সোনা কান্তি বড়ুয়া : ‘আত্মবত সর্বভূতেষু’, কি কেবল ব্রাহ্মণ্যবাদী হিন্দুরাজনীতির পুঁথিতে থাকবে না কি? মানুষের সকল মৌলিক অধিকার পরিপস্থী এবং মানবতা বিরোধী এক কালো আইনের নাম ব্রাহ্মণ্যবাদী হিন্দুরাজনীতির জাতিভেদ প্রথা! হিন্দুরাজনীতির জাতিভেদ প্রথায় প্রাচীন বৌদ্ধ হত্যাযজ্ঞের ইতিহাস! তুমি ব্রাহ্মণ যে মানব, অখন্ড মানব জাতি সেই মানব! বাংলাদেশে বৌদ্ধ পাল সাম্রাজ্য মধ্যযুগীয় “উত্তর ভারত” এর সবচেয়ে শক্তিশালী এবং গুরুত্বপূর্ণ সাম্রাজ্য হিসেবে বিবেচনা করা হয়, যা ৭৫০-১১৭৪ আইএসভি পর্যন্ত FOUR HUNDRED YEARS স্থায়ী ছিল। পাল রাজাও এর সময় বৌদ্ধধর্ম ব্যাপকভাবে পৃষ্ঠপোষকতা ছিল। পাল রাজো বৌদ্ধধর্মের উন্নয়নের জন্য অনেক কাজ করেছেন, যা ইতিহাসে লিপিবদ্ধ করা হয়েছে। পাল ক্ষত্রিয় রাজবংশ ভারতের পূর্বাঞ্চলে একটি বিশাল সাম্রাজ্য গড়ে। বাস্তু শিল্প এই রাজ্যে ব্যাপকভাবে উন্নীত হয়। পাল রাজাদের আমলে বৌদ্ধধর্ম ব্যাপকভাবে উন্নীত হয়।

বর্তমানে ভারতে সম্রাট অশোকের ঐতিহাসিক বুদ্ধ বন্দনা বৌদ্ধ ঐতিহ্য ধর্মচক্র (অশোক চক্র) নিয়ে স্বাধীন ভারতের জাতীয় পতাকা এবং জাতীয় স্মারক সনদ (এম্বলেম) পরম পূজনীয় গৌতমবুদ্ধের দর্শন (প্রতীত্যসমূত্পাদ বা সমগ্র কার্যকারণ প্রবাহ) বিরাজমান! ব্রাহ্মণ না হয়ে জন্ম গ্রহণ করা কি অপরাধ? কারণ বাংলার বৌদ্ধ পাল রাজত্বকে হিন্দুরাজনীতি এবং কর্ণাটকের হিন্দু রাজা বিজয় সেন ১১৩৬ সালে উদ্দেশ্য প্রণোদিতভাবে ধ্বংস করে হিন্দু ধর্মের জাতিভেদ প্রথা প্রতিষ্ঠা করা হল। ব্রাহ্মণ্ পুরোহিত ও হিন্দু রাজ শক্তি মানবাধিকার ধ্বংস করতে দিনের পরদিন বৌদ্ধহত্যা যজ্ঞ হুলিয়া জারি করলো। হিন্দু রাজনীতি এবং ব্রাহ্মণ্য ধর্মের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ‘বৌদ্ধ মুক্তিযুদ্ধে চর্যাপদের উত্পত্তি! প্রসঙ্গত: হিন্দু শাসক শশাঙ্ক, আদি শঙ্করাচার্য্য এবং কুমারিল ভট্ট ফতোয়া দিলেন, বৌদ্ধ মাত্রই বধ্য বা বৌদ্ধদেরকে হত্যা কর (পৃষ্ঠা ১২, দেশ, কলিকাতা, ৪ মে, ২০০১)।” ভারতে বৌদ্ধদের সমাধির উপরে হিন্দুস্থান প্রতিষ্ঠিত হল। বর্তমানে ভারতে ব্রাহ্মণ নিয়ন্ত্রিত সমাজে প্রতিটি POLITICAL দলই ব্রাহ্মণ্যবাদীদের হাতে তৈরি এবং পরিচালিত।

