জান্নাত-এ-ফেরদৌসী : জাতি বৈচিত্র্যের দেশ বাংলাদেশ। বাঙালি ছাড়া আটাত্তরটি জাতির বসবাস এই দেশে। এদের জনসংখ্যা বর্তমানে ত্রিশ লাখের বেশি। এদের বেশির ভাগেরই রয়েছে নিজস্ব ভাষা, ধর্ম, সংস্কৃতি আর জীবনবোধ। বাংলাদেশের স্বনামধন্য গবেষণা প্রতিষ্ঠান ‘গবেষণা ও উন্নয়ন কালেকটিভ’ (RDC) এর সাধারণ সম্পাদক এবং সঙ্গীত শিল্পী ও গবেষক জান্নাত-এ-ফেরদৌসী দেড় যুগের বেশি সময় ধরে গবেষণা করছেন বাংলাদেশের প্রান্তিক জনগোষ্ঠী নিয়ে। বাংলাদেশের পঞ্চাশটি জাতি নিয়ে তাঁর গবেষণালব্ধ লেখা ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হবে ‘বাংলা কাগজ’ এর পাঠকদের জন্য।

বিশ.

রাঙ্গামাটি, বান্দরবান, খাগড়াছড়ি, চট্টগ্রাম জেলার রাঙ্গুনিয়া থানার বইস্যাবিলি, কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফে তঞ্চঙ্গ্যা জনগোষ্ঠীর বসবাস রয়েছে। দেশের বাইরে ভারতের ত্রিপুরা, মিজোরাম, অরুনাচল ও মনিপুরে তঞ্চঙ্গ্যা জাতি বাস করেন। এছাড়া মায়ানমারেও তঞ্চঙ্গ্যাদের বসবাস রয়েছে বলে জানা যায়। মায়ানমারে তঞ্চঙ্গ্যাদের দৈংনাক বলে। তঞ্চঙ্গ্যদের পরিচিতি প্রসঙ্গে মতপার্থক্য রয়েছে। কেননা তারা চাকমা রাজা ধরম বক্স খানের শাসনামল ১৮১৯ সালে তারা আরাকান হতে পার্বত্য চট্টগ্রামে আসেন কিন্তু ধরম বক্স খান তাদের অনুমতি না দেয়ায় তঞ্চঙ্গ্যাদের অধিকাংশ লোক আরাকানে ফিরে যায়। গগণচন্দ্র বড়–য়া উল্লেখ করেন, তঞ্চঙ্গ্যারা আরাকানের পাহাড়ি জাতি এবং তাদের সঙ্গে অপর পাহাড়ি জাতির মিশ্রন ঘটে। এই মিশ্র জাতির ভাষা চাকমা হলেও চাকমারা তাদের দলভুক্ত করেনি। কর্ণেল এ.পি. ফেইরীর মতে, ‘চাকমা ও তঞ্চঙ্গ্যারা ভিন্ন জাতি’ এবং ক্যাপ্টেন লুইনের মতে, ‘দৈংনাকেরা চাকমাদেরই অন্যতম শাখা।’ তঞ্চঙ্গ্যাদের সামাজিক আচার-আচরণ ও সংস্কৃতি চাকমাদের থেকে কিছুটা স্বতন্ত্র।

১৯৯১ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী তঞ্চঙ্গ্যাদের জনসংখ্যা ২১,৬৩৯ জন উল্লেখ করা হয়েছে। তঞ্চঙ্গ্যাদের ধারণা এই সংখ্যা সঠিক নয়। এই এলাকার আদমশুমরিীতে তঞ্চঙ্গ্যাদের চাকমা নামে অন্তভুক্ত করা হয়েছে। বাংলাদেশ তঞ্চঙ্গ্যা কল্যাণ সংস্থা পার্বত্য চট্টগ্রাম, কক্সবাজার ও চট্টগ্রামে জরিপের মাধ্যমে তঞ্চঙ্গ্যাদের জনসংখ্যা ৫১,৭৭৩ জন বলে উল্লেখ করেছে।

