জান্নাত-এ-ফেরদৌসী : জাতি বৈচিত্র্যের দেশ বাংলাদেশ। বাঙালি ছাড়া আটাত্তরটি জাতির বসবাস এই দেশে। এদের জনসংখ্যা বর্তমানে ত্রিশ লাখের বেশি। এদের বেশির ভাগেরই রয়েছে নিজস্ব ভাষা, ধর্ম, সংস্কৃতি আর জীবনবোধ। বাংলাদেশের স্বনামধন্য গবেষণা প্রতিষ্ঠান ‘গবেষণা ও উন্নয়ন কালেকটিভ’ (জউঈ) এর সাধারণ সম্পাদক এবং সঙ্গীত শিল্পী ও গবেষক জান্নাত-এ-ফেরদৌসী দেড় যুগের বেশি সময় ধরে গবেষণা করছেন বাংলাদেশের প্রান্তিক জনগোষ্ঠী নিয়ে। বাংলাদেশের পঞ্চাশটি জাতি নিয়ে তাঁর গবেষণালব্ধ লেখা ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হবে ‘বাংলা কাগজ’ এর পাঠকদের জন্য।
বাইশ.
বাংলাশের আদিবাসী জনগোষ্ঠীর মধ্যে সিলেটের খাসি জাতি অন্যতম, তবে বাংলাদেশে তারা খাসিয়া নামেই পরিচিত। সিলেট জেলার জাফলং, গোয়াইনঘাট, কানাইঘাট উপজেলায়, মৌলভীবাজারের সবকটি উপজেলায়, হবিগঞ্জের চুনারুঘাট ও বাহুবল উপজেলায়, সুনামগঞ্জের তাহিরপুর উপজেলায় খাসিদের বসবাস রয়েছে। বাংলাদেশের বৃহত্তর সিলেট অঞ্চলের বনভূমি আচ্ছাদিত অঞ্চলের টিলায় খাসি পানচাষীদের বসবাস রয়েছে।
১৯৯১ সালের আদমশুমারী অনুযায়ী বাংলাদেশে খাসিদের মোট জনসংখ্যা ছিল ১২,২৮০ জন। তবে ১৯০১ সালে শুধু সিলেট জেলায় খাসিদের মোট সংখ্যা ছিল ৩০৮৩ জন। তবে আদিবাসী নেতাদের মতে খাসিদের মোট জনসংখ্যা প্রায় ২০,০০০ জন। মৌলভীবাজার এলাকায় জনসংখ্যার দিক দিয়ে সবচেয়ে বেশি খাসিরা বসবাস করেন। খাসিদের বৃহৎ অংশ গ্রামে বসবাস করেন। চাষযোগ্য জমির অভাব ও শিক্ষা দীক্ষায় পরিবর্তনের ফলে তারা বর্তমানে শহরমুখী হচ্ছে। পড়াশোনা, চাকরি এবং ব্যবসা সংক্রান্ত কাজের জন্য খাসি জনগণ গ্রাম ছেড়ে দিন দিন শহরমুখী হচ্ছে। তবে এ সংখ্যা খুবই সীমিত।
পরিবারের ধরণ
খাসি’রা প্রধানত যৌথ পরিবারে বসবাস করেন। কিন্তু বর্তমানে নানা কারণে তা ভেঙ্গে যাচ্ছে। বিবাহের পরে আলাদাভাবে তারা একক পরিবার গঠন করে বসবাস করছেন। খাসিদের পারিবারিক বলয়ে মায়ের প্রভাব বেশি থাকায় সন্তানেরা মায়ের পরিচয়ে পরিচিত হয়। সম্পত্তি ভোগ ও গ্রহণের ক্ষেত্রে নারীদের অগ্রাধিকার দেওয়া হয়। পরিবারের গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে পিতার ভূমিকা রয়েছে। গোষ্ঠী বা বংশের সিদ্ধান্ত মামা গ্রহণ করতে পারেন।
সামাজিক ব্যবস্থা
খাসি সামাজিক বন্ধন অত্যন্ত সুদৃঢ়। অনেকগুলি পরিবার নিয়ে একটি সমাজ গড়ে তোলেন তারা। প্রত্যেক সমাজে বা পুঞ্জিতে একজন প্রধান থাকে, যিনি হেডম্যান হিসেবে পরিচিত। গ্রাম সমাজের আইনশৃঙ্খলা, সামাজিক নিরাপত্তা এবং যে কোন প্রয়োজনীয় সমস্যা সমাধানকল্পে হেডম্যানরা যথাযথ ভূমিকা পালন করেন।
