জান্নাত-এ-ফেরদৌসী : জাতি বৈচিত্র্যের দেশ বাংলাদেশ। বাঙালি ছাড়া আটাত্তরটি জাতির বসবাস এই দেশে। এদের জনসংখ্যা বর্তমানে ত্রিশ লাখের বেশি। এদের বেশির ভাগেরই রয়েছে নিজস্ব ভাষা, ধর্ম, সংস্কৃতি আর জীবনবোধ। বাংলাদেশের স্বনামধন্য গবেষণা প্রতিষ্ঠান ‘গবেষণা ও উন্নয়ন কালেকটিভ’ (জউঈ) এর সাধারণ সম্পাদক এবং সঙ্গীত শিল্পী ও গবেষক জান্নাত-এ-ফেরদৌসী দেড় যুগের বেশি সময় ধরে গবেষণা করছেন বাংলাদেশের প্রান্তিক জনগোষ্ঠী নিয়ে। বাংলাদেশের পঞ্চাশটি জাতি নিয়ে তাঁর গবেষণালব্ধ লেখা ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হবে ‘বাংলা কাগজ’ এর পাঠকদের জন্য।
নয়.
পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড় ও অরণ্যের অত্যন্ত গভীরে বম জনগোষ্ঠী বসবাস করেন। বম শব্দের অর্থ বন্ধন। অতীতে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কয়েকটি জনগোষ্ঠীর লোকেরা যাদের জীবন প্রবাহ, কৃষ্টি-সংস্কৃতি, আচার-অনুষ্ঠান, নৃত্যগীত ইত্যাদি প্রায় একই রকম ছিল তারা নিজেদেরকে বম নামে আখ্যায়িত করতেন। উল্লেখ করা হয়। ১৮৬৭ সালে টি এইচ লুইন এদেরকে বনযোগী নামে উল্লেখ করেন। প্রাচীনকাল থেকেই বমরা পার্বত্য চট্টগ্রামের দক্ষিণ-পূর্ব সীমান্ত এলাকায় বসতিস্থাপন করেন। বর্তমানে বান্দরবান জেলার রুমা, থানচি, রোয়াংছড়ি ও সদর থানা এবং রাঙ্গামাটি জেলার বিলাইছড়ি থানায় মোট ৭০টি গ্রামে বমদের বসবাস।
নামকরণ : বম-জো (Bawm- zo) জাতিগোষ্ঠীর প্রাচীন ইতিহাস অনেকটা কিংবদন্তীতে আচ্ছন্ন। বমদের প্রথম পরিচিতি ছিল বম-জো নামে। জো শব্দটি একটি জনগোষ্ঠীকে নির্দেশ করতো। ইন্দো-বার্মান জনগোষ্ঠীর ঐতিহাসিক প্রকাশনায় ‘জো’ শব্দটির উল্লেখ পাওয়া যায়। ৮৬২ খ্রিষ্টাব্দে চিনে তাং রাজবংশের ফানচ ও নামের একজন প্রশাসক চিনদউইন উপত্যাকার এক রাজ্যের রাণী ও তার প্রধানকে ‘জো’ নামে অভিহিত করেছেন। ১৭৮৩ সালে ‘জো’ নামে একটি ছোট জাতির কথা উল্লেখ করেছেন একজন পাদ্রি। পরবর্তীতে বিভিন্ন লেখকের রচনায় তাদেরকে Bonjogi, Bangoogies, Banjoos, Bangogies, Bom-Zou, Bom নামে।
জনসংখ্যা : ১৯৯১ সালের আদমশুমারী অনুযায়ী বাংলাদেশে বমদের জনসংখ্যা ছিল ৬৯৭৮ জন এবং পরিবার সংখ্যা ১৩৪৯টি। বমদের ধারণা সরকারি পরিসংখ্যানে তাদের সঠিক সংখ্যা উল্লেখিত হয়নি। ২০০৩ সালে বম সোশাল কাউন্সিল বাংলাদেশ কর্তৃক পরিচালিত জরিপে তাদের সংখ্যা ছিল ৯,৫০০ জন।
