সুজিত কুসুম পাল : খবরটি ছোটো এবং পুরনো, কিন্তু তাৎপর্যপূর্ণ। ফ্রান্সে হাই স্কুল কিংবা বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে শিক্ষকতা পেশায় এসে যাঁরা ইংরেজি সাহিত্য পড়াতে ইচ্ছুক তাঁদের শিক্ষণ পাঠ্যসূচিতে স্যার থমাস মুর (১৪৭৮-১৫৩৫) ও উইলিয়াম শেক্সপীয়র (১৫৬৪১৬১৬) এর পাশাপাশি মার্গারেট অ্যাটউড (১৯৩৯-) দীর্ঘদিন ধরে আবশ্যিক বিষয়। অর্থাৎ উচ্চতর শ্রেণিতে মুর, শেক্সপীয়র এবং অ্যাটউড বিষয়ক পড়াশােনার ব্যাকগ্রাউন্ড ছাড়া কেউ ইংরেজি সাহিত্যে মাস্টার্স কিংবা ডক্টরেট করলেও তিনি ফ্রান্সের কোনো হাই স্কুল বা বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে ইংরেজি সাহিত্যের শিক্ষক হওয়ার যোগ্য নয় বলে বিবেচিত হবেন। ফ্রান্সে সরকারি চাকুরির প্রতিযোগিতামূলক লিখিত পরীক্ষার সিলেবাসেও অ্যাটউডের ‘দ্য হ্যান্ডমেইড’স টেইল’ (১৯৮৫) গ্রন্থটি অন্তর্ভুক্ত। অথচ সত্য প্রকাশে নিঃসংকোচ সাহিত্যিক অ্যাটউডের ‘দ্য হ্যান্ডমেইড’স টেইল’ গ্রন্থটি যৌনতা এবং ক্রিশ্চিয়ান প্রতীতিতে আঘাত করার অভিযোগে অ্যামেরিকার তেরোটি রাজ্যে এই পর্যন্ত আটাশটি লাইব্রেরি থেকে সরিয়ে ফেলা হয়েছে। অবরুদ্ধ সত্যকে অনিরুদ্ধকরণে অবিচল বিশ্ব সাহিত্যের এই ‘লিভিং লিজেন্ড’ মার্গারেট অ্যাটউড ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে ‘ইন্ডেপেন্ডেন্ট পত্রিকার সাথে এক সাক্ষাৎকারে অ্যামেরিকায় লিঙ্গ, শ্রেণি, সম্পদ ও বর্ণ বিষয়ক বৈষম্য এতো বেশি বেড়ে গেছে যে এই দেশের পলিটিকাল সিস্টেমে পরিবর্তন না এনে কেবলমাত্র আইনসভায় পাশ করানো আইন দিয়ে দেশ শাসনের নামে আইনসভার সদস্যদের ধনী বানানোর সংস্কৃতি ধরে রাখলে অ্যামেরিকায় আরেকটি ‘ফরাসি বিপ্লব’ আসন্ন’ বলে মন্তব্য করেছিলেন। দুনিয়াব্যাপী গ্রন্থ বিরোধী এই ধরণের স্বৈর মানসিকতার বিরুদ্ধে প্রতীকী প্রতিবাদ ও পদক্ষেপ হিসেবে পেঙ্গুইন র্যান্ডম হাউজ স¤প্রতি ৩৮৪ ধাতব পৃষ্ঠার ‘দ্য হ্যান্ডমেইড’স টেইল’ গ্রন্থটির অগ্নিনিরোধক সংস্করণের একটি কপি বাজারে ছেড়েছে। গত ০৭ জুন ২০২২ বিশ্বের প্রথম অগ্নিনিরোধক এই উপন্যাসটি নিলামে বিক্রি হয়েছে এক লক্ষ তিরিশ হাজার ডলারে। নিলাম থেকে প্রাপ্ত সমুদয় অর্থ প্রদান করা হয়েছে লেখকদের স্বাধীনতা সংরক্ষণে সদা নিয়োজিত প্রতিষ্ঠান পেন অ্যামেরিকার তহবিলে।। ১৯৮৫ সালে রচিত ‘হ্যান্ডমেইড’স টেইল উপন্যাসটি অ্যাটউডকে জগতখ্যাত করলেও প্রকৃতপক্ষে তাঁকে আন্তর্জাতিক লেখক হিসেবে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলো তাঁর গবেষণাধর্মী প্রবন্ধগ্রন্থ ‘সারভাইভাল’ (১৯৭০) এবং উপন্যাস, নিঃসন্দেহে, সারফেসিং’। ‘সারফেসিং’ উপন্যাসের রচনাকাল ১৯৭২ সাল। ১৯৬৭ সালে ক্যানাডার মাটিতে দাঁড়িয়ে ফরাসি প্রেসিডেন্ট চার্লস ডে গলের ‘ভাইভ লে ক্যুবেক লিব্রে ক্যুবেক দীর্ঘজীবী এবং মুক্ত হোক) শ্লোগানের পর, সাহিত্য সমালোচকদের বীক্ষণে, ক্যানাডিয়ানদের আত্মপরিচয়ের অভাববোধ ও সংকটের চরমকালে সারফেসিং’ উপন্যাসের আত্মপ্রকাশের ঘটনাটি ছিলো ক্যানাডার তৎকালীন রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ এবং সংবেদনশীল। উপন্যাসটি এগিয়ে গেছে একজন অনামিকা কথকের ধারা বর্ণনায়। এই অনামিকার বর্ণনায় উঠে আসা গল্পটি অনেকটা রূপকথার মতোই। তাঁর শিক্ষকের সাথে সম্পর্ক হলো, পরিণামে গর্ভপাত হলো, পরিণয় হলো না। আরেকজনের সাথে পরিণয় হলো, পরিণামে সন্তান হলো, ডিভোর্সও হলো; সন্তানের ওপর অধিকারও হারাতে হলো। তারপর এলো একজন অনিশ্চিত প্রেমিক, জো। দীর্ঘদিন পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন থাকার পর অনামিকা জো এবং বন্ধু ডেভিড ও ডেভিডের স্ত্রী আন্নাকে সাথে নিয়ে নিখোঁজ পিতার সন্ধান করতে গিয়ে খুঁজে পান তাঁর নিজেরই নানান একান্ত অজানা বিষয়। কাহিনির বিভিন্ন চরিত্রের যাবতীয় কার্যক্রম সম্পাদিত হয় কুবেক প্রদেশের সীমান্তবর্তী একটি ছোট্ট শহরে। কুবেক কেন্দ্রিক ক্যুবেকীয় ক্যানাডিয়ান ও মাইনাস ক্যুবেক ক্যানাডিয়ান, এবং ক্যানাডিয়ান ও অ্যামেরিকানদের মধ্যকার বিরাজমান ভিন্নতা ও বৈষম্যকে কেন্দ্র করে বিকশিত হয়েছে কাহিনির চড়াই-উতরায়। ক্যুবেক হল ক্যানাডার একমাত্র প্রদেশ যেখানে অ-ব্রিটিশ তথা ফরাসি বংশোদ্ভূত বাসিন্দারা জনবহুল। অ্যাটউড এমন এক সময়ে সারফেসিং উপন্যাসটি পাঠকের হাতে তুলে দিয়েছিলেন, যখন ক্যুবেক এবং ক্যানাডার বাকি অংশের মধ্যে সংস্কৃতিগত নানান ভিন্নতার কারণে ক্যুবেক জাতীয়তাবাদের ক্রম উন্মেষ ঘটছিলো। গত শতকের ষাটের দশকে ক্যুবেকে গড়ে ওঠে একটি শান্ত বিপ্লবের (কোয়ায়েট রিভলুশন) প্রতিচ্ছবি। সমাজকে ধর্মনিরপেক্ষ করে গড়ে তোলার পাশাপাশি এই বিপ্লব জন্ম দেয় অর্থনৈতিক ও শিক্ষাগত সংস্কারের একটি ধারা। এই শান্ত বিপ্লব অশান্ত ক্যুবেককে বৃহত্তর রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্বায়ত্তশাসন প্রদান করে। কুবেকের ফরাসি নাগরিকদের মধ্যে জাতীয়তাবাদের অনুভূতি এবং ক্যানাডা থেকে আলাদা হওয়ার আকাঙক্ষা ছড়িয়ে দেয়। অ্যাটউড ‘সারফেসিং’ উপন্যাসে এই রাজনৈতিক পরিবর্তনকে চিহ্নিত করার