বনানী বাবলি : মার্চের শেষ সপ্তাহ। ১৯৭১ সাল। চট্টগ্রাম শহর থেকে দূরে কোন এক গ্রামের খোলা উঠানে একদল শিশু কিচির মিচির করেই চলেছে বিকাল বেলা। এদের বয়স পাঁচ থেকে বারো বছর। দলপতিরা হলো বাপ্পি, অপর্ণা, শেখর আর বিশু। খেলা চলছে মিছা মিছি চড়ুইভাতির। কচুরি পানা ডুমো ডুমো করে রান্না করছে মেয়েরা ‘মাংসের কষা ঝোল’। তৈরী হচ্ছে ‘তরকারি’ হলুদ গাঁদার পাপড়ি খুলে। ঘন ‘ডালও’ হবে বুনো ফুলের গুল্ম দিয়ে। ছেলেরা যায় বাজারে এবং বাজার থেকে এসে আক্ষেপ করে বলে ঠিক বড়োদের সুর নকল করে, “যুদ্ধের বাজার গিন্নি, কিছুই নাই বাজারত। কেরোসিন তেল নাই, ডাইল নাই, চইল উধাও হই গিয়ে। কী গজ্জুম কিছুই তো নবুজির।”

যে গিন্নি সেজেছে সে মুখ ঝামটা দিয়ে বলে উঠে, “এতইন মানুষ, কী দি কী রাইনধুম? কী খাবায়ুম আজিয়া বেখকুনরে?” কপালে চিন্তার ভাজ ফেলে ছেলেরা আবার বাজারে যায় পকেটের ছিড়া কাগজের টুকরাকে টাকার মতো গুনতে গুনতে। গিন্নিদের বায়না রক্ষায় তারা হাঁটে পুকুর পাড়ে, বেতের ঝোপে, অথবা বালির ছড়ায়। প্রকৃতির সাথে বাস্তবের রূপরেখাকে সম্মিলন ঘটায় কল্পনায়। তৈরী করে ধূসর বালিকে ‘লবণ’, ভাঙা পরিত্যাক্ত নারিকেলের মালায় টলমলে পুকুরের পানিকে দুষ্প্রাপ্য ‘তেল’ বানিয়ে এনে গিন্নিকে বলে, “আজিয়া কোনোরকমে চালাও। বেক কিছুর দাম বেশি।”

কখনো কখনো খেলা পুরো দমে তুঙ্গে উঠে যখন গ্রামের ও পাড়ার ছেলে মেয়েরাও যোগ দেয় এদের সাথে। তখন মিছা মিছি বাজারের দোকান হয়, হাঁট বসে, চায়ের দোকান হয় আরো কত কী। খেলা ঘর তৈরী হয় সুপারি গাছের পাতা দিয়ে ছাউনি, ঘরের দেওয়াল হয় ভাঙা বেড়া দিয়ে। সেদিন সবাইকে বিশুর ছোট কাকু বললো যে শহরে যুদ্ধ। সন্ধ্যায় ছোট বড়ো সবাই ট্রান্সিস্টারে শুনছে ‘ও আমার দেশের মাটি তোমার পরে ঠেকাই মাথা’, ‘আগুন নিভাইব কে রে,’ ‘ওরা আমার মুখের ভাষা কাইড়া নিতে চায়’। ছোট কাকু মাঝে মাঝে কখন যে উধাও হয়ে যান কিন্তু যখন আসেন তখন তিনি গল্প করেন ছোটদের সাথে যুদ্ধের। এই সময় স্কুল ছিল খোলা। কয়েক মাইল হেঁটে যেতে হতো স্কুলে। পথে যেতে যেতে ছোটরা দেখতো কোন গাছে পাখির বাসা, কোন খেজুর গুলি ডাটাসহ পুকুরের পানিতে ডুবিয়ে রাখলে তারপরের দিন অনায়াসে টুকটুকে লাল মিষ্টি হয়ে যায় কিংবা গাছের পেয়ারা গুলি যদি পাখিতে ঠোকর দেয় তবেই জানা যায় এগুলি খাবার জন্য তৈরী। তাছাড়া মেঠো রাস্তার পাশে কুল গাছ, আমলকি গাছের হাতছানি উপেক্ষা করে স্কুলে পৌঁছতে পৌঁছতে দেরী না হয়ে যায় সেই ভয়ে থাকে এই বিশুর দল। তাই কিছু দস্যিপনা তারা তুলে রাখে স্কুল ছুটির পর।