বৌদ্ধরা কিভাবে নমঃশূদ্র হলো? ব্রাহ্মণ্যধর্মী বল্লাল সেন যখন বাংলার রাজা হলো, তখন সে বৌদ্ধধর্মীদের হিন্দুধর্ম গ্রহণ করতে হুলিয়া জারি করলো। বৌদ্ধরা তা মানলো না। শুরু হলো রাষ্ট্রশক্তির বলপ্রয়োগ ও অত্যাচার। অকথিত অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে, বৌদ্ধরা জলে জঙ্গলে (পূর্ববঙ্গে) পালালো। বল্লাল সেনাবাহিনীকে হুকুম দিল, ওদের পিছনে ধাওয়া করে হত্যা করো। (গুরুচাঁদচরিত ষষ্ঠ সংস্করণের ২৩৮ ও ২৩৯ পৃষ্ঠা দেখুন)।

একজন মন্ত্রী পরামর্শ দিল, প্রাণভয়ে পলাতকদের হত্যা করা রাজার উচিত কাজ নয়।
রাজা তখন জিজ্ঞেস করলো, এদের কি পরিচয় হবে? মন্ত্রী বললো, হিন্দু রাজত্বে এরা সর্বনিম্ন শূদ্র বর্ণের অন্তর্ভুক্ত হোক। তবে এরা লোক খারাপ না। তাই নমঃশূদ্র হোক। বল্লাল মেনে নিল।

কিন্তু ব্রাহ্মণের তাতে পোষালো না। তারা বেজায় চটে গেল। রাজার কাছে তারা দরবার করে সিদ্ধান্ত দিল, রাজধানী গঞ্জ থেকে যারা দূরে বসবাসের অযোগ্য স্থানে বাস করে, তাদের চণ্ডাল বলে। ওদের চণ্ডাল নাম যথাযথ। ব্রাহ্মণের মুখের কথাই শাস্ত্র ও অনুশাসন। তাঁর বিধানে ভুল ধরলেই মুণ্ডু নেবে। সুতরাং চণ্ডালই পাকা হলো।

সেই থেকে বৌদ্ধরা চণ্ডাল পরিচয়ে পরিচিত হলো। ঘৃণ্য অস্পৃশ্য জাতিরূপে সরকারি খাতায় পরিচিত হলো। গুরুচাঁদ ঠাকুর ১৯১১ সালে তাদের নমঃশূদ্র বানালেন, কিন্তু তাদের মূল পরিচয় বৌদ্ধ বানাতে পারলেন না। বাবা সাহেব ডঃ আম্বেদকরও একই সিদ্ধান্ত দিয়েছেন, “যে বৌদ্ধরা হিন্দু হতে অস্বীকার করলো, ব্রাহ্মণরা তাদের অস্পৃশ্য রূপে সরকারি খাতায় পরিচয় লিখলো।”

গুরুচাঁদ ঠাকুর বল্লালের মন্ত্রী প্রদত্ত নমঃশূদ্র পরিচয় বহাল করলেন, তাদের মূল পরিচয় দিতে পারেননি। কিন্তু গুরুচাঁদ চরিতে বারে বারে বহু জায়গায় তিনি আমাদের এই সত্যের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন যে নমঃশূদ্ররা বৌদ্ধ ছিল। পূর্ব পরিচয় প্রকাশ করতে তিনি ভয় পাননি।

গুরুচাঁদ ঠাকুর বার বার আমাদের পূর্ব পরিচয় স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন, এর তাত্পর্য কি বোঝেন, প্রিয় স্বজাতি আত্মীয় জ্ঞাতি বান্ধবগণ? আমি বুঝি, গুরুচাঁদ ঠাকুরের পক্ষে যতটা সম্ভব, ততটা তিনি করে গেছেন, বাকী কাজ তার শিক্ষা আন্দোলনে শিক্ষিত সমাজকে করতে হবে। বাবা সাহেব ডঃ আম্বেদকর গুরুচাঁদ ঠাকুরের ইতিহাস আলোচনার তাত্পর্য বুঝে সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়ে স্বধর্মে প্রত্যাবর্তন করেছেন। আমরা কি করবো? জয়জয় হরিচাঁদ, জয়জয় গুরুচাঁদ, জয়জয় ভীম, জয়জয় মহাপ্রাণ যোগেন্দ্রনাথ। গুরুচাঁদ ঠাকুর চন্ডালদের নমঃশূদ্র পরিচয় দিলেন অথচ বৌদ্ধ পরিচয় দিলেন না কেন? কী বাঁধা ছিল? নমঃশূদ্ররা বৌদ্ধ ছিল গুরুচাঁদ চরিত্র গ্রন্থের এই বক্তব্যের স্বপক্ষে ঐতিহাসিক তথ্য-প্রমাণ দিন।

