জান্নাত-এ-ফেরদৌসী : জাতি বৈচিত্র্যের দেশ বাংলাদেশ। বাঙালি ছাড়া আটাত্তরটি জাতির বসবাস এই দেশে। এদের জনসংখ্যা বর্তমানে ত্রিশ লাখের বেশি। এদের বেশির ভাগেরই রয়েছে নিজস্ব ভাষা, ধর্ম, সংস্কৃতি আর জীবনবোধ। বাংলাদেশের স্বনামধন্য গবেষণা প্রতিষ্ঠান ‘গবেষণা ও উন্নয়ন কালেকটিভ’ (RDC) এর সাধারণ সম্পাদক এবং সঙ্গীত শিল্পী ও গবেষক জান্নাত-এ-ফেরদৌসী দেড় যুগের বেশি সময় ধরে গবেষণা করছেন বাংলাদেশের প্রান্তিক জনগোষ্ঠী নিয়ে। বাংলাদেশের পঞ্চাশটি জাতি নিয়ে তাঁর গবেষণালব্ধ লেখা ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হবে ‘বাংলা কাগজ’ এর পাঠকদের জন্য।

বারো.

পার্বত্য চট্রগ্রামে বসবাসরত আদিবাসীদের মধ্যে সবচেয়ে সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠী হল লুসাই। লুসাইরা রাঙ্গামাটি জেলার বাঘাইছড়ি থানার সাজেক উপত্যকায় বাস করেন। তবে খাগড়াছড়ি ও বান্দরবান জেলায় এবং সিলেট জেলায় লুসাই-এর বসবাস রয়েছে বলে জানা যায়। বাংলাদেশের বাইরে ভারতের মিজোরামে এদের সংখ্যা অধিক। এছাড়া মিয়ানমারের চীন প্রদেশেও লুসাইরা বাস করেন। ১৯৯১ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী পার্বত্য চট্টগ্রামে লুসাইদের সংখ্যা ৬৬২ জন। তবে লুসাইরা মনে করে তাদের সংখ্যা প্রায় ১০০০ এর কাছাকাছি। লুসাই শব্দটির উৎপত্তি ‘লুসেই’ থেকে। ‘লু’ এর অর্থ হলো মাথা এবং ‘সেই’ এর অর্থ লম্বা। লুসাই পুরুষরা পূর্বে চুল লম্বা রাখতেন এবং কপালের উপর চুলের খোঁপা বাঁধতেন। তাই তাদের মাথা দেখতে লম্বা মনে হওয়ায় এইরুপ নামকরণ হয়েছে বলে মনে করা হয়।

গোত্র : লুসাইদের মধ্যে গোত্র বিভাজন রয়েছে। গোত্রের নামগুলো হল: পাঁচো, চাংতি, চাওয়াংতি, চোয়াঙ্গু, চাকচুয়াং, হোনার, হ্রাসেল, ভানচুয়াং, লালচি, তালু, পাউটু, পুনতে গোত্রের বসবাস রয়েছে। পূর্বপুরুষের উল্লেখযোগ্য ব্যক্তির নাম অনুসারে তাদের গোত্রের নামকরণ করা হয়।

ভাষা : লুসাইরা লুসাই ভাষায় কথা বলেন। এই ভাষা টিবেটো-বর্মণ ভাষা পরিবারভুক্ত। লুসাই ভাষার শব্দগুলি রোমান অক্ষরে লেখা হয়। লুসাই ভাষার সঙ্গে খিয়াং ও মণিপুরী ভাষার কিছু কিছু মিল থাকলেও প্রায় শতকরা ৭০ ভাগ মিল রয়েছে বম ও পাংখোয়া ভাষার সাথে। লক্ষ্যণীয় বিষয় যে, লুসাইরা বিভিন্ন এলাকাতে থাকলেও তাদের ভাষার কোন পার্থক্য পরিলক্ষিত হয় না। মিজোরামে লুসাই ভাষায় অনেক সাহিত্য বিদ্যমান থাকলেও বাংলাদেশে তার লেশমাত্র নেই। এডুকেশন প্রোগ্রামের মাধ্যমে ভাষা সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি করে বাংলাদেশে লুসাই জাতির নিজস্ব ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতির মেলবন্ধন করতে হবে।

উত্তরাধিকার : লুসাইরা সাধারণত একক পরিবার প্রথা। তবে যৌথ পারিবারিক প্রথাও তাদের মধ্যে দেখা যায়। পরিবারের প্রধান হচ্ছেন পিতা। তবে মাতার ভূমিকাও কম নয়। পরিবারে কোন পুত্র সন্তান না থাকলে পিতার নিকট আত্মীয়ের পুত্র সম্পদ ভোগ করেন। স্ত্রী বা কন্যারা সম্পদের দাবী করতে পারেননা। কেবলমাত্র ভরণপোষনের অধিকার রাখেন। বিধবা স্ত্রী দ্বিতীয় বিবাহ করলে সে ভরণপোষণ পাওয়ার অধিকার হারান। লুসাই সমাজে উত্তরাধিকার সূত্রে পুত্ররা সম্পদের মালিক হন।