ভাষা: তঞ্চঙ্গ্যা জাতির নিজস্ব ভাষা রয়েছে। তবে গোত্র ভেদে ভাষার উচ্চারণে কিছুটা পার্থক্য রয়েছে। জার্মান পণ্ডিত ড. জি এ গিয়ারসন চাকমা ও তঞ্চঙ্গ্যা ভাষা আলাদা হলেও উভয় ভাষাকে ইন্দো-এ্যারিয়ান ভাষার অন্তর্ভুক্ত বলে উল্লেখ করেছেন। তঞ্চঙ্গ্যাদের নিজস্ব লিপি রয়েছে। তাদের লিপি বার্মিজ লিপির অনুরূপ। বর্তমানের তঞ্চঙ্গ্যা বর্ণমালা হলো দাইনাক বর্ণমালা। বৃদ্ধরা আরাকানি ভাষায় কথা বলেন এবং তরুণেরা বাংলা ভাষা ব্যবহার করছেন।

জীবিকা নির্বাহ: অন্যান্য পাহাড়ি আদিবাসীদের ন্যায় তঞ্চঙ্গ্যারাও জুম চাষ করে জীবিকা নির্বাহ করেন। বর্তমানে জুমের জমি হ্রাস পাওয়ায় অনেকে সমতল ভূমিতে ধান এবং বিভিন্ন মৌসুমী ফসল উৎপাদন করছে। এছাড়া সমুদ্র উপকূলবর্তী এলাকার বহু তঞ্চঙ্গ্যা ভূমির অভাবে মৎস্য চাষ করে জীবিকা নির্বাহ করছেন।

সামাজিক কাঠামো: তঞ্চঙ্গ্যা সমাজে পিতার মৃত্যুর পর পুত্ররা সম্পত্তির মালিক হয়। কন্যারা পিতার সম্পদে উত্তরাধিকার সূত্রে মালিক হয় না। তঞ্চঙ্গ্যাদের বিচারিক ব্যবস্থা অন্যান্য আদিবাসীদের মতই। পাড়া বা গ্রামের প্রধানকে কার্বারি বলা হয়। তাকে জনগণ নয় হেডম্যান নির্বাচন করে। তিনি গ্রামের লোকের বিচার সম্পন্ন করেন ছোট-খাট সামাজিক বিষয়ে কার্বারি মত প্রদান করেন এবং সমাধান দেন এবং জটিল বিষয় নিষ্পত্তির ক্ষেত্রে হেডম্যানের সাহায্যে গ্রহণ করেন।

খাদ্য: পার্বত্য চট্টগ্রামের অন্যান্য আদিবাসীদের মতো তঞ্চঙ্গ্যাদেরও শুঁটকি মাছ অতি প্রিয়। চিংড়ি, ছুড়ি, হাঙ্গর ইত্যাদির শুঁটকি তাদের প্রতিদিনের খাদ্য। সিদ্ধ তরকারিকে তারা ‘উসনা চন’ বলে। এই ‘উসনা চন’ তারা প্রতিবেলা খেয়ে থাকে। এছাড়া তারা তরকারিতে নাপ্পি নামে এক ধরনের শুঁটকি ব্যবহার করেন। সাংসারিক ও ধর্মীয় কাজে মদের ব্যবহার রয়েছে।

স্কুলে যাচ্ছে তঞ্চঙ্গ্যা শিশুরা

পোশাক পরিচ্ছেদ: তঞ্চঙ্গ্যাদের পোশাক-পরিচ্ছেদ স্বকীয় হওয়ায় তাদের অতি সহজেই সনাক্ত করা যায়। তারা উজ্জল রঙের পোশাক পছন্দ করেন। তাদের ঐতিহ্যবাহী পোশাকের নাম ‘পিনুইন’ এবং ব্লাউজের নাম ‘কোবোই’। তারা মাথায় সাদা রঙের ‘খবং’ এবং ফুলের কাজ করা ফাদুই (কোমরবন্ধনী) ব্যবহার করেন। তারা পায়ে রূপার খাড়– বা মল, কনুই বা হাতে সোনা বা রূপার তৈরি কুচি খাড়–, বাঘোর বা চুড়ি ব্যবহার করে। বাহুতে বাজু বন্ধ, কানে রাজজোড়, ঝংগা, গলায় চন্দ্রহার, রূপার টাকার ছড়া এবং খোঁপায় রূপার কাঁটা ব্যবহার করেন। বর্তমানে শিক্ষিত নারীরা বাড়ির বাইরে কোন কাজে যাওয়ার সময় শাড়ি বা শার্ট প্যাণ্ট পড়েন।

