জান্নাত-এ-ফেরদৌসী : জাতি বৈচিত্র্যের দেশ বাংলাদেশ। বাঙালি ছাড়া আটাত্তরটি জাতির বসবাস এই দেশে। এদের জনসংখ্যা বর্তমানে ত্রিশ লাখের বেশি। এদের বেশির ভাগেরই রয়েছে নিজস্ব ভাষা, ধর্ম, সংস্কৃতি আর জীবনবোধ। বাংলাদেশের স্বনামধন্য গবেষণা প্রতিষ্ঠান ‘গবেষণা ও উন্নয়ন কালেকটিভ’ (RDC) এর সাধারণ সম্পাদক এবং সঙ্গীত শিল্পী ও গবেষক জান্নাত-এ-ফেরদৌসী দেড় যুগের বেশি সময় ধরে গবেষণা করছেন বাংলাদেশের প্রান্তিক জনগোষ্ঠী নিয়ে। বাংলাদেশের পঞ্চাশটি জাতি নিয়ে তাঁর গবেষণালব্ধ লেখা ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হবে ‘বাংলা কাগজ’ এর পাঠকদের জন্য।
তেরো.
শেরপুর জেলার উত্তর সীমান্তবর্তী ভারতের মেঘালয় পাহাড়ের পাদদেশে ঝিনাইগাতি, নালিতাবাড়ি ও শ্রীবর্দিতে ২২টি গ্রামে প্রায় ৩ হাজারের মত কোচ বসবাস করেন। এছাড়াও নেত্রকোনা, কিশোরগঞ্জ, টাঙ্গাইল, গাজীপুর ও বরেন্দ্র অঞ্চল তথা উত্তরাঞ্চলের পাবনা, বগুড়া, রাজশাহী, মালদহ, রংপুর, দিনাজপুর, জয়পুরহাট ও নওগাঁ জেলাতে কোচদের বসবাস রয়েছে। মোট ৫০০০ এর মত কোচ সমগ্র দেশে বসবাস করছেন।
১৮৭২ সালের আদমশুমারীতে পাবনা, বগুড়া, রাজশাহী, মালদহ, রংপুর ও দিনাজপুরে প্রায় ১০ লাখ এবং ১৯১৩ সালের আদমশুমারীতে ১ লাখ ৫৬ হাজার লোক বাস করত বলে জানা যায়। এখনো ভারতের আসাম ও মেঘালয় রাজ্যে বিপুল সংখ্যক কোচ বাস করছে। ইদানিং তারা গোষ্ঠীর পদবীর নামের শেষে প্রধানত বর্মন, রায় এবং সরকার ব্যবহার করে। পাবনার জনাকীর্ণ এলাকায় এদের বসতি রয়েছে। হিলি, হাকিমপুর, পাঁচবিবি, পলাশবাড়ি এলাকায় তাদের ঘনবসতি রয়েছে। ১৯১৩ সালের আদমশুমারী রিপোর্ট থেকে জানা যায়, বাংলাদেশে অন্তত ১ লাখ ৫৬ হাজার লোকের মধ্যে ১২,৬৩১ জন রাজশাহী বিভাগের বাসিন্দা। তবে এই পরিসংখ্যান গ্রহণযোগ্য নয় কেননা উত্তরাঞ্চল ছাড়াও বৃহত্তর ময়মনসিংহ, টাঙ্গাইল, গাজীপুর ও শেরপুর জেলায় যথেষ্ট পরিমাণে কোচদের বসবাস লক্ষ্যণীয়।
ভাষা: কোচ জনগোষ্ঠীর নিজস্ব ভাষা রয়েছে। ভাষার মধ্যে হল: অহমীয়া, বাংলা, গারো প্রভৃতি ভাষা। হাডসনের মতে কোচদের ভাষা বাংলা, উড়িয়া, গণ্ড, হিন্দি, অহম ও ছোট নাগপুরী।
গোত্র : কোচ সমাজে দুটি গোত্র দেখা যায়, যার একটি আজোম এবং অন্যটি হল সিংছাং। আজোম হল তারাই যারা কাকমাঞ্চি পূজাতে ছাগল মানত করে এবং বলিদান করে থাকে। অন্যদিকে যারা নিকিনী/জুখূ বা মাহারী ছাগণ পাঠা বলিদান করে তারাই সিংছাং গোত্রের। কোচ সমাজের তন্ত্রধারক তুলারাশির মাধ্যমে দেউছী নিয়োগ দেওয়া হয় এবং তাদের দ্বারা কাকমাঞ্জির পূজা সম্পন্ন করা হয়। কোচ সমাজব্যবস্থায় পিতাই পরিবারের সর্বেসর্বা। গ্রামের সামাজিক পরিষদের সিদ্ধান্তই কোচ সমাজের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হিসেবে গণ্য হয়। কোচ সমাজে প্রধান ব্যক্তির মৃত্যু হলে