তানজির আহমেদ রাসেল : দীর্ঘ ১৭ বছর ধরে বৃটিশ সরকারের ভুলের খেসারত দিচ্ছেন বাংলাদেশি সাইফুল। বৃটিশ হোম অফিসের ভুল সিদ্ধান্তের কারণে দীর্ঘ ১৭ বছর ধরে আইনি লড়াই চালিয়ে নির্দোষ প্রমাণিত হবার পরও তাকে বহিষ্কারের পাঁয়তারা করছে বৃটেন। হোম অফিসে জমা তিন যৌন অপরাধীর কাগজপত্রের সঙ্গে সাইফুলের জমা দেয়া কাগজপত্র ভুলক্রমে মিশে যাওয়ায় যৌন হয়রানির মিথ্যা মামলার কবলে পড়েন তিনি। দীর্ঘ আইনি লড়াইয়ের পর বৃটিশ হোম অফিস কর্তৃপক্ষ তাদের ভুলের জন্য সাইফুলের কাছে দুঃখ প্রকাশ করে ক্ষমা প্রার্থনা করলেও তারা তাকে বৃটেনে স্থায়ীভাবে বসবাসের অনুমতি দিতে নারাজ। গতকাল রাতে (৫ জুলাই) মানবজমিনের সঙ্গে আলাপকালে বৃটিশ সরকারের এই অমানবিক আচরণ ও হৃদয়বিদারক ঘটনার বর্ণনা দেন সাইফুল।

পটুয়াখালীর কলাপাড়া থানার বাসিন্দা সাইফুল ইসলাম জীবিকার তাগিদে ২০০৩ সালে হাইস্কিলড ভিসায় শেফ হিসেবে যুক্তরাজ্যে পাড়ি জমান। যোগ দেন কার্ডিফের একটি রেস্তরাঁয়। সেখানে ভাগ্য সু-প্রসন্ন না থাকায় মিথ্যে যৌন অপরাধের অভিযোগে অভিযুক্ত হন তিনি। এই অভিযোগে তাকে বৃটেন থেকে বহিষ্কারের নির্দেশ দেয় হোম অফিস।
পরে সাইফুল এই বহিষ্কারাদেশের বিরুদ্ধে আইনি লড়াই শুরু করেন। এখন পর্যন্ত এই মামলা চলমান রয়েছে। তবে হোম অফিস তাদের ভুলের জন্য আনুষ্ঠানিকভাবে দুঃখ প্রকাশ করে প্রথমে পাঁচ হাজার পাউন্ড ও পরে আরো এক হাজার পাউন্ডসহ মোট ছয় হাজার পাউন্ড ক্ষতিপূরণ দিয়ে সাইফুলকে দেশে ফেরত পাঠাতে চাইছে। সাইফুলের প্রতি এই অমানবিক আচরণের খবর ফলাও করে প্রচার বৃটেনের প্রভাবশালী বিবিসি, গার্ডিয়ান ও স্কাই নিউজসহ অনেক গণমাধ্যম।

সাইফুল জানান, ২০০৩ সালে বৃটেনে পাড়ি জমানোর পর অসহনীয় দুর্ভোগের মাঝে একাধিক রেস্টুরেন্টে কাজ করে পাঁচ বছর পার করেছেন। ইমিগ্রেশন আইন অনুযায়ী পাঁচ বছর পর স্থায়ীভাবে বসবাসের জন্য তিনি আবেদন করলে হোম অফিস তার আবেদন প্রত্যাখ্যান করে। হোম অফিস জানায়, তার পাসপোর্টে ‘আগমনের’ সিলমোহর নেই। তিনি অবৈধভাবে বৃটেনে প্রবেশ করেছেন। হোম অফিস তার বিরুদ্ধে মিথ্যে যৌন অপরাধসহ একাধিক অভিযোগ উপস্থাপন করে তা গোপন রাখে এবং তাকে বহিষ্কারের চেষ্টা করে। একপর্যায়ে আইনি লড়াইয়ের মাধ্যমে তথ্য অধিকার আইনের আওতায় তথ্য কমিশনের মাধ্যমে হোম অফিসের আনীত অভিযোগ সম্পর্কে তিনি অবগত হন এবং এ বিষয়ে চ্যালেঞ্জ করলে হোম অফিস পাসপোর্টের ফটোকপি ফেরত দিতে বাধ্য হয়। ফলে প্রমাণিত হয় পাসপোর্টে ‘আগমনের’ সিলমোহর ছিল, তিনি বৈধভাবেই বৃটেনে প্রবেশ করেছেন। পরে এসবের জন্য ক্ষমা চায় হোম অফিস।