স্বামী বিবেকানন্দ বলেন, “হিঁদুর ধর্ম বেদে নাই, পুরাণে নাই, ভক্তিতে নাই, মুক্তিতে নাই- ধর্ম ঢুকেছে ভাতের হাঁড়িতে। হিঁদুর ধর্ম বিচারমার্গেও নয়, জ্ঞানমার্গেও নয়- ছুঁতমার্গে; আমায় ছুঁয়ো না, আমায় ছুঁয়ো না, ব্যস্। এই ঘোর বামাচার ছুঁতমার্গে পড়ে প্রাণ খুইও না। ‘আত্মবত সর্বভূতেষু’, কি কেবল পুঁথিতে থাকবে না কি? যারা এক টুকরো রুটি গরীবের মুখে দিতে পারে না, তারা আবার মুক্তি কি দেবে? যারা অপরের নিঃশ্বাসে অপবিত্র হয়ে যায়, তারা আবার অপরকে কি পবিত্র করবে?” লেখক জয়ন্ত ঘোষালের লেখা “উচ্চবর্ণ আর দলিতে সংঘাতে হিন্দুত্ববাদীরা বেসামাল” শীর্ষক প্রবন্ধে বিরাজমান “একশোটা স্বামী বিবেকানন্দ আবির্ভূত হলেও চণ্ডাল ভারতবাসী চণ্ডাল হয়েই থাকবে (আনন্দবাজার পত্রিকায় (১৬ অগষ্ট ২০১৬)!”

হিন্দু বর্ণাশ্রম ও জাতিভেদ প্রথা বিরোধী সাহিত্য সম্রাট বঙ্কিম চন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ব্রাহ্মণদের কুসংস্কারের বিরুদ্ধে ‘সাম্যবাদ’ নামক বই লিখেছিলেন, “বর্ণ বৈষম্য মিথ্যা। যাগযজ্ঞ মিথ্যা। বেদ মিথ্যা, সূত্র মিথ্যা, ঐহিক সুখ মিথ্যা, কে রাজা, কে প্রজা, সব মিথ্যা। ধর্মই সত্য। মিথ্যা ত্যাগ করিয়া সকলেই সত্যধর্ম পালন কর এবং ঘোষণা করলেন, “তখন বিশুদ্ধাত্মা শাক্যসিংহ (গৌতমবুদ্ধ) অনন্তকালস্থায়ী মহিমা বিস্তার পূর্বক, ভারতাকাশে উদিত হইয়া, দিগন্ত প্রসারিত রূপে বলিলেন, “আমি উদ্ধার করিব। আমি তোমাদেরকে উদ্ধারের বীজমন্ত্র দিতেছি, তোমরা সেই মন্ত্র সাধন কর। তোমরা সবাই সমান। ব্রাহ্মণ শুদ্র সমান। মনুষ্যে মনুষ্যে সকলেই সমান। সকলেই পাপী, সকলের উদ্ধার সদাচরণে।” (বঙ্কিম রচনাবলী, ২য় খন্ড, পৃষ্ঠা ৩৮২ থেকে ৩৮৩, সাহিত্য সংসদ প্রকাশিত, কলকাতা)।”

বর্তমানে হিন্দু বলে যে, যে জাতিরা ইচ্ছা অনিচ্ছায় লিখে চলেছেন – তাদের (জাতিগুলিকে) ৬টি তপশিল বা ঝপযবফঁষব এ ভাগ করা হয়। জনগণনার শ্রেণী বিন্যাসের দায়িত্ব ব্রিটিশ সরকার দিয়েছিলেন হিন্দুদের। যেহেতু, ব্রিটিশরা ভারতের সনাতন ধর্মীয় ও হিন্দুধর্মীয় জাতিসমূহের সম্পর্কে আদ্যোপান্ত ধারণা ছিল না বলে।

১৯৩১ সালে জনগণনার রিপোর্ট এ ভারতের এবং অখন্ড বাংলায় ৬টি তপশিল বা 6th schedule – নিম্ন রূপ :– ১) 1st = ব্রাহ্মণ, ২) 2nd = ক্ষত্রিয়, ৩) 3rd = বৈশ্য, ৪) 4th = শুদ্র। ৫) 5th = অর্ধ হিন্দু অবদমিত ৩৯টি জাতি, বর্তমানে ৬০টি জাতি, ৬)। 6th = অর্ধ হিন্দু আদিবাসী ৪০টি জনজাতি। উপরের ৪টি তপশিল বা schedule ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য, শুদ্র নিয়ে হিন্দুর তপশিল বা schedule নিয়ে হিন্দুধর্মের তালিকা সম্পূর্ণ হয়। (১৯৩১ সাল।) হিন্দুর তালিকা থেকে 5th এবং 6th schedule’ এর জাতি এবং জনজাতি গুলি হিন্দুধর্মের বাইরে রাখা হয়।

