মনিস রফিক : কানাডার বর্তমান প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো নিজের জন্ম, বেড়ে উঠা আর কানাডার নেতৃত্বে আসার অসাধারণ কিছু ঘটনা উপস্থাপন করেছেন তাঁর আত্মজৈবনিক গ্রন্থ ‘কমন গ্রাউন্ড’ এ। জাস্টিন ট্রুডোর সাবলীল আর অসম্ভব সুন্দর বর্ণনা খুব সহজেই পাঠকের সামনে উম্মোচিত করে কানাডার রাজনীতি, সংস্কৃতি আর স্বপ্নকে। ইংরেজি ভাষায় লিখিত গ্রন্থটি বাংলায় অনুবাদ করেছেন মনিস রফিক। ‘বাংলা কাগজ’ এ ‘কমন গ্রাউন্ড’ এর অনুবাদ ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হবে।
তেইশ.
বারকিনা ফাসো’র মধ্য দিয়ে আমরা সামনে এগুতে থাকলাম। আমাদের এই সামনে এগুনোর পথে আমরা ধীরে ধীরে আইভরী কোস্ট, ঘানা, টগো আর বেনিন পার হয়ে গেলাম। আমরা যতই সামনে এগুচ্ছিলাম ততই আমাদের সামনে বৈপরীত্বের চিত্র ভেসে আসছিল। চমত্কার সুন্দর সুন্দর সব জায়গা আর বন্ধুপ্রিয় সব মানুষদের দেখতে দেখতে আমরা আমাদের ভ্রমণের স্বাদ নিচ্ছিলাম। সেই সাথে আমরা কেঁপে কেঁপে উঠছিলাম জায়গা জায়গায় বিক্ষিপ্তভাবে অতীত আর বর্তমানের কিছু কিছু ক্ষত দেখে। আমরা কিছুদূর যেতে না যেতেই দেখতে পাচ্ছিলাম সব দাস’দের ডেরা। এই সব ডেরা থেকেই লাখ লাখ আফ্রিকানদের সারা জীবনের জন্য দাসত্বের বন্ধনের শৃঙ্খলিত করে আটলান্টিকের অপর পাড়ে পাঠানো হতো। সেই ডেরাগুলো দেখতে সেন্ট পিটার্স গীর্জার চেয়েও বড়। সেই সাথে আমরা দেখেছিলাম, রাজকীয় সব প্রাসাদ যেগুলোর চারিদিক ছিল কুমীরে ভর্তি পরিখা দিয়ে ঘেরা।
আমরা ডিসেম্বরের শেষের দিকে নাইজেরীয়ার সীমান্ত এলাকায় পৌঁছেছিলাম। তখন আমাদের এই ভ্রমণের পরবর্তী ধাপে যাবার সময় হয়ে গিয়েছিল। ফলে আমরা কটোনুউ থেকে এরোফ্লোটের একটা ফ্লাইট ধরে মাল্টা ও মস্কো হয়ে হেলসেংকি’তে গেলাম। মার্ক ওখান থেকে মন্ট্রিয়লে ফিরে গেলো আর আমরা তিনজন ওদিকে না গিয়ে স্থানীয় এক দূতাবাসের মাধ্যমে চীনের ভিসার জন্য দরখাস্ত করলাম। সেখানে আমাদের সহযাত্রী এক ফিনিসীয় বন্ধুর ফুপুর এক রুমের এক এপার্টমেন্ট এ কয়েক দিন কাটালাম। ঐ বছরের বড়দিনটি আমরা হেলসিংকি’তেই কাটিয়েছিলাম, কিন্তু বছরের শুরুর দিনটিতেই আমরা ট্রান্স-সাইবেরিয়ান এক্সপ্রেস এ প্রচণ্ড বেগে স্তেপ পার হতে শুরু করলাম।
ওটা ছিল আমার জীবনের আরেকটি মনে রাখার মত অভিজ্ঞতা। যদিও সেই ট্রেনের খাবার আর যাত্রীসেবার জন্য ওটার একটা বিশেষ নামডাক ছিল, কিন্তু সোভিয়েত রাশিয়ার সেই বছরগুলোতে সেই ট্রেনে সেগুলোর লেশমাত্র ছিল না। এমন কি বলা যেতে পারে, সেই সময় ভালো খাবারের প্রত্যাশা আর প্রত্যাশিত যাত্রীসেবার চিন্তাটায় ছিল সুদূরের কোনো স্বপ্ন।
