ভজন সরকার : আমি প্রথম যখন ভারতের পশ্চিমবঙ্গে যাই তখন জ্যোতি বসুর নেতৃত্বে বাম ফ্রন্ট ক্ষমতায়। অনেক আশা নিয়ে গিয়েছিলাম। ভেবেছিলাম একটি নিখাদ সাম্য ও সৌহার্দের শাসন ভূমি দেখতে যাচ্ছি। প্রথম দিনেই আমার ভুল ভেঙে যায়। বেনাপোল থেকে বনগাঁও স্কুটারে এসে সেখান থেকে কলকাতার ট্রেন ধরবো। বেনাপোল থেকে বনগাঁও আসতেই প্রাণ ত্রাহিত্রাহি। মোড়ে মোড়ে স্কুটার থামিয়ে জোরজবরদস্তি করে পূজার চাঁদা তুলছে। এ মোড়ে যদি শীতলা পূজা হয়, তার সামনেই বারোয়ারী কালীপূজার চাঁদা। এ যেন এক মগেরমুল্লুক। কেউ দেখার নেই। ইচ্ছে মতো যার যা খুশী টাকা আদায় করছে।
বনগাঁও এসে কলকাতার ট্রেন ধরলাম। ট্রেন সামনে এগুচ্ছে আর আমার ভারত দর্শণের স্বপ্নভগ্ন হচ্ছে। রেল লাইনের দুইপাশে বস্তি আর হাঁড়জিরজিরে মানুষের আনাগোনা। বারাসাত থেকে দমদম ক্যান্টনমেন্ট, মধ্যমগ্রাম, দমদম জংশন মাইলের পর মাইল রেল লাইনের দু’পাশে খুপড়ি ঘর। আলো-বাতাসহীন অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে লক্ষ লক্ষ মানুষের বাস।
আরও আশ্চর্য হয়েছিলাম একটি কমিউনিষ্ট শাসিত রাজ্যের এমন এক ভয়ানক ধর্মান্ধতার উত্থান দেখে। রেল লাইনের দু’পাশের বস্তিতে মাইলের পর মাইল মাইক্রোফোন বসানো। আর সে মাইক্রোফোনে বেজে চলেছে কোনো খুপড়ি ঘর থেকে ভেসে আসা হরিনাম কীর্তন। দিন-রাত চব্বিশ, আটচল্লিশ, বাহাত্তর কিংবা ছিয়ানব্বই ঘন্টাব্যাপি উত্কট-উচ্চকন্ঠে বেজেই চলেছে এই ধর্মীয় সঙ্গীত। শব্দ নিয়ন্ত্রণের বালাই নেই। ঠিক যেমনটি দেখি বাংলাদেশের ওয়াজ মাহফিলে।
সঙ্গে থাকা আত্মীয় ভদ্রলোক বলছিলেন, এটি নাকি নিত্যদিনের চিত্র। এই ধর্মীয় সংগীত নাকি এই সব বস্তিবাসী মানুষের বিনোদনের উত্স। সেই সাথে আরও দু’টি উত্স প্রায় ঘরে ঘরে। একটি, হিন্দি সিনেমা; আরেকটি, ক্রিকেট। আয় -উপার্জন, বোধ-বুদ্ধি বিসর্জন দিয়ে মানুষকে ভুলিয়ে রাখা হয়েছে এই সব কৃত্রিম বিনোদনে। নিজেদের নাগরিক অধিকার এবং প্রতিবাদ থামিয়ে রাখতে এর চেয়ে বড় আফিম আর কী আছে?