সামাজিক কাঠামো : সমাজ সরদার বা হেডম্যান দ্বারা পরিচালিত। লুসাই সমাজ পিতৃতান্ত্রিক।

বিয়ে : তাদের মধ্যে পিতার রক্ত সম্পর্কের নিকট আত্মিয়ের মধ্যে বিয়ে নিষিদ্ধ। অতীত কাল থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত এই ধারা অব্যাহত রয়েছে। একই গোত্রের ছেলে মেয়েদের মধ্যে সাধারণত বিয়ে হয়না। লুসাই সমাজে বিয়ের ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি হলেন মেয়ের নানা ‘পু’। নাতনি নানার কাছে কোন দাবি করলে নানা সাধ্যমতো তা পূরণ করার চেষ্টা করে। পিতামাতা রাজি হলেও নানার অমতে বিয়ে অনুষ্ঠিত হতে পারেনা। লুসাইদের মধ্যে কনেপক্ষকে বর পক্ষের পণ দেওয়ার রীতি প্রচলিত রয়েছে ।

বাসস্থান : বন্য জীবজন্তুর হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য লুসাইরা ভূমি থেকে উঁচু করে বসতঘর নির্মাণ করেন। তারা বনের সহজপ্রাপ্য বাঁশ, গাছ, ছন দিয়ে মাচাংঘর তৈরি করেন। বর্তমানে শহরের লুসাইরা মাচাংয়ের পরিবর্তে উন্নত ঘরবাড়ি নির্মাণ করে থাকেন।

খাদ্য : লুসাইদের প্রধান খাদ্য ভাত ও শাকসবজি। তারা পাহাড়ে জুম চাষের মাধ্যমে ধান, শাকসবজি ইত্যাদির চাষ করেন। এছাড়া কখনো ঝর্না বা ছড়া থেকে শামুক, কাঁকড়া, মাছ ইত্যাদি সংগ্রহ এবং বনের পশুপাখিদের শিকার করেন। লুসাইরা সাধারণত কম লবণ ও পানি দিয়ে যে কোন তরকারি সিদ্ধ করে খেতে পছন্দ করেন। তাদের প্রিয় খাবারের নাম ‘সা-উম-বাই’। প্রিয় খাবারের মধ্যে আছে ভাইপোদেন, সাউম, মাইআন বাই, জংটা, খহাংহু, সারেপ, বেকাং ইত্যাদি।

লুসাইদের ঘর নির্মাণ

পোশাক পরিচ্ছেদ : অতীতে কিছু গ্রামে লুসাইরা পশুর চামড়া দিয়ে পোশাক তৈরি ও ব্যবহার করতেন। পরবর্তীতে তুলা থেকে সুতা তৈরি করে কোমর তাঁতে বোনা চাদর পুরুষ ও নারী উভয়ই ব্যবহার করতেন। ঐতিহ্যবাহী পোশাকের মধ্যে পুয়ার রোপুই, পুয়ানচেই-করচেই, ঙৌতে খেরঃ ইত্যাদি অন্যতম।

জীবিকা নির্বাহ : সাধারণত জুম চাষ করে লুসাইরা জীবিকা নির্বাহ করেন। তবে বর্তমানে জুম চাষের বিভিন্ন প্রতিকুলতার কারনে তারা অন্য পেশার দিকে যাচ্ছেন। লুসাই পরিবারে নারীরা খুবই কর্মঠ। শিক্ষিত যুবকরা চাকরি বা ক্ষুদ্র পেশায় নিয়োজিত হয়ে অর্থনৈতিক চাহিদা মেটানোর প্রচেষ্টায় রয়েছেন। কিস্তু পুঁজির অভাবে তারা ব্যবসা করতে পারছেন না। ব্যাংক থেকে সহজে ঋণও পায় না তারা।