সামাজিক ব্যবস্থা : অতীতে বম সমাজের প্রতিটি গ্রাম স্বতন্ত্র রাজ্য হিসেবে প্রধান দ্বারা শাসিত হতো। কোন গ্রাম বয়স্কদের সভা-পরিষদ আবার কোন গ্রাম হেডম্যানের নিয়ন্ত্রণে পরিচালিত হতো। ভূমির উপর ব্যাপক নিয়ন্ত্রণকারী ভূম্যধিকারি রয়েছে যাদের, কৃষকরা তাদের খাজনা প্রদান করেন। গ্রামের প্রধান চীফের কথা আদেশে পরিণত হয় এবং যুদ্ধের সময় সে প্রধান সেনাপতির দায়িত্ব পালন করে। নতুন ফসল উঠার পর প্রধানকে গ্রামের প্রতিটি পরিবার তিন ঝুড়ি ধান দেয়। এছাড়া তাকে চাষের উৎকৃষ্ট জমিও দেওয়া হয়। গ্রামের প্রশাসনিক কাজ পরিচালনার জন্য মুরুব্বিরা প্রধানকে সহায়তা করে এবং উভয়ে মিলে গ্রামবাসীদের উন্নয়ন, ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠা ও চাষযোগ্য জমির সমবন্টন করে।
ভাষা : বম জনগোষ্ঠীর নিজস্ব ভাষা রয়েছে। ইদানিং রোমান বর্ণমালাকে ব্যবহার করছেন। ধর্মগ্রন্থ বাইবেল, উপাসনার গানসহ সামাজিক আইনের গ্রন্থ ইত্যাদি তাদের নিজের ভাষায় লিপিবদ্ধ আছে। বম ভাষার ব্যবহার এ অঞ্চলের বম জনগোষ্ঠীর মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, এ ভাষার ব্যবহার ভারতের মিজোরামের কোন কোন এলাকায় আছে এবং মিয়ানমারের চিন হিলসে বেশিরভাগ লোকের মধ্যেও এ ভাষার প্রচলন দেখা যায়।
সামাজিক প্রথা : বমরা দলবদ্ধভাবে বসবাস করেন। কাজ করার জন্য তারা একত্রে বের হয় আবার কাজ শেষে একত্রে ফিরে আসে। এই একত্রে কাজ করাকে বমদের ভাষায় ‘লৌমকাল’ বলে। অতীতে কেউ একা কাজ করেছে বা বাইরে গেছে এমন দৃশ্য দৃষ্টিগোচর হতনা। নিজের কাজ করা এবং অন্যকে সহযোগীতা করা বম সমাজের সামাজিক প্রথা হিসেবে বিবেচিত। সমাজের উন্নয়ন কর্মকান্ড যেমন রাস্তাঘাট নির্মাণ, পানির ব্যবস্থা করা ইত্যাদিকে বম ভাষায় ‘তলাংসুয়াক’ বলে।
জীবিকা নির্বাহ : বম জনগোষ্ঠীর প্রধান পেশা জুমচাষ। পাহাড়ের ঢালে বিশেষ কায়দায় জুম চাষের মাধ্যমে তারা ধান, ভূট্টা, মরিচ, শিম,কাকরোল, তিল, কার্পাস, হলুদ, আদা, ঢেড়স, শশা, কুমড়া ইত্যাদি শাক-সবজি উৎপাদন করে নিজেদের প্রয়োজন মেটায়। বমরা ভাত ও মাছ, মাংশ খেতে পছন্দ করে। তারা শুটকি মাছ ও নাপ্পি খেতে অভ্যস্ত। বমরা নিজস্ব ঐতিহ্যবাহী দ্রব্য সামগ্রি উৎপাদনে নিজেদের সৃজনশীল প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছেন। তারা বন থেকে প্রাপ্ত গাছ, বাঁশ, ছন, পাতা, তুলা, পশুর চামড়া, পাখির পালক ও লেজ ইত্যাদির সাহায্যে বিবিধ ব্যবহার্য সামগ্রী ও বাদ্যযন্ত্র তৈরি করে। তারা বাঁশ ও বেত দিয়ে বাচ্চাদের দোলনা ও মাছ ধরার ফাঁদ তৈরি করে। কাঠের ব্যবহারও বম সমাজে লক্ষণীয়। আদিকাল থেকে বমরা লোহার তৈরি দা ব্যবহার করে। বমদের ব্যবহৃত ধারালো অস্ত্রগুলির মধ্যে বল্লম, কোদাল, কুড়াল ইত্যাদি রয়েছে। বমরা সাধারণত নম্র স্বভাবের এবং পুরুষ ও মহিলা উভয়েই পরিশ্রমী।