উত্তরাধিকার সূত্রে তার বয়োজ্যেষ্ঠ সন্তানকে মণ্ডল হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। কোচ জাতি ৮ শ্রেণীতে বিভক্ত। জাতিগুলো হল: তি টেকিয়া কোচ, মার্গান বা দশগাঞা, চাপ্রা কোচ, বানাই কোচ, ওয়ানাং কোচ, সাতপারি কোচ ও শংকর কোচ। তাদের মধ্যে ভাষাগত পার্থক্য থাকলেও ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান ও পোশাক পরিচ্ছেদে কোন পার্থক্য পরিলক্ষিত হয় না।
পরিবার: কোচদের পরিবার ছিল যৌথ এবং বড়। কিন্তু বর্তমানে একক পরিবারের সংখ্যা বাড়ছে। পরিবারে মেয়েদের যথেষ্ট প্রভাব থাকায় সন্তানরা মায়ের পরিচয়ে পরিচিত হয়। পরিবারের ছেলে-মেয়েরা পূর্ণ বয়স্ক না হলে তাদের বিয়ে দেওয়া হয় না। মেয়েদের ১৫-১৬ বছর এবং ছেলেদের ২২-২৩ বছর বয়সে বর্তমানে বিয়ে হচ্ছে এবং ছোট পরিবার কেন্দ্রিক সংসার ব্যবস্থা গড়ে তুলেছে।
বিবাহ ব্যবস্থা : বর্তমানে ব্রাহ্মণ পুরোহিতদের মাধ্যমে মন্ত্র দিয়ে আইরো করে বিবাহকার্য সম্পন্ন হয়ে থাকে। বিয়ের সময় কোচ পরিবার কানি ওয়াই পূজা করেন। এ সময়ে মাছ, ছাগল ও কচ্ছপ বলিদান হয়। বিবাহ অনুষ্ঠানে রান্নাবান্না করার জন্য গ্রামের যুবতী বা বিধবা রমনীদের ও অন্যান্য কাজে সহযোগীতার জন্য পুরুষদের পানসুপারি দিয়ে চুক্তি করা হয়। কোচ সমাজে মেয়েদের প্রভাব থাকায় প্রায় ছেলেরাই ঘরজামাই যেত। ভোজের আয়োজনে গ্রামের আত্মীয়স্বজন ও প্রতিবেশীরা প্রায় সবাই চাল, আলু, গুড় ও মদ নিয়ে আসে বিয়ে বাড়িতে। রমণীরা অতিথি আপ্যায়ন করে নিজেদের ধন্য মনে করেন। কোচরা চিড়ামুড়িম খই, চা ও মদ দিয়ে অতিথিদের আপ্যায়ন করে থাকে। জাত বিয়া ও পাপমান্নি বিয়া এ দু ধরনের বিবাহ প্রথা চালু রয়েছে কোচ সমাজব্যবস্থায়। জাত বিয়েতে বিয়ে ঠিক করার পূর্বে তৃতীয় পক্ষ থেকে একজন বয়স্ক লোক ঘটক হিসেবে কাজ করে। প্রস্তাব বিনিময়ের মাধ্যমে বিয়ের বিষয়টি চূড়ান্ত করা হয়। প্রস্তাব চূড়ান্ত হওয়ার পর ঘটক দু পক্ষের আত্মীয় স্বজন ও প্রতিবেশীদের ডেকে এনে স্বাক্ষী রাখেন, যাতে পরে কোন ঝামেলা না হয়। বিবাহের দিন বর ও কনেকে উপোস থাকতে হয়। অবিবাহিত ছেলেদের দ্বারা বর ও কনে উভয় পক্ষের বাড়িতে পানচিনি অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। কোচদের বিয়ে অনুষ্ঠানে ঢোল, সানাই ও অন্যান্য বাদ্যযন্ত্র বাজিয়ে জাঁকজমকভাবে অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়।
পাপমান্নি মানে দোষী সাব্যস্ত হওয়ার পরে বিয়ের পিঁড়িতে বসা। যদি কোন যুবক-যুবতী প্রেম করে পালিয়ে যান এবং পরবর্তী সময়ে ফিরে আসেন বা অভিভাবকদের কাছে এসে আশ্রয় গ্রহণ করেন তখন পাপমান্নির বিয়ে অনুযায়ী তাদেরকে সমাজে স্থান দেওয়া হয়। উভয়পক্ষের অভিভাবকগণ সমাজের প্রধান মণ্ডলকে এ ব্যাপারে জানান এবং এক পক্ষের পিত্রালয়ে এসে সবাই উপস্থিত হন। আলোচনার মাধ্যমে পরবর্তীতে বর ও কনেকে ৫০ টাকা ও এক হাঁড়ি মদ জরিমানা করা হয়। পূজার দিনে সবাই একসাথে সেই মদ পান করেন।
