আকাশ আমায় ভরল আলোয়
জানালার একচিলতে আকাশ দেখেই কেটে যায় কিছু কিছু দিন। সকাল থেকে অনিয়মিত বিরতিতে ওই এক খন্ড আকাশেই কত রকমের কারুকাজ। রোদ-মেঘ-ছায়ার পালাবদল। তীব্র আলোয় ভেসে ওঠা নীল আকাশ। মুহুর্তেই বদলে যাওয়া মুখভারী সাদা কিংবা কালোয়। কখনো ছোঁ-মারা ঈগলের মতো হঠাৎ মেঘের আগ্রাসন। পরক্ষণেই একেবারে জগৎ অন্ধ করা কালোয় চরাচর ঢেকে দেওয়া। কোথাও যাবার দরকার নেই। ঘরের বিছানায় শুয়ে কিংবা জানালার পাশে বসে বিশালের সাথে ঘরে আবদ্ধ মানুষের মিলন। এ বিচিত্র এক একাকী ভ্রমণ।
ছোটবেলায় বালতির কিংবা গামলার জলে সূর্যকে ধরে রাখার প্রয়াস দেখতাম সূর্যগ্রহণের দিনে। কোটি কোটি নক্ষত্রের একটি নক্ষত্রের নাম সূর্য। সেই ক্ষুদ্র সূর্যকে কেন্দ্র করেই আমাদের পৃথিবীর মতো আরও কিছু গ্রহের অবস্থান। সৌরজগতে পৃথিবী নামক আমাদের এই গ্রহটি সূর্যের আলো এবং উত্তাপ নিয়েই প্রাণের অস্তিত্বকে বহে বেড়াচ্ছে। পৃথিবীকে কেন্দ্র করে আছে একটি বায়ুমন্ডলের বলয়। সেই বলয়ের দৃশ্যমান অংশটুকুই আকাশ। যাকে আমরা আকাশ বলি, বিজ্ঞানের সুক্ষ্ণ বিশ্লেষণে তা বহু গ্যাসের সম্বন্বয়ে গড়া অনেক শক্তির আধার। আর এই নানান শক্তির আকর্ষণ-বিকর্ষণেই আমরা আকাশের নানান রঙ দেখি, দেখি মেঘেদের ভেসে বেড়ানো।
আমার ছোটবেলার সেই বেড়ে ওঠা সময়ে জেলা কিংবা মহুকুমা শহরের চৌহদ্দির বাইরে বিদ্যুৎ ছিল না। যে গ্রামীন জনপদে ছিল আমাদের বাস, সেখানে বিদ্যুৎ থাকার তো প্রশ্নই উঠে না। ফলে প্রকৃতি ছিল একেবারে নির্মল। কৃত্রিমতা, যার পোষাকি নাম আধুনিকায়ণ, সেই আধুনিকতার ছাপ বিবর্জিত একেবারে ভার্জিন। নিচের গাছ-পালা-প্রকৃতি কিংবা জীববৈচিত্র ছিল যেমন, তেমনি ছিল উপরের আকাশ বা বায়ুমন্ডল। চারিদিক থৈ থৈ জলে ভেসে থাকা জগতের আর সব কিছু থেকে বিচ্ছিন্ন একটি দ্বীপ যেন ছিল আমাদের বাড়িগুলো। শ্রাবণ-ভাদ্রের সেই তালপাকা গরমে ডিংঙি নৌকার পাটাতনে শুয়ে শুয়ে সন্ধে-বিকেলের আকাশ, মেঘ, রাতের চাঁদ কিংবা অগণিত তারা দেখার সে মুহুর্তগুলো এত বছর পরেও কেমন উদ্বেল করে তোলে।
পৃথিবীসহ সারা বিশ্বব্রহ্মান্ড যেমন ঘুরছে, মানুষ যতো ক্ষুদ্রই হোক না কেনো, মানুষও ঘুরছে এই পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে। মানুষের এই যে বাস্তুবদল, এর আধুনিক নাম অভিবাসন। কতো উছিলায় কিংবা কতো প্রয়োজনে মানুষ ছুটছে। আগে দেখতাম, চাঁইচাঁই বরফ গলার মতো গ্রামের পরে গ্রাম ঝুপঝুপ করে ভেংগে নিচ্ছে যমুনা নদী তার নিজের গহবরে। এই জনপদের হাজার হাজার মানুষ উঁচু সড়কের পাশে সারি সারি ঝুপড়ি ঘরে আবাসন গেড়েছে। একদিন এক জায়গায়, অন্যদিন অন্যত্র। এক বস্তি থেকে অন্য বস্তিতে। গ্রাম থেকে মফস্বলে, তারপরে শহরে কিংবা রাজধানীতে। পায়ের নিচে সর্ষে দানা নিয়ে মানুষ সারাক্ষণ গড়াচ্ছে। কিছুটা প্রকৃতির কারণে আর অধিকাংশই মানুষের হিংস্রতা আর ক্ষমতার দাপটে; সাথে বিভক্তির বাতাবরণ তো আছেই। গ্রাম থেকে শহর, শহর থেকে অন্য শহরে, দেশ থেকে অন্য দেশে মানুষ ছড়িয়ে পড়েছে। এই দূরে যাওয়ার, এই বাস্তুচ্যুতির আধুনিক নাম বিশ্বায়ণ বা গেøাবালাইজেশন।
