আতোয়ার রহমান : বাঙালির জীবনে উত্সবের রং ছড়িয়ে বছর ঘুরে আবার এল পয়লা বৈশাখ। টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া, সুনামগাঞ্জ থেকে চুরুলিয়া, টোকিও থেকে টরন্টো পর্যন্ত আজ ভাসবে বিপুল আনন্দের বাঁধভাঙা উচ্ছ্বাস। সবাই যোগ দেবে বাঙালির সর্ববৃহত তথা সার্বজনীন উত্সব বৈশাখী উত্সবে। বাঙালির কন্ঠে আজ ছড়িয়ে যাবে বাংলা নতুন বছরকে সম্ভাষণ জানিয়ে রচিত রবি ঠাকুরের সঙ্গীতের সেই চেনা সুর ‘এসো হে বৈশাখ, এসো এসো…। ‘

বাংলা নববর্ষ উদ্যাপন আজও ধর্ম ও স¤প্রদায় নির্বিশেষে সব শ্রেনীর বাঙালির জাতীয় উত্সব। পয়লা বৈশাখ ভ্রাতৃত্ব ও সৌহার্দ্যের দিন হিসেবে একেবারেই আমাদের মাটি আর মানুষ থেকে উত্সারিত। এটি আমাদের আপন সাংস্কৃতিক চেতনা ও ঐতিহ্যের স্মারক, আপন জাতিসত্তায় অনুপ্রাণিত হওয়ার উত্স, জাতীয় ঐক্যবোধে দীপ্ত হওয়ার উপলক্ষ, জাতির প্রতিচ্ছ¡বি। বাঙালির বৈচিত্রের মধ্যে ঐক্যের প্রতিক পয়লা বৈশাখ। বাংলাদেশে এই দিন কে মানবতার সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য হিসেবে আয়োজিত করা হয়। দিন এই উত্সব উদযাপনের ব্যাপকতা বৃদ্বি পাচ্ছে। যদিও গত বছর থেকে করোনার অতিমারীর জন্য সমস্ত আনুষ্ঠানিকতা সারতে হচ্ছে ভার্চুয়াল মাধ্যমেই।

মূলত কৃষিকাজ ও খাজনা আদায়কে ঘিরে বাদশাহ আকবরের সময় এর প্রচলন।পরে এর সঙ্গে যুক্ত হয় ব্যবসা-বানিজ্যের হালখাতার বিষয়টি। যদিও আজকাল হালখাতায় বাকি বকেয়া পরিশোধের প্রবণতা কমে গেছে। পয়লা বৈশাখের উত্সব শুরুর দিকে ছিল গ্রামাঞ্চলকেন্দ্রিক; এখন শহর-বন্দর-গ্রাম-গঞ্জ–সারা দেশে চলে প্রাণের জোয়ার। চারিদিকে নতুন প্রাণের উচ্ছ্বাস। পথেপথে উত্সবপ্রিয় বাঙালির ঢল। মাটির হাঁড়ি, আলপনা, নাগরদোলা, পুতুলনাচ, ঢোলের বাদ্য, আর বাঁশির সুর।

তরুণেরাই এখন এ উত্সবের প্রাণ। তরুণেরা এখন বিভিন্নভাবে এ উত্সবকে পুনরাবিস্কার করছেন। চৈত্র শেষ হতে না হতেই সব তরুণের মনে উত্সবের রঙ জমে। তাঁরাই উত্সবের রঙ ছড়ায় সবখানে, গান বাজায় প্রাণে প্রাণে। এ উত্সবের ভিত্তিটা গড়ে দিয়েছেন বাংলাদেশের কৃষক সমাজ। তরুণ-তরুণীরা বৈশাখী উত্সবের রঙিন পোশাক পরে বেরিয়ে আসে। তরুনীরা লালপেড়ে সাদা শাড়ি, সালোয়ার-কামিজ, কাচের চুড়ি, ফুলের মালায় সাজবে, তরুণদের পরনে থাকবে রঙিন পাঞ্জাবি, ফতুয়া, পায়জামা।

এধরণের একটি শেকড়ধর্মী উত্সব সংস্কৃতির ক্রমাগত শক্তি সঞ্চয়ে সহায়তা করে তারুণ্যকে নানা ধান্দাবাজি ও অপরাজনীতির কবলে পড়ে বিভ্রান্ত হওয়া থেকে বিরত রাখতে সহায়তা করবে। এ উত্সব আমাদের আপন সংস্কৃতি লালন ও নিজেদের মধ্যে তা বিকশিত করার নতুন প্রেরণা সৃষ্টি করবে, বিদেশি অপসংস্কৃতি থেকে দূরে রাখবে আমরা এই প্রত্যাশা করি। তবে কর্পোরেট বানিজ্যের আগ্রাসি থাবা থেকে এ উত্সবের মূল সুরকে রক্ষা করার ব্যাপারে আমাদের সকলকে সজাগ থাকতে হবে। মিডিয়ার সাহায্যে কোম্পানিগুলো আমাদের প্রাণের এই উত্সবকে যেনো বিপণনযোগ্য আইটেমে পরিণত করতে নাপারে, সেব্যাপারে আমাদের সকলকে সচেতন থাকতে হবে।