সেবারই কলকাতা থেকে দীর্ঘ সড়ক পথে পশ্চিমবঙ্গের উত্তরের জেলাগুলোতেও যাওয়ার সৌভাগ্য হয়েছিল। কলকাতার আশপাশের হিন্দু-অধ্যুষিত অঞ্চলে সড়কের মোড়ে মোড়ে মন্দির ও নানাবিধ দেবদেবীর মূর্তি। একটু পরপরই কোনো উঁচু গাছের নিচে লাল রংয়ের সিদুঁর জাতীয় কিছু মেখে বানানো হয়েছে পুজোর স্থান। ভাড়া গাড়ির ড্রাইভারের সামনে কতো রকমের দেব-দেবীর ছবি যে আছে তার হিসেব নেই। এসব দেব-দেবীর প্রতি এতো বিশ্বাসেও যেনো আস্থা নেই। একটু পরপরই কোনো বড় বা উঁচু গাছ দেখলেই হাত কপালে ঠেকিয়ে কৃপা প্রার্থনা।
কলকাতা থেকে ঘন্টাখানিক দেড়েক গেলেই মুর্শিদাবাদ এবং বহরমপুরের মুসলমান জনবসতি। হিন্দুদের সাথে পাল্লা দিয়ে সেখানেও সড়কের দু’পাশে মসজিদ ও মক্তবের ছড়াছড়ি। ভাংগাচোরা চালাঘরের পাশেই সুরম্য মসজিদ। দেখলে সহজেই বোঝা যায়, সরকারী বা বিদেশী অনুদানে গড়া এই সব ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান। বাংলাদেশের সাথে এই সমস্ত জেলার কোনো পার্থক্যই নেই।
সব ভোটের রাজনীতি। ধর্মীয় ভাবাবেগ উস্কে দিয়ে বামপন্থীদের এই ভন্ডামি আমাকে সেদিন ভাবিয়ে তুলেছিল। আমার সৌভাগ্য হয়েছিল সে সফরেই একটি স্থানীয় নির্বাচন প্রত্যক্ষ করার। ভোট কেন্দ্রে ভোটারের লাইন নেই। জিজ্ঞেস করে জেনেছিলাম, সিপিএম তথা বামফ্রন্ট ছাড়া অন্য কোনো দলই স্থানীয় ভোটে প্রতিদ্বন্দিতা করতে সাহস পায় নি। যদিও তার বছর পনের পরে বামপন্থীরা আরেকটি স্থানীয় দলের কাছে ক্ষমতাচ্যুত হয়েছিল। কিন্তু ভোটহীন আর আধিপত্যের রাজনীতির কোনোই উন্নতি হয়নি।
যাহোক, আসল কথায় আসি। খুব হতাশ হয়েছিলাম সেবার। বাংলাদেশে পুঁজিবাদসহ মধ্যপ্রাচ্যের ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক আগ্রাসন তখন পুরোদমে চলছে। পেট্রোডলারের লোভে লক্ষ লক্ষ শ্রমিক মধ্যপ্রাচ্যে চলে গেছে। এই লাখ লাখ মানুষ শুধু যে পেট্রোডলার আনবে সেটি তো নয়। সাথে নিয়ে আসছে সংস্কৃতি, নিয়ে আসছে পোশাকপাতি, হিজাব-নিকাব-খুরমা -খেঁজুর। গ্রামের গরীব মানুষটি একটু টাকার মালিক হ’লেই বাড়ির সামনে তৈরী করছে একটি ঝকমকে দালান, যার নাম মসজিদ। এ যে শুধু পরকালের উদ্দেশ্যে সেটি কিন্তু নয়। এতোদিন গরীব হিসেবে অবহেলা অবজ্ঞা পেয়ে আসা মানুষটির একটু সম্মানও এসবের প্রধান উদ্দেশ্য।
সেবার পশ্চিমবঙ্গে অনেকগুলো জেলা ঘুরেছিলাম। ধর্ম এবং পুঁজিঁবাদী সাংস্কৃতিক আগ্রাসন মানুষকে কিভাবে মোহগ্রস্থ ক’রে রেখেছে, তা দেখে সত্যি যারপরনাই বেদনাহত হয়েছিলাম।
