জান্নাত-এ-ফেরদৌসী : জাতি বৈচিত্র্যের দেশ বাংলাদেশ। বাঙালি ছাড়া আটাত্তরটি জাতির বসবাস এই দেশে। এদের জনসংখ্যা বর্তমানে ত্রিশ লাখের বেশি। এদের বেশির ভাগেরই রয়েছে নিজস্ব ভাষা, ধর্ম, সংস্কৃতি আর জীবনবোধ। বাংলাদেশের স্বনামধন্য গবেষণা প্রতিষ্ঠান ‘গবেষণা ও উন্নয়ন কালেকটিভ’ (RDC) এর সাধারণ সম্পাদক এবং সঙ্গীত শিল্পী ও গবেষক জান্নাত-এ-ফেরদৌসী দেড় যুগের বেশি সময় ধরে গবেষণা করছেন বাংলাদেশের প্রান্তিক জনগোষ্ঠী নিয়ে। বাংলাদেশের পঞ্চাশটি জাতি নিয়ে তাঁর গবেষণালব্ধ লেখা ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হবে ‘বাংলা কাগজ’ এর পাঠকদের জন্য।

 

চব্বিশ.

বাংলাদেশের সিলেট বিভাগে কন্দরা বসবাস করেন। শ্রীমঙ্গল উপজেলার উদনাছড়া, হরিণছড়া, পুটিয়া, খেজুরী, কুরূঞ্জী, নোয়াপাড়া, তেলিয়াপাড়া এবং কমলগঞ্জ উপজেলার কুমরিছড়া গ্রামের চা বাগানে এদের বসবাস রয়েছে। রেল লাইনের স্থাপন এবং চা বাগানের কাজের জন্য কন্দদের এ দেশে আগমন ঘটে। কন্দদের মতে, চা শ্রমিকদের সংখ্যা দুই হাজারের মত। জাতিগতভাবে কন্দ সমাজ বিভিন্ন গোত্রে বিভক্ত যেমন ক্যাশ্যত, নাগ ছাড়াও দাডিং বোড়িয়া, বোড়া, হলদি এবং বহিরবাদর নামে আরও চারটি গোত্রের সন্ধান পাওয়া যায়। বাংলাদেশের অন্যান্য আদিবাসীদের সংস্কৃতি ও জীবন ধারণের সঙ্গে কন্দ আদিবাসীর বৈসাদৃশ্য খুঁজে পাওয়া যায়। শ্রীমঙ্গলে ১,৯০,০০০, কুলাউড়ায় ১,৬০,০০০, রাজনগরে ২,০০,০০০ লোক বাস করেন। এদের মধ্যে কন্দের সংখ্যা ১৭০০ জন।

ভাষা : কন্দফার্সী নামক ভাষাকে কন্দরা তাদের আদি ভাষা হিসেবে উল্লেখ করেন। তবে এ ভাষার এখন প্রচলন নেই বললেই চলে। বয়স্করা এ ভাষায় কথা বলেন। বর্তমানে অধিকাংশ কন্দ উড়িয়া ভাষায় কথা বলেন। তাদের ব্যবহৃত ভাষার মধ্যে বাংলার প্রভাব দেখা যায়। বলা হয়ে থাকে চা বাগানের মাতৃভাষা হল উড়িয়া ভাষা। উড়িয়া ভাষার নিজস্ব বর্ণমালা রয়েছে।

লোকসংস্কৃতি : কন্দ সমাজের সংস্কৃতি চর্চার মধ্যে গান নাটক উল্লেখযোগ্য। তাদের বিনোদনের মাধ্যমগুলি ধর্মীয় উৎসব কেন্দ্রিক হয়ে থাকে। তারা দলগতভাবে নৃত্য পরিবেশন করে থাকে। এ ধরনের নাচে মেয়েদের চেয়ে ছেলেরা বেশি অংশগ্রহণ করেন। নাচ গানের সাথে বাদ্যযন্ত্র হিসেবে ঢোল, করতাল, হারমোনিয়াম, খোল, ঢাপড়া, চাঙ্গু, ঘণ্টা, বাঁশি এবং দোতারা ব্যবহার করেন।

পোশাক-পরিচ্ছেদ : আনুষ্ঠানিক পোশাক হিসেবে ছেলেরা ধুতি ও পাঞ্জাবী পরিধান করেন। মেয়েরা পরেন শাড়ি।

অলংকার : মেয়েরা নাকফুল, মালা, চুড়ি ও আংটি ব্যবহার করেন। বিবাহিত নারীরা কপালে টিপ এবং হাতে শাঁখা ব্যবহার করেন। ছেলেরা আংটি ব্যবহার করেন।

আসবাবপত্র: কাঠের পরিবর্তে আসবাবপত্র হিসেবে বাঁশ ও দড়ি তৈরি দিয়ে মাচা এবং খাটিয়া ব্যবহার করেন। কাঠের তৈরি খাট-চেয়ার-টেবিল এবং আধুনিক স্টিল, মেলামাইন এবং কাঁচ ইত্যাদি।

