলেন। তাঁর ওয়ালেটে মা কালির ছবি থাকত, জবাফুল থাকত। উনি সেটা কপালে ঠেকাতেন। ওঁর কিন্তু ‘সালাগ বরারি তোড়ি’ রাগে ‘সুমির সাহব সুলতান আলম’ গানটা শেখাতে কোনো অসুবিধা হয়নি। এর নাম উপমহাদেশ। এর নাম ভারত। এর নাম বাংলাদেশ। আমরা এটা ভুলে যাই।
“আমি ধ্রুপদের লোক না হলেও ধ্রুপদের সঙ্গে আমার যথেষ্টই যোগাযোগ আছে, আপনাদেরও আছে। যেমন ইমনকল্যাণ রাগে রবীন্দ্রনাথের গান ‘মহাবিশ্বে মহাকাশে মহাকাল-মাঝে, আমি মানব একাকী ভ্রমি বিস্ময়ে।’ এই যে গানের ধরন, এটাই ধ্রæপদ। এইরকম একাধিক রবীন্দ্রনাথের গান আছে। ধ্রæপদের চলন ছিল এইরকম, বেশ হেভি ডিউটি, মানে বেশ গুরুত্বর ব্যাপার। এই হচ্ছেন রবীন্দ্রনাথ। এই হচ্ছে তাঁর ধ্রæপদ ভেঙে তৈরি আধুনিক গান। কোন হিসেবে এটাকে আমি আধুনিক গান বললাম? তাঁর হিসেবে। ইন্দিরা দেবী চৌধুরানীকে লেখা তাঁর একটি চিঠিতে তিনি লিখছেন, ‘আমার আধুনিক গানে রাগ, তালের উল্লেখ নেই বলে তুই আক্ষেপ করেছিস।’ এই যে মানুষটি তিনি ধ্রুপদাঙ্গে গান যেমন লিখছেন, তেমনি খেয়াল আঙ্গিকে লিখছেন, ‘নব আনন্দে জাগো আজি নবরবিকিরণে।’ গানটি তিনতালে। এটি কেউ চাইলে খেয়াল হিসেবে গাইতেই পারেন। কোনো আপত্তি নেই কিন্তু।
“ধ্রুপদ থেকে খেয়ালে শিফটের একটা বড়ো জায়গা হলো – পরিবর্তনশীলতা। একভাবে কিছু নেই। মিয়া তানসেনের যুগ তো থেমে নেই। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘সঙ্গীতের উৎপত্তি ও উপযোগিতা’ প্রবন্ধে লিখেছেন, ‘সঙ্গীতে এতখানি প্রাণ থাকা চাই যাহাতে সে সমাজের সহিত বাড়িতে থাকে, সমাজের বিবর্তনের সহিত পরিবর্তিত হইতে থাকে, সমাজের উপর নিজের প্রভাব বিস্তৃত করিতে পারে ও তাহার উপরে সমাজের প্রভাব প্রযুক্ত হয়।’ বাংলা গানে একদিকে যেমন কীর্তন অন্যদিকে তেমনি ধ্রুপদ অঙ্গও। যেমন স্বামী বিবেকানন্দ বাগেশ্রী রাগে গান তৈরি করছেন ‘নাহি সূর্য নাহি জ্যোতি, নাহি শশাঙ্ক সুন্দর’। এটা ধ্রুপদ। উনি তানপুরা নিয়ে গাইতেন। অত্যন্ত সুকণ্ঠী গায়ক ছিলেন। উনি ধ্রুপদ গাইতেন, খেয়ালও গাইতেন, বাংলা খেয়াল। এইসব আগ্রহোদ্দীপক বিষয় আমাদের খুব একটা বলা হয় না। উনি ধ্রুপদ গাইছেন, বাংলায় ধ্রুপদ। হিন্দি, ব্রজবুলি বা ঠেট ইত্যাদি ভাষায় না। তেমনি আছে রামমোহন রায়ের গাওয়া বেহাগ রাগে ত্রিতালে ব্রহ্মসংগীত ‘নিত্য নিরঞ্জন নিখিল কারণ, বিভু বিশ্বনিকেতন।’ আবারও ধ্রুপদ। রবীন্দ্রনাথ যেমনটা বলেছেন, সমাজ তো এক জায়গায় দাঁড়িয়ে নেই। সমাজ পাল্টাচ্ছে। তার চাহিদা পাল্টাচ্ছে। চাহিদা পূরণের নতুন নতুন জায়গা বের হচ্ছে। মানুষের অভ্যেস পাল্টাচ্ছে। এর সঙ্গে সঙ্গে সঙ্গীতও পাল্টাতে লাগলো। প্রাণ ছিল বলেই হলো। ধ্রুপদ থেকে খেয়ালে যে পরিবর্তনটা এলো, যে রূপান্তরটা ঘটল, এটা প্রাণ ছিল বলে হলো। এবারে খেয়ালে তো গান চাই। গানগুলো কারা লিখবেন? লেখকরা যে সবসময় এগিয়ে এসেছেন, তা কিন্তু না। আগ্রহোদ্দীপক ব্যাপার হলো, যাঁরা গায়ক-গায়িকা তাঁরা গান লিখেছেন। যেমন ওস্তাদ ফৈয়াজ খান সাহেব অনেক খেয়ালের বন্দিশ লিখেছেন। তেমনি আচার্য চিন্ময় লাহিড়ী অনেক খেয়াল বন্দিশ লিখেছেন। আবদুল করিম খান সাহেব লিখেছেন ‘যমুনা কি তীর’। ভৈরবী রাগে ঠুমরি আঙ্গিকের গান। এই যে সঙ্গীত সমানে পাল্টাচ্ছে, সংক্ষিপ্ত হয়ে আসছে, বড়ো জিনিস থেকে ছোটো হচ্ছে এটা কিন্তু একটু ভাবা দরকার। তখন গ্রামোফোন রেকর্ড এসে গেছে। নতুন উদ্ভাবন। আড়াই মিনিটের মধ্যে শিল্পীকে গাইতে হবে। আসরে তিনি গাইছেন হয়ত দশ মিনিট ধরে কি এক ঘণ্টা ধরে। কিন্তু আড়াই মিনিটের মধ্যে শিল্পীকে গাইতে হবে রেকর্ডে। গালার রেকর্ড আড়াই মিনিটের, ৭৮ আরপিএম। তাতে শিল্পী গাইছেন। ফলে সমাজের পরিবর্তনটা কোথায় কোথায় হলো? এইখানেও। অর্থাৎ সঙ্গীত গতিশীল হয়ে উঠল। কীভাবে? যেটা অষ্টাদশ শতাব্দীতে ছিল না, ঊনবিংশ শতাব্দীতেও ছিল না, বিংশ শতাব্দীতে হলো। কীভাবে হলো? বেতার উদ্ভাবন হলো? বেতার এলো উপমহাদেশে। আর এলো গ্রামোফোন রেকর্ড। রেকর্ডিং এলো। ফলে প্রচুর সঙ্গীত দরকার হলো। সম্ভবত ১৯২৩ সাল নাগাদ কোলকাতা ছিল এই রেকর্ডিং জগতের কেন্দ্র। শুধু ভারত না, সমগ্র উপমহাদেশের। যেমন ইরানের গ্রামোফোন রেকর্ড কোলকাতায় ছাপা হতো। কোলকাতার বেলেঘাটায় ফ্যাক্টরি ছিল গ্রামোফোন কোম্পানি অফ ইন্ডিয়ার। এবং পৃথিবীর বিভিন্ন গ্রামোফোন কোম্পানির রেকর্ড লেবেল কোলকাতায় এসে বাসা বাঁধে। তার একটা কারণ, ১৯১৩ সাল অব্দি কোলকাতা ছিল বৃটিশ ভারতের রাজধানী। এখানে তখন প্রথম শিল্পায়ন শুরু হলো। ফলে এখানে বলা বাহুল্য গ্রামোফোন রেকর্ডের কারখানাও তৈরি হলো। ১৯২৩ সাল নাগাদ বৈদ্যুতিক রেকর্ডিং পদ্ধতি এলো। আগে ছিল হাতে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে। ফলে উৎপাদন ক্ষমতা অনেক বেড়ে গেলো। এরকম সমাজের পরিবর্তনগুলো হচ্ছে।