সম্রাট অশোক ব্রাহ্মণ শাসিত সংস্কৃত ভাষা বাদ দিয়ে বৌদ্ধ ত্রিপিটক পালি ভাষায় প্রকাশনা প্রচার ও প্রসার করার দায়িত্ব গ্রহণ করেছিলেন। অহিংসা পরম ধর্ম ও ব্রাহ্মণ্যবাদীদের জাতিভেদ প্রথা প্রসঙ্গ! বৌদ্ধরা কিভাবে নমঃশূদ্র হলো? ব্রাহ্মণ্যধর্মী বল্লাল সেন যখন বাংলার রাজা হলো, তখন সে বৌদ্ধধর্মীদের হিন্দুধর্ম গ্রহণ করতে হুলিয়া জারি করলো। বৌদ্ধরা তা মানলো না। শুরু হলো রাষ্ট্রশক্তির বলপ্রয়োগ ও অত্যাচার। অকথিত অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে, বৌদ্ধরা জলে জঙ্গলে (পূর্ববঙ্গে) পালালো। বল্লাল সেনাবাহিনীকে হুকুম দিল, ওদের পিছনে ধাওয়া করে হত্যা করো। (গুরুচাঁদ চরিত, ষষ্ঠ সংস্করণের ২৩৮ ও ২৩৯ পৃষ্ঠা দেখুন)!

সম্রাট অশোক বৈদিক প্রাণী হত্যা মূলক যজ্ঞ এবং জাতিভেদ প্রথা আইন করে বন্ধ করে দিয়ে বৌদ্ধধর্ম গ্রহণ করেছিলেন। মানবাধিকার এবং আইনের শাসন অগ্রাহ্য করে বৈদিক পন্থী হিন্দুরাজনীতির ভারত সরকার “বুদ্ধগয়া টেম্পল অ্যাক্ট ১৯৪৯” শীর্ষক বেআইনি হিন্দুমার্কা সনদ রচনা করে ২০১২ সালের ভারতের সুপ্রীম কোর্টের রায় নাকচ করেছে। মানুষের মনুষ্যত্ব কেড়ে নেওয়াটাই হিন্দু রাজনীতির হিন্দু ধর্ম!

হিন্দু সমাজে একসময় এক ধরণের রীতি প্রচলিত ছিল। এই প্রথা অনুসারে বিয়ের পর স্ত্রীর সাথে সহবাস করার আগেই গুরুদেবের কাছে নিজের স্ত্রীকে নিবেদন করতে হত। গুরুর খাওয়া হয়ে গেলে তার প্রসাদ পেতেন শিষ্য, তাই এই প্রথার নাম হল গুরুপ্রসাদী। কালরাত্রির ইতিহাস… যেটাকে এখন বেহুলা-লখিন্দরের নাম দিয়ে ধর্মীয় সংস্কৃতিভাবে চালানো হয়! গুরুপ্রসাদী প্রথাঃ হিন্দুসমাজে নববধূ যখন গুরুদেবের প্রসাদ! ঊনবিংশ শতাব্দীতে লেখা কালিপ্রসন্ন সিংহের ‘হুতুম প্যাঁচার নক্সা’ বইয়ের ৬০ পৃষ্ঠার পর থেকে এই প্রথার মোটামুটি ভালো বিবরণ মেলে। কালিপ্রসন্ন তার বইয়ে গুরুপ্রসাদী প্রথার এরকম বিবরণ দিয়েছেন: পূর্বে মেদিনীপুর অঞ্চলে বৈষ্ণবতন্ত্রের গুরুপ্রসাদী প্রথা প্রচলিত ছিল। নতুন বিয়ে হলে গুরুসেবা না করে স্বামী সহবাস করবার অনুমতি ছিল না।