পোশাক-পরিচ্ছেদ ও অলংকার : বমরা নিজস্ব কোমর তাঁতে পোশাক তৈরি করে পরিধান করেন। মেয়েরা করচাই (শার্টের মতো) পরে আর বুকে আলাদা এক টুকরা কাপড় ব্যবহার করেন। এছাড়া নকশাযুক্ত মোটা কাপড়ের তৈরি ‘নুফান’ কোমর থেকে হাঁটু পর্যন্ত পরিধান করে। পূর্বে পুরুষরা নেংটি ও গায়ে ফতুয়া পরিধান করেন। আজকাল অবশ্য অধিকাংশ পুরুষ লুঙ্গি ব্যবহার করেন। বম মেয়েরা অলংকার পড়তে পছন্দ করেন।
বিবাহ : একই গোত্রের মধ্যে বমদের বিবাহ হয় না। তাদের সমাজে যৌতুক প্রথা নাই। একাধিক বিয়ে নেই। পুরোহিতরা সমাজে সম্মানিত ব্যক্তি এবং তারা বিবাহের কাজ সম্পাদন করেন।
উত্তরাধিকার: বমদের সামাজিক প্রথা অনুসারে পুত্র সন্তান কেবলমাত্র সম্পদের উত্তরাধিকারী হন। সন্তান না থাকলে পিতার নিকটবর্তী আত্মীয়ের পুত্রদের মধ্যে সম্পত্তি ভাগ করে দেওয়া হয়। প্রথা অনুসারে বম সমাজে মাতা কেবলমাত্র পরিবারের সম্পদের দেখাশুনা করতে পারে। মা এবং বোন কোন সম্পদের ভাগ পায় না। অপরদিকে স্ত্রীর মৃত্যুর পর মৃতস্ত্রীর সম্পদের পুরো অধিকার লাভ করেন তার স্বামী। বম পিতা-মাতারা বৃদ্ধ বয়সে সাধারণত ছোট ছেলের বাড়িতে থাকে।
ধর্ম : অধিকাংশ বম জনগোষ্ঠী বর্তমানে খ্রিষ্টান ধর্ম পালন করলেও খুজিং-পাথিয়ানকে তারা বিধাতা পুরুষ মানেন। তারা মনে করেন বিধাতা কখনো রুষ্ট হন না, তিনি সদা কল্যাণময়ী। তিনি কারো অমঙ্গল করেন না। তাই বিধাতার উদ্দেশ্যে কোন অর্ঘ্য নিবেদন করা হয় না। যত পূজা, যজ্ঞ সবই অপদেবতার উদ্দেশ্যে করা হয়।
সাংস্কৃতিক কার্যক্রম : প্রাচীনকাল থেকে বমরা বর্ষবিদায়, বর্ষবরণ ও নবান্ন উৎসব উৎযাপন করে আসছে। বর্তমানে তারা ইংরেজি নববর্ষ অর্থাৎ পহেলা জানুয়ারিকে নববর্ষ হিসাবে উৎযাপন করছেন। বিভিন্ন উৎসবের মধ্যে নবান্ন উৎসব বমদের একটি গুরুত্বপূর্ণ উৎসব। প্রাচীন কাল থেকে বমরা এ উৎসব উদযাপন করছেন। বমরা খ্রিষ্টধর্ম গ্রহণ করার পর থেকে নবান্ন উৎসব পাড়া ভিত্তিক এক সঙ্গে আয়োজন করেন। জুমের ফসলাদি ঘরে এনে ভালো ফসলগুলি গির্জায় নিয়ে সৃষ্টিকর্তার কাছে সমর্পণ করার পর সবাই মিলে এক সাথে ভাগাভাগি করে খাবার গ্রহণ করেন। উক্ত দিনে বিভিন্ন ধরণের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও খেলাধুলার আয়োজন করে থাকেন। ছেলেমেয়েরা বিভিন্ন ধরণের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেন। দলে দলে নাচ-গান করতে দেখা যায়। সেই দিনে প্রতিযোগিতামূলক খেলাধুলা, প্রতিযোগিতামূলক গানের অনুষ্ঠান, প্রতিযোগিতামূলক নৃত্য পরিবেশন করা হয়। প্রতিযোগিতার শেষে অংশগ্রহণকারী খেলোয়ার ও শিল্পীদের বিশেষত বিজয়ীদের মাঝে পুরস্কার বিতরণ করা হয় আয়োজকদের পক্ষ থেকে। বর্ষবিদায়ের বেলায় মানুষের সতেজ ভাব কমে যায়। বমরা ৩১ ডিসেম্বর রাতে বর্ষবিদায় অনুষ্ঠান আয়োজন করেন। বিভিন্ন গ্রামে গির্জায় প্রার্থনা সভা অনুষ্ঠিত হয়। বর্ষবিদায় ও বর্ষবরণ অনুষ্ঠানে সবাই মিলে মিশে গ্রামবাসীরা অংশগ্রহণ করেন। ইদানীং বর্ষবিদায় সাধারণত রাত ১১.