এখন বৈশাখ মাস। চারিদিকে কেমন যেন থম থমে পরিবেশ। বড়রা আর হাসে না। কথা বলে না কাছে এসে এবং শাসন করে না আগের মতো। কিন্তু গাছে গাছে নুতন কুঁড়ি আর আসে পাশে আম, জাম, লিচু, বেল, কাঁঠালের সম্ভার। নুতন ধানের গন্ধ চারিদিকে ছড়িয়ে আছে মৌ মৌ সুবাসে। গ্রামের চাষিরা নেই, গোছা গোছা সোনালী ধানের শীষ বাতাসে ঢেউয়ের তালে তালে দুলে আনমনে। এই শিশুরা কল্পনায় হয়ে যায় কৃষান কৃষাণী। তাদের ভূমিকায় মিছামিছি চলে ধান কাটা, মাথায় করে আনে কল্পনার ক্ষেতের ফসল। তারপর নাচে গানে মেতে উঠে “আয়রে আয়রে সবাই …. সোনালী ধানের ইশারাতে, আয়রে সবাই কাস্তে হাতে আয়রে কাটি ধান…. কাটি ধান আয়রে …।”

আজ তারা শুনলো পাশের কুমার গ্রামে আগুন লেগেছে তাই সবাইকে এই পাড়া থেকে চলে যেতে হবে। এই দস্যি ছেলেরা বুঝতে পারে না কেন সবাই চলে যাচ্ছে নিজেদের ঘর বাড়ি ফেলে। গতকাল পাড়ার সমুরা চলে গেলো না জানিয়ে। বিশুদের কষ্ট হয় এই খেলাঘর ফেলে কোথাও যেতে। বিশুর ভাইয়ের মেয়ে বুরুন এসেছে দুপুরে চট্টগ্রাম শহর থেকে। বিশু বুরুন সবাই এখন পথের যাত্রী। সবার মাথায়, কাঁধে জিনিস ভর্তি ঝোলা। সবাই শুধু হাঁটছে অজানা নিরাপদ জায়গায়। সবাই পৌঁছতে চায় কোনো এক ঠিকানায় যেখানে যুদ্ধ নেই, আগুন নেই। বুরুন হাঁটে মায়ের আগে আগে ছোট ছোট পা ফেলে। কেউবা বুড়ো বাবাকে কাঁধে নিয়ে ছেলে পথ চলছে। কারো গায়ে রক্ত মাখা, কারো কোলে কাঁখে কান্নারত শিশু। বুরুন দেখতে পায় সবাই চলছে ধূলি মাখা পায়ে এক গ্রাম থেকে অন্য গ্রামে। চারিদিকে শুধুই মানুষের স্রোত। সবাই গম্ভীর মুখে শুধু ছুটছেই। সারাদিন হেঁটে ওরা এসে পৌঁছলো একটা নুতন গ্রামে। যে ঘরে বুরুনরা থাকলো রাতে অনেক লোকজন। সকালে মুড়ি আর গুড় দিয়ে খেতে দিলো সবাইকে। এখানে বুরুন আর বিশুর আরো অনেক খেলার সাথী হয়ে গেলো। অফুরন্ত সময়।
পড়া নেই। স্কুল নেই। শাসন নেই। সারাদিন শুধু যুদ্ধ যুদ্ধ খেলা। সমস্যা হলো এই খেলতে গিয়ে কারণ সবাই হতে চায় ‘মুক্তি’। কেউ ‘শত্রু’ বা ‘রাজাকার’ হতে চায় না। বুরুন জানে না রাজাকার কী, মুক্তি কী। তবে এটা বুঝে যে ‘মুক্তি’ ভালো কিন্তু ‘রাজাকার’ মন্দ লোক। সবাই মিলে সন্ধ্যায় এখন আর আগের মতো কেউ ট্রান্সিস্টার শুনে না। বড়রা চুপি চুপি শুনে যাতে কেউ জানতে না পারে। বিশুরা জানে না কেন। বিশুরা এখন মায়েদের অনুরোধে পুকুর থেকে তুলে আনে হেলঞ্চ শাক, জঙ্গলে খুঁজে বেড়ায় তিতা মাঙ্গুনী, কচি আম পাতা, কলার থোড়, কচু শাক, কচুর লতি, তুড়ুম পাতা। বিশেষত এগুলি আর যদি পুকুরের মাছ পাওয়া যায় তা দিয়েই গ্রামের সব মায়েরা রান্না করে ঘরে ঘরে এবং তারপর দুইবেলা কলা পাতায় খেতে দেয় বাড়ির সমস্ত শরণার্থীদের। বাজারের কোনো চিহ্ন নেই, উড়ে গেছে বোমায়। এখানে প্রত্যেকটা ঘরে এখন বিশ কিংবা পঁচিশ জন, ছোট বড় মিলে। সবাই চাটাই পেতে ঘরে আর বারান্দায় রাত কাটায়। গ্রামের বাবা কাকুরা পালা করে ঘুমায় এবং কারণ হলো গ্রাম পাহারা দেয়, বিশু বলে।

