হাসান আমিন: গত ১ জুন, বৃহস্পতিবার ‘নেচার কেমিক্যাল বায়োলজি’ জার্নালে প্রকাশিত এক সংবাদে জানা যায়, কানাডার গবেষকরা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) ব্যবহার করে সুপারবাগের প্রাণঘাতী একটি প্রজাতিকে ধ্বংস করতে সক্ষম এমন অ্যান্টিবায়োটিক আবিষ্কার করেছেন। গবেষকরা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সাহায্যে হাজার হাজার সম্ভাব্য কার্যকর রাসায়নিক থেকে মুষ্টিমেয় কয়েকটিকে বেছে নেয় এবং সেগুলো পরীক্ষাগারে পরীক্ষা করে। পরীক্ষার ফলাফল ছিল খুবই কার্যকর। পরীক্ষামূলক অ্যান্টিবায়োটিকের নাম দেওয়া হয়েছে অ্যাবাউসিন। যদিও ব্যবহারের আগে সেটির আরো বেশকিছু পরীক্ষা নিরীক্ষার প্রয়োজন হবে।
গবেষকরা সবচেয়ে বেশি জটিলতা সৃষ্টিকারী ব্যাকটেরিয়ার প্রজাতি ‘অ্যাসিনেটোব্যাক্টর বাউমানি’ নিয়ে কাজ করেছেন। ব্যাকটেরিয়ার এই প্রজাতিটি ক্ষতস্থানে মারাত্মক সংক্রমণের সৃষ্টি করতে পারে এবং নিউমোনিয়ার সংক্রমণের জন্য দায়ী।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, বাউমানি প্রজাতি যেসব রোগীদের ভেন্টিলেটরের মতো ডিভাইসের প্রয়োজন হয় তাদের জন্য একটি গুরুতর হুমকি। গবেষণার নেতৃত্বে থাকা হ্যামিলটন এর ম্যাকমাস্টার ইউনিভার্সিটির সহকারী অধ্যাপক জোনাথন স্টোকস বলেন, “এটা সামলানোটা খুবই চ্যালেঞ্জিং। জোনাথন স্টোকস এই সুপারবাগটিকে ‘মানুষের এক নম্বর শত্রু’ হিসেবে বর্ণনা করেছেন। কারণ এটি ‘প্রায় প্রতিটি অ্যান্টিবায়োটিকের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারে।’ এমন একটি সুপারবাগের বিরুদ্ধে কাজ করে এমন একটি ওষুধ খুঁজে পাওয়া সত্যিই অসাধারণ একটি ঘটনা হবে। “যখন আমরা নতুন অ্যান্টিবায়োটিকের সন্ধান করতে যাই, তখন অপরিহার্যভাবে আমরা রাসায়নিক, অ্যান্টিবায়োটিকগুলো খুঁজতে শুরু করি যেগুলোর একেবারে নতুন কাঠামো এবং একেবারে নতুন কার্যকারিতা রয়েছে। আমাদের একটি মৌলিকভাবে নতুন চিকিৎসা বিকাশ করতে হবে,” তিনি দ্য কারেন্টস ম্যাট গ্যালোওয়েকে বলেন।
সাধারণত, এই রোগের বিরুদ্ধে কোনটি সবচেয়ে ভাল কাজ করে তা দেখতে কয়েক হাজার রাসায়নিক পরীক্ষা করা প্রয়োজন। স্টোকস বলেছেন “এটি উল্লেখযোগ্যভাবে শ্রমসাধ্য, সময়সাপেক্ষ এবং ব্যয়বহুল।”
এ কারণেই স্টোকস এবং গবেষণা দলের বাকি সদস্যরা, যার মধ্যে ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজির বিজ্ঞানীরা ছিলেন; সহায়তা পাওয়ার জন্য এআই-এর ওপর নির্ভর করেছিলেন। কানাডার এই গবেষকের মতে, নতুন ওষুধ আবিষ্কারের কাজকে ব্যাপকভাবে ত্বরান্বিত করার ক্ষমতা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা এআই-এর রয়েছে।
“আদর্শভাবে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার অ্যালগরিদমগুলো ব্যবহার করে তারা এই রাসায়নিকগুলোকে আরও দ্রুত দেখতে পারে এবং খুব দ্রুত রাসায়নিকের বিস্তৃত শ্রেণিবিন্যাসের আলোকে তারা আমাদের পরীক্ষাগারে কোন পরীক্ষাগুলো চালানো যেতে পারে তার অগ্রাধিকার প্রদানে সাহায্য করতে পারে,” বলেন স্টোকস।
স্টোকস এবং তার দল গত ১ জুন, বৃহস্পতিবার নেচার কেমিক্যাল বায়োলজি জার্নালে তাদের ফলাফল প্রকাশ করেছেন। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা কীভাবে বিজ্ঞান এবং চিকিৎসা বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে একটি যুগান্তকারী শক্তি হতে পারে তার সর্বশেষ উদাহরণ এই গবেষণা।