অর্থনৈতিক অবস্থা : দরিদ্রতা, ভূমিহীনতা, শ্রমজীবী পেশা ইত্যাদি হচ্ছে কোচদের অর্থনৈতিক অবস্থার চিত্র। গরু, মহিষ, ছাগল, ভেড়া, হাঁস, মুরগি, কবুতর পালন ইত্যাদি তাদের পেশা। তবে বর্তমানে চারণভূমির অভাবের কারণে কোচরা এ পেশাতে প্রায় নেই বললেই চলে। পূর্বে জমির পরিমাণ বেশি ছিল বলে কৃষি উৎপাদন ও পশু পালন করেই তাদের জীবিকা নির্বাহ হতো কিন্তু এখন আর আগের মত সুযোগ না থাকায় তারা অন্য কাজে যুক্ত হচ্ছেন। বর্তমানে কোচ সম্প্রদায়েব লোকজন পাথর তোলা, পাথর ভাঙ্গা, বনজঙ্গল থেকে লাকড়ি ও বাঁশ সংগ্রহ করা এবং দিনমজুরীসহ অন্যান্য কাজের সাথে জড়িত আছেন।
ধর্মীয় অবস্থা : কোচ জাতি সনাতন ও প্রকৃতিপূজারি। অসুখ বিসুখে তারা দেব দেবতার কাছ থেকে কৃপা আশা করেন। কোচদের দেবতাদের মধ্যে আছে: লাম ওয়াই, হাজং বুড়ি, আন্দাহুরা, বারুমখোলা, হুদুম ওয়াই, ওয়াচেং দেলী বা বাঙ্গাল ওয়াই, হলাই বুড়ি, নিগামানি ওয়াই, কাকসাঞ্চি, গাসুম ওয়াই, তাম লাংনি ওয়াই, মুইলা ওয়াই ইত্যাদি দেবতাদের পূজা পালন করে থাকে। দেবতাদের প্রতি মানত করে ছাগল, ভেড়া, হাঁস, মুরগি, কবুতর, কচ্ছপ, মাছ ইত্যাদি বলিদান করেন।
সামাজিক অবস্থা : কোচদের উল্লেখযোগ্য উৎসবের মধ্যে হচ্ছে কালী পূজা, আষাঢ় আর্মতি, যাত্রাগাছা, লক্ষীবাড়ি, মারাবাতি, মাই আকলানি, মাইপিদানছানি, পৌষনাপিঠা, আবির খেলা ও চৈত্রসংক্রান্তি অন্যতম। উৎসবের সময় কৃষি কাজ বন্ধ করে রাখা হয়। আম, কাঁঠাল, চিড়া, মুড়ি, খই, দই এবং দুধের ব্যবস্থা করে। যাত্রা গাছা হলে দেবী দুর্গার বিসর্জন দিন। অগ্রহায়ণ মাসে রমণীরা নতুন জামা কাপড় পরে সেজেগুজে ফসলের ক্ষেতে গিয়ে তাদের ঐতিহ্যগত নিয়মে রেওয়াজ করে থাকে।
মৃত্যু : কোচ সমাজে মৃত্যুর সাথে সাথে জরুরীভাবে গ্রামের প্রতিবেশী ও সবাইকে জানানো হয়। মৃত্যুর সংবাদ পাওয়ার সাথে সাথে আত্মীয়স্বজন এবং গোত্রের লোকজনের নিজ নিজ বাড়ি থেকে এক মুঠি চাল কলাপাতায় মুড়িয়ে মৃতের বাড়িতে সমবেত হয়। এ সময় মৃতের আত্মীয়রা উচ্চস্বরে কান্না করেন। মৃত ব্যক্তিকে উত্তর দিকে রেখে কাঁচা হলুদ দিয়ে উত্তমরূপে স্নান করানো হয়। সাদা কাপড় দিয়ে মৃত ব্যক্তিকে ঢেকে রাখা হয়। অবিবাহিত পুরুষ বা মেয়েদের ও শিশুদের মৃতদেহ মাটিতে সমাধিস্থ করা হয়। মৃত্যুর তেরদিন পর শ্রাদ্ধ ক্রিয়া সম্পন্ন করা হয়। শ্রাদ্ধ অনুষ্ঠানে মৃত পরিবারের সদস্যরা মাছ মাংস খেতে পারেন না।
তথ্যসূত্র :
কামাকথো যুগল কিশোর কোচ, অমলেন্দু কোচ ‘কোচ’ প্রকাশিত হয়েছে মঙ্গল কুমার চাকমা ও অন্যান্য সম্পাদিত বাংলাদেশের আদিবাসী, এথনোগ্রাফিয় গবেষণা (দ্বিতীয় খণ্ড), উৎস প্রকাশন, ঢাকা, ২০১০। ছবি: ইণ্টারনেট