কামাল কাদের : “সম্পর্কের” কথাটির পরিধি অনেক বড়। মানুষের সাথে মানুষের সম্পর্ক অনেক আকারে হয়ে থাকে। বন্ধুত্বের খাতিরে, আত্মীয়তার খাতিরে, সহকর্মী হিসাবে, আরো অনেক প্রকারের, যা বলে শেষ করা যাবে না। তবে সবচেয়ে বড় সম্পর্ক হলো মা, বাবা আর ভাই বোনের মাঝে। এই সম্পর্কের কোনো মাফ কাঠি নেই। কারণ এর সাথে একই ধারার রক্ত জড়িয়ে আছে। সোজা কথায় যাকে বলা যায় “ব্লাড রিলেসন”। আমাদের পৃথিবীটা আজও বেঁচে আছে তিনটি স্থম্ভের উপর। বিশ্বাস, আশা এবং ভালোবাসা নিয়ে। এর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো “ভালোবাসা”। যেখানে ভালোবাসা নেই, সেখানে জীবন নেই।
অফিস ফেরতা মধ্যে বয়সী অকৃতদার আহসান সাহেব আধা ভেজা শরীর নিয়ে সবেমাত্র ঘরে ঢুকেছেন। বাইরে মুশলধারে বৃষ্টি হচ্ছে। মনে হচ্ছে যেন কুকুর-বেড়ালের মধ্যে ঝগড়া চলছে। এমন সময়ে মোবাইল ফোনটি বেজে উঠলো। একান্ত অনিচ্ছাসত্তে¡ ফোনটা পকেট থেকে বের করলেন। ওপর প্রান্ত থেকে একজন অপরিচত ভদ্রলোকের করুন স্বর ভেসে উঠলো, “হ্যালো, আপনি কি মিস্টার আহসান সাহেব?” “জী, আমি মিস্টার আহসান, আপনি কে বলছেন?”

“আপনি আমাকে চিনবেন না, আমার নাম মামুনুর রশিদ। আপনার ফোন নম্বরটা আপনার বন্ধু আজিজ সাহেবের কাছ থেকে জোগাড় করেছি। আপনাকে ফোন করার উদ্দশ্য হলো আপনার সহযোগীতা আমার একান্ত প্রয়োজন।” “আমি আপনাকে চিনি না জানি না, আপনাকে আমি কি সাহায্য বা সহযোগিতা করতে পারি! তাছাড়া কোন দুঃখে নিজের খেয়ে বনের মেষ তাড়াতে যাবো?”

“প্লিজ রাগ করবেন না, আমি আপনার কাছে ফোন করেছি বড় আশা নিয়ে, আমাকে আশাহত করবেন না প্লিজ। যদি আপনি একটু সময় দিন তাহলে আমার প্রতি আপনার ধারণা বদলাতে পারে। আমি ভীষণ অসুস্থ, ডাক্তার রায় দিয়ে দিয়েছেন। আমি আপনার সাথে কিছুক্ষণের জন্য দেখা করতে চাই”। “আপনার কথাগুলো কি টেলিফোনে বলা যায় না?” “বলা যেতে পারে, তবে বিষয়টি আমার খুবই ব্যক্তিগত এবং আমি মনেকরি আপনি আমাকে স্ব শরীরে দেখলে আমার দৃঢ় বিশ্বাস আপনার মনে কোনো সন্দেহ থাকবে না, তাতে করে আমার প্রতি সদয় হয়ে আপনি আমার কাজটি করার ব্যাপারে সচেষ্ট হবেন”। “আমি ঠিক বুঝতে পারছি না আপনার উদ্দশ্যটা কি!”

“কাজটা খুবই মানবিক, আপাততঃ শুধু এইটুকু বলতে পারি”। “ঠিক আছে, এতো করে যখন বলছেন তাহলে চলুন কোন এক জায়গায় দেখা করি”। একটু নীরব থেকে আহসান সাহেব বললেন, “নবাবপুর রোডে ‘চন্দ্রিমা রেস্টুরেন্টে’ সাক্ষাৎ করলে কেমন হয়?” “ধন্যবাদ ভাই, খুবই ভালো প্রস্তাব। আমি সময় মতো আপনার জন্য ওখানে অপেক্ষা করবো”।