উৎপাদন ক্ষমতা যেই বেড়ে গেলো, সঙ্গে সঙ্গে গান আরো বেশি দরকার হলো। আমার বাবা সুধীন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়ের কাছে আমি শুনেছি, পূর্ববঙ্গের সওদাগররা ছিলেন গানের বড়ো ক্রেতা। তাঁদের জন্য টুইন রেকর্ড নামে একটা লেবেল বের হয়। এই লেবেল ছিল বিভিন্ন বড়ো বড়ো কোম্পানির যেমন গ্রামোফোন কোম্পানি অফ ইন্ডিয়া, এইচএমভি, কলাম্বিয়া, আমেরিকার বড়ো বড়ো কোম্পানির। তাদের জনপ্রিয় গানগুলো সস্তায় মানুষ যাতে কিনতে পারে সেভাবে ছাপানোর জন্য। স্টিমারে স্ট্যাক করে গ্রামোফোন যেত কোলকাতা থেকে বাংলাদেশে। বাংলাদেশের সওদাগরদের মধ্যে একটা অদ্ভুত ক্ষুধা দেখা দিয়েছিল সঙ্গীতের ব্যাপারে। তাঁরা অসম্ভবরকম সঙ্গীত শুনতেন। এই জায়গাটা খুব জরুরি। টুইন রেকর্ড এবং স্ট্যাক করা বা দম দেওয়া গ্রামোফোন যেতো পূর্ববঙ্গে স্টিমারে করে। এই যে যাচ্ছে ততো কিন্তু বাজার বড়ো হচ্ছে। অর্থাৎ একদিকে আমরা মিয়া তানসেনের ধ্রুপদ থেকে এসেছি খেয়ালে। কিন্তু খেয়ালও তো আর দাঁড়িয়ে নেই। এদিকে আমরা কোলকাতায় পাচ্ছি পটভূমির বড়ো রকমের পরিবর্তন। দেবী স্বরস্বতীর বরপুত্র ওস্তাদ ফৈয়াজ খান কোলকাতা এসে বাসা বাঁধলেন। দেবী স্বরস্বতীর আরেক বরপুত্র সঙ্গীতাচার্য বড়ে গোলাম আলি খান সাহেব কোলকাতা এসে বাসা বাঁধলেন। তেমনি এলেন বাদল খান সাহেব। ঐ যে রবীন্দ্রনাথের উক্তি, ‘সঙ্গীতে এতখানি প্রাণ থাকা চাই যাহাতে সে সমাজের সহিত বাড়িতে থাকে, সমাজের বিবর্তনের সহিত পরিবর্তিত হইতে থাকে, সমাজের উপর নিজের প্রভাব বিস্তৃত করিতে পারে ও তাহার উপরে সমাজের প্রভাব প্রযুক্ত হয়।’ একসময় ক্ল্যাসিক্যাল গান শুনতেন ধনীরা, সামন্ত রাজারা, রাজা-রাজড়া, আমির ওমরাহরা। সঙ্গীত দরবার থেকে বেরিয়ে এলেও কুঠি ছাড়তে পারছে না। কিন্তু তিনের দশকে একটা বিরাট পরিবর্তন এলো। কোলকাতা শহরে শুরু হলো কনসার্ট ইন্ডাস্ট্রি। ফৈয়াজ খান সাহেব, বড়ে গোলাম আলি খান সাহেব, বাবা আলাউদ্দিন খাঁ, তবলা যাঁর হাতে তৈরি হয়েছে সেই মসিদ খান সাহেব, আচার্য জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষ, আচার্য কেরামতউল্লাহ খান সাহেব এঁরা সবাই কোলকাতা এসে বাসা বাঁধলেন। এঁদের তো খেতে হবে। এঁরা তখন ফাংশন করা শুরু করলেন। এই ফাংশন যেই শুরু হলো, সেখানে সবাই টিকিট কেটে দেখার সুযোগ পেলো। সেখানে শুধু আর ধনী রাজা রাজড়ারা যাচ্ছেন না। এমনকি মেয়েরাও ঘোমটা টেনে যাওয়া শুরু করলো। একটা মস্ত গণতন্ত্রায়ন শুরু হয়ে গেলো। সমাজের বিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গীত কীভাবে পরিবর্তিত হলো? সঙ্গীত আর তার অচলায়তনে থাকতে পারছে না। গানে শ্লথগতি আর রইলো না, গতি দেখছি সেখানে। তাতে অন্যান্য কথা আসছে। প্রেমের কথা যেমন আসছে, তেমনি আসছে প্রকৃতির কথা। যেমন বসন্তকালের রাগ রাগেশ্রী। সেখানে বসন্তের সমাগমের কথা আসছে, কাব্য লিখছেন লোকে। এটা অতীতে ছিল কিনা আমাদের হাতে প্রমাণ নেই। আচার্য সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় লিখেছিলেন, শ্রীকৃষ্ণ কীর্তন আমাদের একটা প্রাচীনতম কাব্য সৃষ্টির নিদর্শন। যা পশ্চিমবঙ্গের মালদহের এক গোয়ালঘরে পাওয়া গিয়েছে? শিবনাথ শাস্ত্রী এটি উদ্ধার করেন। শ্রীকৃষ্ণ কীর্তন হচ্ছে গান। গান তো বুঝলাম আমরা। কিন্তু সুর কেমন ছিল জানি না, আঙ্গিক কেমন ছিল জানি না। কারণ না-ছিল রেকর্ডিং ব্যবস্থা, না ছিল স্বরলিপি। কিন্তু ছিল ঘরানা নামে অচলায়তনের কুঠি। ঘরানাতে লোকে শিখল যতো, তার চেয়ে বেশি শিখল পরনিন্দা-পরচর্চা। তবে সবটাই মন্দ না। ঝগড়াঝাঁটির মধ্য দিয়েই এগোতে লাগল সঙ্গীত। অর্থাৎ এরই মধ্য দিয়ে আমরা পেলাম কাজী নজরুল ইসলামকে। রবীন্দ্রনাথের গান কিন্তু সমাজে সচল হয়ে উঠতে পারেনি। কাজী নজরুল ছিলেন সাধারণ মানুষ। উনি গান বানিয়ে খান। উপমহাদেশের প্রথম পেশাদার সঙ্গীতকার। আকাশবাণী কোলকাতার উনি একজন কর্মচারী এবং অফিসার। তিনি কাজ করছেন পূর্ববঙ্গের সুরেশ চক্রবর্তী মশায়ের সঙ্গে। নজরুল গান শুনছেন আর রাগ তৈরি করছেন। যেমন ‘ভোরে ঝিলের জলে, শালুক পদ্ম তোলে, কে ভ্রমর-কুন্তলা কিশোরী।’ কোনোদিন বাঙালির ছিলই না এসব। অর্থাৎ সমাজে পরিবর্তন হয়ে গেছে। পরিবর্তন হচ্ছে। কোথাকার বর্ধমানের এক গ্রামের ছেলে লেখাপড়া শিখে, বইপত্র প্রচুর পড়ে এসে গেছেন পেশাগত সঙ্গীতের জগতে। মির্জা গালিবের কবিতায় সুর দিয়ে তৈরি করা ‘দিল-এ নাদান তুঝে হুয়া কিয়া হ্যায়’ রেকর্ড করলেন আচার্য মেহেদী হাসান। এই একই রাগে অর্থাৎ শুদ্ধ সারং রাগে নজরুলের লেখা, সুর করা গানের একটি – ‘ধুলি-পিঙ্গল জটাজুট মেলে, আমার প্রলয়-সুন্দর এলে।’ যারা সমানে বলে যাচ্ছেন বাংলায় খেয়াল হয় না কারণ বাংলা ভাষার নাকি ওজন নেই। তারা কি কাজী নজরুল ইসলামের গান শোনেননি? হিন্দী, ঠেট, ব্রজবুলি, পাঞ্জাবি, মুলতানি, কাশ্মিরি, দারি কোনো ভাষায় এই ধুলিপিঙ্গলের মতো গান আছে? কাজী নজরুল ইসলামের বিশিষ্ট বন্ধু ধীরেন্দ্র চন্দ্র মিত্র এ গানটা রেকর্ড করেছিলেন। এটাই বাংলা খেয়াল। বাংলা খেয়ালের একটা আঁকড় আমরা পেলাম। একটা মাত্র, আরো আছে। এইভাবে পরিবর্তনটা হচ্ছে। অর্থাৎ রবীন্দ্রনাথ, দ্বিজেন্দ্রলাল রায় একরকম পরিবর্তন আনছেন। সঙ্গে সঙ্গে কিন্তু তেড়ে পরিবর্তনের জোয়ারে চলেছে বাঙালি জাতি, বাংলা ভাষা।
“রবীন্দ্রনাথের উক্তিতে আবার ফিরে যাই – ‘সঙ্গীতে এতখানি প্রাণ থাকা চাই যাহাতে সে সমাজের সহিত বাড়িতে থাকে, সমাজের বিবর্তনের সহিত পরিবর্তিত হইতে থাকে, সমাজের উপর নিজের প্রভাব বিস্তৃত করিতে পারে ও তাহার উপরে সমাজের প্রভাব প্রযুক্ত হয়।’ সমাজের ওপর সঙ্গীত কীভাবে প্রভাব বিস্তার করল? এই গানগুলো লোকে গাওয়া শুরু করলো বাড়িতে বাড়িতে। গানের শিক্ষক এলেন। তাঁরা ঘরে ঘরে গিয়ে ছেলেমেয়েদের গান শেখানো শুরু করলেন। এভাবে পরিবর্তন হচ্ছে। গানগুলো আর আটকে থাকছে না, কারো কুক্ষিগত নয় আর গান। গানগুলো রেকর্ডিং এবং রেডিওর মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ছে সারা সমাজে। নজরুলের গান প্রচণ্ডরকমভাবে গতিশীল হয়ে উঠল বেতার এবং গ্রামোফোন রেকর্ড প্রযুক্তি ছিল বলে। যদি না-থাকত তাহলে মুশকিল হতো। বাঙালির ঘরে ঘরে নজরুলের গান পৌঁছে গেল। নজরুলের গান গান হয়ে উঠল। যে গান খোলামেলা গান। এই যে পরিবর্তনটা হচ্ছে এরই পূর্বসূত্র হচ্ছে মোগল সম্রাট মহম্মদ শাহ রঙিলের দরবারে ধ্রুপদ থেকে খেয়ালের পরিবর্তন। এই খেয়াল আঙ্গিক প্রভাব ফেলেছে গানে। আমরা বিশ শতকের ছয় এর দশকে আসি। সেখানে আমরা পাচ্ছি কলাবতী রাগে তিনতালে সলিল চৌধুরীর সুরে ‘ঝনন ঝনন বাজে, সুরবাহারে রসশৃঙ্গারে লাজে বাজে।’ এই রাগ কাজী নজরুলের সময়ে ছিল না। থাকলে অনেক গান তিনি কম্পোজ করতে পারতেন। এত প্রেম এই রাগে! গানটি শুনলে বোঝা যায় এটি খেয়াল অঙ্গের। এই গান গাইতে গেলে গান শিখতে হবে? এই পরিবর্তনটা এলো। অর্থাৎ গান শিক্ষা সাপেক্ষ। বাংলার মধ্যবিত্ত সমাজ সঙ্গীত শিক্ষায় এলেন। এই ধাক্কাটা এসে পড়ল। আমরা যদি দেখি রবীন্দ্রনাথের গান ‘জগতের আনন্দযজ্ঞে আমার নিমন্ত্রণ।’ এটা একতাল মধ্যগতিতে। দেখছি, খেয়াল প্রভাব ফেলছে আধুনিক গানে। রবীন্দ্রনাথ বলেননি এটা খেয়াল হিসেবে গাইতে হবে। কিন্তু সঙ্গীতাচার্য গোপেশ্বর বন্দোপাধ্যায় রবীন্দ্রনাথের একাধিক রচনা একদম বাংলা খেয়াল হিসেবেই গেয়েছেন। আরেক মস্ত শিল্পী ও ওস্তাদ জ্ঞানেন্দ্র প্রসাদ গোস্বামীও গেয়েছেন। তেমনি আছে ডি এল রায়ের গান ‘পতিতোদ্ধারিণী গঙ্গে।’ এটা এলো কোত্থেকে? ডি এল রায়ের পিতৃদেব ছিলেন বর্ধমানের দেওয়ান। উনি হিন্দি খেয়াল শিখেছিলেন। ডিএল রায় তাঁর ছেলে দিলীপ কুমার রায়কে বাড়িতে ওস্তাদ রেখে খেয়াল শেখান। এইভাবে খেয়াল আঙ্গিক আমাদের গানগুলোর ওপর প্রভাব ফেলতে থাকে।