ঠিক তেমনি বেদনাহত হয়েছিলাম পুঁজিবাদের স্বর্গভূমি আমেরিকা ভ্রমণকালেও। মিশিগান রাজ্যের ডেট্রয়েটসহ কিছু এলাকায় গিয়ে ভুলেই গিয়েছিলাম, আমি কোথায় এসেছি! মানুষ এমন চরম দারিদ্রের মধ্যে থাকে সেটি ভেবে নিজেই হতাশ হয়েছিলাম। যেমনটি হতাশ হয়েছিলাম পৃথিবীর ব্যস্ততম শহর নিউইয়র্কের অভিবাসী অধ্যুষিত কিছু এলাকায় গিয়েও। আধুনিক জীবনমানের লেশমাত্র নেই এমন অনেক এলাকা আছে নিউইয়র্কের অনেক ব্যুরোতে। মানুষ অনুন্নত দেশগুলোর চেয়েও নিম্নমানের জীবনযাপন করে এখানে।
পুঁজিবাদ এখন এমন এক স্বীকৃত বিধান হিসেবে পরিগণিত হয়েছে, বিশেষকরে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পরে যে, এর বিরুদ্ধে বলতে চেষ্টা করাও এখন ধিক্কারজনক একটি কাজ । অথচ পুঁজিবাদ মানুষকে ক্রমশঃ এমন লোভী করে তুলেছে যে, মানুষ নিজেদের বেঁচে থাকার বিষয়গুলোকেও প্রাধান্য দেওয়া ভুলে গেছে। আর বৃহত্তম জনগোষ্ঠী যা চাইবে, পুঁজিবাদে সরকারও সেদিকে ধাবিত হবে।
ফলে হয়েছেও সেটিই। অনুন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলোতে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান-গবেষণাগার-হাসপাতালের চেয়ে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে ব্যাংগের ছাতার মতো। ভারত -বাংলাদেশে গ্রামে গ্রামে মসজিদ-মন্দির প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। অথচ হাসপাতাল কিংবা লাইব্রেরি গড়ে উঠে নি। উন্নত দেশগুলোতে ধর্মের প্রভাব কমেছে কিন্তু পুঁজিবাদী অর্থনীতির জন্য স্বাস্থ্য-শিক্ষা খাতের চেয়ে সমরাস্ত্র কিংবা বিনোদনে জন্য অর্থ ব্যয় হয়েছে বেশী।
২০২০ থেকে এ পর্যন্ত ( ডিসেম্বর, ২০২১) “করোনা” ভাইরাসে মৃত্যু হয়েছে অর্ধ-কোটিরও অধিক মানুষের। উন্নত দেশগুলোর মানুষও মরেছে। পৃথিবীর দুর্দন্ড প্রতাপশালী এবং উন্নত দেশের অসহায় নেতাদের মুখ ভেসে উঠছে মিডিয়ায়। এক আর্তকান্নায় বুক ফেঁটে যাচ্ছিল যখন দেখেছিলাম নিউইয়র্ক -লন্ডনের মতো জায়গায় বাংলাদেশের অভিবাসী শ’শ’ মানুষের মৃত্যুর খবর। এই মানুষগুলো ভালো ভাবে বেঁচে থাকতেই পাড়ি জমিয়েছিল এমন উন্নত দেশে। অথচ জীবনের শেষ সময়ে এদের অনেকেরই চিকিত্সার সুযোগটিও জোটেনি হাসপাতাল বেডের অপ্রতুলতায়। এমন বিনে চিকিত্সাতেই যদি মরতে হবে তাহ’লে নিজ জন্মভুমিতে আপনজনের সান্নিধ্যে জীবনযাপন করে মরলেও ক্ষতি ছিল কি?
পৃথিবীর যে প্রান্তের মানুষই এমন নির্মমভাবে মরুক না কেনো প্রতিটি মৃত্যুই বেদনাহত করে। আহা রে, এমন ক্ষণস্থায়ী মানুষের জীবন!
(ভজন সরকার: কবি, কথাসাহিত্যিক ও প্রকৌশলী। হ্যামিল্টন, কানাডা)