দিনক্ষণ ঠিক করে তারা চন্দ্রিমা রেস্টুরেন্টে মিলিত হলেন। প্রাথমিক সম্ভাষণ শেষ করে দু কাপ চা এবং দু প্লেট পেস্ট্রি অর্ডার দিয়ে দুজনে মুখোমুখি একটা খালি টেবিলে গিয়ে বসলেন।

মামুন সাহেব কোন সময় নষ্ট না করে বলা শুরু করলেন কেন আহসান সাহেবের সহযোগীতার তার প্রয়োজন। বললেন, “আমার এক আত্মীয়র কাছ থেকে জানতে পারলাম আপনার কলিগ মিস্টার মুরাদ আপনার খুবই অন্তরঙ্গ বন্ধু, এক কালে সেও আমার অতি কাছের মানুষ ছিল। কাছের মানুষ কি ভাবে দূরে সরে গিয়ে আমার প্রবল শত্রু হয়ে দাঁড়াল, তারই ধারাবাহিকতা আপনাকে জানাতে চাইছি এবং আপনি একটু চেষ্টা করলে আমাকে আমার এ জীবনের চরম আঘাত থেকে রক্ষা করতে পারেন, ফলে আমার মনোবাসনাটি পূর্ণ হতে পারে। ঘটনাটি খুলেই বলি, “মুরাদ এবং আমি কলেজ জীবনে থেকে একে অপরের প্রিয় বন্ধু ছিলাম। আমরা দুজনে একই ক্লাসে পড়তাম H S C (science) বিভাগে। দুজনেই ভাল গ্রেড নিয়ে ফাইনাল পরীক্ষায় পাস করার পর আমি ইকোনমিক্স এ অনার্সে ভর্তি হলাম আর মুরাদ কেমিক্যাল ইঞ্জিনারিংএ ভর্তি হলো।

এম,এ পাস করে আমি বি,সি এস পরীক্ষা দিয়ে সরকারী কলেজে অধ্যাপকের কাজ নিলাম। এরই মধ্যে বিয়ের কাজটিও সেরে ফেললাম। বউটি আমার মধ্যবৃত্ত ঘরের এবং চোখে পড়ার মতো সুন্দরী। এদিকে মুরাদ ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করে আমেরিকায় চলে যায়। কয়েক বছর আমেরিকায় থাকার পর সে আমেরিকার ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানী চভরুবৎ এর চিফ ইঞ্জিনিরিংয়ের চাকরী নিয়ে তাদের ঢাকার হেড অফিসে যোগ দেয়। ইতিমধ্যে আমার একটি ছেলে সন্তান হয়। সুখ, শান্তিতে জীবন ভালোই কাটছে। আগেই বলেছি মুরাদ আমার খুবই অন্তরঙ্গ বন্ধু। স্বভাবতই সে আমেরিকা থেকে দেশে ফেরার আগে আমার সাথে যোগাযোগ করে। আমিও তার ডাকে সাড়া না দিয়ে পারিনি, তাকে সাদর আহব্বান জানাই। সে তখনও বিয়ে করেনি। কোম্পানী থেকে থাকার একটা ফ্লাট ছাড়াও সে তার দৈনন্দিন ব্যবহারের জন্য ড্রাইভারসহ একটা গাড়িও পেয়েছে। ব্যাচেলার মানুষ, বন্ধুত্বের খাতিরে সে আমাদের বাসায় নিয়মিত যাওয়া আসা করে এবং আমার স্ত্রী তাকে নিজের দেবরের মতো গ্রহণ করে নেয়। তখনও বুঝিনি আমি কি ভুল কাজ করতে যাচ্ছি। যদিও আমার ভালো রোজগার ছিল তবুও সে অনুপাতে মুরাদের বেতন এবং কোম্পানীর তরফ থেকে নানাবিধ সুযোগ-সুবিধা আমার চাইতে ঢের বেশি ছিল। প্রায় প্রতি উইকেন্ডে নিজে ড্রাইভ করে আমাদের বাসায় আসতো এবং রীতিমতো আড্ডা মেরে রাত্রের ডিনার করে সে তার ফ্ল্যাটে ফিরে যেত।