“আগ্রহোদ্দীপক ব্যাপার হচ্ছে, খেয়াল তখন সারা উপমহাদেশে। উত্তর ভারতের গানে আমরা হিন্দিটাই তখন বেশি শুনছি। এই হিন্দি কিন্তু খাড়ি বোলি না অর্থাৎ বিশুদ্ধ হিন্দি না। তার মধ্যে উর্দুসহ বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর ভাষা, লোকায়ত ভাষা ঢুকেছে। যে কারণে হিন্দি এত জীবন্ত। সংস্কৃত ভাষাটা মরে গেল অন্য কোনো ভাষা থেকে শব্দ নেয়নি বলে। কোনোদিন কেউ ঐ ভাষায় কথা বলেনি। এরপর ভারতে, পাকিস্তানে কেলেঙ্কারি হয়েছে। ভারতে হয়েছে হিন্দির ধর্মায়ন আর পাকিস্তানে হয়েছে উর্দুর ধর্মায়ন। উর্দু ভাষায় জোরজার করে কিছু হিন্দি শব্দ উঠিয়ে পার্সিয়ান শব্দ ঢোকানো হয়েছে। ঠিক উল্টোটা হয়েছে ভারতে। এই রোগেই আমাদের গোড়াটা মরেছে এবং আরো মরবে। তবে আমার বিশ্বাস, বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান এর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ করবে। আজকে যে জায়গায় খেয়াল এসে দাঁড়িয়েছে তাতে দেখা যায় লোকে হিন্দিতে গাইছে। আপনি যদি দিল্লীতে, পেশোয়ারে কিংবা লাহোরে গান করেন, সেখানে বাংলায় গাইলে লোকে কথা বুঝতে পারছে না। এমন হতে পারে, এ কারণেই বাঙালি হিন্দি, উর্দু, ব্রজবুলি ইত্যাদি ভাষায় খেয়াল গেয়েছেন বেশি। বাংলায় অতটা গাননি। সঙ্গীতাচার্য সত্যকিঙ্কর বন্দোপাধ্যায় প্রথম বাংলা খেয়ালের চর্চা শুরু করলেন। সত্যকিঙ্কর বন্দোপাধ্যায় ছিলেন বিষ্ণুপুর ঘরানার শিল্পী। যে ঘরানায় বাংলাদেশের পণ্ডিতপ্রবর শিল্পীপ্রবর আজাদ রহমানও শিখেছেন। বিষ্ণুপুর ঘরানার শিল্পী আজাদ রহমানও। সত্যকিঙ্কর বন্দোপাধ্যায়ের চাচা গোপেশ্বর বন্দোপাধ্যায় ছিলেন সত্যকিঙ্করের গুরু। এঁরা সবাই বিষ্ণুপুর ঘরানার। বিষ্ণুপুর ঘরানা কিন্তু খেয়ালের না, ধ্রুপদের ঘরানা। আজাদ রহমানের লড়াইয়ের তুলনা নেই। উনি শুধু বাংলাদেশ না, পুরো উপমহাদেশে একটা দীর্ঘ সময় ধরে একা লড়াই করে গেছেন বাংলা খেয়ালের জন্য। ওঁর কোনো কাউন্টারপার্ট পশ্চিমবঙ্গে ছিল না। আর কেউ ছিলেন না যাঁর মুখ চেয়ে মানুষ ভাবতে পারে যে আমি বাংলা খেয়াল শিখব। কিন্তু আজাদ রহমান এই জায়গাটা দিতে পেরেছিলেন। এটা তাঁর মস্ত কৃতিত্ব এবং সেটা বাংলাদেশে। ওঁর ছবি ঘরে ঘরে থাকা উচিত, যেমনি থাকা উচিৎ সত্যকিঙ্করের ছবি। মোট কথা বাংলা খেয়ালের সেবক আর পাওয়া গেল না। রচয়িতা আর পাওয়া গেল না। আস্তে আস্তে দুর্বল হয়ে গেল বাংলা খেয়াল। এর কারণ বাঙালির আস্থার অভাব। বাঙালিরাই শুধু অভিযোগ করেন, বাংলায় নাকি খেয়াল হয় না। কারণ হিন্দি নাকি দাপুটে ভাষা। ইচ্ছে করে কেউ বধির হয়ে থাকলে তাকে বোঝানো অসম্ভব।”
এ পর্যায়ে কবীর সুমন সঙ্গীতাচার্য সত্যকিঙ্কর বন্দোপাধ্যায়ের লেখা ও সুর করা দুর্গা রাগে ‘নাচে সখীগন কুঞ্জে, ফুলদল ভাবে অলি এলো ধেয়ে গুঞ্জে। বিহবল চিত্তে হেরে ময়ুর ময়ুরী। মৃগদল দাঁড়ায়ে দেখে রূপমাধুরী। ঝুলনে রাধা-শাম প্রেমসুখে ভুঞ্জে’ গানটি গেয়ে শোনান। কবীর বলেন, “আমাদের মনে রাখতে হবে, গানটি যিনি লিখেছেন তিনি আজকের লোক না। বিশ শতকের ৫ এর দশকের তিনি আকাশবাণী কোলকাতার ধ্রুপদ, ধামার ও হিন্দুস্তানি খেয়ালের শিল্পী। তিনি স্বভাব কবি নন। তিনি গান লিখছেন বাংলা খেয়াল লিখতে হবে বলে। সঙ্গীত ইন্ডাস্ট্রিতে ওঁর লেখা গান কেউ গেয়েছেন বলে নজির পাওয়া যায় না। তবুও উনি লিখলেন। বাড়িতে বসে গালমন্দ করেননি। উনি লিখে দেখালেন লেখাটা সম্ভব। আজাদ রহমান সেটাই করেছেন। উনিও লিখে, সুর করে দেখিয়েছেন বাংলায় খেয়াল সম্ভব। এখন বাঙালি বা অবাঙালি সেসব গ্রহণ না-করলে তো সেটা এঁদের অপরাধ না, বাংলা ভাষারও অপরাধ না। আবার আসি বাংলার সাহিত্যে, সাহিত্যের অগ্রগতিতে। মাইকেল মধুসূদন দত্তর কথা ধরা যাক। বাংলাতেই আধুনিক মহাকাব্য লেখা হয়েছে, হিন্দি, মৈথিলি, ব্রজবুলি ভাষায় হয়নি। আধুনিক নাটক শুরু হয় বাংলায়। ‘শর্মিষ্ঠা’ মাইকেল মধুসূদন দত্তর লেখা। তেমনি ‘দুর্গেশনন্দিনী’ আধুনিক উপন্যাস। এটা বাংলা ভাষায় শুরু হয়েছে পুরো উপমহাদেশে। কিন্তু খেয়ালটা নাকি বাংলায় হবে না। খেয়াল বাঙালির না। সনেট তো হয়। সনেট ইতালিতে উদ্ভাবিত একটা কাব্য আঙ্গিক।