![](https://i0.wp.com/www.banglakagoj.com/wp-content/uploads/2022/04/Bk-0012.jpg?resize=696%2C508&ssl=1)
আমরা এমন এক সময় সেই ট্রেন ভ্রমণ করছিলাম যখন রাশিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে পড়ুয়া চীনা ছাত্ররা তাদের নতুন বছরের ছুটি কাটাতে ঘরে ফিরছিল। আমি সপ্তাহের অধিকাংশ সময়ই প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখে, ছবি এঁকে আর লেভ টলস্টয় এর ‘ওয়ার এন্ড পিস’ উপন্যাস পড়ে কাটিয়েছিলাম। নতুন বছরের শুরুর দিনে ট্রেনের কন্ডাক্টর তার চলনসই ইংরেজীতে আমাদেরকে তার সংগ্রহে থাকা যথেষ্ঠ পরিমাণের ভদকা খাওয়ার জন্য আমন্ত্রণ জানিয়ে আমাদের সাথে সেই সময়ের পৃথিবীর অবস্থা নিয়ে ব্যাপক আলোচনা করতে চাচ্ছিলেন। তার আলোচনার প্রধানতম বিষয় ছিল আফগানিস্তানে সোভিয়েত সেনাবাহিনীর অনুপ্রবেশ। যদি তার বলা সেনাবাহিনীর গল্পগুলো আকর্ষণীয় হতো, তাহলে তার কাজের সময় আমাদের মতো যাত্রীদের সাথে সময় কাটানোটার একটা তাত্পর্য থাকতো। ১৯৯৫ সালের পহেলা জানুয়ারীর প্রথম সূর্য ওঠার সময় আমি মন থেকেই একটা প্রতিজ্ঞা করে ফেললাম, আমি আর কখনও ভদকা পান করবো না, আমি কিন্তু প্রতিজ্ঞাটা এখন পর্যন্ত রেখেছি।
বেইজিং এর কাছে আমাদের যাত্রা শেষ হয়েছিল, জায়গাটা ছিল মস্কো থেকে প্রায় নয় হাজার কিলোমিটার দূরে। ওখান থেকে আমরা সাংহাই, হংকং, হ্যানয়, ব্যাংকক এবং কো সামুই এর চমত্কার সুন্দর জায়গা থাই দ্বীপ চষে বেড়ালাম। এই দ্বীপে কয়েক বছর আগে বাবা আমাকে আর আমার দুই ভাইকে নিয়ে এসেছিলেন। এই ভ্রমণকে স্মরণীয় করে রাখার জন্য আমি আমার বাম কাঁধে স্থানীয় এক আর্টিস্টকে দিয়ে ধরিত্রীকে ধারণ করা যায় এমন এক ছবির ট্যাটু আঁকিয়ে নিয়েছিলাম।
শেষ পর্যন্ত বসন্তের শেষে আমি বাড়ীতে ফিরেছিলাম। প্রথমে আমি মায়ের পরিবারে যাওয়ার জন্য ভ্যাংকুভারে গিয়েছিলাম তারপর হুইসলারে, তখন মিশেল হুইসলারে কাজের সুবাদে বসবাস শুরু করে দিয়েছে। প্রায় এক বছর বাইরে থেকে কানাডায় ফিরে আমি সত্যিই অনুধাবন করেছিলাম, কানাডায় হচ্ছে একমাত্র দেশ যেটাকে সত্যিই একেবারে আমার নিজের বলা যায়।