সমীর বিশুদের এখন অনেক কাজ। ওরা পাড়ায় পাড়ায় গিয়ে খবর নিয়ে আসে বড়দের জন্য। সেদিন তারা জানালো ওপাড়ার পদ্ম পিসী, ঝর্ণা পিসী আর ললিতা মাসিকে ধরে নিয়ে গেছে কারা যেন। এই খবরের পর এই বাড়ির মেয়েরা রাতের অন্ধকারে তিন মাইল দূরে পাহাড়ের মন্দিরে আশ্রয় নেয় এবং সেখানেই লুকিয়ে থাকে সারা রাত। অন্ধকার ভোরে আবার বাড়িতে চলে আসে। বুরুনের মাও ওদের সাথে যায়। বুরুন মাকে ছাড়া রাতে ঘুমাতে পারে না কিন্তু ওকে যেতে দেওয়া হয় না মায়ের সাথে। তাই ছোট্ট শিশু ভাইটির পাশে সে ঘুমিয়ে থাকে, ভোরে মায়ের আগমনীর প্রতীক্ষায়।

হেমন্ত কাল এখন। বড় উঠানে বাড়ির বাবা কাকুরা ধান গাছ দিয়ে মাথার টুপি বানায়। বুরুন অবাক হয়ে দেখে বড়দের। প্রশ্ন জাগে মনে কী হবে ওই খড়ের টুপি দিয়ে? জগা বলে কানে কানে বুরুনকে ওই টুপি মাথায় দিয়ে ধান ক্ষেতে বড়োরা লুকিয়ে থেকে শত্রুদের গতিবিধি দেখে। যাতে দূর থেকে ওরা বুঝতে না পারে যে ধানের ক্ষেতে বাবা কাকুরা লুকিয়ে আছে। বুরুনের মনে সহস্র প্রশ্ন কিন্তু উত্তর দেওয়ার সময় নেই যেন কারো। বড়দের সাথে সাথে বিশু জগারাও ভীষণ ব্যস্ত সারা দিন রাত। বাবা কাকুরা গাছের ডাল দিয়ে লাঠি বানায়, চাকু শান দেয়, মাচা তৈরী করে কিন্তু কেন এসব বানায় জানেনা বুরুন। সেদিন মাধাই জেঠু কোথেকে যেন ঘন সবুজ, রক্ত লাল আর হলুদ কাপড় আনলো। সারাদিন উঠানে বড়োরা সেই কাপড় ভাজ করে কেটে কেটে সবুজ কাপড়ের মাঝখানে একটা লাল গোল বৃত্ত আর তার মধ্যে কেমন যেন আঁকা বাঁকা হলুদ কাপড়ের টুকরা দিয়ে কী যেন তৈরী করলো। ওঁরা বলেন ওটা নাকি হবে স্বাধীন দেশের পতাকা। আর বলেন যুদ্ধ প্রায় শেষ। সবাই আবার নিজেদের গ্রামে ফিরে যেতে থাকে।

