সাজ্জাদ আলী : তোমার নাকটি মুখের সাথে ভারি মানানসই। চোখ ফেরানো দায়। যদি তা আরেকটু লম্বা আর সূচালো হতো তাহলে কিন্তু ছন্দপতন ঘটতো। কি জানো, তোমার চোখের ভ্রæ জোড়া থেকে নাকের ডগা অব্দি ধনুকের মতো একটা বাঁক আছে। সেজন্যেই তোমাকে আমার তীরান্দাজ বলে মনে হয়। যেন চাইলেই তুমি শিকার ধরতে পারো। আবার নাকফুল ও নথ পরার জন্য দুটো ছিদ্র করেছ। কোনোটাই অবশ্য পরোনি, নাক খালি। তবে তাতে কোনো ক্ষতিবৃদ্ধি হয়নি। অমন সুডৌল নাকে বসতে পারলে নাকফুলেরাই বরং ধন্য হতো। ওই যে কপালের দুই ভ্রুর মাঝখানটায় যেখান থেকে নাকটি শুরু, সেখানে একটি টিপ পরলে বেশ মানাতো তোমায়! কোনো একদিন টিপ আর নাকফুলে সেজে আমাকে একখানা ছবি পাঠাবে, বলে রাখছি!

এ কথাগুলো লিখেছিলাম ফেসবুক বন্ধু শম্পার ম্যাসেঞ্জার ইনবক্সে। শম্পা চ্যাটার্জী নাকি ব্যানার্জী ঠিক মনে আসছে না এখন। তবে ‘শম্পা’ মনটা জুড়ে আছে। পশ্চিম বাংলার কোনো একটা জেলা শহরে সে থাকে। পেশায় শিক্ষক, নেশায় লেখক। ভারি শক্তপোক্ত লেখার গাঁথুনি তার। বিয়েথা করেছে কি না বা বয়স কত জানি না। তবে ছবি দেখে আন্দাজ করি চল্লিশের ধারে কাছে হবে। কাউকে এ ধরনের প্রশ্ন করাও তো চূড়ান্ত অভদ্রতা। আর শম্পাকে যতটা বুঝেছি তাতে মনে হয় ওকে চুমু দিলে বেজার হবে না। ফেরত পাওয়ারও সম্ভাবনা বিপুল। কিন্তু বৈবাহিক অবস্থার খোঁজখবর করলে আমাকে নিচু ভাববে।

প্রোফাইলের ছবিখানা ছাড়া ফেসবুকে শম্পার আর কোনো ছবি নেই। সবেধন নীলমনি এই ছবিখানাও মুখের ক্লোজআপ ছবি। অগত্যা শুধু ওই মুখখানা দেখেই ওর বাকি কাঠামো ওকে কল্পনায় বলি। যখন সত্যি সত্যি কিছু একটা মিলে যায়, সে ভারি খুশি হয়। তো একদিন লিখলাম, আচ্ছা শম্পা ফেসবুকে তোমার আরও দশ বিশখানা ছবি থাকাই তো উচিত ছিলো।
কেন ছবি দিয়ে কি হবে, শম্পার জিজ্ঞাসা।

ঢোক গিলে লিখলাম, তাহলে তোমাকে পরিপূর্ণ দেখা যেত। এখন তো শুধু মুখখানাই সম্বল। আন্দাজ করা যেত তুমি কতটা লম্বা, গড়ন কেমন, শরীরে মেদ কতটা, বক্ষ পরিপুষ্ট কি না ইত্যাদি। মানে বলতে চাই যে তুমি আমার এত ভাল বন্ধু অথচ তোমার কায়া সম্পর্কে আমার কোনো আন্দাজই নেই।

হা হা হা ! হাসালে মোরে বালক ! আচ্ছা আজ নয়তো কাল, আমাকে দেখতে তুমি তো আসছই। এলে আমার এপার্টমেন্টেই তোমার থাকার ব্যবস্থা করবো। তখন না হয় ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখো। হতাশ হবে না বন্ধু, কথাগুলো লিখে পাঠালো শম্পা।

বন্ধুত্বের গাড়ত্বে সবদিনই আমি উচ্ছ¡সিত হই। প্রাচুর্যে ভরে উঠে তনুমন। সে আনন্দ উপভোগে “ছুঁয়ে দেখাটা” কোনো পূর্বশর্ত নয়। শুধু “স্পর্শে সম্মতি আছে” এটুকু জেনেই প্রাণ ভরে যায়। আর সেই ভরা প্রাণে স্পর্শের কোনো প্রয়োজনও থাকে না। বর্নাঢ্য বন্ধুভাগ্য আমার। অভিজ্ঞতা বলে, ছোঁয়াছুঁই বন্ধুত্বকে দূরে ঠেলে। শম্পা সাবলিল, জড়তাহীন, মনের আকাঙ্খা গড়গড় করে বলে যায়। বন্ধুকে সে বন্ধুই ভাবে, পুরুষ বা নারী নয়।

একবার সপ্তাহ দেড়েক হবে শম্পার খবর নিতে পারিনি। সেও নিরব, গুডমর্নিংও বলেনি। আমি লিখলাম, কি ব্যাপার, শম্পারানীর কোন খোঁজ নাই খবর নাই! সে কি তবে ত্যাগ করলো আমায়?