ভাষা
খাসি ভাষার কোন লেখ্য রূপ নেই, তবে এ ভাষায় এখনো ১০ লাখের বেশি মানুষ কথা বলেন। খাসি ভাষার সঙ্গে সান্তাল এবং ওঁরাও ভাষার সম্পর্ক আছে। ভারত-বাংলাদেশে খাসি ভাষা মন ঘুমরে ভাষার ধারক ও বাহক। যথাযথ স্কুল ও মাতৃভাষা শিক্ষার ব্যবস্থা না থাকায় দিনে দিনে খাসি ভাষা লুপ্ত হচ্ছে। অস্ট্রিক ভাষাভাষী খাসি ভাষা একটি মজবুত ভাষা। প্রায় ৪০% শব্দ বাংলা ভাষার অস্ট্রিক থেকে এসেছে। গ্রাম্য এলাকায় খাসি ভাষার সাথে অন্য ভাষার সংমিশ্রণ দেখা যায় না, তবে শহরাঞ্চলে এর প্রভাব দেখা যায়। ভাষাগত দিক দিয়ে বাংলাদেশে ৪টি খাসি আঞ্চলিক ভাষা ব্যবহার করতে দেখা যায়।
সংস্কৃতি
পূর্বে খাসিদের সংস্কৃতি খুবই গৌরবময় ছিল। জৈন্তাপুর একসময় খাসিদের সাংস্কৃতিক রাজধানী ছিল। যেখানে প্রতিনিয়ত নাচ, গান, থিয়েটার, বাজনা, নাটক ইত্যাদি জাঁকজমকপূর্ণ অনুষ্ঠান হতো। নাচ খাসিয়াদের একটি গুরুত্বপূর্ণ সাংস্কৃতিক উপকরণ। পূজা, পার্বন, বিয়ে এবং শেষকৃত্যানুষ্ঠানে নাচ গানের মাধ্যমে নিজের ধারণা ও বিশ্বাসকে ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করা হয়। খাসি ভাষায় অনেক ধরনের গান পাওয়া যায়। এসব গানের মধ্যে আধ্যাতিœক গান, প্রকৃতির উদ্দেশ্যে গান, গল্প কাহিনী ভিত্তিক গান ইত্যাদি। এছাড়াও রয়েছে শিশুদের ঘুম পাড়ানি গান, ফাওয়ার, দুঃখের গান, বিলাপ সংগীথ, আধুনিক সংগীত, দেশাত্মবোধক গান, বিয়ের গান এবং ব্যান্ড সংগীত ও রয়েছে তাদের সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে। নৃত্যের মধ্যে রয়েছে, খালেক নৃত্য, বীর নৃত্য, নংক্রেম নৃত্য, ফালাং নৃত্য, প্লেট নৃত্য, বাঁশ নৃত্য ইত্যাদি। নাটক এবং মঞ্চ নাটক খাসি সমাজে ব্যাপক জনপ্রিয়। মঞ্চ নাটক শরৎ, বসন্ত ও শীতকালে পরিবেশন করা হয়। কবিতা, গল্প, ছোট গল্প, রাজকীয় গল্প বলার জন্য সময় নিয়ে অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হতো। এক একটি গল্প বলতে দুই-তিন দিন সময় লেগে যেত। বর্তমানে খাসি সমাজে খাসি সাহিত্যচর্চা পূর্বের তুলনায় কমে গেছে।
পোশাক-পরিচ্ছেদ ও অলংকার
খাসিদের ঐতিহ্যবাহী নিজস্ব পোশাক পরিচ্ছেদ রয়েছে। তবে পুরুষেরা তাদের ঐতিহ্যবাহী পোশাক পরিধান করে না। পুরুষেরা কোর্ট, পাগড়ি, ধুতি মোঙ্গল পরিধান করতেন। পোশাকের দিক দিয়ে শুধু গ্রামের নারীরাই তাদের ঐতিহ্য ও স্বকীয়তাকে বজায় রেখে চলেছে। নারীরা ৪-৫ ধরনের পোশাক পরিধান করেন। অনুষ্ঠানে বিশেষ ধরনের সাজসজ্জা করে থাকেন। মেয়েরা কানে দুল, গলায় স্বর্ণের চেইন, গলার হার ও বিভিন্ন ধরনের চুড়িও পরিধান করেন।