বিবাহ: তঞ্চঙ্গ্যারা বিবাহকে ‘সাঙা’ বলে। উভয় পরিবারের মধ্যে আলাপ আলোচনার মাধ্যমে বিবাহ সম্পন্ন করাই হলো তঞ্চঙ্গ্যা সমাজের সামাজিক রীতি। বিবাহযোগ্য হলে তঞ্চঙ্গ্যা পুরুষকে কমপক্ষে তিন দিন শ্রমণ হয়ে শ্রামণ্য ধর্ম পালন করার রীতি প্রচলিত। তাদের মধ্যে বিধবা বিবাহের প্রচলন রয়েছে। তাদের বিয়েতে দুই জন করে ঘটক থাকেন। বরকে উঠান থেকে বিবাহ আসরে আনেন ঘটক এবং কনের সাথে যে মেয়েটি লুকানো থাকেন তিনিও ঘটক। মামাতো বোন ছাড়া সাধারণভাবে তঞ্চঙ্গ্যরা কাউকে বিয়ে করতে পারেন না। তাই এই সমাজে অবিবাহিত নারী পুরুষের সংখ্যা বেশি। ছেলেমেয়েদের বিয়েতে পিতামাতার মতামতই প্রাধান্য। বিয়েতে কন্যাপক্ষ ছেলেকে দা, অস্ত্রশস্ত্র, বল্লম ইত্যাদি যৌতুক হিসেবে দেয়া হয়। তবে বিয়েতে ছেলেকে একহাজার ডিম দিতে হবে। ডিম না হলে বিয়ে সমাধা হবে না।

ধর্ম: তঞ্চঙ্গ্যারা বৌদ্ধ ধর্মালম্বী। তবে কাল্পনিক কিছু দেব দেবীর পূজাও তারা করে। যেমন, গাঙপূজা, ভূতপূজা, চুমুলাংপূজা, মিত্তিনীপূজা, লক্ষীপূজা ইাতাদি। ধর্মীয় অনুষ্ঠানের মধ্যে তারা বুদ্ধপূজা, সংঘদান, অষ্ট পরিষ্কার দান, কঠিন চীবর দান, মাঘী পূর্ণিমা ইত্যাদি অনুষ্ঠান পালন করে।

সাহিত্য সংস্কৃতি: তঞ্চঙ্গ্যাদের সাহিত্য খুবই সমৃদ্ধ। তাদের নিজস্ব ঐতিহ্যবাহী বিভিন্ন রূপকথা, উবাগীত, বারোমাসী প্রেমগীত, আধুনিক সংগীত লোককাহিনী-কিংবদন্তি প্রচলিত রয়েছে। উবাগীত অর্থাৎ প্রেমের গান তাদের সংস্কৃতিতে উল্লেখযোগ্য স্থান দখল করে রয়েছে। উবাগীত বিভিন্ন অনুষ্ঠানে তারা পরিবেশন করেন। পালাগান ও নাটকেও রয়েছে তাদের বিশেষ দক্ষতা ।

বাদ্যযন্ত্র: বাঁশি, বেলা, খেংখ্যং, ঢুঢুক প্রভৃতি বাদ্যযন্ত্র উৎসবের সময় ব্যবহার করেন তঞ্চঙ্গ্যরা। মৌমাছির দ্বারা ছয় ছিদ্র বিশিষ্ট বাঁশের ছোট নালীর মাঝখানে মোম দিয়ে যুবকরাই এ বাঁশি তৈরি করেন। প্রাচীন উবাগীতের ঐতিহ্যবাহী সুরে শ্রোতাদের হৃদয় ছুঁয়ে যায়। বেহালার অপর নাম বেলা। মাদার গাছ দিয়ে এটি তৈরি করা হয়। মিতিঙ্গা বাঁশের ছোট কঞ্চি দিয়ে তৈরি হয় খেংখ্যং। আধুনিক শিক্ষিত তঞ্চঙ্গ্যা শিল্পীরা গান রচনা করে আধুনিক সংগীতও গেয়ে থাকে বিভিন্ন উৎসব ও অনুষ্ঠানে।