প্রয়াসে, বলা যায়, সফল হয়েছেন। উপন্যাসটিকে ক্যানাডিয়ান জাতিসত্তার সাথে প্রাসঙ্গিক করে তোলার আগে ক্যানাডীয় স্বাধীনতার শততম বার্ষিকীতে ক্যানাডায় ঘটে যাওয়া একটি রাজনৈতিক অঘটনের প্রসঙ্গ এই প্রবন্ধের পাঠকের কাছে উন্মোচিত করলে বিষয়টি অপ্রাসঙ্গিক হবে বলে মনে হয়। উল্লেখিত অঘটনের (১৯৬৭) পাঁচ বছরের মাথায় ‘সারফেসিং’ কাহিনির প্রকাশনা জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক মহলে নথিবদ্ধ এবং চেতনাবদ্ধ হয়। পাঠকদের তাই নিয়ে গেলাম ইতিহাসের নীরব নিভৃত নিখাদ নিকুঞ্জে। ক্যানাডার স্বাধীনতা অর্জনের শতবর্ষ উদযাপিত হয় ১৯৬৭ সালে। ব্রিটিশ সরকারের কাছ থেকে দেশটি আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীনতা লাভ করে ১ জুলাই ১৮৬৭। শতবর্ষ উদযাপনকালে ২৭ এপ্রিল থেকে ২৯ অক্টোবর ১৯৬৭ ক্যুবেকীয় শহর মন্ট্রিয়ালে অনুষ্ঠিত হয় বিশ্বমেলা ৬৭। উল্লেখ্য, এই মেলার তৃতীয় দিন উপস্থিত ছিলেন ৫ লক্ষ ৬৭ হাজার ৫শ’ আমন্ত্রিত অতিথি; কোনো আন্তর্জাতিক মেলায় এক দিনের উপস্থিতির পরিসংখ্যানে এটি আজ পর্যন্ত একটি রেকর্ড। মেলায় অংশগ্রহণকারী বাষট্টিটি দেশের সরকার প্রধানদের একজন হিসেবে তদানীন্তন ফরাসি সরকারের প্রেসিডেন্ট চার্লস দ্য গল (১৮৯০-১৯৭০) ছিলেন আমন্ত্রিত অতিথিদের একজন। শুরু থেকেই গলের এই সফর নিয়ে উৎকণ্ঠায় ছিলেন কানাডীয় প্রধানমন্ত্রী লেসটার বাউলস পিয়ারসন্স (১৮৯৭-১৯৭২)। রীতি অনুযায়ী ক্যানাডা সরকারের অতিথি হিসেবে সবারই রাজধানী অটোয়ার বিমানবন্দরে অবতরণ করার কথা। কৌশলী গল ফ্রান্স থেকে যাত্রা করেন জলজাহাজ যোগে; জাহাজ থেকে নামলেন কুবেকের প্রাদেশিক রাজধানী ক্যুবেক সিটি নৌবন্দরে। বন্দরে সমাগত উৎফুল্ল জনতা গলকে আন্তরিক অভ্যর্থনা জানালেও সেখানে ক্যানাডা সরকারের প্রতিনিধি হিসেব উপস্থিত সেদিনকার গভর্নর জেনারেল ড্যানিয়েল রোল্যান্ড মিচেনার (১৯০০-১৯৯১)কে বিভিন্ন অশালীন উক্তি দিয়ে টিটকারি করেন। সমবেত জনতার উদ্দেশে বক্তব্য প্রদানকালে প্রেসিডেন্ট গল ক্যানাডার কথা না বলে বরং কুবেকের সাথে ফ্রান্সের সম্পর্ক উন্নয়নের প্রত্যয় প্রকাশ করেন।
সফরসূচিতে অন্তর্ভুক্ত না থাকা সত্বেও, ২৪ জুলাই ১৯৬৭ মন্ট্রিয়াল সিটি হলের বেলকনিতে দাঁড়িয়ে ক‚টনীতিক বিধি ভঙ্গ করে প্রেসিডেন্ট গল ভাষণ দিলেন স্বাধীন ক্যুবেক আন্দোলনের সমর্থকদের উদ্দেশে। ভাষণের শেষ পর্যায়ে তিনি বলে ফেললেন, ‘ভাইভ মন্ট্রিয়াল! ভাইভ লে ক্যুবেক!’ (‘মন্ট্রিয়াল দীর্ঘজীবী হোক! ক্যুবেক দীর্ঘজীবী হোক!’)