চৌদ্দটা লাইন। শেষ দুটো লাইনে অন্তঃমিল থাকতে পারে। সনেট বাংলা ভাষায় আনলেন মাইকেল মধুসূদন দত্ত। তখন তো বলা হয়নি, সনেট ইতালিয় ভাষায় হয়, বাংলায় হবে না। রবীন্দ্রনাথ চমৎকার একটা আর্গুমেন্ট দিয়েছিলেন, যাকে বলা হয় সুরের যুক্তাক্ষর বা স্বরসঙ্গতি অর্থাৎ হার্মনি। হার্মনির অভাবে আমাদের বাংলার সঙ্গীত বা ভারতীয় সঙ্গীতের একটা দিক ফাঁকা পড়ে রয়েছে। রবীন্দ্রনাথ বলছেন, যাঁরা বলেন হার্মনি ইউরোপিয় ওটা বাংলা গানে চলবে না, এরপর তাঁরা বলবেন শল্যচিকিৎসা ইউরোপিয় ওটা বাঙালির দেহে চলবে না। একই সমস্যার মুখে রবীন্দ্রনাথও পড়ছেন। এবং এক জায়গায় উনি লিখছেন, লক্ষ্ণীছাড়ার ক্ষ্যাপা হাওয়া যার গায়ে লাগিল একদিন সে আসিবে। এই লক্ষ্ণীছাড়ার ক্ষ্যাপা হাওয়া যাদের গায়ে লাগে তাঁদের বাংলাতেই বেশি পাওয়া যায়? আরেকটা দিকে তাকালে পাওয়া যায় হাইকু। হাইকু হলো জাপান এবং চীনের এক প্রাচীন কাব্য আঙ্গিক। বারোটি সিলেবল দিয়ে তৈরি। কখনো কখনো তিনটি লাইনে, কিন্তু সিলেবল। এই হাইকু তো শুধু জাপানি বা চিনে ভাষাতে আটকে থাকেনি। হাইকু ইংরেজি, ফরাসি, বাংলা সহ আরো অনেক ভাষায় লেখা হয়। সারা পৃথিবী আজ এগিয়ে এসেছে আমাদের কাছে। আমরা কি তাকে বরণ করে নেব না? হিন্দিতে না-হলে খেয়াল হবে না এটা কোনোমতেই ধোপে টেকে না।”
এ পর্যায়ে কবীর সুমন তাঁর রচিত একুশের ওপর বসন্তের রাগ হিন্দোলে খেয়াল গান ‘একুশে ফেব্রুয়ারি ডাকে, ডাকে দুনিয়ার সকলের মাতৃভাষায়’ গেয়ে শোনান। তিনি বলেন, “এই হিন্দোল রাগের বড়ো সৌরভ, এই রাগ ভয়ঙ্কর, এই রাগ ওলটপালট করে দেয়। এই রাগেই একটা জনপ্রিয় রাগপ্রধান গান আছে ‘হিন্দোলে দোলা দিলো কে।’ কেউ যদি বলেন, একুশে ফেব্রুয়ারি তো আজকের বিষয়, তুমি একে খেয়ালে নিয়ে গেলে! কিন্তু বারণ আছে কি কোথাও? এটা হলো আরেকটা দিক। আমাদের খেয়ালের বা সঙ্গীতের কোনো হ্যান্ডবুক নেই, ম্যানুয়াল নেই, কোনো পেনাল কোড নেই যে শাস্তি পেতে হবে। কোনো সংবিধান নেই। খেয়াল মানেই হচ্ছে কল্পনা। খেয়াল মুক্ত।
“চিন্ময় চট্টোপাধ্যায় ১৯৩০ এর দশকে সম্ভবত প্রবাসী পত্রিকায় একটা নিবন্ধ লিখেছিলেন যে, চিনে বা ইংরেজি ভাষাতেও খেয়াল হতে পারে, যদি আঙ্গিকটা ঠিক থাকে। আঙ্গিকটা কী? খেয়ালে একটা গান থাকে। এর সঙ্গে থাকে নানা উপাদান যেমন স্বরবিস্তার, বোলবিস্তার যা হিন্দি থেকে এসেছে। তাল ও রাগ ঠিক রেখে কথাগুলো দিয়ে বিস্তার করা হয়। এখানেই আমার খেয়াল নিয়ে লেগে থাকার যুক্তি। প্রত্যেক খেয়াল শিল্পীই কম্পোজার। আধুনিক গান যখন আমরা গাই, সে রবীন্দ্রনাথেরই হোক, নজরুলেরই হোক, হিমাংশু দত্ত কিংবা শচীন দেব বর্মনেরই হোক, যাঁরই হোক, আমরা নিজে থেকে কিছু করতে পারি না। কিন্তু খেয়ালে আমরা প্রত্যেকেই কম্পোজার। এটা হলো সবচেয়ে আনন্দের যে, খেয়ালে কল্পনার বিস্তার সম্ভব। এরপর আছে তালের ওপর সারগাম। খেয়াল গাইতে গেলে যে জোরের সঙ্গে খুব দ্রæত তান-সারগাম করতে হবে তা মোটেই না। জরুরি হচ্ছে গানটাকে সুন্দরভাবে উপস্থাপন করা।” কবীর সুমন তাঁরই লেখা ‘একুশে ফেব্রুয়ারি ডাকে, ডাকে দুনিয়ার সকলের মাতৃভাষায়’ খেয়াল গানটি দিয়ে খেয়ালের এই বিষয়গুলোর বিশদ ব্যাখ্যা করেন। তিনি বলেন, “এই কথাগুলো তো অন্য ভাষায় হবে না। কিংবা হলে হোক। কিন্তু আমরা কী এমন অপরাধ করেছি যে এই কথাগুলো আমরা আমাদের বাংলা ভাষায় গাইতে পারব না? এই ‘একুশে ফেব্রুয়ারি’ কথাটা আমরা একটু সাহস করলে অনায়াসেই খেয়াল গানে লাগাতে পারি। কলাবতী রাগে রূপক মধ্যলয়ে আমি একটা বাংলা খেয়াল গান বানিয়েছিলাম। এখন কীরকম গান হতে পারে তার একটা ধারণা পাওয়া যাবে গানটা থেকে। এটা কোনো নীরিক্ষা না। এটা একটা যথাযথ বাংলা গান। গানটা হচ্ছে ‘কে তুমি বাজাও ঠোঁটের সুর হারমোনিকায়।’” এ পর্যায়ে গানটির একটি অডিওক্লিপ বাজিয়ে শোনানো হয়। কবীর বলেন, “আমরা রবীন্দ্রনাথের সন্তান। আগে রবীন্দ্রনাথ এসে গেছেন। এরকম কথা লেখা তো আমাদের দায়ও। তিনি লিখছেন, ‘পথে হলো দেরি, ঝরে গেল চেরি/ দিন বৃথা গেল, প্রিয়া/ তবুও তোমার ক্ষমা-হাসি বহি/ দেখা দিলো আজেলিয়া।’ কিংবা ‘শুনি ক্ষণে ক্ষণে মনে মনে অতল জলের আহবান।’ যিনি লিখছেন, আমরা তাঁর সন্তান। আমাদের একটা দায়ও তো থাকে। এগোতে হবে সময়ের সঙ্গে। এবং আজকের নবীনদের কাছে যেতে হবে। মানুষ আসবেন না সঙ্গীতের কাছে, সঙ্গীতকে বরং যেতে হবে মানুষের কাছে।” এ পর্যায়ে পরপর আরো কয়েকটি সুমনের লেখা বাংলা খেয়াল গানের অডিওক্লিপ বাজিয়ে শোনানো হয়। গানগুলো হচ্ছে – সঙ্গীতাচার্য আমির খানের ‘আব গুনন কি’ বন্দিশের সুরে ইমন রাগে ঝাঁপতাল মধ্যলয়ে ‘কাকে বিরহ বলে জেনেছ কী’; স্বরস্বতী রাগে তিনতাল মধ্যলয়ে ‘এমন কিছু নয় তবু মনে হয়, আবার যদি আসি আবার ভালোবাসি’; ভূপালী রাগে ঝাঁপতাল মধ্যলয়ে ‘জ্বালেনি কেউ সাঁঝের বাতি, আকাশে ফোটে সন্ধ্যাতারা’; কবীর সুমন সৃষ্ট দিনশেষ রাগে বিলম্বিত ঝুমরায় ‘ধীরে ধীরে বিকেল ফুরোয়, গোধূলির উদাসীনতা, আলো তার শরীর জুড়োয় সন্ধ্যে হাওয়ায়।’ ‘ধীরে ধূরে বিকেল ফুরোয়’ গানটির আলোচনায় কবীর বলেন, “বিলম্বিত লয়ে বাংলা খেয়াল কিন্তু আমার আগে আর রচনা হয়নি। হয়েছে মধ্যলয়ে। বিলম্বিত লয়ে আচার্য সত্যকিঙ্কর বন্দোপাধ্যায়, আচার্য তারাপদ চক্রবর্তী, আচার্য চিন্ময় লাহিড়ী কেউ খেয়াল গাননি। প্রশ্ন জাগতে পারে, বিলম্বিত লয়ের মাহাত্ম্য বা গুরুত্বটা কোথায়? খেয়াল বড়োও হতে পারে, ছোটোও হতে পারে। বড়ো খেয়াল প্রথম বিলম্বিতে গাওয়া হয়, তারপর মধ্যগতি বা দ্রæত। তো বিলম্বিত লয়টা কেমন? ধরা যাক ১২ মাত্রার তাল। একে একতাল বলে। ‘জগতে আনন্দযজ্ঞে আমার নিমন্ত্রণ’ রবীন্দ্রনাথের এই গানটা হচ্ছে মধ্যগতি একতালে। রবীন্দ্রনাথের আরেকটা গান ‘মোরে বারে বারে ফিরালে’ একদম খেয়াল অঙ্গের। মধ্যলয়ে। ১২ মাত্রা। এই ১২ মাত্রাকে অনেকে দুটো ৬ মাত্রা ভাবতে পারেন। দাদরা যেটাকে আমরা বলি। তাহলে কিন্তু হবে না। এখানের চলনটাই আলাদা। একটা ১২ মাত্রা। এই ছন্দে নাচ খুব ভালো হয়। বিলম্বিত লয় হচ্ছে এর প্রতিটি মাত্রাকে আমরা দুভাগে ভাগ করছি। অর্থাৎ প্রতিটি মাত্রাকে দুমাত্রায় ভাগ করা। আবার কেউ কেউ অতি বিলম্বিত করেন। সঙ্গীতাচার্য আমির খান যেটা করতেন। ঝুমরা ১৪ মাত্রার তাল। অর্থাৎ প্রতিটি মাত্রাকে ৪ মাত্রায় ভাগ করছেন। ৫৬ মাত্রা। অতি বিলম্বিতে প্রতিটি মাত্রাকে ৪ মাত্রায় ভাগ করা হয়। এখন মানুষের আর এত সময় নেই। মানুষ মনে মনে যদি অন্তত একটু তাল দিতে না-পারে, তাহলে ভালো লাগে না। সময় পালটে গেছে। আমাদের জীবনের গতি পালটে গেছে। এজন্য সত্যকিঙ্কর বন্দোপাধ্যায় বলে গিয়েছিলেন, অতি বিলম্বিত করা ঠিক না। এতে ছাত্রছাত্রীরা বুঝতেও পারে না, ওদের শিখতে অসুবিধা হয়। এ কারণেই আমি কখনো ৪৮ মাত্রার একতাল করি না। তবে বিলম্বিতের সুবিধে হচ্ছে, এতে এক্সপানশন বা বিস্তার সম্ভব। খেয়ালের দুটো ব্যাপার আছে? হিন্দিতে বা উর্দুতে বলা হয় ঠেহরানা অর্থাৎ নোটে দাঁড়ানো।
আরেকটা হলো বাড়ানো। এই বাড়ানোটাই এক্সপানশন, সুরের কম্পোজিশনের মধ্য দিয়ে। যেমন রবীন্দ্রনাথের গান ‘এ মোহ-আবরণ খুলে দাও, দাও হে’। এটা আসলে বিলম্বিত একতালে একটা খেয়াল। বিলম্বিত কেন? কারণ আমরা ব্যাপারটাকে প্রলম্বিত করছি। একটু বাড়ানো হচ্ছে। আমি মৃত্যু পর্যন্ত খেয়ালই গাইব। কারণ আমি বাড়াতে পারি। আমার কল্পনার বিস্তার ঘটাতে পারি, যেটা আধুনিক বা রাগপ্রধানে আমি পারি না। ভজনে পারি না। এই হচ্ছে বিলম্বিত। এর মধ্যে ঢুকবে কথা দিয়ে বোলবিস্তার। রবীন্দ্রনাথ ‘এ মোহ আবরণ’ এ নিজেই কথা দিয়ে বোলবিস্তার করেছেন। শুধুমাত্র রবীন্দ্রনাথের ছাত্রী রাজেশ্বরী দত্ত এই গানটা বিলম্বিত একতালে গেয়েছেন। আজকাল এই গানটা কেউ আর তালে গাইছেন না। কারণ কেউ আর গান শিখে রবীন্দ্রনাথের গান গাইছেন না। দুলাইনের এই গানটি একটা ব্রিলিয়ান্ট বিলম্বিত বন্দিশ। আমরা এইভাবে ভাবতেও শিখিনি।
আমাদের গুরুরাও শেখান না। অথচ এই কাজগুলো কিন্তু হয়ে বসে আছে। খেয়াল খুব শক্ত কিছু না। এটা বিনোদনের জন্য, ভালো লাগার জন্য। বিলম্বিত লয়ে একটু সময় পাওয়া যায়। রবীন্দ্রনাথের গান থেকেই মধ্যলয়ের গান হচ্ছে ‘দাঁড়িয়ে আছ তুমি আমার গানের ও পারে’। রবীন্দ্রনাথ এ দুটো গান পরপর করাতেন। প্রথমে ‘এ মোহ আবরণ’ তারপর ‘দাঁড়িয়ে আছ তুমি আমার।’ অর্থাৎ বিলম্বিত, তারপর মধ্যলয়।”