পরিবারের সবার সাথে বিশু বুরুনের দলও আবার রাস্তায়। পথের পর পথ পাড়ি দেয় একসাথে। ঘরে ফিরে সন্ধ্যায়। কিন্তু এ কোন ঘর? পুরা ভিটা শূন্য। চারিদিকে শুধু পোড়া কাঠের গন্ধ, ঘর বাড়ি সব ভাঙা, কিচ্ছু নেই। মাটির চুলার রান্না ঘর, ঢেকি ঘর, ঘরের চালার টিন, দরজা জানালার কোনো অস্তিত্ব নেই। শুধু বুরুনদের দাদুর বৈঠকখানার পাশের বড় কদম গাছটা দাঁড়িয়ে আছে সাক্ষী হয়ে। আজ বিশুরা জানলো ছোট কাকু আর আসবে না। ছোট কাকুর শেষ চিঠি নিয়ে এসেছে মুক্তি স্বপন ও মুক্তি বেলাল। সেদিন কী কান্না সারা বাড়িতে।

সারা দিন রাত বড়োরা তৈরী করে নিজেদের ঘর। বুরুন দেখতে পায় বড়োরা সব সময় খুশিতে গান গায় ‘আজি বাংলাদেশের হৃদয় হতে’ কিংবা ‘শোনো একটি মুজিবরের থেকে’ ‘… আর ঘরের চালা দেয় খাপরা দিয়ে। ঘর নেই, বাড়ি নেই, ছোট কাকু নেই। তবুও সবার মুখে হাসির ঝিলিক। এই সবার চোখেই বুরুন তার বিশ্বকে দেখে অবাক হয়ে। আর বিশু বাপ্পির দল পুরো উদ্দ্যমে তৈরী করে আবার তাদের নুতন খেলাঘর। অথবা দল বেঁধে নদীতে যায়। ভেলা বানিয়ে নেয় কুড়িয়ে পাওয়া বাশ ঝাড়ের পরিতেক্ত বাশ দিয়ে। কলা গাছের সবুজ পাতা কেটে মাঝখানে রক্ত জবা গেঁথে দিয়ে তৈরী করে পতাকা। তারপর সবাই মিলে ছুঁটে চলে সেই পতাকা নিয়ে বিলে ঝিলে, স্বাধীনভাবে। বিপ্লবের ঝান্ডা উড়ায় ছোট কাকুর মতো যেন নির্ভিক খোলা হাওয়ায়। যুদ্ধের আটটি মাস প্রায় শেষ হওয়ার পথে। শীতের শুরু আগামীতে। বুরুনরা কোনো এক উদাস দুপুরে সাদা খাতার কাগজে রং পেন্সিল দিয়ে আঁকে পতাকা। স্বাধীন পতাকা। তারপর সেই পতাকাকে ঘুড়ি বানিয়ে উড়িয়ে দেয় আকাশে। বুরুনদের স্বাধীন দেশের স্বপ্নরাও উড়ে চলে পাখা মেলে ওই নীল আকাশে।
বনানী বাবলি : প্রকাশিত গ্রন্থ: বাংলাদেশ তোমারই জন্য
shadhinotaakattor@gmail.com