মুনজের আহমদ চৌধুরী, লন্ডন : ব্রেক্সিটের পর করোনাভাইরাস মহামারিতে স্মরণকালের সবচেয়ে বড় সংকটের মুখোমুখি হয়েছে ব্রিটেনের আট লক্ষাধিক বাংলাদেশি। এখন পর্যন্ত মহামারিতে প্রায় দুইশ’ বাংলাদেশির মৃত্যুর খবর নিশ্চিত হওয়া গেছে। ব্রিটেনের ব্ল্যাক অ্যান্ড মাইনোরিটি এথনিক (বিএমই) কমিউনিটিগুলোর মধ্যে করোনায় বাংলাদেশিদের মৃত্যুহার ছিল শীর্ষ তালিকায়। বাংলাদেশিদের কর্মসংস্থানেও করোনাভাইরাস বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। বেড়েছে পারিবারিক সহিসংতাও। সবমিলে করোনায় অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে ব্রিটিশ বাংলাদেশিদের একটা বড় অংশের জীবন। ভালো নেই তারা।
ব্রিটেনের জাতীয় পরিসংখ্যান দফতরের তথ্য অনুসারে, করোনার কারণে গত মার্চ থেকে জুন পর্যন্ত ২৬ লাখ মানুষ কর্মহীন ভাতার আবেদন করেছেন। ব্রিটেনে বেকারত্বের হার এখন গত ৪০ বছরের মধ্যে নতুন রেকর্ড গড়েছে। দেশটিতে নতুন কাজ খুঁজছেন দুই লাখ ৫৩ হাজার মানুষ। গত মার্চ থেকে জুন পর্যন্ত দেশটিতে কাজ হারিয়েছেন প্রায় ৬ লাখ ৪৯ হাজার জন। বাংলাদেশি কমিউনিটির হাজার হাজার মানুষ ইতোমধ্যে বেকার হয়ে পড়েছেন। আবার অনেকে আগামী দুই মাসের মধ্যে কাজ হারাবার নোটিশ পেয়েছেন।
গত তিন দশক ধরে ইফতেখার চৌধুরী ব্রিটেনে বসবাস করছেন। লুটন বিমাবন্দরে কর্মরত এই বাংলাদেশি বলেন, ব্রেক্সিট জনিত অর্থনৈতিক ধাক্কার মধ্যেই ব্রিটেন করোনার বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে। সব মিলিয়ে দেশটি এখন বড় অর্থনৈতিক ঝুঁকির মধ্যে। সরকার এখন পর্যন্ত ফার্লো স্কিমের (বিশেষ কর্মসূচি) মাধ্যমে দেশটির কর্মজীবীদের বেতনের ৮০ শতাংশ পরিশোধ করে যাচ্ছে। এ স্কিম চালু থাকায় বেকারত্বজনিত বিপর্যয়ের প্রকৃত চিত্রটি সামনে আসছে না।
করোনাভাইরাসের মহামারির মধ্যে বেকারত্ব, কর্মহীনতার হতাশা আর গৃহবন্দিত্ব জনিত কারণে ব্রিটেনজুড়ে পারিবারিক সহিংসতার ঘটনাও বেড়েছে উদ্বেগজনক হারে। দেশটিতে সবচেয়ে বেশি সংখ্যক বাংলাদেশি বসবাস করেন পুর্ব লন্ডনের টাওয়ার হ্যামলেটস বারায়। এ বারার সাবেক ডেপুটি মেয়র ও কাউন্সিলর অহিদ আহমদ বলেন, ব্রিটেনে আর্থ সামাজিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে সামনে আরও ভয়াবহ দুর্দিন আসছে। বাংলাদেশি কমিউনিটিতে হতাশা থেকে পারিবারিক সংঘাত, সহিংসতা গত কয়েক মাসে আশংকাজনক হারে বেড়ে গেছে। প্রতিদিন একাধিক ঘটনার খবর পাচ্ছি। করোনার কারণে ঘরের বাইরে না যেতে পারা শিশু কিশোরদের মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য মা-বাবার পারিবারিক সংঘাত খুব নেতিবাচকভাবে প্রভাব ফেলছে।
লুটনে বসবাসরত নারী ও কিশোরদের মানসিক স্বাস্থ্যের কাউন্সিলিংয়ে যুক্ত পান্না আহমেদ বলেন, করোনাজনিত অর্থনৈতিক সংকট, বেকারত্বের সঙ্গে পারিবারিক সহিংসতাও ভয়াবহভাবে বেড়েছে। অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে যাচ্ছে। এদেশে কয়েক লাখ বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত বসবাস করেন। আমাদের কমিউনিটিতেও পারিবারিক সংঘাত, সহিংসতাকে কেন্দ্র করে বিচ্ছেদ বেড়েছে। এর কারণ অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা, সামাজিক সীমাবদ্ধতা ও মানসিক স্বাস্থ্যের অবনতি।