শুধু দেশে নয়, বিদেশে বসবাসকারি বিপুলসংখ্যক প্রবাসী বাঙালির মধ্যেও বৈশাখ নিয়ে উত্সাহ উদ্দীপনার কমতি নেই। পহেলা বৈশাখ নিয়ে দেশের মধ্যে যে উদ্দীপনা, তার চেয়ে বিশ্বের সর্বত্র মাকড়সার জালের মতো ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা প্রবাসীদের মোটেও কম নয়। শুধু প্রথম প্রজন্ম নয়, ভিন্ন ভাষা আর সংস্কৃতিতে বেড়ে ওঠা প্রবাসের নতুন প্রজন্মের ছেলেমেয়েরাও বেশ আন্তরিকতা ও মমতার সাথে এসব উত্সব অনুষ্ঠানও অংশগ্রহন করে থাকে। প্রবাসে জন্ম নেয়া ও বেড়ে ওঠা বাঙালি প্রজন্মকে জাতির ভাষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি ও এর ইতিহাসের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয় এ উত্সব। এখানে কানাডাতেও বৈশাখী মেলা ৫-৬ দিন ব্যাপী হয়। আমাদের তরুণ প্রজন্মই অবশ্য এ উত্সব অনুষ্ঠান আয়োজনে অগ্রনী ভুমিকা পালন করে থাকে। অনেক ধরণের মেলাহয়, পিঠাউত্সবহয়, ঢাকার চারুকলার আদলে মঙ্গল শোভাযাত্রা বের হয়। সামাজিক সাংস্কৃতিক ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের আয়োজনে মনোজ্ঞ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, বৈশাখী মেলার আয়োজন করা হয়, মেলা ও অনুষ্ঠানস্থল একেবারে লোকারণ্য হয়ে যায়। যদিও প্রবাসে কালবৈশাখীর ঝোড়ো হাওয়া বহে না, কালোমেঘ ধেয়ে এসে কোন ধুলিঝড়ের সৃষ্টি করে না, তবুও বাঙালিরা উত্সবে মেতে ওঠার ক্ষেত্রে কোনক্রমেই পিছিয়ে নেই।এর মধ্যে তারা খুঁজে পায় তাদের শৈশবে দেখা নদীর ধারের গ্রাম্য মেলার স্মৃতি, হারানো ঐতিহ্য, তাদের হারানো শিকড়, ফেলে আসা মা, মাটি, দেশ।
ঐতিহ্যবাহী দেশি খাবারের উত্সব চলে। খাবার দাবারেও প্রাধান্য পাবে বাঙালির ঐতিহ্যবাহী পছন্দের খাবারগুলো। পান্তা, ইলিশ, বিভিন্ন রকমের ভর্তা, ভাজি, আচার, চাটনি, চটপটি, খই-মুড়ি-মুড়কি, জিলাপি, বাতাসা-মন্ডা-বুন্দিয়া আরও কত কী! বছরের প্রথম দিনটি উদর পূর্তি করে কাটিয়ে দিবে উত্সবে গা ভাসানো আপামর বাঙালি। তবে আমাদের মনে রাখতে হবে ইলিশ মাছ খাওয়াই যেন নববর্ষের প্রধান আকর্ষণ না হয়।

সাধারণ মানুষের আশা নতুন বছরে নতুন সুখ সমৃদ্ধির শুরু হবে, জীবনযাপনের মান আরও উন্নত হবে- অশুভের দমন করা হবে। সমাজ ও রাজনীতি সুস্থ হবে, দূষণমুক্ত হবে, সকলের জীবনে শান্তি আসবে, নতুন বছরটি সবার ভালোভাবে কাটবে। গেল বছরের সব গ্লানি মুছে দিয়ে, সকল জীর্ণতা, শীর্ণতা দূরে ঠেলে দিয়ে সামনে এগোনোর জন্য আমাদের প্রেরণা যোগাবে।তাদের যাপিতজীবনে অনন্ত আনন্দধারা বয়ে যাক। সমস্ত বিভেদ ও অনৈক্য ভুলে গিয়ে আমরা যেন মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারি বিশ্বসভায়। একটি সুখী ও শান্তিপূর্ণ সমাজের আশায় সকলকে আবারও নববর্ষের শুভেচ্ছা। নতুন বছর করোনা নিরাময়ের বছর হোক, বয়ে আনুক সকলের জীবনে অনাবিল আনন্দ। শুভ নববর্ষ।
লেখক: গল্পকার