আমিও একদিন গেøাবালাইজেশনের চাকায় চড়েই উড়ে এসেছি উত্তর মেরুর একেবারে কাছে। শুধু সমান্তরাল অক্ষেই তেরো হাজার মাইল সরে আসিনি, আমার জন্মস্থান থেকে ন্যূনতম পক্ষে হাজার খানিক ফুট উর্ধ্বেও উঠে এসেছি। তাই ব’লে কি চাঁদে হাত বাড়িয়েছি? অভিবাসনের ঘাত-অভিঘাত, জীবন সংগ্রামের চরম চরাই-উৎরাই, সংস্কৃতির চরম বৈপরীত্য এবং প্রজন্মের উৎপাটিত শেকড় নিয়ে বেড়ে ওঠা- এসব কি সত্যি চাঁদে হাত বাড়ানো? ভবিষ্যৎ সেটি বলে দেবে। তবে ৩৮৫,৩৯৯ কিলোমিটার গড় দূরত্বের চাঁদ যে অভিবাসী জীবনে হাজার খানিক ফুট কাছাকাছি চলে এসেছে সেটি নির্দ্বিধায় বলাই যায়। আমার মতো অনেক অভিবাসীর জীবনে এই উন্নতিটুকুই কি স্থায়ী প্রাপ্য? উত্তর আমার জানা নেই।
তবে এটা জানা আছে যে অনেকটাই বায়ুদূষণমুক্ত বায়ুমন্ডলে চাঁদ অনেকটাই কাছে মনে হয় এই উত্তর মেরুর কাছাকাছি দেশগুলোতে। এই তো গতকালই আকাশে একাদশীর চাঁদ সামনে রেখেই হাঁটছিলাম। অন্যদিনের বিকেলবেলার স্বাস্থ্যরক্ষার হাঁটাহাঁটিতে নির্মল আকাশে আলোর ছাঁট থাকে। তাই চাঁদের সৌন্দর্যটা তেমন চাক্ষুষ করা যায় না। কিন্তু কালকে ঘটলো অন্যরকম অনুভূতি। তখন গোধুলীর আলো পশ্চিম আকাশের মেঘগুলোকেও অন্ধকার করে সরে গেছে। দূরের নক্ষত্রেরা মিট্মিট করছে। তার পাশেই একাদশীর চাঁদ তার চারিদিকে বেশখানিকটা আলোর বৃত্ত রচনা করে কী উজ্জ্বল আভায় দ্যুতি ছড়াচ্ছে। আগে তো বর্ষার নির্মল আকাশে নৌকার পাটাতনে শুয়ে শুয়ে চাঁদ দেখেছি। এই দীর্ঘ অভিবাসী জীবনেও আকাশ দেখেই স্মৃতির সরণীকে টেনে নিয়ে গেছি জন্মভুমিতে অনেক সময়। কিন্তু সেদিনের মতো এমন মনকেমনকরা অনুভূতি হয়নি কোনোদিনই।
সারা পৃথিবীর মানুষের মতো আমিও ঘরবন্দী বছরাধিক কাল। প্রচন্ড শীতের এ দেশে বছরের অধিকাংশ সময়েই ঘরের জানালা দিয়ে দিনে আকাশের মেঘ দেখতে হয়। রাতে জানালা দিয়েই জ্যোছনা দেখি, দেখি আকাশের নক্ষত্রমন্ডলীর আলোও। মাত্র কয়েকটি মাস অবকাশ থাকে বাইরের উঠোনে বের হওয়ার। অফিসের শেষে কিংবা ছুটির দিনে পেছনের কাঠের পাটাতনে বসি। মনের সুখে বই পড়ি, গান শুনি, কখনো কখনো কবিতা পড়ি, নিজের আনন্দে গেয়ে উঠি প্রিয় কোনো গানের বাণীও। কিন্তু সব কিছুর সাথেই থাকে হঠাৎ হঠাৎ বদলে যাওয়া আকাশ। পুবদিকের ‘লেক এরি’ থেকে উঠে যাওয়া মেঘ উত্তরের ‘লেক ওন্টারি’-র মেঘের সাথে মিলেমিশে একাকার হ’তে থাকে ক্ষণেক্ষণে। আমি ঘাড় উঁচু করে এই মেঘেদের মেলামেশা দেখি। দেখি কেমন করে একের বিভা অন্যের মাধুরীতে মিশে অপূর্ব সৌন্দর্যের সৃষ্টি হয়। রবীন্দ্রনাথ কী সুন্দরভাবে বর্ণনা করেছেন এই দৃশ্যকেই, “চিরদিবস নব মাধুরী, নব শোভা তব বিশ্বে”। ঘরবন্দী সময়ে আমাদের বিশ্ব এখন ওই ঘাড় উঁচু করে দেখা আকাশখানিই।
ভজন সরকার : কবি, কথাসাহিত্যিক ও প্রকৌশলী। হ্যামিল্টন, কানাডা