সংস্কৃতি : ১৮৯৪ সালের আগে লুসাইদের মধ্যে শিক্ষিত মানুষের সংখ্যা কম ছিল। বর্তমানে লুসাইরা শতকরা ৯৬ ভাগ শিক্ষিত এবং বিভিন্ন সরকারী, বেসরকারী প্রতিষ্ঠানে কর্মরত রয়েছে। লুসাইরা সংগীত প্রিয় ও সংস্কৃতিমনা। তারা নিজেদের সংস্কৃতি রক্ষার ব্যাপারে সচেতন। তাদের নিজস্ব ঐতিহ্য অনুযায়ী পোষাক-পরিচ্ছেদ, বাদ্যযন্ত্র, অলংকার ইত্যাদির ব্যবহার এখনও রয়েছে। বিভিন্ন উৎসব-অনুষ্ঠান ও পূজা-পার্বণের সময় তারা বিভিন্ন ধরণের নৃত্য পরিবেশন করেন। তাদের উল্লেখযোগ্য নৃত্যের মধ্যে রয়েছে বাঁশ নৃত্য, শিকারি নৃত্য, জুম নৃত্য, যুবক-যুবতীদের নৃত্য ইত্যাদি। লুসাইদের লোক-সংস্কৃতি প্রাচীন ও সমৃদ্ধ। তাদের লোক-কাহিনী মুখে মুখে প্রচলিত। সমাজ ব্যবস্থা, নৈতিকতা, প্রচলিত রীতিনীতির উপর ভিত্তি করে তাদের রূপকথা ও লোক-কাহিনী প্রচলিত রয়েছে।

উৎসব : লুসাই অন্যান্য উৎসবগুলির মধ্যে সবচেয়ে জাঁকজমকভাবে বিভিন্ন ঐতিহ্যবাহী খেলাধুলা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান আয়োজনের মাধ্যমে পালিত হয়ে থাকে। চাপচারকূত : ফেব্রুয়ারি/মার্চ মাসের দিকে বসন্ত উৎসব পালিত হয়। মীমকূত : আগস্ট/সেপ্টেম্বর মাসের দিকে মৃত আত্মাদের স্মরণে এ উৎসব পালন করা হয়। পলকূত : শস্য কাটার উপলক্ষে এ উৎসব পালিত হয়।

ধর্ম : লুসাইরা প্রকৃতি পূজারী হলেও তারা সৃষ্টিকর্তাকে বিশ্বাস করেন। সারা বছর তাদের বিভিন্ন ধরণের পূজা-পার্বণ অনুষ্ঠিত হয়। তারা খোয়াবং সাখু-আ, তুইহুয়াই, মিভেংগেতু ইত্যাদি দেবদেবীর পূজা করেন। লুসাইদের একটি বৃহৎ অংশ বর্তমানে খ্রিষ্টান ধর্মের অনুসারী। খ্রিষ্টান ধর্মের অনুসারীরা গীর্জায় প্রার্থনা করে। বর্তমানে খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীরা ধর্মীয় উৎসব বড়দিন, পুনরুত্থান ইত্যাদি পালন করছেন।

মৃত্যু : লুসাই সমাজে তিন মাসের কম বয়সের শিশু মারা গেলে বিবাহিত ব্যক্তিরা সমাহিত করেন। লুসাই ভাষায় এই মৃত শিশুদের ‘হ্লামজুই’ বলা হয়। লুসাইরা মৃতদেহ সমাহিত করেন। পুরুষ বা মহিলা মারা গেলে প্রথমে ¯œান করানো হয় এবং অন্যরা বাঁশ দিয়ে মাচা তৈরি করেন। স্নানের পর মরদেহকে তার ব্যবহার্য জিনিসপত্র সহ কবর দেওয়া হয়। করব দেওয়া সংক্রান্ত যাবতীয় কাজ যুবকদের করতে হত। কবরে বৃদ্ধ/বৃদ্ধারা আগে মাটি দেন, তারপরে পরিবারের লোক এবং অন্যরা মাটি দেন। লুসাইদের ধারণা মৃতের আত্মা তিন মাস পর্যস্ত ঘুরাফেরা করে তার অসম্পন্ন কাজ সম্পন্ন করার জন্য। এ কারণে তারা তিন মাস পর্যন্ত মৃত ব্যক্তিকে খাবার দিতেন।

তথ্যসূত্র :
মঙ্গল কুমার চাকমা ও অন্যান্য সম্পাদিত বাংলাদেশের আদিবাসী: এথনোগ্রাফিয় গবেষণা (প্রথম খণ্ড), উৎস প্রকাশন, ঢাকা, ২০১০।
খুরশিদ আলম সাগর, বাংলাদেশের আদিবাসীদের কথা, পত্রপুট, ঢাকা, ২০০৮।

মেসবাহ কামাল, জাহিদুল ইসলাম, সুগত চাকমা সম্পাদিত আদিবাসী জনগোষ্ঠী, বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি, ঢাকা, ২০০৭।

Abul Barkat, Sadeka Halim, Asmar Osman, Md. Ismail Hossain, Manzuma Ahsan, Status and Dynamics of Land Rights, Land use and Population in Chittagong Hill Tracts of Bangladesh, Human Development Research Centre, Dhaka, 2010.
Chattapadhyaya. Annapurna. The People and Culture of Bengal: A Study in Origins Vol I, Farma Klm Private Limited, Kalkata, 2002.
ছবি: ইণ্টারনেট