। তারপর তিনি যোগ করলেন, ‘ভাইভ লে ক্যুবেক লিব্রে! ভাইভ, ভাইভ, ভাইভ লে ক্যানাডা ফ্রাঙ্কাইস! এট ভাইভ লা ফ্রান্স!’ (‘দীর্ঘজীবী হোক মুক্ত ক্যুবেক! দীর্ঘজীবী হোক, দীর্ঘজীবী হোক, দীর্ঘজীবী হোক ফ্রেঞ্চ ক্যানাডা! দীর্ঘজীবী হোক ফ্রান্স!’[)। গলের অনুমোদন পেয়ে জনতা গর্জে উঠল, ভাইভ লে ক্যুবেক লিব্রে! ধ্বনি দিয়ে। গলের এই বক্তব্যটি ছিলো স্বাধীন ক্যানাডা রাষ্ট্রের অভন্তরীণ ব্যাপারে সেদিনের ফরাসী প্রেসিডেন্ট তথা ফ্রান্সের হস্তক্ষেপ এবং একটি ক‚টনৈতিক অশালীনতা। প্রতিক্রিয়া হিসেবে তার পরদিনই সেদিনের কানাডীয় প্রধানমন্ত্রী লেসটার পিয়ারসন্স জাতির উদ্দেশে প্রদত্ত টেলিভিশন ভাষণে জানিয়ে দেন, “ক্যানাডা একটি মুক্ত দেশ। ক্যানাডার জনগণ স্বাধীন। ক্যানাডার প্রত্যেকটি প্রদেশ স্বাধীন। ক্যানাডিয়ানদের নতুন করে মুক্তির প্রয়োজন নেই। বরং মনে করিয়ে দেয়া যায়, ফ্রান্সসহ অনেক ইউরোপীয় দেশের কল্যাণে দুটি বিশ্বযুদ্ধে হাজার হাজার ক্যানাডিয়ান সৈন্য তাঁদের জীবন উৎসর্গ করেছেন। ক্যানাডা সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে এই ধরণের চরম প্রতিক্রিয়া প্রকাশের পরদিনই, সফরের পরবর্তী যাবতীয় কর্মসূচি বাতিল করে সেদিনের ফরাসী প্রেসিডেন্ট তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত নিয়ে ক্যানাডা ত্যাগ করতে বাধ্য হন। এই বিশ্বমেলা ক্যানাডিয়ানদের মধ্যে জাগিয়ে তুলতে পেরেছিলো তাদের নিজস্ব জাতীয়তাবাদের ব্যঞ্জনা। তারা উপলব্ধি করতে পেরেছিলো কোন বিষয়গুলো তাঁদের মধ্যে একতাবোধ এবং কোন বিষয়গুলো বিচ্ছিন্নতাবোধ তৈরিতে ইন্ধন যোগাচ্ছিল। অটোয়ায় জন্মগ্রহণ এবং বাবার চাকরির সুবাদে অটোয়া ও উত্তর ক্যুবেকে শৈশব কাটানো হার্ভার্ড গ্র্যাজুয়েট অ্যাটউড, ১৯৬৭-৬৮ সালে মন্ট্রিয়ালে অবস্থানের কারণে, নিজেও বিষয়টি উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন। লেখক জিম পকের সাথে অ্যাটউডের পরিণয় সম্পন্ন হয় ক্যাথলিক প্রভাবিত ক্যুবেকের মন্ট্রিয়াল শহরেই। পকের পরিবার ক্যাথলিক অনুসারী হলেও, অ্যাটউডের পরিবারে ধর্মীয় চর্চা না হওয়ার কারণে তাঁরা আদালত মতে পরিণয় পর্ব সম্পন্ন করেন। অ্যাটউড ছিলেন ইংরেজি সাহিত্যের ভিক্টোরিয়ান বিশেষজ্ঞ। এই সময় স্যার জর্জ উইলিয়াম এবং ম্যাকগিল বিশ্ববিদ্যালয়ে ভিক্টোরিয়ান লিটারেচারের কোনো শিক্ষকের পদ খালি না থাকায় অ্যাটউড এবং হার্ভার্ড থেকে সদ্য পিএইচডি করা পক দুজনই মন্ট্রিয়াল ছেড়ে এডমন্টন চলে যান। মন্ট্রিয়ালে অবস্থানকালে তিনি