৩০টায় অনুষ্ঠিত হয়। অতঃপর নতুন বছরকে স্বাগত জানাতে থাকেন। বর্ষবিদায় ও বর্ষবরণ অনুষ্ঠান চলাকালে বিভিন্ন ধরণের অনুষ্ঠান সাজানো হয়ে থাকে। বিদায়ীবর্ষকে বৃদ্ধ বা বৃদ্ধার সাথে তুলনা করা হয়। এমন ভাবে সাজিয়ে দেখানো হয় যে, ছেঁড়া কাপড়-চোপড় পরিয়ে দিয়ে দুজন সমবেত অনুষ্ঠান হলে উপস্থিত সবার প্রতি পুরান বছরের পরিচয় দিয়ে সবার কাছ থেকে বিদায় নিতে থাকে। অল্প কিছুক্ষণ পরে আরও দুই জন যুবক-যুবতী সাজিয়ে সমবেত অনুষ্ঠান স্থলে উপস্থিত সবার প্রতি নতুন বছরের স্বাগত জানিয়ে সবাইকে সবাইকে আর্শীবাদ দান করে। এভাবে পুরাতন বর্ষকে বিদায় ও নতুন বর্ষকে স্বাগত জানানোর অনুষ্ঠানাদি সাজানো হয়ে থাকে। অতীতকাল থেকে অদ্যাবধি বর্ষবরণ, বর্ষবিদায় এবং নবান্ন উৎসব অনুষ্ঠানাদি বম সমাজ পালন করছে। সামাজিক পরিবর্তনের ফলে বম সমাজের উৎসব অনুষ্ঠান ইত্যাদি ক্ষেত্রেও আগের চেয়ে বর্তমানে অনেক পরিবর্তন লক্ষ করা যায়।
মৃত্যু : বমরা মৃতদেহ কবর দেন। বম সমাজে সৎকার ও অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া সম্পাদনের ক্ষেত্রে কিছু সামাজিক রীতি-নীতি রয়েছে। মৃত্যুর পর থেকে কবরস্থ করার পূর্ব পর্যন্ত আত্মীয়রা উপবাস থাকেন। সামাজিক অনুশাসন অনুসারে মৃতের আতœার শান্তির জন্য কিছু আচার-অনুষ্ঠান করা হয়। যা পালনের মধ্য দিয়ে মৃত ব্যক্তি উত্তরাধিকারের মর্যাদা ও শান্তি লাভ করে।
তথ্যসূত্র : মেসবাহ কামাল, জাহিদুল ইসলাম, সুগত চাকমা সম্পাদিত আদিবাসী জনগোষ্ঠী, বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইট, ঢাকা, ২০০৭।
মঙ্গল কুমার চাকমা ও অন্যান্য সম্পাদিত বাংলাদেশের আদিবাসী, এথনোগ্রাফীয় গবেষণা (১ম খণ্ড), উৎস প্রকাশন, ঢাকা, ২০১০।
সঞ্জীব দ্রং, বাংলাদেশের বিপন্ন আদিবাসী, নওরোজ কিতাবিস্তান, ঢাকা, ২০০৪।
উ চ নু, ‘বান্দরবান পার্বত্য জেলা: উপজাতীয় নৃগোষ্ঠীর পরিচিতি’, মুস্তফা মজিদ সম্পাদিত বাংলাদেশের মঙ্গোলীয় আদিবাসী, মাওলা ব্রাদার্স, ঢাকা, ২০০৫।
আবদুল মালেক ও মশিউর রহমান, বাংলাদেশের ক্ষুদ্র আদিবাসী জনগোষ্ঠী ‘বম’: আর্থ-সামাজিক ও নৃতাত্তি¡ক আলোচনা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পত্রিকা, সংখ্যা ৮২, জুন ২০০৫/ আষাঢ় ১৪১২।
ড. মুস্তাফা মজিদ‘বম জাতিসত্বার নৃতাত্তি¡ক ও সাংস্কৃতিক পরিচিতি’, মুস্তফা মজিদ সম্পাদিত আদিবাসী সংস্কৃতি, মাওলা ব্রাদার্স, ঢাকা,
Abul Barkat, Sadeka Halim, Asmar Osman, Md. Ismail Hossain, Manzuma Ahsan, Status and Dynamics of Land Rights, Land use and Population in Chittagong Hill Tracts of Bangladesh, Human Development Research Centre, Dhaka, 2010
ছবি: ইণ্টারনেট