জান্নাত-এ-ফেরদৌসী : জাতি বৈচিত্র্যের দেশ বাংলাদেশ। বাঙালি ছাড়া আটাত্তরটি জাতির বসবাস এই দেশে। এদের জনসংখ্যা বর্তমানে ত্রিশ লাখের বেশি। এদের বেশির ভাগেরই রয়েছে নিজস্ব ভাষা, ধর্ম, সংস্কৃতি আর জীবনবোধ। বাংলাদেশের স্বনামধন্য গবেষণা প্রতিষ্ঠান ‘গবেষণা ও উন্নয়ন কালেকটিভ’ (RDC) এর সাধারণ সম্পাদক এবং সঙ্গীত শিল্পী ও গবেষক জান্নাত-এ-ফেরদৌসী দেড় যুগের বেশি সময় ধরে গবেষণা করছেন বাংলাদেশের প্রান্তিক জনগোষ্ঠী নিয়ে। বাংলাদেশের পঞ্চাশটি জাতি নিয়ে তাঁর গবেষণালব্ধ লেখা ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হবে ‘বাংলা কাগজ’ এর পাঠকদের জন্য।

পনেরো.

বাংলাদেশে বসবাসকারী ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর মধ্যে অন্যতম খাড়িয়া জনগোষ্ঠী। সিলেট, মৌলভীবাজার ও হবিগঞ্জ জেলার বিভিন্ন উপজেলা এবং চা বাগান এলাকায় খাড়িয়ারা বসবাস করেন। মৌলভীবাজার জেলার শ্রীমঙ্গল উপজেলার বর্মাছাড়া, মংরাবস্তি, শিশিলবাড়ি ও হুগলিছড়া, বাহুবল উপজেলার বালুছড়া, চুনারুহাট উপজেলার সাতছড়ি, আমু, চণ্ডী, কৃষ্ণছড়া, দারাগাঁও, নালুয়া, জঙ্গলবাড়ি ও সোনারূপা গ্রামে খাড়িয়াদের বসবাস রয়েছে।

খাড়িয়াদের প্রকৃত জনসংখ্যা কত তার কোন নির্দিষ্ট পরিসংখান জানা নেই। কিন্তু খাড়িয়াদের সম্ভাব্য জনসংখ্যা পাঁচ হাজারের অধিক। মৌলভীবাজার ও হবিগঞ্জ জেলায় ৫৩০০ এর মতো খাড়িয়া জনগোষ্ঠী বাস করছেন। খাড়িয়াদের নিজস্ব কোন গ্রাম নেই। তারা অন্যান্য জনগোষ্ঠীর সাথে বসবাস করার কারণে তাদের স্বাতন্ত্র্যে বিরূপ প্রভাব ফেলছে। জীবিকার তাগিদে এক গ্রাম থেকে অন্য গ্রামে তাদের স্থানান্তর হয়েছে। শহরমুখীতা খাড়িয়াদের মধ্যে দেখা যায় না। তবে শিক্ষিত হওয়ার ফলে তাদের মধ্যে শহরে কাজ করার প্রতি প্রবণতা তৈরি হয়েছে।

জীবিকা
খাড়িয়ারা অনেকেই সনাতন কৃষি ব্যবস্থার উপর নির্ভরশীল।

গোত্র
খাড়িয়াদের মধ্যে ৬টি গোত্রের বসবাস রয়েছে। এগুলো হল: পাহাড়ী বা এরেঙ্গা, ঢেলকি, দুধ, বেরগা, মুণ্ডা এবং ওরাওঁ। বাংলাদেশে বসবাসরত খাড়িয়াদের মধ্যে দু ধরনের গোষ্ঠী বিদ্যমান। একটি দুধ এবং অন্যটি ঢেলকি খাড়িয়া। যারা সাঁওসার ধর্মের অনুসারী তারা নিজেদেরকে সবচেয়ে বড় খাড়িয়া বলে দাবি করেন। পাহাড়ী খাড়িয়ারা আদিগোষ্ঠী হলেও বাংলাদেশে এদের সংখ্যা খুব কম।

পরিবার
খাড়িয়া সমাজে একক পরিবারের আধিক্য বেশি থাকলেও যৌথ পরিবারও রয়েছে। বাংলাদেশের খাড়িয়া পরিবারগুলোতে ৪:৬ অনুপাতে সদস্য থাকে। পিতৃতান্ত্রিক পরিবার ব্যবস্থা থাকলেও সংসারে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে তিনি অন্যের মতামতকে গুরুত্ব দেন। বিয়ের পর মেয়েরা স্বামীর বাড়িতে চলে যায়। আর পরিবারের প্রবীণ সদস্যরা ছোট ছেলের সাথে থাকে।