ক্যুবেকারদের অসন্তোষের কারণগুলো খুঁজে বের করার চেষ্টা করেন। অ্যাটউড লক্ষ্য করেন, যেখানে স্বাধীনতা প্রাপ্তির একশো বছর পরও ক্যানাডিয়ানদের মধ্যে নিজস্ব জাতীয়তাবোধের ধারণা পরিপক্ক হয়নি, এমনকি ক্যানাডার নিজস্ব পতাকার জন্ম হয় স্বাধীনতা প্রাপ্তির দীর্ঘ পঁচানব্বই বছর (১৫ ফেব্রæয়ারি ১৯৬৫) পর, সেখানে ক্যুবেকারদের সাংস্কৃতিক জাগরণকে তিনি উদার চিত্তে গ্রহন করেন। এই সময় ইংলিশ ক্যানাডিয়ানদের সাহিত্য ও সংস্কৃতি বিষয়ক অগ্রসরমানতার দিকেও ক্যুবেকারদের আগ্রহ ও আসক্তি ছিলো। কিন্তু তাঁদের আন্দোলনের একটি কালো দিকও ছিলো; একটি উগ্রপন্থী জঙ্গি সংগঠনের সম্পৃক্ততার কারণে তাঁদের আন্দোলনের সঠিক বার্তাটি ক্যানাডিয়ানদের কাছে পৌঁছেনি। এই জঙ্গি দলটি ১৯৬৩ সালে ক্যানাডা পোস্টের মেইল বক্স, বিভিন্ন বেসরকারি ভবন ও সেনানিবাসে বোমা বিস্ফোরণ ঘটিয়ে হত্যার রাজনীতি শুরু করে। তিনি কুবেক সংস্কৃতিকে স্বতন্ত্র মর্যাদা দানের পক্ষে থাকলেও তাঁদের বিচ্ছিন্নতাবাদী রাজনীতিকে কখনো সমর্থন করেননি। যখনি সুযোগ পেয়েছেন, তিনি ক্যুবেকবাসী লেখকদেরকে সাথে নিয়ে কাজ করেছেন। তিনি নিজে ফরাসি ভাষা শিখেছেন, ফরাসি কাহিনির চিত্রনাট্য লিখেছেন, ক্যুবেক বেতারে তাঁদের সংস্কৃতি নিয়ে কথা বলেছেন। ফরাসি ভাষায় অনুদিত তাঁর নিজের বই নিয়ে অনুষ্ঠান করেছেন। কাহিনির বিন্যাসে ভৌগলিক প্রেক্ষাপটকে অ্যাটউড কখনোই নিছক দুর্ঘটনা বলে মনে করেন না। আজকের উপন্যাসে অনামিকা নায়িকা নিজের অতীতের সন্ধানে ফিরে এসেছেন একটি ক্যুবেকীয় দ্বীপে। কাহিনিতে ‘জিওগ্রাফিক’ অনুষঙ্গ হিসেবে ক্যুবেকের অন্তর্ভুক্তি খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। ইংলিশ ক্যানাডিয়ানদের ভাবনার জগতে ফ্রেঞ্চ ক্যানাডা চিরকালই একটি সৃজনশীল উপাত্ত। ক্যানাডিয়ান সাহিত্যিক ডানকান ক্যাম্পবেল স্কট (১৮৬২-১৯৪৪) থেকে শুরু করে রবার্টসন ডেভিস (১৯১৩-১৯৯৫) পর্যন্ত সবাই তাঁদের লেখনিতে ফ্রেঞ্চ ক্যানাডাকে ব্যবহার করেছেন ইংলিশ ক্যানাডার অবরুদ্ধ অসাধারণ অতীন্দ্রিয় চেতনার অস্পষ্টতাকে উন্মোচিত করার কাজে। অ্যাটউডের বাংলাভাষী বন্ধু সাহিত্যিক ভারতী মুখার্জী (১৯৪০-২০১৭)র স্বামী লেখক ক্লার্ক বেøইজ (১৯৪০-)ও তাঁর ‘অ্যা নর্থ অ্যামেরিকান এডুকেশন গ্রন্থে ক্যানাডীয় জাতীয় সত্তাকে পরিচয় করিয়ে দেয়ার জন্যে ব্যবহার করেছেন মন্ট্রিয়ালের অনেক ব্যক্তিত্বের বৌদ্ধিক বৈভবকে।