আমাদেরও সময় ভালো কাটতো। যখন মুরাদ আমাদের বাসায় আসতো, তখনই সে সাথে করে আমার ছেলে এবং স্ত্রীর জন্য প্রচুর দামী গিফট নিয়ে আসতো। তখন আমি মনে করতাম ঘন ঘন আমাদের বাসায় আসে এবং খাওয়া দাওয়া করে যায়, সে জন্য হয়তো চক্ষু লজ্জায় সে এ সমস্ত গিফট-টিফ নিয়ে আসে। এদিকে ওদের দুজনের মাঝে যে লুকোচুরি খেলা চলছে তা আমার কল্পনাতেও জাগেনি। এখন নিজেকে ংঃঁঢ়রফ ছাড়া অন্য কিছু ভাবতে পারছি না। আমাদের সমাজে লোকচক্ষুর আড়ালে দুটি যুবক যুবতীর মাঝে এরকম ঘটনা অহরহ ঘটছে সেটা আমার বোঝা উচিত ছিল। অবশ্য এখন এ বয়সে এ সমস্ত কথা ভেবে কোনো লাভ নেই।

একদিন শোভা মানে আমার স্ত্রী বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতো আমাকে বললো, সে আমার ছেলেকে সাথে করে নিয়ে মুরাদের ফ্ল্যাটে মুভ করার পরিকল্পনা করছে। এও জানালো মুরাদ খুব শীঘ্রই তাকে নিয়ে নুতন করে সংসার জীবন শুরু করতে অঙ্গীকার করেছে। কথাটা শুনে খুবই দুঃখ পেলাম, শুধু শোভাকে জিজ্ঞাসা করলাম, “আমার অপরাধ?” সে শুধু জানালো, তার কাছে এর কোনো উত্তর নেই। আমার কি দোষ ছিল তা জানতে পারলাম না। অনেক অনুরোধ করলাম আমার সাথে থাকার জন্য, কোন লাভ হলো না। মরিয়া হয়ে ছেলেটিকে আমার সাথে রাখার চেষ্টা করলাম তাও হলো না। বরং যাবার দিন আমাকে শাসিয়ে গেলো, আমি যদি কখনও আমার ছেলের সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করি তাহলে এর পরিনাম ভালো হবে না, আমাকে ডান্ডা মেরে ঠান্ডা করে দেবে। আরো জানালো ছেলেকে যদি পেতে হয় তাহলে প্রয়োজনে আমি যেন কোর্টে মামলা করি।উকিলের পরামর্শ নিলাম, উকিল সাহেব বললেন, মার্ কাছে বাচ্চার থাকাটা স্বাভাবিক, তাই ওপথে পা বাড়ালাম না। যেদিন আমাকে ছেড়ে চলে গেলো আমি শুধু ওদের চলে যাওয়া চেয়ে চেয়ে দেখলাম। সেদিনের সেই মুহূর্তটি আমার কাছে অসহ্য বেদনাদায়ক হয়ে উঠেছিল,তখন মনে হয়েছিল এই বুঝি আমার দম বন্ধ হয়ে যাবে। না, আমি মরিনি, তখনই প্রথম অনুভব করলাম জীবনের শুন্যতা কাকে বলে।

রাগে, দুঃখে দেশান্তরিত হলাম। শিক্ষকতার চাকরী নিয়ে সৌদি আরব চলে গেলাম। মেয়েদের প্রতি অনীহা জন্মালো। তারই সাথে বিতৃষনা এবং ঘৃণাও জন্মালো ফলে আবার বিয়ে করার সাহস হলো না। বাকী জীবনটা এভাবেই কাটিয়ে দিলাম।প্রবাসীদের জীবনে বরাবরই দেশের প্রতি অবিচল ভালোবাসার টান থাকে। গুরুতর অসুস্থ হওয়ার পর দেশের প্রতি ভালোবাসার টানটা আরো বেড়ে গেলো, দেশে ফেরার সাধ জাগলো। পার্মানেন্টলি চলে এলাম।