বিষু বা বর্ষবরণ ও বর্ষ-বিদায়: বাংলা নববর্ষ ও চৈত্র-সংক্রান্তি উপলক্ষে পার্বত্য চট্টগ্রামের অন্যান্য জাতিদের মতো তঞ্চঙ্গ্যা সমাজেও বিশেষ উৎসাহ উদ্দীপনায় এই বিষু উৎসব ও অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। তখন বনে বনে পাহাড়ি জনপদে একটি পাখির বি-ষু-বি-ষু ডাক সবাইকে ‘বিষু’ উৎসবের আগমনী বার্তা জানিয়ে দেয়। তখন ঘরে ঘরে সাড়া পড়ে যায়। আত্মীয়-স্বজন একজন অন্যজনের বাড়িতে বেড়াতে যায় বা আসে। তঞ্চঙ্গ্যা ভাষায় বর্ষবরণ ও বর্ষবিদায় অনুষ্ঠানকে ‘বিষু’ বলা হয়। এ বিষুকে তিনদিনে তিন নামে অভিহিত করা হয়। যথা- ফুলবিষু, মূলবিষু (চৈত্র সংক্রান্তি শেষ দু’দিন) ও গুজ্যা-পূজ্যা দিন বা নতুন বছর। এ তিন দিন মুখরোচক পিঠা, পাঁচন খাবার রান্নার জন্য যাবতীয় শাকসবজি বাজার ও জঙ্গল থেকে সংগ্রহ করে রাখা হয়। ঘরের আশপাশ ও বাড়ির আঙ্গিনা পরিষ্কার করা হয়। তবে বর্তমানে আস্তে আস্তে তাদের সমাজে বিষুর সময় মদ খাওয়া কমে আসছে।

মৃত্যু: তঞ্চঙ্গ্যা সমাজের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া কিছুটা স্বতন্ত্র ধরণের। কোনো লোকের মৃত্যু হলে ঐ ব্যক্তির মুখে রোপার মুদ্রা ঢুকিয়ে দেওয়া হয়। মরদেহের সাথে ভাত ও মুরগি রান্না করে নেওয়া হয়। শশ্মানের চিতা পুরুষের বেলায় ৫ স্তর এবং মহিলার ক্ষেত্রে ৭ স্তর করে রাখা হয়। রীতি অনুযায়ী পুরুষকে পূর্বমুখী এবং নারী হলে পশ্চিমমুখী করে চিতায় স্থাপন করা হয়। তারপর চিতায় অগ্নিসংযোগ করা হয়। শবদাহের ৬ দিন পর মৃতের জন্য ধর্মানুষ্ঠান করা হয়। এ অনুষ্ঠানে ভিক্ষুদের আগমন ও সমাজের বিভিন্ন স্তরের লোকদেরকে নিমন্ত্রণ জানানো হয়। মৃত ব্যক্তির আতœার সৎকারের জন্য টাকা সহ বিভিন্ন গৃহ সামগ্রী ভিক্ষুসংঘকে দান করা হয়।

তথ্যসূত্র : মেসবাহ কামাল, জাহিদুল ইসলাম, সুগত চাকমা সম্পাদিত আদিবাসী জনগোষ্ঠী, বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি, ঢাকা, ২০০৭
খুরশীদ আলম সাগর, বাংলাদেশের আদিবাসীদের কথা, পত্রপুট, ঢাকা, ২০০৮
মঙ্গল কুমার চাকমা ও অন্যান্য সম্পাদিত বাংলাদেশের আদিবাসী: এথনোগ্রাফিয় গবেষণা, প্রথম খণ্ড, উৎস প্রকাশন, ঢাকা, ২০১০।
সঞ্জীব দ্রং, বাংলাদেশের বিপন্ন আদিবাসী, নওরোজ কিতাবিস্তান, ঢাকা, ২০০৪।
Abul Barkat, Sadeka Halim, Asmar Osman, Md. Ismail Hossain, Manzuma Ahsan, Status and Dynamics of Land Rights, Land use and Population in Chittagong Hill Tracts of Bangladesh, Human Development Research Centre, Dhaka, 2010, Page: 29.
ছবি: ইণ্টারনেট