খাদ্যাভ্যাস : কন্দরা সাধারণত দৈনন্দিন খাবারে ভাত-ডাল-মাছ-মাংস ও শাক সবজি গ্রহণ করেন। বিভিন্ন ধরনের অনুষ্ঠানে সাধারণত খিচুড়ি, সবজি, বিভিন্ন ধরনের পিঠা ও নাড়– তৈরি করেন। অনুষ্ঠানগুলিতে রান্নার কাজ মেয়েরা করে পরিবেশনে পুরুষেরা সহায়তা করেন। বাহিরের কাজ ও রান্না বান্নার কাজে মেয়েরাই করে থাকেন। ধর্মীয় অনুষ্ঠানে মাছ-মাংস খাওয়ার কোন প্রচলন নেই।

সম্পত্তির মালিকানা : কন্দ সমাজে উত্তরাধিকার সূত্রে সম্পত্তিতে পুরুষের মালিকানা রয়েছে। যদি কোনভাবে তাদের আর কোন নি¤œগামী পুরুষ না থাকে তবে মেয়েরা সম্পত্তির মালিক হতে পারেন। মালিকানা নির্ধারণের ক্ষেত্রে হিন্দু উত্তরাধিকার আইন প্রযোজ্য হয়। একজন বিধবা নারী জীবদ্দশাতেই তার স্বামীর সম্পত্তির স্বত্ত ভোগ করতে পারেন, তিনি কোনভাবেই সে সম্পত্তির হস্তান্তর করতে পারেন না।

চা-বাগানে কর্মরত কন্দ নারী

কন্দ সমাজে বিবাহ পদ্ধতি : কন্দ সমজে ছেলের বয়স কুড়ি এবং মেয়ের বয়স পনোরো বছর হলে সাধারণত ছেলেমেয়েদের বাবা মা বিয়ের জন্য উদ্যোগ নেয়। প্রেমের মাধ্যমে এ সমাজে বিয়ে হয়। সমাজে কোনো ঘটক নেই। সচারচর তৃতীয় পক্ষের মাধ্যমেই বিয়ের প্রস্তাব আদান প্রদান করা হয়। বিবাহিত কন্দ রমণীরা সিঁথিতে সিঁদুর ও হাতে শাঁখা ব্যবহার করেন। কন্দ সমাজে বিবাহ বিচ্ছেদের প্রচলন নেই, তবে বিধবা বিবাহের প্রথা বিদ্যমান। তাদের সমাজে বহুগামীতার চর্চা নেই। নিজ গোত্র বা বংশের মধ্যে কন্দ সমাজে বিয়ে হয় না। বিবাহের কথা পাকাপাকি হয়ে গেলে উলুধ্বণির মাধ্যমে সেটি ঘোষণা করা হয়। যেমন কোনো পরিবারে পূর্ণবয়স্ক মেয়ে থাকলে গৃহে হঠাৎ এক সময় যদি সমবেত উলুধ্বণি শুরু হয় তখন পাড়া প্রতিবেশি সবাই জেনে যান মেয়েটির বিয়ে পাকাপাকি হয়েছে। বিয়ের প্রস্তাব চূড়ান্ত হওয়ার পরেই অন্যান্য আনুষঙ্গিক আচার-অনুষ্ঠানাদি সম্পন্ন করা হয়। এ পর্বে বর ও কনের পিতৃমাতৃগ্রহের গৃহ দেবাতার (ময়মুরুব্বি) উদ্দেশ্যে দুপ্রস্থ কাপড় উৎসর্গ করা হয়। কাপড় দুটি উভয় গৃহের গৃহদেবতার বেদিতে স্থাপন করা হয়, যে কাপড় পরে বর কনে উভয়েই বিবাহ অনুষ্ঠানে যোগদান করে। এর পর দিন পিঠাবর অনুষ্ঠান পালন করা হয়।

যৌতুক : এ সমাজে আনুষ্ঠানিকভাবে যৌতুকের প্রচলন না থাকলেও বিয়ের সময় কন্যাকে সাধ ও সাধ্যের মধ্যে সমন্বয় রেখে পিতার পরিবার থেকে মেয়েকে দেওয়ার রেওয়াজ রয়েছে। সোনার অলংকার যেমন নাকফুল দেওয়াটা বাধ্যতামূলক রীতিতে পরিণত হয়েছে।

পরিবার : আর্থিক সংকট, পেশা বা কর্মের অপ্রতুলতা এবং কর্মবিমুখতা ইত্যাদি কারণে কন্দ সমাজের নারী-পুরুষেরা একক পরিবারে বসবাস করছেন। কেননা, কর্মে নিযুক্ত ব্যক্তি কর্মহীন ব্যক্তির দায় দায়িত্ব নিতে চায় না। তাছাড়া তাদের যে মজুরী ব্যবস্থা তার দ্বারা অন্যদের পরিচালন করা সম্ভব হয় না। পরিবারের জন্য সারাজীবন কঠোর দায়িত্ব পালন করতে হয় ছেলেকে। সন্তানেরা পিতার পরিচয়ে পরিচিত হয় এবং মেয়েদের বিয়ের মাধ্যমে তাদের পরিচয়েরও পরিবর্তন হয়। এ সমাজে নারী ও পুরুষের মাঝে সহজ ও সাবলীল সম্পর্ক বিরাজ করে।