‘সারফেসিং’ উপন্যাসের অনামিকা নায়িকার মনের মানচিত্রে ক্যুবেক হয়ে উঠেছে। কখনো ‘হোম’ কখনোবা নট হোম’। এই জন্যে ‘হোম’ যে তাঁর মা-বাবা বেদনার ভারে নুজ হয়ে বসতি গড়েছিলেন ক্যানাডার এই ক্যুবেকীয় বিজনদ্বীপে; ‘নট হোম’ এই জন্যে যে এই প্রদেশটি কিছু রহস্যময় পরকীয় মানুষের বিচরণভূমি। অনামিকার আশৈশব ধারনা, কুবেকে এক ধরণের অকৃত্রিম সংস্কৃতির চর্চা হয়, যা ইংলিশ এবং অ্যামেরিকান ক্যানাডার নিগ্রহের শিকার। অ্যামেরিকানদের নিয়ে অ্যাটউডের এই কথক নায়িকা সবসময় একটি পূর্বধারণা পোষণ করেন; তাদেরকে তিনি পছন্দও করেন না, বিশ্বাসও করেন না। অ্যামেরিকানদের জীবনবোধ তাঁকে পীড়িত করে। কারণ, তারা নিজেদেরকে নিজেদের চাইতেও বড় মনে করে। তাদের অন্তক ও অর্থহীন সহিংসতা কথককে উত্যক্ত করে। রাস্তার ধারে মাটিতে পুঁতে রাখা একটি লাঠির মাথায় একটি সারস পাখির মৃতদেহকে করুশবিদ্ধ যীশুর মতো ঝুলন্ত অবস্থায় দেখে অনামিকা কথক ভেবেই নেন, অবশ্যই কোনো পুরুষ কোনো যৌক্তিক কারণ ছাড়াই এই পাখিটিকে হত্যা করেছে। হত্যাকারী বিকৃত মানসিকতা সম্পন্ন বলেই পাখিটির মৃতদেহ সমাধিস্থ না করে এইভাবে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে। তিনি বিশ্বাস করেন, যে পুরুষ এটা করেছে সে অবশ্যই অ্যামেরিকান। পরে যখন তিনি জানতে পারেন যে পাখিটির হত্যাকারী একজন ক্যানাডিয়ান, তখন তিনি মোটেই বিভ্রান্ত হন; হবেই তো, তিনি মনে করেন, অ্যামেরিকান সংস্কৃতিই এই জন্যে দায়ী। অ্যামেরিকানদের রুচি ও আচরণ একটি রোাগের মতো; এই রোগ সবকিছুকে সংক্রামিত করে। ক্যানাডিয়ানদের মধ্যে অ্যামেরিকানদের এই সংক্রামক ব্যাধি ক্রমশ ছড়িয়ে পড়ছে। নিখোঁজ বাবাকে খুঁজতে গিয়ে দ্বীপবাসীদের সাথে একই ভাষায় কথা বলতে না পারায় অনামিকার নিজের মধ্যে তৈরি হয়েছে এক ধরণের বিচ্ছিন্নতাবোধ। এই বিচ্ছিন্নতাবোধ থেকে তাঁর উপলব্ধি হয়েছে স্কুলে ইংলিশ ক্যানাডিয়ানদের ‘টোকেন’ ফরাসি ভাষা শেখার চর্চা দুটি সংস্কৃতির মধ্যে ব্যবধান বাড়াতে কাজ করে। ‘টোকেন’ চর্চা করে ভাষার পূর্ণতাকে উপভোগ করা যায় না। ফরাসি নাট্যকার র্যাসিনের নাটক অ্যাথালি’র সংলাপ কিংবা কবি বড়লেয়ারের ‘লেস মেটামরফসিস ডু ভ্যাম্পায়ার’ কবিতার লাইন মুখস্থ করেও একজন ক্যুবেকারের দোকান থেকে হ্যামবার্গার কিনতে গিয়ে একজন অ-ফ্রেঞ্চ ক্যানাডিয়ানকে অপদস্থ হতে হয়। নিজের দেশে ভাষাগত কারণে এই ধরণের বিব্রতকর পরিস্থিতি মেনে নিতে অনামিকার কষ্ট হয়। তাঁর মা ও বাবা প্রতিবেশি পল এবং মিসেস পলের সাথে মুখোমুখি হলে অভিবাদন জাতীয় দুটি মুখস্থ ফরাসি সংলাপ ছাড়া আর কিছুই বলতে পারতেন না। একটি সংলাপের ইংরেজি