কথাশিল্পী শওকত আলীর লেখা “প্রদোষে প্রাকৃতজন” এবং “দুষ্কালের দিবানিশি” গ্রন্থদ্বয়ে দক্ষিণ এশিয়ার হিন্দু মুসলমান শাসকগণ কর্তৃক বৌদ্ধ হত্যাযজ্ঞের রক্তাক্ত ইতিহাস লিপিবদ্ধ করেছেন। ২৩০০ বছর পূর্বে প্রাচীন বৌদ্ধ যুগে সম্রাট অশোকের মৃত্যুর পর ব্রাহ্মণ রাজা পুষ্যমিত্র (খৃষ্ট পূর্ব ১ম শতাব্দী)সহ চক্রান্তকারীরা বিভিন্ন ব্রাহ্মণ্যবাদী জঙ্গীদের সাথে ক‚টনীতি করে উপমহাদেশে বৌদ্ধধর্ম এবং রাশি রাশি বৌদ্ধ মন্দির ধ্বংস করলো। আনন্দবাজার পত্রিকার (সম্পাদকীয়, ২২ আগষ্ট, ১৯৯৩) মতে, … সেই উগ্র হিন্দুত্ববাদীরা কেমন করিয়া ভুলিয়া গেলেন যে, একদা রাশি রাশি বৌদ্ধ ধর্মস্থান ধ্বংস করিয়া একদিন গড়িয়া উঠিয়াছিল রাশি রাশি হিন্দু মন্দির। তাঁহারা কি জানেন, হিন্দুর কাছে অতি পবিত্র পুরীর মন্দিরের প্রাক্ ইতিহাস সম্পর্কে কানিংহাম কিংবা রাজেন্দ্রলাল মিত্রের কী অভিমত? তাই বলিতেছিলাম, অযোধ্যা একটি বৃহত প্রশ্ন বটে, কিন্তু নিতান্তই মনগড়া এক নির্বোধ প্রশ্ন।”

গৌতমবুদ্ধের অহিংস নীতিতে দীক্ষা নিয়ে সম্রাট অশোকের মানবাধিকারের ঘোষণা ছিল “অহিংসা পরম ধর্ম” শিলালিপিতে লিপিবদ্ধ করেছিলেন। বিশ্বকবি রবীন্দ্র নাথ ঠাকুরের ভাষায়, “জগতের মধ্যে শ্রেষ্ট সম্রাট অশোক আপনার যে কথাগুলিকে চিরকালের শ্রুতিগোচর করিতে চাহিয়া ছিলেন, তাহাদিগকে পাহাড়ের গায়ে খুদিয়া দিয়াছিলেন। ভাবিয়া ছিলেন, পাহাড় কোনকালে মরিবে না, সরিবে না, অনন্তকালের পথের ধারে অচল হইয়া দাঁড়াইয়া নব নব যুগের পথিকদের কাছে এক কথা প্রতিদিন ধরিয়া আবৃত্তি করিতেই থাকিবে। পাহাড়কে তিনি কথা কইবার ভার দিয়াছিলেন। তোমার কীর্তির চেযে তুমি যে মহৎ, / তাই তব জীবনের রথ,/ পশ্চাতে ফেলিয়া যায় কীর্তিরে তোমারে,/ বারম্বার। / তাই চিহ্ন তব পড়ে আছে,/ তুমি হেথা নাই।”

ব্রাহ্মণ্যবাদের ভারতীয় রাজনীতি যে রাজ্যে ব্রাহ্মণ্যবাদী POLITICAL দল BJP সরকার চালাচ্ছে সেই রাজ্যে রাজ্যসভায় সংরক্ষণের কোটায় শুধু উঁচুজাতের প্রার্থীরাই নির্বাচিত হচ্ছেন।

রাজ্য সভায় ব্রাহ্মণদের সংরক্ষণ! ভারতীয় রাজনীতিতে কেন্দ্রীয় স্তরে রয়েছে দুটি কক্ষ… উচ্চকক্ষ ও নিম্নকক্ষ।

রাজ্য সভা হল উচ্চ কক্ষ এবং লোকসভা হল নিম্ন কক্ষ। এছাড়া রাজ্যস্তরে রয়েছে বিধানসভা। লোকসভা ও রাজ্যসভার প্রতিনিধিদের সাংসদ (MP) বলা হয়। বিধানসভার প্রতিনিধিদের বলা হয় বিধায়ক (MLA)।

লোকসভা ও বিধানসভার প্রতিনিধিরা সরাসরি জনগণের ভোটে নির্বাচিত হন। রাজ্যসভার প্রার্থীরা নির্বাচিত হন রাজ্যের বিধায়কদের ভোটে। সংবিধানে কেন্দ্রীয় লোকসভা ও রাজ্যের বিধানসভায় তফশিলি সংরক্ষণ রয়েছে কিন্তু কেন্দ্রীয় রাজ্যসভায় তফসিলি সংরক্ষণ নেই। ফলে, লোকসভা বা বিধানসভায় তফসিলি প্রার্থীরা নির্বাচিত হলেও রাজ্যসভার ভোটে তফসিলিদের টিকিট দেওয়া হয় না।

ভারতে লোকসভার মোট আসন ৫৪৩ । এর মধ্যে ১২০টি আসন SC-ST দের জন্য সংরিক্ষত। পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভায় মোট আসন ২৯৪। এর মধ্যে ৮৪টি আসন SC-ST দের জন্য সংরিক্ষত।

