হিমাদ্রী রয় সঞ্জীব
বাঙালির জীবনে এক ভালোলাগার সকাল আসে শরতের প্রাক প্রত্যুষে। মশারির ভিতরে আধো ঘুম আধো জাগায় মনে হয় ঠাকুর ঘরে বসে আছে জগত্ সংসার। হৃদয় আকাশে জাগরিত হোন জ্যোতির্ময়ী। মোহাবিষ্ট হয়ে মর্ত্যের মানুষ শোনে জগন্মাতার আগমন বার্তা। শারদীয় দুর্গোত্সবের শুরুর ইতিহাস থেকে আজকের ইউনেস্কোর তালিকায় বাঙালির প্রধানতম উত্সব হয়ে উঠার পেছনে কিছুটা হলেও ভূমিকা আছে; শারদ প্রাতের ঘুম ভাঙ্গানিয়া আকাশবাণীর। বামুন-কায়েত-আলী-মুন্সীরা মিলে হাওয়ায় তাজমহল গড়েছিলেন ১৯৩২ সালে। বাণী কুমারের অসাধারণ গ্রন্থনা, পংকজ কুমার মল্লিকের চিরন্তনী সুর, বীরেন্দ্র কৃষ্ণ ভদ্রের অনবদ্য স্বরক্ষেপণ ও ভরাট কন্ঠস্বরে, পৃথিবীর কালীমা মুছে পূজোর ঢাকে কাঠি পড়ে। সে বছর নাম ছিলো প্রত্যুষ প্রোগ্রাম। এর পরের বছর নাম হয় মহিষাসুর বধ। ১৯৩৭ সালে এ অনুষ্ঠানের নাম হয় মহিষাসুর মর্দিনী। সেই সময় থেকে এই সময়, গত ৮৭ বছর ধরে, যিনি মাতৃত্বের প্রতি আমাদের দায়টুকু জাগিয়ে তুলেন ‘আশ্বিনের শারদ প্রাতে বেজে উঠেছে আলোক মঞ্জির’। মনে হয় ঐ বুঝি মা এলেন। আকাশবাণীতে বীরেন্দ্র কৃষ্ণ ভদ্র ডাক দিলেই তবে পূজোর দিনগুনা হয় শুরু।
কয়েকটা দিন কাটে কল্পনার কাশের বনে। কমবেশি সবাই হাতরে দেখি স্মৃতির ঝাঁপি। কুলকুল বয়ে চলা নদীর পাশদিয়ে ঘেঁষা আমার ছোট্টো বাজার; ছেলেবেলার-ছেলেখেলার আনন্দের পারাপার। শরত্ পুর গ্রামের কাশবনে কতদিন হেঁটেছি আনমনে। স্কুল পালানো দুপুরে কুমোর পাড়ায় দেখতে যেতাম ঠাকুর গড়া। মনে আছে বাঁশি পাল। ব্যাস্ত সময়ে, নিবিষ্ট মনে হাতের ছোঁয়ায় গড়তেন দুর্গা-লক্ষী-সরস্বতী। ডাকে পাখি না ছাড়ে বাসা লগ্নে, চষে বেড়িয়েছি পাশের গ্রাম গুলিতে একশো আটটি স্থলপদ্মের আশায়। আর ঘরে ফেরে শিউলি তলায় শিশির ভেজা পায়ে দাঁড়ানো ‘মা’। প্রতিটি বাঙালির ‘আমার পূজোয়’ এই গল্প খুঁজে পাওয়া যাবে।
দেশ ছেড়ে আসার আগে, কি জানি কি ভেবে মায়ের সাথে একখানা ছবি তুলেছিলাম শিউলি তলায়। অভিবাসী জীবনে পূজো গেছে পূজো আসে। দেশের সুনীল আকাশের অস্তগামী সূর্য কোন একদিন, বিদায়ের শেষ ক্ষণে এই দূরদেশে আমার হৃদয় আকাশের পশ্চিম দিগন্তে ছড়িয়ে গেছে রক্তিম আভা। ততদিনে শিউলি মালা হয়ে মায়ের ছবিতে। ঘর মন্দিরের মা এখন হৃদয় মন্দিরে থাকেন। শরীর পুড়ে যায়, স্মৃতিরা বেঁচে থাকে। বছর ঘুরে পূজো আসে, মহালয়ার ভোরে গঙ্গার ধারে কিংবে প্রবাসের কোন মন্দিরে পূর্বপুরুষদের তর্পনে ব্যাস্ত; বৈতরণিতে বিশ্বাসী মানুষের ভির। আমি এবং আমার মত যারা তাদের আশ্রয় দেন রবীন্দ্রনাথ। ‘আশ্বিনে আনত মা সেই ফুলের সাজি বয়ে, পূজোর গন্ধ আসে যে তাই মায়ের গন্ধ হয়ে’। মায়ের উদ্দ্যেশ্যে দুফোটা চোখের জলে দর্পন দিই।