চল্লিশ বছর ধরে লন্ডনে বসবাস করছেন কে এম আবু তাহির চৌধুরী। সব সরকারের আমলেই বাংলাদেশি কমিউনিটির নানা আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া এই প্রবীণ নেতা বলেন, ‘ব্রিটেনে প্রায় লাখখানেক বাংলাদেশির কোনও কাগজপত্র নেই। বৈধ কাগজপত্র না থাকায় তারা সরকারের সব ধরনের সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। অনেকে কাজ হারিয়েছেন। অর্থনৈতিক বিপর্যয়সহ নানা ঝুঁকিতে কমিউনিটির লাখ লাখ বাংলাদেশির মধ্যে এক ধরনের হতাশা বিরাজ করছে।
দৈনিক আমাদের নতুন সময়ের যুক্তরাজ্য প্রতিনিধি ও ইউকে বাংলা প্রেসক্লাবের ট্রেজারার সাইদুল ইসলাম বলেন, করোনায় ব্রিটেনে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির ভয়াবহ অবনতি হয়েছে। পুলিশকে রীতিমত লিফলেট ছাপিয়ে জনগণকে প্রতারণার কবল থেকে সতর্ক থাকতে প্রচার চালাতে হচ্ছে।
লন্ডনে শিক্ষকতা, সম্পাদনা ও সাংবাদিকতা পেশায় গত ৪০ বছর ধরে কাজ করছেন ড. রেনু লুৎফা। তিনি বলেন, ব্রিটেনে এখনও বাংলাদেশি কমিউনিটির বড় অংশটি তুলনামুলকভাবে সমাজের নিম্ন অবস্থানে রয়েছেন। তাদের চাকুরি, বাসস্থান, স্বাস্থ্য, জীবনযাত্রা অন্যান্য অনেক কমিউনিটির মানুষের চেয়ে নিম্নমানের। তাই মহামারিতে অন্যদের চেয়ে বেশি মূল্য দিতে হয়েছে বাংলাদেশি কমিউনিটিকে। হাজার হাজার বাংলাদেশি কাজ হারিয়েছেন। অভাব অনটন ও মানসিক সমস্যার কারণে বেড়েছে পারিবারিক সহিংসতা।’
তবে রেনু লুৎফা মনে করেন সবকিছুকে স্বাভাবিকভাবেই নিতে হবে। ‘ইতিমধ্যে নতুন কর্ম পদ্ধতি বের হয়েছে। অনেকেই বাড়ি থেকে কাজ করছেন, অনেকেই আগামীতেও তাই করবেন। বাঁচবে অফিসের বাড়তি খরচ। নতুন জীবিকাও বের করে নিয়েছেন। পরিবারের সাথে সময় কাটাতে পেরেছেন। জীবনের কাছে আসলে কী মুল্যবান তা উপলব্ধি করতে পেরেছেন। তবে দেশ হিসেবে ব্রিটেনকে পুরনো অবস্থানে ফিরে যেতে অন্তত দুই থেকে তিন বছর লাগবে।’ বলেন তিনি।
লন্ডনের দীর্ঘদিন ধরে আইনজীবি হিসেবে কাজ করছেন সলিসিটর বিপ্লব কুমার পোদ্দার। এই কলামিস্ট বলেন, করোনায় ঠিক কত লাখ মানুষ ব্রিটেনে চাকুরী হারাবেন, সেটা বোঝা যাবে সরকারের প্রনোদনায় বেতনের চলমান ফার্লো স্কিম বন্ধ হবার পরে। লকডাউন শিথিল হলেও লন্ডনসহ বড় শহরগুলোতে এখনেও আগের মতো ভীড় নেই। রেস্টুরেন্ট, আবাসিক হোটেল সব ফাঁকা। বাংলাদেশি রেস্তোরাগুলো অস্তিত্ব রক্ষায় শুধু টেইক-ওয়ের দিকে ঝুঁকেছে। ইন্ডিয়ান খাবারের রেস্টুরেন্টগুলোর মুনাফার প্রায় পুরোটাই মদ বিক্রিতে। সঙ্গত কারণে রেস্টুরেন্ট সেক্টরে কর্মসংস্থান কমেছে,যা সরাসরি এই সেক্টরে কাজ করা লাখো বাংলাদেশির উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। সব মিলিয়ে মানুষ কষ্টে আছে, খারাপ সময় পার করছে। আর পরিস্থিতি দ্রুতই যে বদলাবে না, সেটাই বাস্তবতা।