কিন্তু কেন্দ্রীয় রাজ্যসভায় মোট আসন ২৫০। এর মধ্যে পশ্চিমবঙ্গ থেকে ১৬ জন নির্বাচিত করা হয় রাজ্যসভার জন্য। এখানে রয়েছে শুধু ব্রাহ্মণদের সংরক্ষণ। ১৯৪৭ থেকে এ পর্যন্ত পশ্চিমবঙ্গে সরকার চালাচ্ছে কংগ্রেস, বামফ্রন্ট এবং তৃণমূল কংগ্রেস। প্রতিটি দলই ব্রাহ্মণ্যবাদীদের হাতে তৈরি এবং পরিচালিত। রাজ্যসভায় তফসিলি সংরক্ষণ না থাকার জন্য এই দলগুলো ভুলেও কোন তফসিলি ব্যক্তিকে রাজ্যসভায় দাঁড় করায় না। অথচ, পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভায় ৮৪ জন তফসিলি বিধায়ক আছেন।

প্রথমত এঁরা ব্রাহ্মণ্যবাদী ডান-বাম দলের টিকিটে বিজয়ী বিধায়ক, দ্বিতীয়ত ডান-বাম বিভিন্ন দলেও বিভক্ত। এঁরা ঐক্যবদ্ধ ও স্বাধীন হতে পারলে অবশ্যই দু একজন তফসিলি ব্যক্তিকে সাংসদ হিসাবে রাজ্যসভায় পাঠাতে পারতেন। কিন্তু ডান-বাম দলের SC-ST বিধায়করা ব্রাহ্মণ্যবাদী উচ্চতম নেতাদের গোলাম, ভৃত্য ও চামচা। এঁরা শিরদাঁড়াহীন অমেরুদণ্ডী এককোষী প্রাণীবিশেষ। (প্রচারে — মলয় মূলনিবাসী সংগ্রহ — ব্রাহ্মণদের সংরক্ষণ লেখক— দিলীপ গায়েন )১

ব্রাহ্মণ নিয়ন্ত্রিত সমাজে মানবাধিকার রক্ষা ও প্রচার করার মানসে বৌদ্ধধর্মের প্রয়োজন আজও বিরাজমান। এই ঐতিহাসিক রক্তাক্ত প্রান্তরের স্বাক্ষী বাংলা বাঙালি জাতির আত্মপরিচয়ে চর্যাপদ প্রসঙ্গ: বৌদ্ধগণ বন্দী আজ হিন্দুত্বের ঘৃণার অগ্নিগিরিতে!/ফেলে আসা বৌদ্ধ শ্মশান ও হাজার বছরের কবর খুঁড়তে।/ তুমি হিন্দূ মৌলবাদী, বুদ্ধগয়ার মহাবোধি ছাড়ো। / তুমি আমার বুদ্ধগয়ার জলে স্থলের /সীমানা থেকো নামো/ হাতেই নিলেম আমার মহাবোধি মন্দিরের নির্ভরতার চাবি /তুমি হিন্দু রাজনীতি, সরাও তোমার ছায়া, / তুমি বুদ্ধগয়ার মহাবোধি ছাড়ো। /হাজার বছর আগে হরিসেনের বৌদ্ধ হত্যাযজ্ঞের কথা /বল্লালসেনের মহামন্ত্রী হলায়ুধ মিশ্রের নাম ও আছে গাঁথা। গৌতমবুদ্ধকে ধর্মের জগন্নাথ বুদ্ধ পুরাণ শীর্ষক তিন হাজার পৃষ্ঠার বই লিখে উড়িষ্যায় রথ যাত্রা এবং পুরীর বৌদ্ধমন্দিরকে জগন্নাথ মন্দির নাম বদলিয়ে দখল করেছে।

অমর্ত্য সেনের লেখাতে পড়ি ( বিজেপি শাষণে প্রবর্তিত এই সূত্র নির্দেশগুলি অবশেষে ২০০৪ সালের মে মাসে বন্ধ হয়), “হিন্দুত্ববাদী তত্তে¡ অনেক কিছুই নির্রভ করে বেদ এর সৃষ্টি তত্তে¡র উপর। বিশেষ করে এই প্রশ্নগুলিঃ বেদের রচয়িতা কে? এগুলি কি সিন্ধু সভ্যতার পরবর্তীকালে রচিত হয়েছিল? বৈদিক বিজ্ঞান ও গনিত কত প্রাচীন? সুতরাং হিন্দুত্ববাদীরা ভারতীয় ইতিহাসকে এমনভাবে পুনর্লিখিত করার চেষ্টা করলেন যাতে এই সমস্যাগুলিকে একইসঙ্গে অতিক্রম করা যায়। যে সংস্কৃত ভাষী লোকেরা বেদ রচনা করেছিলেন আর যাঁরা সিন্ধু সভ্যতা নির্মাণ করেছিলেন তাঁদের হিন্দুত্ববাদীরা একই লোক বলে চালিয়ে দিলেন।