যে কোনো বিশাল ব্যাপ্তির দীর্ঘ ভ্রমণ অবশ্যই একজন ভ্রমণকারীর চিন্তা চেতনায় একটা পরিবর্তন আনে, এবং এক্ষেত্রে আমিও কোনো ব্যতিক্রম ছিলাম না। অধিকাংশ কানাডিয়ান যারা ব্যাপকভাবে বিভিন্ন দেশ ভ্রমণের সুযোগ পেয়েছে, তাদের মত আমিও দেশে ফিরেছিলাম আমার দেশ সম্পর্কে অন্যদের স্তুতি আর প্রশংসা শুনে। আমি আমার এই ভ্রমণের দীর্ঘ অভিজ্ঞতার সবকিছু কখনও ওভাবে তুলে ধরতে পারেনি, সেই সাথে এই ভ্রমণ কোন কোন দিকে আমার দৃষ্টিভঙ্গিকে পরিবর্তন করেছিল তাও ওভাবে উপস্থাপন করিনি। শুধু এটা বলতে পারি, সাধারণ অর্থে এটা আমার ভিতর এক ব্যাপক পরিবর্তন এনেছিল, বলা যেতে পারে, আমার জীবন পথে সামনে এগুনোর জন্য এই ভ্রমণ আমাকে তৈরী করে দিয়েছিল। এটা আমাদের চারপাশের বিভিন্ন জাতি ও ভাষা ভাষীর মানুষের যা প্রয়োজন এবং একে অপরের মধ্যে যে সুন্দর বুঝাপড়া দরকার সে বিষয়ে আমার চেতনাকে আরো বেশী শাণিত করেছিল। আমি দ্ব্যর্থহীনভাবে বলতে পারি, যদি আমরা সত্যি সত্যিই বিষয়টা অনুধাবন করি এবং সেই মত কাজ করি তাহলে বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে যে প্রভেদ আছে তা অনেকটা কমে আসবে। আমার জীবনে অনেক সময় এসেছে যেখানে আমি বিভিন্ন ধরনের মানুষদের দেখেছি, যারা নিজেদের মধ্যে জাতিগত, ভাষাগত বা ধর্মীয় প্রভেদ থাকা সত্তে¡ও অন্যদের সাথে মিলেমিশে কাজ করে, এক্ষেত্রে আমিও এটাও লক্ষ্য করেছি, এই ধরনের মানুষেরা নিজেদের আলাদা করে রাখা মানুষের চেয়ে অনেক বেশী কর্মদ্যম আর সুখী।
![](https://i0.wp.com/www.banglakagoj.com/wp-content/uploads/2022/04/Bk-014.jpg?resize=696%2C391&ssl=1)
দীর্ঘ সময় ধরে ধীরে ধীরে পূর্ব দিকের এই ভ্রমণে আমি খুব কাছ থেকে ব্যাপক বৈচিত্রতা দেখেছিলাম, এই বৈচিত্রের স্বরূপটা আমি আমার বাড়ীর দিকে তাকালেও দেখতে পাই। আমি যেখানেই গেছি, সেখানেই দেখেছি স্থানীয় মানুষদের। দেখেছি একদল সংখ্যাগরিষ্ঠদের। বলা যেতে পারে যারা মূল ধারার জনগণ। সেই সাথে কাছ থেকে দেখেছি সংখ্যালঘুদের। প্যারিসে দেখেছি উত্তর আফ্রিকার মানুষদের। বারকিনা ফাসো’তে দেখেছি ইউরোপের অভিবাসীদের। আইভরী কোস্টের সুপারমার্কেটের মালিক দেখেছি এক লেবানীজ, আবার রাশিয়ায় দেখেছি চীনের ছাত্রদের। সেইসাথে থাইল্যান্ডে দেখেছি অস্ট্রেলিয়ানদের আর এমনও জায়গা দেখেছি যেখানে আদিবাসী বা সাংস্কৃতিকভাবে সংখ্যালঘুরা একটা দেশের মূল জনসংখ্যার একটা উল্লেখযোগ্য অংশ হওয়া সত্তে¡ও রাষ্ট্রের মূল আইন তাদের ক্ষেত্রে কিছুটা বৈষম্যমূলক বা তাদেরকে অন্য এক আলাদা গোষ্ঠী হিসেবে বিবেচিত করা হয়।