মানে হচ্ছে ‘হাউ আর ইউ’ এবং অপরটি হছে ‘ওয়েদার ইজ ফাইন’। ভাষাগত জটিলতা, সীমাবদ্ধতা ও দৈন্যতা প্রসঙ্গে অনামিকার পর্যবেক্ষণ হচেছ, ক্যানাডিয়ান এবং অ্যামেরিকান ইংরেজি ভাষার মধ্যে পার্থক্য না থাকার কারণে অতি সহজে অ্যামেরিকান সংস্কৃতি ক্যানাডায় অনুপ্রবেশ করছে। ব্রিটিশ উপনিবেশের অবসান হলেও ক্যানাডার দক্ষিণ সীমান্তে দাঁড়িয়ে গেছে। এক নতুন উপনিবেশ সম্রাট। দক্ষিণের ঝড় উত্তরের সব কিছু লণ্ডভণ্ড করে দিচ্ছে। তারা ফিশিং করতে গিয়ে প্রয়োজনের অতিরিক্ত মাছ ধরে লেকের পাড়ে ফেলে রাখে। স্পাের্টসের নামে পশু-পাখি হত্যা করে রাস্তার ধারে রেখে যায়। ক্যাম্পিং করতে এসে পার্কের মাটি পোড়ায়, গাছ কাটে। বোটিং করতে গিয়ে লেক নষ্ট করে। শপিং করতে এসে অশালীন আচার আর অশ্রাব্য ভাষা ছড়িয়ে স্থানীয়দের অ্যামেরিকানাইজ করে। চলমান এই অ্যামেরিকানাইজেশন এক ধরণের উপনিবেশ। অনামিকার দৃষ্টিতে ক্যুবেকে এই অ্যামেরিকানাইজেশনের প্রক্রিয়াটি ক্যানাডার অন্যান্য প্রদেশের চাইতে বেশি দৃশ্যমান। তাঁর কষ্ট হয়, যখন তিনি দেখেন, ক্যানাডিয়ানরা তাদের জাতীয় সত্তাকে পাশ কাটিয়ে ক্রমশ অ্যামেরিকান হয়ে যাচ্ছে। ক্যুবেকের শৈশবকালিন ভার্শানটি অনামিকা খুব মিস করেন। অ্যামেরিকান পর্যটকদের কারণে অতি প্রযুক্তি আর নগর সভ্যতার উত্তরণে নিজের ভূখণ্ড পরিবেশগত ভারসাম্য হারিয়ে ক্রমশ শ্রীহীন হয়ে পড়ছে। উত্তর গ্রামের মেঠো পথ নষ্ট করে কংক্রিটের সোজা রাস্তা বানানো হয়েছে দক্ষিণের পর্যটকদের সুবিধার জন্যে। অ্যামেরিকানদের খুশি করার জন্যে নির্মিত নতুন গ্যাস ষ্টেশনে ক্যানাডার জাতীয় পশু মুসের মূর্তির হাতে উড়ছে অ্যামেরিকান পতাকা। অনামিকার নিজের কথাঃ
“Oh god look at that, they are dressed in human clothes and wired standing up on their hind legs, a father moose with a trench-coat and a pipe in his mouth, a mother moose in a print dress and flowered hat and a little boy moose in short pants, a striped jersey and a baseball cap, waving an American flag.”
এই ‘পতাকা’র বিনিময়ে সীমান্তবর্তী গ্রামের মানুষের জীবিকা নির্ভর করছে ছুটির দিনে সীমান্তের ওপার থেকে মাছ ধরতে আসা অ্যামেরিকানদের ওপর। দক্ষিণের ফিশারম্যানদের কাছে রান্না খাবার বিক্রি করে উত্তরের গ্রামবাসীদের সংসার চলে। এইভাবে মিশতে মিশতে স্থানীয় ক্যুবেকীয়রাও শিখে নিচ্ছে অ্যামেরিকান ভাষা। এখানে ঘুরতে আসা অ-ক্যুবেকীয় ক্যানাডিয়ানরাও অ্যামেরিকান স্টাইলে ইংরেজি বলে। ভাষা