রাগপ্রধান ও খেয়াল গানের পার্থক্য প্রসঙ্গে কবীর সুমন বলেন, “রাগপ্রধান গান আধুনিক গানের মতনই একটা গান। এখানে একটা রাগের প্রাধান্য আছে, সার্বিকতা নেই। যেমন নজরুলের অনেক গান। গানগুলো কিছুটা খেলিয়ে গাওয়া যায়। রাগপ্রধানে গানটাই যেখানে গাওয়ার কথা, লোকে সেখানে গাইতে গিয়ে ধ্রুপদ, ধামারের মতো করে ফেলেন। রাগপ্রধান গান একটা গান আর খেয়াল হচ্ছে একটা আঙ্গিক। দুলাইনের স্থায়ী দুলাইনের অন্তরা রাগপ্রধানে হতে পারবে না। রাগপ্রধান গানে অন্তত দুটো লাইন ও একটি রেজুল্যুশনের লাইন, একটা অন্তরা এবং একটা সঞ্চারী থাকলে ভালো হয়। তবে খেয়ালে সঞ্চারী থাকতে পারে না এমন কথা নেই। কেউ হয়ত কোনোদিন তা লিখবেন। আধুনিক আর রাগপ্রধান গানে স্ট্রাকচারালি কোনো পার্থক্য নেই। খেয়াল স্ট্রাকচারালিই আলাদা। রাগপ্রধান গানে একাধিক রাগ থাকতে পারে কিন্তু খেয়াল একটিমাত্র রাগের ওপর হয়। ১৯৬৭ সাল থেকে আমি আকাশবাণী বেতারের শিল্পী, ১৮ বছর বয়স থেকেই। শিশুমহলে গাইতাম আগে। ১৯৬৭ সালে আকাশবাণীর সঙ্গীত প্রতিযোগিতায় রাগপ্রধান ও ভজনে প্রথম হয়েছিলাম, রবীন্দ্রসংগীতে দ্বিতীয়। কোলকাতার ক্যান্ডিডেট হিসেবে আমাকে দিল্লীতে লড়তে হলো ঠুমরির সঙ্গে। আচার্য জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষ ছিলেন আমার ট্রেইনার। আমি তাঁকে শোনালাম ‘মঞ্জির মুখরিত চঞ্চল চরণে, অম্বর নীলবাস তনু আবরণে। এলায়িত কেশদাম বন্ধনহারা, স্নিগ্ধ উজল দুটি আঁখি ধ্রæবতারা। কে চলে যমুনা জলে ধরনী ভরনী।’ বসন্ত মুখারি রাগে, চিন্ময় লাহিড়ীর সুরে। জ্ঞানদা বললেন, ‘খুব জম্পেশ তান করতে মন চাইছে? ওটা করবে না, এটা রাগপ্রধান, ওটা খেয়াল। গানটা সুন্দর করে পরিবেশন করে, স্থায়ী-অন্তরা গেয়ে তারপর আস্তে করে একটুখানি স্বরবিস্তার, তেমনি অন্তরাতে একটু স্বরবিস্তার, তারপর নরম করে সারগাম করবে।’ অর্থাৎ রাগপ্রধানে তান, সারগাম বেশি করা চলবে না। গানটাই যথেষ্ট?
“খেয়ালের সুন্দর জায়গাটা কোথায়? এক বিখ্যাত গ্রিক দার্শনিক বলেছিলেন, ‘No one steps into the same river.’ ‘কেউ একই নদীতে দুবার পা দেয় না।’ নদী পালটে যায়, খেয়ালও পালটে যায়। এটাই খেয়ালের সবচেয়ে সুন্দর জায়গা। আজ যেভাবে ইমন রাগে বিলম্বিতে গাইলাম, পরের বার গাইবার সময়ই সেটা পালটে যাবে। রাগ ঠিক রেখে নানান প্যাটার্ন তৈরি হচ্ছে। এটাই খেয়াল গাওয়ার আনন্দ। আর তারওপর বাংলা খেয়াল নিজ ভাষায় গাইছি। আমার আনন্দ, বাংলা খেয়ালে আমি আমার ভাষায় কাজটা করতে পারছি। দীলিপ কুমার রায় তাঁর সাঙ্গীতিকি গ্রন্থে লিখেছেন, ১৯৩০ এর দশকে স্ট্র্যাংগোয়েজ সাহেব ভারতে এসেছিলেন সঙ্গীত নিয়ে গবেষণা করতে। তিনি বলেছেন, ভারতের উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতে দক্ষিণ ভারতের মধ্যে তেলেগু আর উত্তর ভারতীয় ভাষার মধ্যে বাংলা সবচেয়ে বেশি উপযুক্ত।”
এ পর্যায়ে বাঁশের বাঁশির ঈশ্বর সঙ্গীতাচার্য পান্নালাল ঘোষ সৃষ্ট কুমারী রাগে ‘কাছের বাঁশি আজ দূরের বাঁশি বুঝি, হারিয়ে যাওয়া শাম তোমায় আজও খুঁজি’ খেয়াল গানটি বাজিয়ে শোনানো হয়। কবীর বলেন, “এই রাগটি শ্রী রাগের একটি স্বর তুলে নিয়ে তৈরি করা। পান্নালাল ঘোষ একটা সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, তাঁর গুরু বাবা আলাউদ্দিন খাঁ তাঁকে বলেছিলেন, ‘তুমি একটা কাজ করবে। তোমার পরিচিত রাগ থেকে একটা স্বর সরিয়ে নেবে, আরেকটা স্বর যোগ করবে। আদৌ ছিল না এমন একটা স্বর যোগ করবে। দেখবে একটা নতুন রাগ তৈরি হচ্ছে।’ চমৎকার ও বিখ্যাত একটি রাগ শ্রী। এই রাগে সঙ্গীতাচার্য আমির খান তাঁর বিখ্যাত বন্দিশ ‘হরি কে চরণকমল’ খুব গাইতেন। পান্নালাল ঘোষ এই রাগের ধৈবতটা সরিয়ে নিয়ে অন্য রাগ ‘কুমারী’ তৈরি করলেন বাবা আলাউদ্দিন খাঁর উৎসাহে। পান্নালাল ঘোষের জন্মশতবর্ষ পশ্চিমবঙ্গে পালিত হয়নি। বাংলাদেশে হয়েছে ৩ দিন ধরে। কিন্তু কারো কখনো মনে হয়নি তাঁর সৃষ্ট রাগগুলোতে গান গাওয়ার। কেউ গাননি মারাঠিরা ছাড়া। গুজরাটের পাঠ্য বইতে পান্নালাল ঘোষের ওপর চ্যাপ্টার আছে। অন্য জায়গায় অনেক কদর থাকলেও পশ্চিমবঙ্গে পান্নালাল ঘোষের কদর নেই। পান্নালাল ঘোষ সৃষ্ট রাগে কোনো খেয়াল বন্দিশ ছিল না।” সঙ্গীতাচার্য পান্নালাল ঘোষ সৃষ্ট দীপাবলি, কুমারী, চন্দ্রমৌলি, নূপুরধ্বনি ইত্যাদি রাগে কবীর সুমন বেশ কয়েকটি খেয়াল গান লিখেছেন। কুমারী রাগে ‘কাছের বাঁশি আজ দূরের বাঁশি বুঝি’ খেয়াল গানটি বাংলা খেয়ালের হাইকু বলা চলে। দুলাইনের স্থায়ী, দুলাইনের অন্তরা। ছোট বন্দিশ। খুব ছোটো বন্দিশ হিন্দী ও মারাঠিতে প্রচুর আছে কিন্তু বাংলা খেয়ালে নেই। কাজেই এটি বাংলা খেয়ালের এক নতুন সংযোজন।