প্রায় সাথে সাথেই শম্পা লিখে পাঠালো, তুমি না ত্যাজিলে মোরে আমি ত্যাজিবো না। হা হা হা! দুচার দিন চুপচাপ থেকে দেখলাম আমাকে নিয়ে তুমি উতলা হও কি না?
আচ্ছা তুমি একটা আর্টিক্যাল পাঠাবে বলেছিলে। ওটা নাকি দেখে দিতে হবে। পাঠালে না তো, লিখলাম আমি।

ধুত্তরিকা, ক’দিন থেকে মাথায় জট লেগে আছে। দু লাইনও লেখা আগায়নি। তুমি দূরে আছ বলে এ যাত্রা বেঁচে গেলে। নইলে মাথা টিপে দেওয়া লাগতো।

তোমার মনে হয় না শম্পা, এই দূরত্বটাই আমাদের সম্পর্কের রক্ষাকবচ। কাছাকাছি থাকলে অতি মাখামাখিতে পরস্পরের প্রতি আকর্ষণ এতদিনে পানসে হয়ে যেত?

তা ঠিক বলেছো, শম্পা লিখলো। আচ্ছা তোমার উপন্যাসখানা লেখা শেষ হলো কি? পাঠাও তো, পড়ার অপেক্ষায় আছি।

আরে না, উপন্যাসে নতুন একটা চ্যাপটার জুড়তে হবে। এখন তা লেখার মুডে নেই আমি। তবে তোমার ছবির মুখখানা নিয়ে একটা প্যারাগ্রাফ লিখেছি। ওটায় আরেকটু মমতা মাখিয়ে ঠিকঠাক করতে হবে। পাঠিয়ে দেবো তোমায়।

আচ্ছা পাঠিও। গুডনাইট।
যতবার তাকাই তোমার মুখচ্ছবি পানে, শঙ্কায় আঁতকে উঠি। যেটুকু পেয়েছি তোমায়, চাওয়ার তুলনায় সে নগণ্য। আবার মন বলে, এর বেশি পেতে নেই, আরো পেলেই হারাবো। ওই একখানা মাত্র ছবির মধ্যেই তুমি আমার কাছে জীবন্ত। কি জান, মুখ ছুঁলে যে শিহরণ জাগে, ছবি ছুঁয়ে তা হয় না। তোমার ডান গালে যে টোলটি দেখাচ্ছে, আঙ্গুলের চাপে তা আরো বড় করতে ইচ্ছা হয়। কপালের ভাঁজগুলোতে আমি যদি কখনও হাত বুলিয়ে দিই, দেখবে ওরা তখন লজ্জায় মিলিয়ে যাবে। তোমার কালো ডাগর চোখদুটো মুদলেও ক্ষতি নেই। ঘন পাপড়ি সে ক্ষতি পুষিয়ে দেবে। তোমার ঠোঁটের উপরে ঘন নি:শ্বাস ফেলবো ঠিক করেছি। অবশ্য তুমি চাইলে অধর ছোঁয়ানোর আব্দার করতেই পারো!

উপরের প্যারাগ্রাফটি শম্পাকে ইনবক্সে লিখে পাঠিয়েছি। জবাবে সে কিছুই লেখেনি। তবে নাকফুল আর নথ পরে এবং কপালে খয়েরি রঙা টিপ লাগিয়ে এখখানা ছবি পাঠিয়েছে। আমি ঠিকই জানি আমার লেখা প্যারাগ্রাফের প্রতিটা শব্দ দূরাগত ওই বন্ধুটির মনে পরশ বুলিয়ে দিয়েছে। রোমান্সে তার অন্তরাত্মা কেঁপেছে ! জীবনকে সামনে টেনে নিতে এমন কাঁপুনির প্রয়োজন আছে বৈকি। আমি শম্পার প্রেমিক না, তবে প্রেমময় বন্ধু বটে। দূরে থেকেও আমরা কতই না কাছে! আমি তাকে সজ্ঞানে আহবান করিনি (সেও না)। আবার কখনও বিসর্জনও দেবো না।

এ লেখা আর লম্বা না করি। রবি ঠাকুরের একটি গানের দুটি চরণ গাইতে গাইতে শেষ করি তবে,
“মুখপানে চেয়ে দেখি, ভয় হয় মনে—
ফিরেছো কি ফের নাই বুঝিব কেমনে।”
(লেখক বাংলা টেলিভিশন কানাডা’র নির্বাহী)