দেশে এসে নানা উৎস থেকে খবরা -খবর নিয়ে জানতে পারলাম আমার ছেলেটি মালয়েশিয়া থেকে এম,বি,এ, করে বর্তমানে এক বিদেশী ব্যাংকে ভালো পদে কাজ করছে। তবে দু’বার বিয়ে করে ডিভোর্স হয়েছে। কানা ঘুষায় যা শুনেছি তাতে জেনেছি যে ,ছেলে বিয়ে করে বউ কে নিয়ে বরাবরই মা, বাবার সাথে থাকতো। ছেলের মায়ের (আমার প্রাক্তন স্ত্রী) দুর্ব্যবহারে কোনো বউই টিকতে পারেনি। দু’দুটো বিয়ে ভেঙে যাবার পর সে নাকি অনেক ডিপ্রেসনে ভুগছে। স্বভাবতই ছেলের এই দূরদর্শার কথা শুনে মনটা খারাপ হয়ে গিয়েছিলো। ছেলেটির সাথে যোগাযোগের জন্য তৃতীয় ব্যক্তির শরণাপন্ন হয়েছিলাম। কোনো ফল হয়নি। উপরোন্ত আমার ছেলে জানিয়েছে যে, আমি নাকি একজন বদরাগী অমানুষ, অসম্ভব রকমের হিংসুটে। যে ছেলে চার বছর বয়সে আমাকে ছেড়ে চলে যায়, সে কি করে জানে আমি একজন বদরাগী হিংসুটে লোক। এতে আমার বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই যে এগুলি ওর মার শেখানো, আমার বিরুদ্ধে এ সমস্ত তকমা লাগিয়ে আমার ছেলের কাছে আমাকে অপদস্ত করা এবং সে যেন সব সময়ে আমাকে ঘৃণা করে চলে তা পাকাপোক্ত করা।আমার ধারণা আমার ছেলেকে তারা রীতিমতো “ব্রেন ওয়াশ” করে ফেলেছে।

এখন আপনার কাছে হাত জোর করে বলছি, যে করে হোক আপনি যদি একটু কষ্ট করে আপনার বন্ধু মুরাদ কে বুঝিয়ে আমার অনুরোধটা জানান তাহলে সে আপনার কথা ফেলতে পারবে না। একবার, শুধু একবার, আমার ছেলেকে আমার সাথে পরিচয় করার সুযোগ দিন। আমি মৃত্যুর পথযাত্রী, আপনার একটু চেষ্টাতে আমার জীবনের শেষ ইচ্ছাটি পূরণ হতে পারে”। কথাগুলি বলার সাথে সাথে মামুন কান্নায় ভেঙে পড়লো। তার কান্না দেখে আহসান সাহেব বেকায়দায় পরে গেলেন। তিনি মামুন কে অভয় দিয়ে বললেন, “আমি সর্বোচ্চ চেষ্টা করবো, বাকি আপনার ভাগ্য”!!

এক সময় সুযোগ বুঝে আহসান সাহেব , মুরাদকে বুঝালেন, “বেচারা, মামুন সাহেব এক কালে আপনার অন্তরঙ্গ বন্ধু ছিল, বর্তমানে তার শারীরিক এবং মানসিক অবস্থা বিপৎজনক পর্যায়ে, এমন অবস্থায় সে আপনার এমন কোনো ক্ষতির কারণ হতে পারে না। অন্তত মানবতার কারণে মামুন সাহেবকে একবার উনার ছেলের সাথে সাক্ষৎ করার সুযোগ দিন”। অনেক বলা কওয়ার পর মুরাদ রাজী হলো।

আহসান সাহেবের শান্তি নগর বাসায় পিতা পুত্রের মিলনের জায়গা ঠিক করা হলো। পিতা পুত্রের দেখা হলো। একজন আরেকজনকে জড়িয়ে ধরলো।কারোর মুখে কোনো শব্দ নেই। শুধু দেখা গেলো দুজনেরই শার্টের বুকের দিকটা অশ্রু জলে ভিজে একাকার হয়ে গেছে। মামুন সাহেবের মুখ মন্ডল দেখে আহসান সাহেবের মনে হলো উনার আবার নুতন করে বাঁচবার স্বাদ জাগছে।

আহসান সাহেব নিজের কাজের সফলতার আবেগে কিছুক্ষনের জন্য চোখ বুজলেন, তার মনে পরে গেলো সেই হারিয়ে যাওয়া গ্রিক পৌরাণিক্ স্তবক : —
If I speak in the tongues of human or of angels, but do not have love, I am only a resounding gong or a clanging cymbal,
If I have a faith that can move mountains, but do not have love, I am nothing.
শেষ
email :– quadersheikh@gmail,com