সুপারবাগ প্রতিরোধ:
অ্যান্টিবায়োটিক ব্যাকটেরিয়া ধ্বংস করে। যদিও কয়েক দশক ধরে নতুন ওষুধের অভাবে ব্যাকটেরিয়ার বিরুদ্ধে চিকিৎসা কঠিন হয়ে উঠছে। কারণ সেগুলো মানুষের হাতে থাকা ওষুধের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে।
বিশ্বে প্রতিবছর গড়ে ১০ লাখের বেশি মানুষ এমন সব ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণে মারা যায় যেগুলো অ্যান্টিবায়োটিক দিয়ে চিকিৎসার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে। ব্যাকটেরিয়ার এই প্রজাতিটির নাম অবশ্য খুব বেশি মানুষের জানা নেই। কিন্তু বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা যে তিনটি সুপারবাগকে ‘মারাত্মক হুমকি’ বলে বর্ণনা করেছে এটি তার একটি।
এই ব্যাকটেরিয়াটি প্রায় সময়ই একাধিক অ্যান্টিবায়োটিকের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারে। বিশেষ করে হাসপাতাল এবং কেয়ার হোমগুলোতে এই ব্যাকটেরিয়া একটি বড় সংকট হয়ে দাঁড়িয়েছে। কারণ, এগুলো মেঝেতে এবং চিকিৎসা যন্ত্রপাতির উপরও বেঁচে থাকতে পারে।
ড. জনাথন স্টোকস এই ব্যাকটেরিয়াকে ‘জনগণের এক নম্বর শত্রু’ বলে বর্ণনা করেছেন। বলেন, ‘‘প্রায় ক্ষেত্রেই দেখা যায় এই ব্যাকটেরিয়াটি প্রায় সব অ্যান্টিবায়োটিকের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে।”
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা :
নতুন অ্যান্টিবায়োটিক পেতে গবেষকদের প্রথমে এআই’কে এ বিষয়ে প্রশিক্ষণ দিতে হয়েছে। তারা হাজার হাজার ওষুধ নিয়েছিলেন যেগুলোর সুনির্দিষ্ট রাসায়নিক গঠন তাদের জানা ছিল। এরপর তারা হাতেকলমে সেগুলো অ্যাসিনেটোব্যাক্টর বাউমানির উপর পরীক্ষা করে দেখেন কোনটি এটিকে ধীর করতে বা মেরে ফেলতে পারে।
তারপর তারা সেইসব তথ্য এআই তে ভরেন যাতে এটি ওষুধের রাসায়নিক বৈশিষ্ট্যগুলি শিখতে পারে এবং সমস্যাযুক্ত ব্যাকটেরিয়াকে আক্রমণ করতে পারে। এরপর এআই ৬,৬৮০টি যৌগের তালিকা প্রকাশ করে যেগুলোর কার্যকারিতা অজানা ছিল। এজন্য এআই মাত্র দেড় ঘণ্টা সময় নিয়েছিল।
গবেষকরা পরীক্ষাগারে ২৪০টি পরীক্ষা করে নয়টি সম্ভাব্য অ্যান্টিবায়োটিক খুঁজে পেয়েছে। সেগুলোর মধ্যে একটি অ্যাবাউসিনা, যেটি দারুণ কার্যকারিতা দেখিয়েছে। এটি দিয়ে গবেষণাগারে ইঁদুরের ক্ষতের উপর পরীক্ষা চালিয়ে সফলতা পাওয়া গেছে। তবে এটা সবে মাত্র কাজের শুরু বলে মনে করেন ড. স্টোকস। পরের ধাপ হলো পরীক্ষাগারে এটিকে ওষুধে রূপান্তর করা এবং তারপর ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল। তিনি ধারণা করছেন, ২০৩০ সাল নাগাদ প্রথম এআই অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধ রূপে বাজারে আসতে পারে। অদ্ভুতভাবে এই পরীক্ষামূলক অ্যান্টিবায়োটিকটি ব্যাকটেরিয়ার অন্যান্য প্রজাতির উপর একেবারেই কাজ করে না। শুধু অ্যাসিনেটোব্যাক্টর বাউমানির উপর এটি কার্যকর।
অনেক অ্যান্টিবায়োটিক নির্বিচারে ব্যাকটেরিয়া মেরে ফেলে। গবেষকরা বিশ্বাস করেন যে অ্যাবাউসিনের নির্ভুলতা ব্যাকটেরিয়ার জন্য ওষুধ-প্রতিরোধ সক্ষমতা অর্জন করা কঠিন করে তুলবে এবং এতে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া কম হবে।