বলাবাহুল্য, এই ইতিহাসের প্রধান সমস্যা এই যে এটা পুরাপুরি মিথ্যার উপর প্রতিষ্ঠিত, সাহিত্য ও প্রত্নতত্তে¡র উপর নির্ভর করে যা কিছু সাক্ষপ্রমান পাওয়া গেছে এটা সেসব কিছুর বিরুদ্ধে। এই সমস্যা অতিক্রম করার জন্য ‘নতুন’ প্রত্নতাত্ত্বিক সাক্ষ্যপ্রমাণের খোঁজ পড়ল। এটা করা হল বা করা হল বলে দাবি করা হল, নটবর ঝাঁ ও এন এম রাজারাম রচিত বহু প্রচারিত “সিন্ধু লিপির পাঠোদ্ধার” বইতে। বইটি ২০০০ সালে প্রকাশিত হয়। লেখকরা দাবি করলেন যে তাঁরা আজ পর্যন্ত পাঠোদ্ধার না হওয়া সিন্ধু লিপির পাঠোদ্ধার করেছেন। এবং এই সভ্যতাকে খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ সহস্রাব্দের মাঝামাঝি সময়ের বলে নির্নয় করলেন। এইভাবে “ইতিহাসকে” একতরফা আরও প্রায় এক হাজার বছর পেছনে ঠেলে দিলেন। তাঁরা বললেন সিন্ধু লিপিগুলোতে ঋক বেদের সরস্বতী নদীর উল্লেখ আছে। তা ছাড়া তাঁরা এক পোড়ামাটির শিলমোহরের ছবি দেখালেন যাতে ঘোড়ার ছবি অঙ্কিত রয়েছে। এতে সিন্ধুসভ্যতার বৈদিক এবং আর্য চরিত্রের আরও প্রমাণ পাওয়া গেল। বেদে ঘোড়ার বহু উল্লেখ রয়েছে, কিন্তু সিন্ধু সভ্যতার ধ্বংসাবশেষে এ যাবত প্রচুর ষাঁড়ের চিহ্ন পাওয়া গেলেও ঘোড়ার চিহ্ন পাওয়া যায়নি। এই আবিষ্কার ও পাঠোদ্ধারের দাবিটি বিরাট বিতর্কের জন্ম দেয়। দেখা যায় যে প্রকৃতপক্ষে কোনও পাঠোদ্ধারই করা হয়নি। এবং তথাকথিত ঘোড়ার শিলমোহরটি ছিল সরাসরি জালিয়াতি।

একশৃঙ্গ ষাঁড়ের ভাঙা শিলমোহরের ছবি থেকে কম্প্যুটারের মাধ্যমে এটা বানানো হয়েছিল। দাবি করা ঘোড়ার মোহরটি বিংশ শতাব্দীর শেষে তৈরি এবং এরজন্য অবশ্যই হিন্দু আন্দোলনের আন্দোলনকারীরা কৃতিত্ব দাবি করতে পারেন। জালিয়াতিটা দেখিয়ে দেন হাভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মাইকেল উইজেল- স্টিভ ফার্মার এর সঙ্গে লেখা তাঁর এক যৌথ প্রবন্ধ। জালিয়াতিটা ফাঁস হয়ে যাওয়ার পরেও এন.সি.ই.এর.টি স্কুলের পাঠ্যবই থেকে ‘পোড়ামাটির ঘোড়া’ ও সিন্ধু সরস্বতী সভ্যতাকে বাদ দেয়নি। (অমর্ত্য সেন reported বিঃদ্রঃ — লেখাটি ছোট করার জন্য একটি অনুচ্ছেদ এবং বন্ধনীর ভেতরের লেখাগুলো বাদ দেওয়া হয়েছে। সাথে এটাও জানিয়ে রাখি “তর্কপ্রিয় ভারতীয়” বইটি প্রকাশের পর বহু সপ্তাহ ধরে বেস্টসেলার-এর প্রথম স্থানে নাম ছিলো। তাই আশা করছি বহু সংখ্যক পাঠকের নিকট বইটি থাকবে)।