শিক্ষা
শিক্ষাক্ষেত্রে খাসি জনগোষ্ঠী পূর্বের তুলনায় এগিয়ে যাচ্ছেন। মিশনারি হোস্টেল চালু করে তাদের ছেলে-মেয়েদের শিক্ষার ব্যবস্থা করা হচ্ছে। লক্ষ করা যাচ্ছে, উচ্চ শিক্ষা গ্রহণের জন্য অনেকেই ভারতের মেঘালয়, শিলং সহ অন্যান্য দেশেও যাচ্ছেন।
ধর্ম
খাসি’রা বহু দেবদেবী এবং ঈশ্বরের পূঁজা করেন। খাসি ভাষায় ধর্মকে নিয়াম বলে। তারা একশ্বরবাদে বিশ্বাসী। এক ঈশ্বরের অস্তিত্বে বিশ্বাস করে এবং তার কাছেই প্রার্থনা করেন। কেউ পাপ বা অপকর্ম করলে তার জন্য তাকে অনুতপ্ত হতে হয় এবং পাপমোচনের জন্য তাকে ক্ষমা চাইতে হয়। কৃত পাপকাজের জন্য তাদেরকে বলিদান করা হয়। খাসী ধর্মে ৯টি গুরুত্বপূর্ণ কাজ সম্পন্ন করতে হয়। জীবনাচারণের জন্য এ ধর্মে তিনটি শিক্ষা খুবই তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। যার প্রথমটি হচ্ছে সৎ উপার্জন করা, মানুষকে চেনা বা ঈশ্বরকে চেনা আর তৃতীয়টি হল আত্মীয়স্বজনকে চেনা। তবে আদিধর্মের এ বিষয়গুলো বাংলাদেশে আর পালিত হয় না। বাংলাদেশে অধিকাংশ খাসি জনগণ খ্রিষ্টান ধর্মাবলম্বী (প্রায় ৮০ ভাগ)। তাই তাদের ধর্মীয় উৎসব বলতেই বড়দিন, নিউ ইয়ার এবং ধর্মীয় সভাগুলোকে বোঝানো হয়। তবে বেশ কিছু খাসি ধর্মান্তকরণ হলেও তাদের প্রাচীন আচার অনুষ্ঠান, রীতিনীতি প্রথা ইত্যাদি তারা ধরে রেখেছেন।
মৃত্যু
খাসি সমাজে মৃত সৎকারের বিষয়টিকে খুব গুরুত্বের সঙ্গে নিয়ে থাকেন। কেননা, তারা মনে করেন এর সাথে মৃতব্যক্তি এবং তার আত্মীয়স্বজনদের ভাল মন্দ জড়িত। কেউ মারা গেলে তাকে হালকা গরম পানিতে গোসল করানো হয় এবং সাদা কাপড় দিয়ে ঢেকে দেওয়া হয়। মোরগ উৎসর্গ করে থাকে মৃত ব্যক্তির আত্মার সৎকারের জন্য। উৎসর্গ, প্রার্থনা ও অন্যান্য ধর্মীয় আচার শেষে নিকট আপনজন, মামা বা ভাই বা বাবা প্রথমে অগ্নিসংযোগ করে এবং সকলেই তাকে অনুসরণ করে চিতায় অগ্নিসংযোগ করে থাকেন। দেহাবশেষ নিয়ে একটি বিশেষ জায়গায় কবর দিয়ে দেওয়া হয় অথবা সংরক্ষণে রাখা হয়।
তথ্যসূত্র :
রুশ পতাম ‘খাসি’ প্রকাশিত হয়েছে মঙ্গল কুমার চাকমা ও অন্যান্য সম্পাদিত বাংলাদেশের আদিবাসী এথনোগ্রাফীয় গবেষণা (দ্বিতীয় খণ্ড), উৎস প্রকাশন, ঢাকা, ২০১০।
খুরশীদ আলম সাগর বাংলাদেশের আদিবাসীদের কথা, পত্রপুট, ঢাকা, ২০০৮। ছবি: ইণ্টারনেট