শরত্ এলেই মাতৃশক্তির পদধ্বনি অসিম ছন্দে বেজে উঠে, কল্পলোক-রুপলোক-ভাবালোক। আনন্দের ঝর্ণা ধারায় ধুইয়ে দেয় প্রকৃতির মলিনতা, মনের অন্ধকার হয় আলোকিত। আনন্দময়ীর আগমনে, আমরা মিলিত হই প্রাণের উতসবে। এই উত্সব নিজেরা আবার বাঙালি হওয়ার উত্সব। এই উত্সব ঘরের মেয়ে ঘরে ফিরে আসার।
এই উত্সব ‘সর্ব মঙ্গল মঙ্গল্যে’ সকলের মঙ্গলে অঞ্জলি দেওয়ার পূজা; নিজের জন্য নয়।
অথচ আজ অতিরিক্ত আড়ম্বরে সেজে উঠেন দুর্গতিনাশিনী। লাখ টাকার চালা বেঁধে, একে অন্যকে টপকে যাওয়ার ঘোরে, পাশের বাড়ির চাল বিহীন চালাটি আমাদের নজর কাড়ে না। ভারাক্রান্ত শরীর আর ক্লান্ত চোখে, ভেসে বেড়ানো ছেঁড়া -ছেঁড়া মেঘের মত দুঃশ্চিতার ভেলা, জীবনযুদ্ধে একলা পথ চলা পাড়ার সেলাই দিদিমণি; তাঁর চোখে কেমন দেখতে? শরতের আগমনী। প্যান্ডেলে-প্যান্ডেলে থিমের পূজায় কত স্পটলাইট, আছে হয়ত অনেক বার্তা; আমাদেরি অনাদরে ভাসান হয়েছে আন্তরিকতা।
ধরণীর বুকে রক্তবীজ থেকে আজো জন্ম নেয় হাজারো-লাখো রক্তাসুর। ঘরে-বাহিরে, বিদ্যাপিঠে, রাজনীতিতে, সমাজনীতিতে; দুর্যোধন-দুঃশাসনেরা দাপিয়ে বেড়ায়। আমার-আপনার ঘরের দুর্গাটি নিরাপদ নয় সাধু-সন্ত কিংবা আলেমের আস্তানায়। দায় আমাদের যাদের গর্জে উঠার, সব সয়ে যাই নিচু মাথায় আসলে সব সওয়া হয়ে যায়।
হারিয়ে গেছে আশ্বিনের নদী, কাঁশবন, ফুরিয়ে যাচ্ছে জল, হারিয়ে গেছে বিশুদ্ধ হাওয়া। মরিচীকার দামে বিকোয় ভালবাসা, ভূলতে বসেছি প্রতিবাদের ভাষা। বাড়ছে বৈশ্বিক উষ্ণতা আর জাত ধর্মের নামে অসুরেরা রক্তাক্ত করে চলছে মানবতা।
স্বর্গের অসুর পীড়িত দেবতা রক্ষণে যে রণদেবী আবির্ভূত হয়েছিলেন, তিনি নিত্য, তাঁর আদি নেই, তাঁর প্রাকৃত মুর্তি নেই, এই বিশ্বের প্রকাশেই তাঁর মূর্তি। তাঁর মহা তেজ চীর জাগরুক আগুন হয়ে কখনো-কখনো জ্বলে উঠে মাটির পৃথিবীর নারী শক্তির মধ্যে। সেই দূর্গাই দিল্লির মহিলা কমিশনার স্বাতি মালিয়ালা যে ধর্ষণের শাস্তি মৃত্যুদন্ড করিয়ে তবে অনশন ভাঙেন। সেই দূর্গাই অগ্নিলোচনা মেধা পাটেকার যে মনিপুরে নগ্ন মিছিলে হেঁটেছিল। সেই দুর্গা কন্যা সাহসিকা নুসরাত সময়ের শ্রেষ্ঠ প্রতিবাদ। ত্রিশূল হাতে স্বর্গের দুর্গাই মর্ত্যের আঁধার ছেঁড়া আলো অগ্নিবর্ণা গ্রেটা থুনবার্গ। যেন মোম হয়ে তারায় অমাবস্যার আঁধার; এঁকে দেয় লক্ষণরেখা। ‘পৃথিবী জেগে উঠছে, পরিবর্তন সমাগত, তুমি পছন্দ কর আর নাই কর’। এরাই ভবিষ্যতের আশাকে বাঁচিয়ে রেখেছে।
দুষ্টের দমন আর শিষ্টের পালনে সেই দুর্গাই আবির্ভুত হোন আশ্বিনের ঊষালগ্নে। “হে মহাদেবী, তোমার উদ্বোধনে বাণীর ভক্তিরসপূর্ণ বরণ কোমল আলোক শতদল মেলে বিকশিত হোক দিক-দিগন্তে; হে অমৃতজ্যোতি, হে মা দুর্গা, তোমার আবির্ভাবে ধরনী হোক প্রাণময়ী”। দেশে-প্রবাসে মন্দিরে-মন্দিরে প্রতিমার ধ্যানবোধিতায়, প্রতিটি’মায় প্রার্থনা থাক। আমাদের ভক্তি-শক্তি-বিবেক জাগ্রত হউক।
হিমাদ্রী রয় সঞ্জীব, সাংস্কৃতিক কর্মী, টরন্টো, কানাডা।