হিন্দুধর্ম তথা হিন্দু-সংস্কৃতির কেন্দ্রে আছে ব্রাহ্মণ্যবাদী বৈদিক-সংস্কৃতি। আদিতে বৈদিক সংস্কৃতির ঔরসে জন্ম বর্ণাশ্রম আইন। সবার উপরে ব্রাহ্মণ বর্ণ। রয়েছে -যজ্ঞ-পুজো-উপাসনা-মন্ত্র-স্বর্গ-পরজন্ম ইত্যাদি তত্ত¡। রয়েছে শ্রমিক ও নারী জাতির প্রতি বিমাতৃসুলভ আচরণ তথা অস্পৃশ্যতা।

বর্ণাশ্রম কিন্তু নিছক প্রথা ছিল না। এটাই ছিল রাষ্ট্রীয় আইন (Law)। বর্ণাশ্রম ব্যবস্থাকে প্রথা না বলে আইন বলাই উচিত। বর্তমান হিন্দু ধর্মেও সেই বর্ণাশ্রম-আইন বেসড বৈদিক সংস্কৃতি চলছে। এ হেন সংস্কৃতি বা ধর্মের মধ্যে তফসিলি তথা এসসি-এসটি-ওবিসি এবং নারী জাতিকে বলা হয় শূদ্র বা নিচু বর্ণ। এমন কি কায়স্থ-বৈদ্য জাতিকেও শূদ্র বলা হয়। এরাও ব্রাহ্মণ বা আর্য তকমা পায় না। স্বামী বিবেকানন্দ তথা নরেন্দ্রনাথ দত্ত তো ব্রাহ্মণ তকমা পাননি। তিনিও শূদ্র হয়ে রয়েছেন। এই হল হিন্দু ধর্ম।

ভারতের তফসিলি সমাজকে ভাবতে হবে এই বৈদিক বা হিন্দু সংস্কৃতি কি তফসিলিদের ক্ষেত্রে সম্মানজনক? হিন্দুত্ববাদী ধর্ম ও রাজনীতি কি তফসিলিদের ক্ষেত্রে স্বাধীনতা মূলক? তফসিলি সমাজের শিক্ষিত মানুষদের এটা ভাবতে হবে। গোলামী করা ভালো না স্বাধীনতা ভালো?

মুসলিমদের বিরোধিতা করবার জন্য বৈদিক বা হিন্দু সংস্কৃতির অধীনে থেকে ব্রাহ্মণ ও ব্রাহ্মণ্যবাদের অধীনতা মেনে নিতে হবে,এটা তো খেলো যুক্তি। দুঃখের বিষয় তফসিলি সমাজের উচ্চ শিক্ষিত মানুষেরাও খেলো যুক্তি দেখিয়ে ব্রাহ্মণের গোলাম হয়ে আছেন। অথচ গোলামী করছেন কিনা বুঝতে পারেন না।

বাবা সাহেব Dr Ambedkar কিন্তু শুধু সংরক্ষণের কোটার আন্দোলন করেননি। করেছেন ভোট বা রাজনৈতিক অধিকার অর্জনের আন্দোলন ও গোলামী দশা থেকে মুক্তির জন্য বৌদ্ধ সংস্কৃতির পুনর্জাগরণ আন্দোলন। দুঃখের কথা তফসিলি সমাজের ৯৯.৯৯% শিক্ষিত লোক সংরক্ষণের কোটা নিয়ে মেতে আছেন আর ব্রাহ্মণের গোলামী করছেন। বিশ্বকবির ভাষায়:
“অহমিকা বন্দীশালা হতে। ভগবান তুমি!

নির্দ্দয় এ লোকালয়, এ ক্ষেত্র তব জন্মভূমি।
ভরসা হারালো যারা, যাহাদের ভেঙেছে বিশ্বাস
তোমারি করুনা বিত্তে ভরুক তাদের সর্বনাশ ! “

বিশ্ববৌদ্ধ পুরস্কার প্রাপ্ত প্রখ্যাত মানবতাবাদী লেখক সোনা কান্তি বড়ুয়া (Bachelor of Arts, University of Toronto), সাবেক সভাপতি, বাংলা সাহিত্য পরিষদ, টরন্টো, খ্যাতিমান ঐতিহাসিক, কথাশিল্পী, বিবিধগ্রন্থ প্রনেতা প্রবাসী কলামিষ্ঠ, লাইব্রেরীয়ান, বিশ্ববৌদ্ধ সৌভ্রতৃত্ব পত্রিকার সহ সম্পাদক এবং জাতিসংঘে বিশ্ববৌদ্ধ প্রতিনিধি!