কিন্তু আমাদের আধুনিক কানাডার পরিচয়টা আর জাতি, ধর্ম, ইতিহাস বা ভৌগোলিক আবর্তে সীমাবদ্ধ নেই। কানাডিয়ান বলতে সব ধরনের রং, সংস্কৃতি আর বিশ্বাসের মানুষদের বুঝায়, এবং আমাদের এই বৈচিত্রতাকে আমরা সবাই সাদরে গ্রহণ করেছি, বলা যেতে পারে, আমরা এই বৈচিত্রতাকে উপভোগ করি। আমরা আমাদের জাতীয় পরিচয় এমনভাবে সৃষ্টি করেছি, যেখানে রয়েছে একে অপরের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ, সমতা, ন্যায়বিচার, সহাবস্থান আর সবার জন্য সমান সুযোগ। আমি যে প্রায় একশ’টার মতো দেশ ঘুরেছি, তার মধ্যে অনেক দেশই এই মূল্যবোধ নিয়ে নিজেদের গড়তে চাই, কিন্তু আমি সত্যিই বলবো, কানাডা হচ্ছে একমাত্র দেশ যেটা এসব বিষয়কে সুন্দরভাবে প্রতিফলিত করতে সক্ষম হয়েছে। এই কারণে কানাডায় হচ্ছে পৃথিবীর মধ্যে একমাত্র দেশ যেটা শুধুমাত্র বৈচিত্রের জন্যই বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য নয়, বরং এই বৈচিত্রতা হয়ে গেছে এক একক পরিচয়। বৈচিত্রময় সহাবস্থান কানাডার মূল সৌন্দর্য।
ঐ গ্রীষ্ম ও শরতে আমি মন্ট্রিয়লে বাবার কাছে ছিলাম। সেখানে আমি আমার চার বছরের সত বোন সারাহ’কে একটু ভালোভাবে জানতে পেরেছিলাম। তার মা সাংবিধানিক আইনজীবী ডেবোরা কইনি ছিলেন বাবার একজন খুব ভালো বন্ধু।
![](https://i0.wp.com/www.banglakagoj.com/wp-content/uploads/2022/04/Bk-015.jpg?resize=696%2C464&ssl=1)
সারাহ খুব ছোট থাকতে আমি তাকে কয়েকবার দেখেছিলাম, তখন সে ছিল একেবারে শিশু। সেই ছোট্ট সুন্দর মেয়েটাকে দেখে আমি খুবই আনন্দ পেতাম। সত্যি বলতে কি বাবার সেই আশি ছুঁই ছুঁই বয়সে তাঁর কাঁধে করে সারাহ’কে নিয়ে ঘুরতে দেখে আমার মনটা আনন্দের ভরে উঠতো। ঐ দৃশ্যটা দেখে আমার বারবার মনে পড়ে যেতো সেই সময়ের কথা যখন সারাহ’র মত বয়সে আমাকে আর আমার ভাইদের বাবা ওমন করে কাঁধে নিয়ে ঘুরে বেড়াতেন।
২০০০ সালের সেপ্টেম্বরে, বাবার মৃত্যুর কিছুদিন আগে যখন সারাহ ও ডেবোরা শেষ বারের মত তাঁর কাছে বেড়াতে এসেছিলেন তখন আমি সারাহ’কে বাইরে নিয়ে গিয়ে পাহাড়ে উঠেছিলাম। আমি জানতাম, আমার এমন কাজটা বাবার খুব ভালো লাগবে।
বাবার অন্তোষ্টিক্রিয়ার পর আমি সারাহ’কে আর ওভাবে কাছে পাইনি। তবে আমার হৃদয়ের ভিতরে সব সময়ই তার প্রতি আমার এক পরম ভালোবাসা আছে। আমি তাকে নিয়ে সব সময় গর্ব অনুভব করি। আমি আশাবাদী, ভবিষ্যতে তার সাথে আমার যোগাযোগটা আরো সুন্দর হবে। (চলবে)
মনিস রফিক ঃ চলচ্চিত্রকর্মী, টরন্টো, কানাডা