সাইফুল জানান, অনেক চেষ্টা ও দীর্ঘ আইনি লড়াইয়ের মাধ্যমে হোম অফিসের সব অভিযোগ মিথ্যা প্রমাণ করার পরও তারা আমাকে স্থায়ীভাবে বসবাসের অনুমতি দিচ্ছে না। তিনি বলেন, তারা এমন আচরণ করেছে যেন আমি একজন অপরাধী। এই দীর্ঘ সময়ে আমার শারীরিক ও মানসিক অনেক ক্ষতি হয়েছে। ১৮টি মামলায় আমি প্রায় চল্লিশ হাজার পাউন্ড খরচ করেছি, জীবনের ১৭টি বছর পার করেছি এসবের মূল্যায়ন তাদের কাছে নেই। তারা আমার জীবনের ১৭ বছরের মূল্য নির্ধারণ করেছে ছয় হাজার পাউন্ড। তবে বৃটিশ হোম অফিস এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি না হলেও তারা স্বীকার করেছে যে সাইফুলের জমাকৃত কাগজপত্রের সঙ্গে তিন অপরাধীর কাগজপত্র ভুলক্রমে মিশে গিয়েছিল। এজন্য তারা সাইফুলের কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে ক্ষমা চেয়েছে। হোম অফিস আরো জানায় বৃটেনে কারো স্থায়ীভাবে বসবাসের অনুমতি না থাকলে তিনি স্বেচ্ছায় চলে যাবেন এবং সেটাই আশা করা হয়। আর তা না হলে তাকে এদেশ ছেড়ে যেতে বাধ্য করা হবে।

এতো কিছুর পরও হাল ছাড়েননি সাইফুল। যুক্তরাজ্যের রাস্তায় একাই হ্যান্ড মাইক হাতে প্রতিবাদের আওয়াজ তুলছেন। কখনো বৃটিশ পার্লামেন্টের সামনে, কখনো ১০ ডাউনিং স্ট্রিটে আবার কখনো সুপ্রিম কোর্টের সামনে অবস্থান করে নিজের অধিকার ফিরে পেতে ক্যাম্পেইন চালিয়ে যাচ্ছেন। তার ক্যাম্পেইনে আকৃষ্ট হয়ে ইতিমধ্যেই প্রিন্স চার্লস, বৃটিশ পার্লামেন্টের একাধিক এমপিসহ অনেকেই লিখিতভাবে তার প্রতি সহানুভূতি প্রকাশ করেছেন। স্থায়ীভাবে বসবাসের অধিকার আদায়ে ব্যক্তিগত প্রতিবাদ, যুক্তরাজ্যের বিভিন্ন আদালতে লড়াইয়ের পর ইউরোপিয়ান আদালতের দ্বারস্থ হন তিনি। সবখানেই প্রমাণিত হয়েছে হোম অফিসের ভুল। কিন্তু সর্বশেষ ভিসা আবেদনের আগে তার ওয়ার্ক পারমিট ছিল না, ভিসা কারটাইল (মেয়াদ কমিয়ে দেয়া) ছিল, এ অজুহাতে তাকে বৈধতা দিতে রাজি নয় বৃটেন।

সাইফুল জানান, আদালতে জুডিশিয়াল রিভিউয়ের এক রায়ে বলা হয়, ওয়ার্ক পারমিট না থাকায় ২০০৮ সালের একটি আবেদন প্রত্যাখ্যাত হয় এবং সেটিই বৃটেনে তার স্থায়ীভাবে বসবাসের আবেদন প্রত্যাখ্যান হবার কারণ। ২০০৮ সালে ওয়ার্ক পারমিট না থাকার কারণ হিসেবে সাইফুল বলেন, তখন ভুলভাবে তাকে অপরাধী হিসেবে অভিযুক্ত করা হয়েছিল। তাছাড়া তার ফাইলের কিছু প্রয়োজনীয় কাগজপত্র নষ্ট করে অন্য একটি মামলায় তা আদালতে উত্থাপন করা হয়নি। তিনি যে বৈধভাবে বৃটেনে প্রবেশ করেছিলেন তার প্রমাণস্বরূপ পাসপোর্টের কপিও আদালতকে উপস্থাপন করা হয়নি। সাইফুলের আবেদনের ক্ষেত্রে অতীতে কিছু ভুল ও অবিচার করা হয়েছে আদালত এমন রুলিং দিলেও এসবই তার বর্তমান অবস্থার কারণ। সাইফুলের এমন দাবি নাকচ করে দেন।

মিথ্যা মামলা, অমানবিক আচরণ, হয়রানি আর ভোগান্তির মধ্যে জীবনের ১৭টি বছর পার করে সাইফুল এখন মানবেতর জীবনযাপন করছেন। তিনি বলেন, আমার বিরুদ্ধে সকল অভিযোগ মিথ্যা প্রমাণিত হওয়া সত্ত্বেও আদালতেও আমি ন্যায়বিচার পায়নি। হোম অফিসই আমাকে ক্রিমিনাল সাজিয়েছে, তারাই আমাকে অবৈধ বানিয়েছে, তাদের সব ভুলের জন্য তারাই ক্ষমা চেয়েছে। আমি এখন ঘুমাতে পারি না। আমার ভেতরের মানুষ তাড়া দেয় যে কাপুরুষের মতো অন্যায়ের কাছে হেরে যেও না, রুখে দাঁড়াও অন্যায়ের বিরুদ্ধে। বৃটেনের একাধিক আইনজীবী বিষয়টিকে নজিরবিহীন আখ্যা দিয়ে বলেন, সাইফুলের বিষয়টি হোম অফিস মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিবেচনা করতে পারতো।