বাজার ব্যবস্থা : সপ্তাহে একদিন চা বাগানে হাট বসে। এর ছাড়া কেনাবেচার কোন সুবিধা নেই। তবে সাম্প্রতিক সময়ে গ্রামের ভিতর দু-একটি দোকান বসেছে যেগুলোতে নিত্য প্রয়োজনীয় সামগ্রী পাওয়া যায়। গ্রামের বাইরে থেকে অন্যান্য ব্যবসায়ীরা হাটগুলোতে নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যের পসরা নিয়ে আসেন। মনোরম পণ্যের জন্য কন্দদের উপজেলা শহরে যেতে হয়।

চারু ও কারু শিল্প : বাঁশ ও বেতের কাজ করেন নিপুণভাবে। দৈনন্দিন কাজের পাশাপাশি তারা বাঁশ ও বেতের সাহায্যে ঝুড়ি, ধামা, কোলা প্রভৃতি সামগ্রী তৈরি করে বাড়তি উপার্জন করেন। তাদের তৈরিকৃত বসার মোড়ার চাহিদা ব্যাপক। এ সমাজের নারীরাও চারুশিল্পে বিশেষ করে অনুষ্ঠানে আল্পনা আঁকার মাধ্যমে নিজেদের পারদর্শীতার পরিচয় দেন।

সংগীত চর্চা : নারীরা সমবেত হয়ে নাচ-গান পরিবেশন করেন। গানগুলি কন্দ ভাষাতেই পরিবেশিত হয়। গানের সাথে সাথে বিভিন্ন রকমের বাদ্যযন্ত্র ও বাজানো হয়। তাদের তাল, লয় এবং মাত্রাজ্ঞান খুবই ভাল।

মৃত্যু : ব্যক্তির মধ্যে যখন ঈশ্বরের প্রস্থান হয় তখনই ব্যক্তির মৃত্যু হয় বলে মনে করা হয়। মৃত্যুর সাথে সাথে মৃতদেহকে ঘর থেকে বাহিরে আনা হয়। খোলা জায়গায় রাখা হয়। মৃতদেহে তেল হলুদ মেখে সাবান লাগিয়ে গোসল করানোর পর নতুন পোশাক পড়ানো হয়। কন্দরা মৃতদেহ দাহ করেন। একসাথে দল বেঁধে কন্দরা বাদ্য যন্ত্র বাজিয়ে কীর্তন গেয়ে মৃতদেহকে শ্মশানে নিয়ে যান। সেখানে কিছু আনুষ্ঠানিকতা রয়েছে। বিভিন্ন ধরণের কাঠ সংগ্রহ করেন। কন্দদের মধ্যে মৃত ব্যক্তির পুত্রের মাধ্যমে মুখাগ্নি করা হয়, পুত্র না থাকলে ভ্রাতুষ্পুত্র মুখাগ্নি করেন। তা না থাকলে কন্যা সন্তান মুখাগ্নি করেন। চিতা তৈরি করতে কাঠের সাথে চন্দন কাঠ, বেল কাঠ এবং তুলসী কাঠ ব্যবহার করেন। মৃতদেহের ছাই নদীর জলে ভাসিয়ে দিয়ে শ্মশান যারা গিয়েছিলেন তারা গোসল করে ঘরে ফিরেন। মৃত ব্যক্তির পরিবার ১১ দিন অশৌচবস্থা পালন করেন এবং তার পুত্ররা এক কাপড়ে এবং নগ্ন পায়ে থাকেন। দশদিন পর নাপিত এসে অশৌচবস্থা পালনকারী সকলকে মাথা মুড়িয়ে দেন। মৃত্যুর ১১ দিনের মাথায় মৃত ব্যক্তির নামে শ্রাদ্ধ পালন করা হয়। এ দিনে মোরগ জবাই করা হয় গৃহ দেবতা ও পূর্ব পুরুষদের নামে। মোরগের মাংস ও আতপ চাল একত্রে রান্না করে পাখিদের জন্য বাইরে খোলা জায়গায় রেখে দেওযা হয়। যে পাখিটি প্রথমে এসে খাবার খাবে, বাড়ির সকলে মনে করবেন এই পাখিটির মধ্যেই মৃতব্যক্তির আত্মা রয়েছে। এরপর সকলে মৃতব্যক্তির মঙ্গল কামনায় আরাধনা করবেন। এদিন সকলকে ভোজের মাধ্যমে আপ্যায়িত করা হবে।

তথ্যসূত্র :
সুভাষ জেংচাম ‘কন্দ’ প্রকাশিত হয়েছে মেসবাহ কামাল, জাহিদুল ইসলাম ও সুগত চাকমা সম্পাদিত আদিবাসী জনগোষ্ঠী : বাংলাদেশ সাংস্কৃতিক সমীক্ষামালা-৫, বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি, ঢাকা, ২০০৭
ছবি: ইণ্টারনেট