আর্থ-সামাজিক অবস্থা
খাড়িয়াদের অর্থনৈতিক অবস্থা কৃষিনির্ভর ছিল। বাগানে কাজ করার পাশাপাশি তারা বাগান নিয়ন্ত্রিত ধানি জমিতে নানা ধরনের মৌসুমী ফলের আবাদ করেন। চা বাগানে শ্রমিকরা স্থায়ী এবং খণ্ডকালীন ভিত্তিতে কাজ করে থাকেন। বর্তমানে তারা অন্যান্য পেশায় নিয়োজিত হয়েছেন। খাড়িয়াদের মাঝে অনেকেই শিক্ষিত হয়ে চাকরি, শিক্ষকতা, নার্সিং সহ নানা ধরনের পেশার সাথে নিজেদের যুক্ত করছেন।

উৎসবে খাড়িয়া কিশোরীগণ

বিবাহ
এ সমাজে বিবাহ অসবর্ণ প্রথা দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। নিজ গোত্রে কেউ বিবাহ করতে পারেন না। বিবাহের ক্ষেত্রে ছেলের বয়স কুড়ি এবং মেয়ের বয়স ১৬ হলে তাদেরকে বিবাহযোগ্য বলে ধরে নেওয়া হয়। সমাজে বিবাহ বিচ্ছেদ ও বিধবা বিবাহের প্রথাও বিদ্যমান। খাড়িয়া মহিলারা সিঁথিঁতে সিঁদুর ও হাতে লোহার বালা পরিধান করেন। বিবাহের মধ্যে যৌতুক প্রথা বিদ্যমান এবং তা নগদে পরিশোধ করার বিধান রয়েছে। ঐতিহ্য অনুসারে সম্পন্ন হওয়া বিবাহ ব্যতিরেকে সকল ধরনের বিবাহকে অবৈধ হিসেবে গণ্য করা হয়। এ সব বিয়ের বৈধতা দানের জন্য অভিযুক্ত পরিবারকে এলাকার সবাইকে নিমন্ত্রণ করে খাওয়াতে হয়। এ সমাজে বিবাহ সর্ববৃহৎ ও চমকপ্রদ অনুষ্ঠান এবং এতে অনেক ধরনের আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন হয়।

ধর্ম
খাড়িয়ারা প্রকৃতির পূজারি বা সারাণা ধর্মের অনুসারী। তবে বেশির ভাগ খাড়িয়া হিন্দু ধর্মে বিশ্বাসী। তাদের আদি ধর্মের নানা আচারাদি যথাযোগ্য মর্যাদায় পালন করে থাকেন। তাদের প্রধান দেবদেবী : দুর্গা, স্বরস্বতী, কালী এবং শীতলা দেবী। বসন্ত রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা দিলে তারা শীতলা দেবীর পূজা পালন করেন। যারা খ্রিস্টান ধর্মের অনুসারী তাদের মধ্যে সচ্ছলতা রয়েছে ও কিছুটা উন্নত জীবনযাপন করছেন।

উৎসব
খাড়িয়ারা অন্যান্য ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী জাতির মত বিভিন্ন ধরনের উৎসব পালন করেন। তার মধ্যে অন্যতম হল: ফাগু, সাহরুল বা সারানা, কারাম পূজা, গহাল পূজা, রোপন উৎসব, নাওয়াখিয়া সহ নানা রকমের জাঁকজমকপূর্ণ উৎসব আয়োজন করে থাকেন।

মৃত্যু
কোন মানুষ মারা গেলে প্রথমে মৃত ব্যক্তির আত্মীয়স্বজনদের জানানোর বিধান রয়েছে। হলুদ লাগিয়ে ম্লান করানো হয়। সাদা কাপড় দিয়ে মৃতদেহকে ঢেকে দেওয়া হয়। শ্রাদ্ধ অনুষ্ঠান মারা যাওয়ার ১০ দিন পর করা হয়। এ সময় নিরামিষ আহার, ভূমি শয্যায় শয়ন, নগ্ন পায়ে চলাফেরা ইত্যাদি করতে হয়। শ্রাদ্ধ না হওয়া পর্যন্ত প্রতিদিন মৃত ব্যক্তির জন্য গাছের পাতা দিয়ে তৈরি পাত্রে বা খাপরায় ভাত ও পানি গ্রামের শেষপ্রান্তে রেখে আসা হয়।

তথ্যসূত্র :
পিউস নানোয়ার ‘খাড়িয়া’ প্রকাশিত হয়েছে মঙ্গল কুমার চাকমা ও অন্যান্য সম্পাদিত বাংলাদেশের আদিবাসী, এথনোগ্রাফিয় গবেষণা (দ্বিতীয় খণ্ড), উৎস প্রকাশন, ঢাকা, ২০১০।
সুভাষ জেংচাম ‘খাড়িয়া’ প্রকাশিত হয়েছে মেসবাহ কামাল, জাহিদুল ইসলাম এবং সুগত চাকমা সম্পাদিত আদিবাসী জনগোষ্ঠী, বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি, ঢাকা, ২০০৭।
Chattapadhyaya. Annapurna. The People and Culture of Bengal: A Study in Origins Vol I, Farma Klm Private Limited, Kalkata, 2002. ছবি : ইণ্টারনেট