দিয়ে এখন আর অ্যামেরিকান আর ক্যানাডিয়ানদের স্বতন্ত্র করে চিহ্নিত করার উপায় নেই। অনামিকার বন্ধু ডেভিড যখন অ্যামেরিকানদের স্বভাব-চরিত্র নিয়ে সমালোচনা করে, তখন ডেভিডের উচ্চারণ আর শরীরি আচরণ দেখে মনে হয় সে নিজেই একজন অ্যামেরিকানাইজড ক্যানাডিয়ান। ‘ডেভিড’রা নারীকে সম্মান করে না। সে যৌনতাকে ‘কঞ্জিউম’ করে, ‘এঞ্জয় করে না। ‘র্যান্ডম স্যাম্পল’ নামে একটি ডকুমেন্টারি ছবি নির্মাণের নামে সে তার স্ত্রী আন্নাকে উদোম হয়ে ক্যামেরার সামনে দাঁড়াতে বাধ্য করে। দ্বীপে অবস্থানকালে অন্টারিও থেকে আগত একদল ফিশারম্যানের সাথে কথা হলে তারা পরস্পরকে মনে করেছে অ্যামেরিকান। ভুল ভাঙার পর সত্তর দশকের অনামিকার মনে হয়েছে, উত্তর অ্যামেরিকায় প্রকৃতপক্ষে অ-অ্যামেরিকান হয়ে থাকা সম্ভব নয়। তাঁর ভাষায়ঃ “If you look like them and talk like them and think like them you are them … you speak their language, a language is everything you do.” তাঁর মন্তব্যে আরও একটি পর্যবেক্ষণ উঠে এসেছে : অ্যামেরিকানাইজেশন একটি ধাবমান ভাইরাস যেটি ক্যুবেককে ছাড়িয়ে ক্যানাডার অন্যান্য প্রদেশেও ছড়িয়ে পড়েছে।
ডেট্রয়েট বন্যপ্রাণী সংস্থার সদস্য হিসেব পরিচয় দিয়ে ম্যালস্ট্রম নামে যে একজন অ্যামেরিকান দ্বীপটি কিনতে চান, ডেভিড তাকে সিআইএ-র সদস্য হিসেবে অভিযুক্ত করে, এবং অনামিকা ম্যালস্ট্রমকে ফিরিয়ে দেন। ‘ম্যালস্ট্রম’ আসলে ক্যানাডায় অ্যামেরিকান উপনিবেশের আরেকটি চিত্রকল্প। লেকে ডুব দিয়ে বাবার অস্তিত্ব খুঁজতে গিয়ে ডিভোর্সি অনামিকার মনে হলো তিনি তাঁর অতীত বিবাহিত জীবনের গর্ভপাত জনিত মৃত সন্তানের সন্ধান পেয়েছেন। তখন তাঁর মনে হয়েছে ক্যুবেক তাঁর ‘হোম’। পরে তিনি আবার ডুব দিয়েছেন বাবার কাছে থাকা সেই পুরনো দিনের কিছু রক পেইন্টিংয়ের সন্ধানে। দ্বিতীয় ডুবটি হছে একটি অসাধারণ চিত্রকল্প। ক্যুবেকীয় শিল্পীর চিত্রকর্মের নান্দনিক উচ্চতার প্রতি একজন অ-ফ্রেঞ্চ ক্যানাডিয়ানের মূল্যায়নকে তুলে ধরার জন্যে লেখক দ্বিতীয় ডুবটির আয়োজন করেছেন। মনে হচ্ছে ক্যানাডিয়ানদের মনের মানচিত্রে ক্যুবেক অঞ্চলটি স¤প্রসারিত হচ্ছে। কাহিনির কথকের পর্যবেক্ষণ, ক্যানাডিয়ানদের শিক্ষা-শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি বিষয়ক জাতীয় সত্তার অনুসন্ধানে ক্যুবেকের মাটি থেকেই শুরু হতে পারে অভিযাত্রা। কুবেকের সাংস্কৃতিক বিপ্লবের আয়নায় নিজেদের হতাশচিত্রটি একবার দেখে নেয়া যায় অভিযাত্রা পূর্বনির্ঘণ্ট হিসেবে।