কবীর সুমন বলেন, “মাতৃভাষায় আমরা গাইব, আমাদের ছেলেমেয়েরা গাইবে এটাইতো স্বাভাবিক। অথচ এ নিয়ে কোন দাবি নেই। কেউ এসে দাঁড়াচ্ছেন না। বাংলাদেশে আজাদ রহমান একটা চালিকাশক্তির ধাক্কা দিয়েছেন যাতে লোকে বাংলা খেয়াল শেখে, গায়। ওঁর পরিচালনায় সমবেত কণ্ঠে খেয়াল গাওয়া হচ্ছে। এটা একটা মস্ত জিনিস। আমি সঙ্গীতজ্ঞ আজাদ রহমানের স্মৃতির উদ্দেশ্যে পূরবী ঠাটের ওপর ‘আজাদ’ নামে একটি রাগ বা স্কেল সৃষ্টি করেছি। পিথাগোরাস গ্রিসে স্কেল তৈরি করেছিলেন। যাকে বলা হয় পিথাগোরিয়ান স্কেল। এমনি আরো অনেক স্কেল আছে। জ্যাজ মিউজিক হয় স্কেলের ওপর। অর্থাৎ জ্যাজেও কিন্তু রাগ বাজে। ওঁরা রাগ বলেন না, স্কেল বলেন। নতুন রাগ তৈরির সময় হিন্দুস্তানি রাগে সেটির পরিবারভুক্তির ব্যাপারে কর্ণাটকী সঙ্গীতে প্রশিক্ষিত, সঙ্গীত গবেষক, আকাশবাণীর একাধিক স্টেশনের পরিচালক আমার বন্ধু শ্রীমিতি স্বপ্না মণ্ডল তথ্য দিয়ে আমাকে সহযোগিতা করেন। আর পরিবারে না পড়লে সেটা একটা ইউনিক রাগ হলো। যেমন সদ্য প্রয়াত গীতশ্রী সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের স্মৃতিতে আমি তৈরি করেছি রাগ ‘সন্ধ্যা।’ এই রাগটির ব্যাপারেও শ্রীমতী স্বপ্না মণ্ডল আমাকে নিশ্চিত করেছেন। হংসধ্বনি রাগের গান্ধারকে কোমল করে দিয়ে পান্নালাল ঘোষ সৃষ্টি করেছেন নূপুরধ্বনি রাগ। স্বপ্না মণ্ডল জানিয়েছেন, এই স্কেলে আরেকটা রাগ আছে অর্থাৎ আরেকটা নামে এই রাগ আছে যেমনটা আছে রবিশঙ্কর সৃষ্ট পরমেশ্বরী রাগের।”
এ পর্যায়ে কবীর সুমনের লেখা আরো কয়েকটি খেয়াল গানের অংশবিশেষ বাজিয়ে শোনানো ও দেখানো হয়। যেমন দেশ রাগে একতালে ‘চলে যায় সব, চেনা হাসি মুখ কুড়োনো ঝিনুক’; কত্থক নাচের সঙ্গে বাংলা খেয়ালের যুগলবন্দি লতাঙ্গী রাগে ‘আলো থেকে ছায়ায় যায় দিন’; এবং অরুণ কুমার সরকারের লেখা ‘সিন্ধুক নেই স্বর্ণ আনিনি, এনেছি ভিক্ষালব্ধ ধান্য। ও দুটি চোখের তাৎক্ষণিকের পাব কি পরশ যৎসামান্য’।
সুমন বলেন, “ডি এল রায় রবীন্দ্রনাথের কাব্যশৈলী নিয়ে উপহাস করে লিখেছেন ‘আনন্দ বিদায়।’ এই হচ্ছে বাঙালি। কিন্তু ইকবাল বা মুন্সী প্রেমচাঁদকে নিয়ে নামী কোন লোক এইরকম তামাশা করার সাহস পাননি। হুমায়ুন আজাদ তাঁর প্রবচনগুচ্ছে লিখেছেন, নোবেল পুরষ্কারটা রবীন্দ্রনাথের জন্য দরকার ছিল না। দরকার ছিল বাংলা সাহিত্যের জন্য। রবীন্দ্রনাথ নোবেল না পেলে যে কেউ রবীন্দ্রনাথের চেয়ে তার শ্রেষ্ঠত্ব দাবি করে বসত। এদিকে বাঙালি তো বাংলা খেয়াল গাইছিলেনই না। বাংলাদেশে আজাদ রহমান লড়ে গেলেন আর পশ্চিমবঙ্গে ছয়ের দশকে সত্যকিঙ্কর বন্দোপাধ্যায়। তারপরে বাংলা খেয়ালের ধারাবাহিক চর্চা খুব একটা হয়নি। ধরে নেওয়া যায়, হয়ইনি। আমি এখন বাংলা খেয়াল নিয়ে কাজ করতে চাইছি আর তাতে বাধ সাধছেন বাঙালিরাই। আমার আধুনিক বাংলা গান নিয়েও তারা বলেছিলেন, আমার গান আধুনিক বাংলা গান নয়। কাগজের পর কাগজেও ছাপা হতো। এই হচ্ছে আমাদের জাতি। এখন একদল এসে হাজির হয়ে বলছেন, এটা খেয়াল না। আমার আর নিজেকে বাঙালি পরিচয় দিতে ইচ্ছে করে না। তবে আমি বাংলা ভাষার লোক। আর এ ভাষায় শুধু বাঙালির না, সব জাতিগোষ্ঠীর অধিকার, যেমন অধিকার তাদের নিজ নিজ ভাষায়। বাংলা গান যেমন সকলের, বাংলা খেয়ালও সকলের। একুশে ফেব্রæয়ারিও তাই সবার দিন।”
এই মুহূর্তে উপমহাদেশের বলা চলে একমাত্র মিউজিকোলজিস্ট কবীর সুমনের বাংলা খেয়াল নিয়ে আলোচনার প্রতিটি মুহূর্ত উপভোগ করেন শ্রোতা-দর্শকেরা। শ্রোতা-দর্শকের বাংলা খেয়াল সম্পর্কিত গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নের সাবলীল উত্তর দেন কবীর সুমন। সুমনের আলোচনা, গানের প্রায়োগিক ব্যাখ্যা এবং তাঁর বাংলা খেয়াল নিয়ে কাজের উপস্থাপন- সব মিলিয়ে, পাঠশালার ভাষার মাসের আসরটি সত্যিকার অর্থেই অর্থবহ হয়ে ওঠে সর্বোতভাবে।
পাঠশালার এ আসরের সঞ্চালনায় ছিলেন ফারহানা আজিম শিউলী।